নারী পুরুষের নামাজের সামঞ্জস্য ও সুস্পষ্ট পার্থক্য
![]() |
নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্য |
মহিলাদের নামাজ, পার্থক্য আছে? নাকি পুরুষের মতই?
এই বিষয়ে কিছু লেখার জন্যে বারবার তাগাদা দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়ক একটা রেসালাহ তৈরি করতে গিয়ে অনুভব করলাম এক পর্বে শেষ করা সম্ভব না। তাই, মোট ৪ পর্বে এই বিষয়ক প্রবন্ধটি শেষ করার ইচ্ছা। ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ!
প্রথম পর্বে কিছু উসূল বা মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত আলোচনা থাকছে। কারণ এই মৌলিক নীতিমালার উপর ভর করেই তর্ক বিতর্কের ডালপালা ছড়িয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বে নামাজের পার্থক্য সংক্রান্ত ৪ মাজহাবের দলীল ও পর্যালোচনা।
তৃতীয় পর্বে নামাজের পার্থক্য নেই মর্মে বর্তমান যামানার কিছু মুহাক্কিকদের দাবী, দলীল ও পর্যালোচনা।
চতুর্থ ও শেষ পর্বে, সালাফি আলেমদের মতামত ও অধমের কৈফিয়ত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
মহিলাদের নামাজ, যেভাবে পেলাম:
উম্মাহর নারীরা আজীবন যেভাবে নামাজ পড়ে এসেছে তা শতভাগ পুরুষের মত নয়। এভাবেই আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। সেই সাহাবী থেকে তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ক্রমধারায় কোটি কোটি মুসলিমাহ, পুণ্যবতী নারী নামাজ পড়ে আসছেন। তারপর?
কয়েক বছর আগে, আনুমানিক ২০/৩০ বছর আগে নতুন গবেষণা বের হলো। যার বক্তব্য হচ্ছে “নারী পুরুষের নামাজের কোন পার্থক্য নেই”! গবেষণার কেন প্রয়োজন হলো? কারণ, নতুন গবেষকরা হাদিসের শুদ্ধতা ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের উপর নামাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। তারপর যখন দেখলেন, নারীদের নামাজে যে পার্থক্যগুলো মেনে নামাজ পড়া হয়, সে হাদিসগুলোর সনদ মজবুত নয়। সুতরাং তারা বললেন নামাজে কোন পার্থক্য নেই।
এখানে গোঁড়ায় কিছু প্রশ্ন আসে। আপনারা যদি ‘তাদবীনে হাদিস’ (হাদিস সংকলনের ইতিহাস) নিয়ে পড়ে থাকেন, এই প্রশ্ন এতক্ষণে আপনার মাথায় চলে আসার কথা। আচ্ছা, হাদিসের প্রচলিত কিতাবগুলো লেখা হলো হিজরী ১৫০-২০০ বছর পর। এই হাদিস গ্রন্থগুলোর ভিত্তি করে নামাজকে পুনর্বিন্যাস যদি করা হয়, তাহলে এই গ্রন্থগুলো লেখার আগের যুগে যে সকল সাহাবী/তাবেয়ী/তাবে তাবেয়ী ছিলেন, তারা কীভাবে নামাজ পড়লেন? তখন তো এই কিতাবগুলো লেখা হয় নি। তাহলে নামাজটা শিখলেন কীভাবে? নিশ্চয় কেতাব পড়ে শিখেন নি? সাহাবীরা শিখেছেন, রাসূল সা. থেকে, তারপর তাবেয়ীরা শিখেছেন সাহাবীদের থেকে। নামাজ তো ইতোমধ্যেই পূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। হাদিসের গ্রন্থগুলো লেখার আগেই। সাহাবা থেকে নিয়ে পরবর্তী ৩ প্রজন্ম নামাজ শিখেছে “তা’আমুল ও তাওয়ারুছ” এর মাধ্যমে।
যদি মনে করা হয়, ইমাম বুখারীর বুখারী লেখার আগে কেও সহীহভাবে নামাজ পড়তে পারেন নি। মনগড়া নামাজ পড়েছেন, সুতরাং বোখারী লেখার পর সে নামাজকে বদলানো জরুরী। তাহলে ৪ মাজহাব ও লা মাজহাব এর সবারই একমত হওয়া উচিত, প্রচলিত হাদিসগ্রন্থগুলোর উপর ভিত্তি করে নামাজকে পুনর্বিন্যাস বা শুদ্ধিকরণ জরুরী।
কিন্তু যদি এর বিপরীত হয়, অর্থাৎ সাহাবারা নামাজ শিখেছেন রাসূল সা. থেকে। তারপর তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। সেখানে তারা নামাজ শিখিয়েছেন। তাদের থেকে তাদের ছাত্ররা.. এভাবে যুগ পরম্পরা। সুতরাং তাদের নামাজ ভুল হয় নি। কারণ তাদের নামাজ ছিল রাসূল সা. এরই নামাজ। উত্তর যদি এটা হয়, তাহলে প্রশ্ন হবে, এই নামাজ তো সাহাবাদের নামাজই ছিল। প্রচলিত কিতাবের আলোকে নামাজকে পুনর্বিন্যাস বা পুনরায় তাহকীক এর কি প্রয়োজন আছে?
প্রসঙ্গত না বললেই নয়, পূর্বসূরিদের বহু কিতাব এমন আছে যে এখনো ছাপার হরফে আসে নাই। অনেক পাণ্ডুলিপি আছে যা উদঘাটন করা হয় নাই। আমি যতদূর জানি, শায়খ আব্দুল মালিক হাফিজাহুল্লাহ ‘তাহকীকু তুরাছ’ বিষয়ে কাজ করছেন। হানাফী মাজহাবের প্রাণকেন্দ্র ছিল বাগদাদ নগরী। সেই বাগদাদ যখন তাতারিদের দ্বারা আক্রান্ত হলো, তখন পুরো নগরীর কিতাবগুলো পানিতে ডুবিয়ে দিল। ঐতিহাসিকদের মতে, কিতাবের পানিতে নদীর পানি স্ফীত হয়ে উঠেছিল। ‘রিসালাতুল মুস্তাতরাফা’ গ্রন্থটির নাম হয়ত শুনেছেন। এটি অনেকটা গ্রন্থপরিচিতি বা গ্রন্থসূচী জাতীয় কিতাব। সেখানে এমন হাজারো কিতাবের নাম পাবেন যা আজকের যুগে অনুপস্থিত। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ২০০ খণ্ডের একটি গ্রন্থ লিখেছেন। অথচ সেই গ্রন্থ আজকে নেই। এই কথা বলছি এই কারণে, অনেক আমল যা রাসূল সা. এর যুগ থেকে ক্রমধারায় প্রচলিত। যেমন মাথায় টুপি পরা। কিন্তু প্রচলিত হাদিস গ্রন্থে সহীহ সূত্রে তা বর্ণিত নয়। তাই দেখা যায়, হাল আমলের প্রচলিত কিতাবসর্বস্ব কিছু গবেষক টুপি পরার সুন্নাহ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। অবশ্য পরবর্তীতে শায়খ আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ একাধিক সহীহ সনদ দিতে টুপির সুন্নাহকে প্রমাণ করেছেন। কোন আমল যখন রাসূল সা. এর যুগ থেকে ধারাবাহিক চলে আসে, যেটাকে “আমালে মুতাওয়ারাসাহ বা সুন্নাতে মুতাওয়ারাসাহ” বলা হয়। সেটাকে প্রচলিত কিতাব নির্ভর গবেষণায় উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
আমলে মুতাওয়াতির / মুতাওয়ারাসাহ কী?
ইসলামের ব্যবহারিক অধিকাংশ আমল রাসূল স. থেকে সাহাবীগণ শিখেছেন। সাহাবীদের থেকে তাবেয়ীগণ, তাবেয়ীদের থেকে তাবে তাবয়ীগণ এবং তাদের থেকে পরবর্তীগণ শিখেছেন। একে পরিভাষায় আমলে মুতাওয়ারিসা বলে।
খবরে ওয়াহিদ অর্থাৎ কোন হাদিস যদি এমন হয়, যা কেবল একজনের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আর উক্ত সনদের সবাই নির্দিষ্ট মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। তাহলে সেটাকে গ্রহণ করা হয়। যদিও বর্ণনাকারী মাত্র একজন। তাহলে হাজার হাজার লোক দ্বারা প্রত্যহ পালিত আমলের ধারা কি একক রাবী বর্ণিত হাদীসের তুলনায় শক্তিশালী নয়? সালাফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত, তারা আমলে মুতাওয়ারিসকে খাবরে ওয়াহেদ সূত্রে বর্ণিত হাদীসের উপর প্রাধান্য দিতেন। অনেক ইমাম নিজে সহীহ সনদে হাদীস বর্ণনা করার পরও এর উপর আমল করতেন না। হাদীসটি রাসূল স. থেকে প্রচলিত আমলের বিপরীত হওয়ার কারণে।
ইমাম মালিক রহ. তার মুয়াত্তায় সহীহ সনদে অনেক হাদীস এনেছেন। কিন্তু মদীনাবাসীর আমল বিপরীত হওয়ার কারণে তিনি হাদীসগুলো পরিত্যাগ করে রাসূল স. থেকে প্রচলিত আমলকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এমনকি মালেকী মাজহাবে অন্যতম একটি দলিল হলো আমলে মুতাওয়ারিস বা মদীনাবাসীর আমল।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিজাহুল্লাহ রচিত “” আসারুল হাদীসিশ্ শরীফ ফী ইখতিলাফি আইম্মাতিল ফুক্বহা”” দেখুন। এছাড়াও আল্লামা হায়দার হাসান খান টুংকী রহ. এর লিখিত অনবদ্য দুটি রেসালাহ, ‘আত তায়ামুল’ ও “উসুলুত তাওয়ারুছ”, শায়খ আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. এর কিতাব ‘আল ইমামু ইবনু মাজাহ ও কিতাবুহুস সুনান’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
বর্তমানে অধিকাংশ অস্থিরতার মূল হল, সালাফের নীতি থেকে সরে যাওয়া। আমলে মুতাওয়ারিসের বিপরীতে খবরে ওয়াহিদকে প্রাধান্য দেয়া। একদিন ড. মানজুরে এলাহী দা.বা. এর সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘বর্তমান যামানার ইলমী অঙ্গনে সবচেয়ে বড় ফেতনা হচ্ছে সালাফে সালেহীন এর অনুসৃত পথ থেকে সরে গিয়ে নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করা।’
জয়ীফ বা দুর্বল হাদিস কি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়?
আমাদের মধ্যে যারা উলুমুল হাদিস পড়েন নি। কেবল আলেমদের বয়ান বা শায়েখদের লেকচার শুনেছেন। তাদের মধ্যে একটা বড় মিসকনসেপশন হচ্ছে, তারা ধারণা করেন হাদিস সহীহ মানে হচ্ছে এটা আমলযোগ্য হওয়া। আর জয়ীফ মানে হচ্ছে এটা পরিত্যাজ্য হওয়া।
কিন্তু বাস্তবতা তা না। সহীহ /জয়ীফ/ হাসান/ মুরসাল/ মুতাবে/ শাওয়াহেদ ইত্যাদি শাস্ত্রীয় পরিভাষা। কখনো একটা হাদিসের সূত্র শাস্ত্রীয় নীতিমালায় উত্তীর্ণ হলে সে হাদিস (কথা/কাজ/সম্মতির বিবরণ) সনদগত দিকে দিয়ে সহীহ হতে পারে, কিন্তু তার উপর আমল করা যাবে না। কেন? কারণ হাদিসের বিধান রহিত হয়ে গিয়েছে। এমনিভাবে একটা হাদিস এর সূত্র দুর্বল, কিন্তু সেটার উপর উম্মাহর ধারাবাহিক আমল চলে আসছে সাহাবীদের যুগ থেকেই। সে সূত্র যখন গ্রন্থিত হয়, তখন শাস্ত্রীয়ভাবে দুর্বল হলেও সেটা গ্রহণযোগ্য। এই প্রকারের জয়ীফের ক্ষেত্রে সূত্রগত দুর্বলতা কোন প্রভাব ফেলে না। এইটুকু পড়ে নিশ্চয় আপনাদের অবাক লাগছে। কারণ আপনারা যা ভেবে আসছেন, তার সাথে মিলছে না। তাহলে আসুন হাদিসবেত্তাদের কিছু শাস্ত্রীয় পর্যালোচনা জেনে নেই।
জয়ীফ হাদিস গ্রহণের ক্ষেত্রে শাস্ত্রজ্ঞদের মতামত —
বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ জয়ীফকে দুভাগে ভাগ করেছেন।
এক. এমন জয়ীফ হাদীস, যার সমর্থনে কোন শরয়ী দলিল নেই, বরং এর বক্তব্য শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। এ ধরণের জয়ীফ হাদীস আমলযোগ্য নয়।
দুই. সনদের বিবেচনায় হাদীসটি জয়ীফ বটে, তবে এর সমর্থনে শরয়ী দলিল প্রমাণ আছে, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ হাদীস অনুসারে আমল চলে আসছে। এমন জয়ীফ হাদীস শুধু আমলযোগ্যই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসের মানোত্তীর্ণ। এটাকে বলা হয় ‘জয়ীফ মুতালাক্কা বিল কাবুল’!
১- এ বিষয়ে ইমাম যারকাশী রহঃ তাঁর হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘আননুকাত’ এ বলেছেন,
ﺇﻥ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺍﻟﻀﻌﻴﻒ ﺇﺫﺍ ﺗﻠﻘﺘﻪ ﺍﻷﻣﺔ ﺑﺎﻟﻘﺒﻮﻝ ﻋﻤﻞ ﺑﻪ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺼﺤﻴﺢ ﺣﺘﻰ ﻳﻨﺰﻝ ﻣﻨﺰﻟﺔ ﺍﻟﻤﺘﻮﺍﺗﺮ
অর্থ, জয়ীফ হাদীসকে যখন উম্মাহ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে নেয়, তখন সঠিক মতানুসারে সেই হাদীসটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তা মুতাওয়াতির হাদীসের মানে পৌছে যায়।
(আননুকাতঃ ১/৩৯০)
২- একই বিষয়ে হাফেজ শামসুদ্দীন আসসাখাবী রহঃও তাঁর ‘ফাতহুল মুগীছ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
ﻭﻛﺬﺍ ﺇﺫﺍ ﺗﻠﻘﺖ ﺍﻷﻣﻪ ﺍﻟﻀﻌﻴﻒ ﺑﺎﻟﻘﺒﻮﻝ ﻳﻌﻤﻞ ﺑﻪ ﻋﻠﻰﺍﻟﺼﺤﻴﺢ ﺣﺘﻰ ﺃﻧﻪ ﻳﻨﺰﻝ ﻣﻨﺰﻟﺔ ﺍﻟﻤﺘﻮﺍﺗﺮ ﻓﻲ ﺃﻧﻪ ﻳﻨﺴﺦﺍﻟﻤﻘﻄﻮﻉ ﺑﻪ ﻭﻟﻬﺬﺍ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺸﺎﻓﻌﻲ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻲ ﺣﺪﻳﺚﻻ ﻭﺻﻴﺔ ﻟﻮﺍﺭﺙ ﺇﻧﻪ ﻻ ﻳﺜﺒﺘﻪ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﻟﻜﻦ ﺍﻟﻌﺎﻣﺔ ﺗﻠﻘﺘﻪ ﺑﺎﻟﻘﺒﻮﻝ ﻭﻋﻤﻠﻮﺍ ﺑﻪ ﺣﺘﻰ ﺟﻌﻠﻮﻩ ﻧﺎﺳﺨﺎ ﻵﻳﺔ ﺍﻟﻮﺻﻴﺔ
অর্থ, উম্মাহ যখন জয়ীফ হাদীসকে ব্যাপকহারে গ্রহণ করে নেয়, তখন সহীহ মত অনুসারে সেটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তার দ্বারা অকাট্য বিধান রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে সেটি মুতাওয়াতির দলীলের মানোত্তীর্ণ হয়। এ কারণেই ইমাম শাফেয়ী র.‘উত্তরাধিকারীর জন্যে কোন ওসিয়ত নেই’ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন, হাদীস বিশারদগণ এটিকে সহীহ মনে না করলেও ব্যাপকহারে আলেমগণ এটি গ্রহণ করে নিয়েছেন, এ অনুযায়ী আমল করেছেন, এমনকি তারা এটিকে ওসিয়ত সম্পর্কিত আয়াতটির বিধান রহিতকারী আখ্যা দিয়েছেন।
(ফাতহুল মুগীছঃ ১/ ৩৩৩)
৩- হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ লিখেন, যে হাদিস অনুযায়ী আমল করা উম্মতের কাছে গৃহীত হয়েছে এবং যে বিষয় অনুযায়ী আমল করার প্রতি উম্মতের ইজমা চলে আসছে,নিঃসন্দেহে তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক কারণ ও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদিস অপেক্ষাও শক্তিশালী।
(আন-নুকাত আলা কিতাবি ইবনে ছালাহ/আসকালানী ১/৪৯৪)।
৪- হাফেজ ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ রহঃ একটি জয়ীফ হাদীস সম্পর্কে বলেছেন,
ﻓﻬﺬﺍ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﺇﻥ ﻟﻢ ﻳﺜﺒﺖ ﻓﺎﺗﺼﺎﻝ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺑﻪ ﻓﻲ ﺳﺎﺋﺮﺍﻷﻣﺼﺎﺭ ﻭﺍﻷﻋﺼﺎﺭ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺇﻧﻜﺎﺭ ﻛﺎﻑ ﻓﻲ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺑﻪ
অর্থাৎ এ হাদীসটি প্রমাণিত না হলে ও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শহরে কোন রূপ আপত্তি ছাড়া এ অনুযায়ী আমল চালু থাকাই হাদীসটি আমলযোগ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
(আর-রূহ লিল ইবনে কাইযুমঃ ১৬)
(জয়ীফ হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন আব্দুল হাই লখনবী রহঃ এর লিখিত কিতাব আল-আমলু বিল হাদীসিস যয়ীফাহ ও শায়েখ সাইদ মামদুহ এর ‘আততারীফু বি আউহামিন’। )
৫- ইমাম মালেক বলেন, ‘কোন হাদিস মদীনাবাসীর নিকট মাশহুর হয়ে গেলে তখন সেটা সনদগত হুকুমের ঊর্ধ্বে চলে যায়।
আল আজভিবাতুল ফাদিলাহ- শায়খ আবু গুদ্দাহর তালীক ২২৭-২৩৮ , আল হাদিসুস সহীহ ওয়া মানহাজুল উলামায়িল মুসলিমিন ফিত তাসহীহ- শায়খ আব্দুল কারীম ইসমাইল সাব্বাহ- ২১৫
৬- খতীবে বাগদাদী রাহ. লিখেন, “যখন উম্মাহ ধারাবাহিকভাবে কোন আমলকে গ্রহণ করে নেয়, তখন সেটার শুদ্ধতার জন্যে সনদ খোজার প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ সনদের মানগত শুদ্ধতার ঊর্ধ্বে চলে যায়।
আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কীহ- ১/১৯০
আল কিফায়াহ- ৫১
৭- ইমাম আহমদ বিন হামবলকে একটা হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো “আপনি এই হাদিস গ্রহণ করলেন, অথচ এই হাদিসটিকে আপনি জয়ীফ বলে থাকেন।” ইমাম আহমদ উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ! হাদিসটি জয়ীফ। কিন্তু এর উপর আমল করা হয়”!!
(আল উ’দ্দাতু ফি উসুলিল ফিকহ লি আবি ইয়া’লা আল ফাররা ৩/৯৩৮-৯৩৯)
৮- পূর্বসূরিদের কিতাব যাদের মোতালায়ার সুযোগ হয়েছে তারা এই বাক্যগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে থাকবেন নিশ্চয়,
تلقّته الأمّة بالقبول/ والعمل عليه عند أهل العلم”
ঘাটতে গিয়ে সালাফি শায়েখ, রাবী আল মাদখালী হাফি. এর একটা রেসালাহ পেয়ে গেলাম। তিনি সেখানে মুতালাক্কা বিল কবুল সম্পর্কে লিখেছেন।
والحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول ينجبر ويجب العمل به؛لأن الأمة لا تجتمع على ضلالة .
مثل يعني الماء الذي تقع فيه النجاسة هل ينجس أو لا ؟ إذا تغير طعمه أو لونه أو ريحه كثيرا كان أو قليلا فهو نجس بإجماع الأمّة.
অর্থাৎ, জয়ীফ হাদিসকে যখন উম্মাহ আমল করে তখন সেটার উপর আমল করা ওয়াজিব হয়ে যায়। ‘কারণ উম্মাহ কোন ভুলের উপর একমত হতে পারে না।’ ( এটি হাদিসের অংশ)
তিনি এর উদাহরণ স্বরূপ আবু উমামার হাদিসটি উল্লেখ করেন, “যখন পানিতে নাপাক পতিত হয় আর পানির স্বাদ, রঙ, ঘ্রাণ বদলে যায়, সে পানি বেশি হোক বা অল্প, উম্মাহর এজমা অনুযায়ী তা নাপাক বলে গণ্য হবে। যদিও হাদিসটি জয়ীফ!
জয়ীফ হাদিস যখন উম্মাহর আলেমদের নিকট সর্বতোভাবে গৃহীত হয়ে যায়, তখন সেটার সনদগত দুর্বলতা বিবেচ্য হয় না। এই বিষয়ে সম্পূর্ণ একটা গ্রন্থ লেখা সম্ভব। বিস্তারিত দেখুন, আন নুকাত লি ইবনে হাজার- ১/৪৯৪, আত তায়াক্কুবাত আলাল মাউযুয়াত লিস সুয়ুতী ১২; তাদরিবুর রাবী ৬৭, ফাতহুল মুগীছ ১২০-১২১, ফাতহুল কাদীর ৩/১৪৩, আল বুরহান ফি উছূলিল ফিক্বহ,আবুল মা’আলী আল জুয়াইনী ,ফাছলুন ফি তাক্বাসীমুল খাবর ১/৩৭৯; আল বায়েসুল হাসীস ফী ইখতেসারে উলূমুল হাদিস,ইমাম ইবনু কাসীর-সংকলক শায়খ আহমাদ শাকের পৃঃ১২৭-১২৮; তাওজীহুন নাজার ইলা উছূলিল আছার ১/২১৩ ইত্যাদি।
এই আলোচনার করার উদ্দেশ্য হলো, নারীদের নামাজের পার্থক্য সংবলিত কিছু হাদিসকে জয়ীফ বলে উম্মাহর হাজার বৎসর যাবত চলে আসা আমালে মুতাওয়ারাসাহকে অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ এই নামাজের পার্থক্য রাসূল সা. এর যামানা থেকেই ক্রমধারায় চলে আসছে। ১৫০ হিজরীর মধ্যে লেখা অনেক কিতাবে “নারীদের নামাজের পার্থক্য” শিরোনামে হাদিসও বর্ণিত হয়েছে।
নারী পুরুষের নামাজে ভিন্নতা আছে? নাকি অভিন্ন?
সাধারণত সবাই এভাবে শিরোনাম দিয়ে থাকে। এই শিরোনামকে কেন্দ্র করে নানা তর্ক বা বিতর্ক হয়। কেউ প্রমাণ করেন, নারী পুরুষের নামাজ একই। কেউ প্রমাণ করেন নারী পুরুষের নামাজে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। আমার দৃষ্টিতে এই শিরোনামটিই যথার্থ নয়। কারণ, নারী পুরুষের নামাজে যেমন রয়েছে কিছু পার্থক্য, তেমনি রয়েছে মিল ও অভিন্নতা! উভয়ধারার আলেমদের মতে, নারী পুরুষের নামাজের বিধানে বেশ কিছু পার্থক্য আছে।
যে পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে উভয়ধারার আলেমগণ একমত –
১- মেয়েদের নামাজে আযান বা একামত নেই
২- মেয়েরা উচ্চস্বরে কেরাত পড়বে না
৩- মেয়েদের নামাজে সতর ঢাকার পরিমাণ পুরুষের চেয়ে বেশি।
৪- মেয়েদের মাথা উন্মুক্ত থাকলে নামাজ হবে না।
৫- মেয়েরা জামাতে নামাজ আদায় করলে পুরুষের পিছনে দাঁড়াবে
৫- মেয়েদের জন্যে জুময়ায় যাওয়া ফরজ নয়।
৬- মেয়েদের জন্যে জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব নয়
৭- মেয়েদের সালাত আদায়ের উত্তম জায়গা মসজিদ নয়, বরং ঘরের কোণ। পুরুষের জন্যে মসজিদে জামাতে অংশ নেয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা ওয়াজিব।
৮- ইমামের ভুল হলে ছেলেদের মত তাসবীহ বা সুবহানাল্লাহ পড়বে না, বরং মেয়েরা নামাজে হাত চাপড়ে শব্দ করবে।
৯- ছেলেদের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে সর্বপ্রথম কাতার, আর মেয়েদের জন্যে উত্তম হচ্ছে সর্বশেষ কাতার।
১০- পুরুষ নারীর ইমাম হতে পারে, কিন্তু নারী পুরুষের ইমাম হতে পারে না।
১১- ছেলেরা জামাতে নামাজ আদায়কালে ইমাম সবার সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু মেয়েদের জামাতে মেয়ে ইমাম হলে সে সবার মাঝে সামান্য এগিয়ে দাঁড়াবে। (উল্লেখ্য, হাসান বসরী রহ., মালেকী ও হানাফী মাজহাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র মহিলাদের জামাত নেই)
১২- নারী পুরুষ জামাত আদায়কালে ছেলেরা মুকাব্বির হতে পারবে। মেয়েরা পারবে না।
১৩- মেয়েরা পুরুষের সাথে জামাত আদায়কালে জোরে আমীন বলবে না।
১৪- মহিলা মাথার চুল বেঁধে নামায পড়তে পারে, কিন্তু (লম্বা চুল হলে) পুরুষ তা পারে না।
১৫- সেজদার সময় মহিলারা পুরুষের পর মাথা উঠাবে।
১৬- মহিলারা জামাতে নামাজ আদায় করলে তারা নামাজ শেষ করেই বেড়িয়ে যাবে। আর পুরুষের জন্যে নামাজের পর কিছুক্ষণ মসজিদে অপেক্ষা করা মুস্তাহাব।
১৭- কাতারে একাকী কোন পুরুষের দাঁড়ানো সকল আইম্মাদের মতে মাকরুহ। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে জায়েজ।
১৮- মেয়েদের জন্যে মুস্তাহাব হচ্ছে ওয়াক্ত শুরু হলেই সালাত আদায় করে নেয়া। পুরুষ তা করবে না। বরং আযান হলে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করবে।
এই সমস্ত পার্থক্যগুলো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এতে সামান্য কমবেশ সবারই সহমত আছে। (প্রতিটা পার্থক্যের হাদিস উল্লেখ করতে গেলে নোট দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায়, শুধু মাসায়েল উল্লেখ করা হলো),
"এত এত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, মাত্র ৩/৪ টা পার্থক্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই কথা বলা “নারী পুরুষের নামাজে পার্থক্য নেই”, এটা অযৌক্তিক বলেই মনে হয়। "
বরং এই শিরোনামটাই আজকে যত তর্কের বিতর্কের উৎস। কারণ নারী পুরুষের নামাজ একই, এর পক্ষে যে সমস্ত বানী ও আছার পেশ করা হয়। তার মূল মর্ম হচ্ছে, নারী পুরুষের নামাজে যেসব ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য বর্ণিত নেই সেখানে উভয়ের নামাজ এক। এটাই যুক্তিসংগত। অর্থাৎ যেখানে পার্থক্য নেই সেখানে নারী পুরুষের নামাজ এক। এভাবে বলা হলে অর্ধেক বিতর্কই শেষ হয়ে যায়। বাস্তবতাও তাই।
এবার আসুন খেয়াল করি,
এই যে পার্থক্যগুলো, শরীয়তে এটা কেন করা হলো? জোরে কেরাত পড়া যাবে না, তাসবীহ বলবে না, হাত চাপড়াবে, চুল খোলা রাখতে পারবে না ইত্যাদি। এই পার্থক্যগুলো লক্ষ করলেই বোঝা যায়, প্রতিটা পার্থক্যের পিছনে একটা সূক্ষ্ম কারণ নিহিত রয়েছে, সেটা হচ্ছে ‘পর্দা’ ‘আবৃত করা’ বা ‘লুকানো’! শরীয়তের মেজাজই হচ্ছে নারীকে নামাজে লুকানো, প্রকাশিত করা নয়।
একটি হাদিস এই বিষয়কে আরো স্পষ্ট করে,
عن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن المرأة عورة فإذا خرجت استشرفها الشيطان وأقرب ما تكون من وجه ربها وهي في قعر بيتها
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন, নারী হচ্ছে ‘আউরাহ’ (যাকে লুকানো হয়)। যখন কোন মেয়ে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তাকে পুরুষের কাছে মোহনীয় করে তোলে। পক্ষান্তরে মহিলারা স্বীয় বাড়ীর সবচেয়ে গোপন স্থানে আল্লাহ পাকের অধিক নৈকট্য লাভ করে থাকে।
সহীহ ইবনে খুযাইমা- ১৬৮৫,
মুজামুল কাবীর- ৯৪৮১, তিরমিজি ১১৭৩, ইবনে হিব্বান -৫৫৯৯ (সহীহ)
এই হাদিসের শুরু অংশটুকু খেয়াল করুন। আল্লাহর নবী শরীয়তের মেজাজ বলে দিয়েছেন এক বাক্যে। “নারী হচ্ছে আউরাহ”! হজ্ব থেকে নিয়ে সালাহ, সফরসহ বহু বিধানের ক্ষেত্রে স্রেফ মেয়েদের পর্দার কারণেই এত এত পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু উভয়ধারার আলেমগণ একমত।
মেয়েদের নামাজের প্রচলিত আরো কিছু পদ্ধতি যাতে উভয়ধারার আলেমগণ একমত-
১- মহিলারা বুকে হাত বাধবে।
২- শেষ বৈঠকে দু পা ডানে বের করে বা পার্শ্বে ভর দিয়ে বসা।
এই ক্ষেত্রেও উভয়ধারার আলেমগণ একমত। আহলে হাদিস আলেমগণ একমত কারণ তারা এটাকেই কেবল সুন্নত মনে করেন। সেটা পুরুষের ক্ষেত্রে হোক বা নারীর ক্ষেত্রে। আর অন্যান্য আলেমগণ কেবল মহিলাদের ক্ষেত্রে এটাকে মুস্তাহাব মনে করেন।
তাহলে প্রকৃত এখতেলাফ কোন জায়গায়?
মাত্র কয়েকটি ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। এই কয়েকটি বিষয় রদ করতে গিয়েই শিরোনাম দেয়া হয় ‘নারী পুরুষের নামাজ একই’! যেমন,
১- মেয়েরা নামাজে হাত কোন পর্যন্ত তুলবে?
মাজহাব- কাঁধ পর্যন্ত বা বুক পর্যন্ত। আর সেটা ওড়নার নীচে।
ভিন্নমত – কান পর্যন্ত
২- মেয়েরা কীভাবে রুকু করবে?
মাজহাব- পুরুষের মত ঘাড় আর নিতম্ব সমান করে দিবে না। বরং অত্যন্ত সংকোচিতভাবে সামান্য ঝুঁকবে। যাতে হাত দিয়ে উরু নাগাল পাওয়া যায়।
ভিন্নমত- পুরুষের মতই পিঠ আর ঘাড় সমান করে দিবে।
৩- নারীরা কীভাবে সেজদা করবে?
মাজহাব – সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, কনুইসহ দু’হাত মাটিতে বিছিয়ে দেবেন। তাদের পেট দু’রানের সাথে মিলিয়ে দেবেন। উভয় বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন। হাত পায়ের আঙ্গুল কিবলামুখী রাখবেন। পা খাড়া করবেন না। মোটকথা সিজদা এমন ভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাযত হয়। পুরুষের মত কোমর উঁচু করে দু হাত ছড়িয়ে লম্বা হয়ে সেজদা করবে না।
ভিন্নমত – পুরুষের মতই কোমর উঁচু করে দু হাত ছড়িয়ে লম্বা হয়ে সেজদা করবে ।
প্রসঙ্গত, নারী পুরুষের নামাজের ভিন্নতা নেই, অথবা আছে। এই যে এখতেলাফ, এটা কেবল হানাফীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং বলতে গেলে ৪ মাজহাবের সবার সাথেই এই এখতেলাফ। সুতরাং মত বর্ণনার ক্ষেত্রে “মাজহাব ও ভিন্নমত” এভাবে লেখা হয়েছে।
নারীকে বলা হয়েছে ‘আওরাহ’। অর্থাৎ যাকে লুকোনো হয়, গোপন করা হয়। ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম দর্শন হচ্ছে এটাই। নারী তার সতর ও আওরাত এর ক্ষেত্রে যত্নশীল হবে, হওয়া উচিতও বটে । তাই অর্ধশত বছর আগ পর্যন্ত গত হওয়া প্রায় তাবৎ ফুকাহায়ে কেরাম নারীদের রুকু ও সেজদার পার্থক্য করেছেন। শালীনতা আর শরীয়তের মেজাজ “আওরাহ” এর প্রতি লক্ষ্য রেখে।
পুরুষের মত রুকু সেজদার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এতে ঐ মাত্রায় শালীনতা থাকে না যেটা পার্থক্য করার ক্ষেত্রে থাকে। যেমন, পুরুষের রুকু হচ্ছে এই পরিমাণ মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়া যাতে কোমর আর ঘাড় সমান হয়ে যায়। এভাবে রুকুতে নিতম্বের আকৃতি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেটা পুরুষের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেও নারীর ক্ষেত্রে মানানসই নয়।
পুরুষের সেজদার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, নিতম্ব উঁচিয়ে দেয়া। দু হাত বগল থেকে পৃথক করে ছড়িয়ে দেয়া। হাত যেন জমিনে না লাগে। আর পেট যেন হাঁটুতে না লাগে।
এই দু অবস্থা পুরুষের ক্ষেত্রে অবলীলায় মানানসই হলেও, মেয়েদের ক্ষেত্রে? নিঃসন্দেহে এটা শরীয়তের পর্দার মেজাজের সাথে যায় না। কারণ এভাবে মহিলারা রুকু বা সেজদায় গেলে, পিছনে মাহরাম অবস্থান করাও মুশকিল হয়ে যাবে। গায়রে মাহরাম তো কথাই নেই। যেমন ধরুন, হজ বা ওমরাহতে যেখানে খোলা জায়গায় নামাজ পড়তে হয়। সেখানে ঐভাবে পুরুষের মত রুকু সেজদা করা কি পর্দাপুশিদার সাথে মানানসই?
মেয়েদের সালাতের ভিন্নতা সম্পর্কে আহলে মাযাহেব ও ফুকাহাদের দলীল ——
পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। নারীদের নামাজের বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিছুক্ষেত্রে সবাই একমত, কিছুক্ষেত্রে দ্বিমত। যেসব ক্ষেত্রে দ্বিমত তার বিস্তারিত বিবরণ গত পর্বে গিয়েছে। যারা পার্থক্যগুলোর প্রবক্তা , তাদের দলীলগুলো আজ উপস্থাপন করা হবে ইনশা আল্লাহ!
নারীদের নামাজে যে পার্থক্যগুলোতে আহলে হাদিস ও সালাফি আলেমগণ একমত ননঃ
১- তাকবীরে তাহরিমার সময় মহিলারা কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলবে। হাতের কব্জি থাকবে থাকবে বুক বরাবর। আঙ্গুলের মাথা থাকবে কাঁধ বরাবর।
২-মেয়েরা বুকে হাত বাঁধবেন। বাম হাতের পিঠের উপর ডান হাতের পাতা রাখবেন। পুরুষের ন্যায় কব্জি ধরবেন না। এবং গোলাকৃতি বানাবেন না।
৩-মেয়েরা রুকুতে সামান্য একটু ঝুঁকবেন। হাঁটুর উপর হাত রাখবেন। রুকুতে হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখবেন। হাতের বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন।
৪- সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে,মেয়েরা যথা সম্ভব চেপে ও মাটির সাথে মিশে সেজদা করবেন। কনুইসহ দু’হাত মাটিতে বিছিয়ে দেবেন। তাদের পেট দু’রানের সাথে মিলিয়ে দেবেন। উভয় বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন। হাত পায়ের আঙ্গুল কিবলামুখী রাখবেন। পা খাড়া করবেন না। এক কথায় সিজদা এমন ভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাযত হয়।
৫- উভয় বৈঠকে মহিলাগণ বাম নিতম্বের উপর বসবেন। হাতগুলো রানের উপর রাখবেন। পা দুটো ডান দিকে বের করে দেবেন। আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখবেন।
যারা এই মতের প্রবক্তা, তারা দলীল দিয়ে থাকেন-
১। হাদীস শরীফের আলোকে।
২। সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য ও কর্মের আলোকে।
৩। তাবেয়ী ইমাম গনের আছারের আলোকে।
হাদীস শরীফের আলোকে:
হাদিস:১
– أخبرناه أبو بكر محمد بن محمد أنبأ أبو الحسين الفسوي ثنا أبو علي اللؤلؤي ثنا أبو داود ثنا سليمان بن داود أنبأ بن وهب أنبأ حيوة بن شريح عن سالم بن غيلان عن يزيد بن أبي حبيب : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم مر على امرأتين تصليان فقال إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل (سنن الكبرى للبيهقى، كتاب الحيض، باب ما يستحب للمرأة من ترك التجافي في الركوع والسجود، رقم الحديث- 3016)
তাবেয়ী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব রহ. বলেন-একবার রাসূল সা. দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন-“যখন সেজদা করবে তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়। (সুনানুল বায়হাকী, হাদিস নং-৩০১৬,কিতাবুল মারাসিল লি ইমাম আবু দাউদ-৫৫, হাদিস নং-৮০)
হাদিসটির ব্যাপারে মুহাক্কিকদের মন্তব্য:
১/ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, আহলে হাদিস ও সালাফী ঘরানার বরেণ্য আলেম, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “আওনুল বারী” (১/৫২০) তে লিখেছেন-“উল্লেখিত হাদিসটি সকল ইমামদের উসুল অনুযায়ী দলীল হিসেবে পেশ করায় যোগ্য”.
২/ একই ধারার অপর মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলুগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) এই হাদিসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সেজদার পার্থক্য করেছেন।
৩/ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়েখ শুয়াইব আরনাউত (র:) হাদীসটির সূত্র সম্পর্কে বলেন, বর্ণনা কারী প্রত্যেক রাবী সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) ।
( তালীক আলা মারাসিলে আবী দাউদ পৃঃ ১১৭ )
৪/ শায়খ আলবানি রহ. এই হাদিসের সনদের রাবীদেরকে নির্ভরযোগ্য আখ্যা দিয়ে হাদিসটির ব্যাপারে বলেন-
فعلة الحديث الإرسال فقط. والله أعلم.
“এই হাদিসের সকল রাবী নির্ভরযোগ্য। তবে এটি দুর্বল হওয়ার একমাত্র কারণ, হাদিসটি মুরসাল। আল্লাহ ভালো জানেন!”
(সিলসিলাতুল আহাদিসীদ দায়ীফাহ – ২৬৫২)
মুরসাল বলতে, এই হাদিসের বর্ণনাকারী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব একজন তাবেয়ী, তিনি রাসূল সা. থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। সুতরাং মাঝে অবশ্যই কেও বাদ পরেছে। হতে পারে তিনি কেবল একজন সাহাবী, অথবা কিবারে তাবেয়ী ও সাহাবী দুজন। যেহেতু একজন তাবেয়ী থাকার সম্ভাবনা আছে তাই হতে পারে তিনি সিকাহ, হতে পারে দুর্বল। এই সম্ভাবনাটাই শায়খ আলবানির কাছে হাদিসের দুর্বলতার কারণ! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শায়খ যে হালকা ভাবে হাদিসটিকে দুর্বল বললেন, আমাদের দেশে এই হাদিসটিই হয়ে গেল ”মারাত্মক দুর্বল”।
মুরসাল প্রায় সকল ইমামের নিকট শর্তসাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য। ইবনে রাজাব হামবলী ৪ টি শর্ত উল্লেখ করেছেন মুরসাল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে। এখানে বিস্তারিত আলোচনার স্থান না, তবে উক্ত ৪ টি শর্ত এই হাদিসে পাওয়া যায়। সুতরাং এখানে মুরসাল হওয়ার দ্বারা হাদিসটি দুর্বল হবে না।
(বিস্তারিত দেখুন, কাওয়ায়েদ ফু উলুমিল হাদিস ১৪৩-১৪৬)।
হাদিস – ২
وَالآخَرُ حَدِيثُ أَبِى مُطِيعٍ : الْحَكَمِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الْبَلْخِىِّ عَنْ عُمَرَ بْنِ ذَرٍّ عَنْ مُجَاهِدٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- :« إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا (السنن الكبرى، كتاب الصلاة، باب مَا يُسْتَحَبُّ لِلْمَرْأَةِ مِنْ تَرْكِ التَّجَافِى فِى الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ، رقم الحديث-3324)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছন-“মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখে বলেন-ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে বায়হাকী-২/২২৩, হাদিস নং-৩৩২৪)
হাদিসের মান-
এই হাদিসের সনদে আবু মুতী বলখী নামে একজন রাবী আছে। তার ব্যাপারে ইমামগণের যে সমালোচনা তার সার কথা হচ্ছে, হাদিস মুখস্থ করার ক্ষেত্রে শিথিল, আর তিনি মুরজিয়া ছিলেন। উকাইলী বলেন তিনি ‘সালেহুল হাদিস’! কিন্তু ইমাম বুখারীসহ অনেকেই উনাকে দুর্বল বলেছেন। যদি উকাইলীর কথা ধরা হয়, তবে এই সনদ হাসান পর্যায়ের। যেমনটা অনেক আলেম বলে থাকেন। আর শায়খ আলবানি সহ আরো অনেকে এই হাদিসকে দুর্বল বলেছেন ইমাম বুখারী ও অন্যান্যদের কথার উপর ভিত্তি করে।
অধমের মত হচ্ছে, এই হাদিস হাসান লি গাইরিহি। কারণ দুর্বল সূত্রে হলেও এর শাওয়াহেদ আছে। সাহাবীদের ফতোয়া ও তাবেয়ীদের আছার আছে। সর্বোপরি খাইরুল কুরুনের আমল আছে এর উপর।
হাদিস- ৩
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ الْحَضْرَمِيُّ قَالَ: حَدَّثَتْنِي مَيْمُونَةُ بِنْتُ حُجْرِ بْنِ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَتْ: سَمِعْتُ عَمَّتِي أُمَّ يَحْيَى بِنْتَ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، عَنْ أَبِيهَا عَبْدِ الْجَبَّارِ، عَنْ عَلْقَمَةَ عَمِّهَا، عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قال : جئت النبي صلى الله عليه و سلم ………….فقال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها (المعجم الكبير، باب الواو، وائل بن حجر الحضرمي القيل، رقم الحديث-28)
হযরত ওয়াইল বিন হুজর রা. বলেন। আমি নবীজী সা. এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং-২৮)
হাদিসের মান-
যারা এই আমলের পক্ষে নয় তারা বলেন, এই হাদিসের একজন রাবী উম্মে ইয়াহইয়া তার হালত জানা যায় না, যে তিনি নির্ভরযোগ্য নাকি দুর্বল? তাই হাদিসটি দুর্বল! হায়ছামী বলেন, উম্মে ইয়াহইয়া ছাড়া বাকী রাবীরা সিকাহ!
যারা এই আমলের পক্ষে তারা বলেন, উম্মে ইয়াহইয়া যে পর্যায়ের রাবী তাতে প্রতিভাত হয় তিনি কিবারে তাবে তাবেয়ীর অন্তর্ভুক্ত। আর এই স্তরের মাসতুর রাবীর বর্ণনা দ্বারা দলীল পেশ করা যায়। সুতরাং হাদিসটি হাঁসান।
অধমের খেয়াল, এই হাদিসটি হাসান লি গাইরিহি। উসূল অনুযায়ী যেহেতু এর সহীহ সূত্রে বর্ণিত বিভিন্ন আছার দ্বারা শাওয়াহেদ (সমর্থন) পাওয়া যায়, তাই এই হাদিস হাসান পর্যায়ে উন্নীত।
সাহাবায়ে কিরামের আমল ও ফতোয়া :-
হাদিস – ১
– عبد الرزاق عن إسرائيل عن أبي إسحاق عن الحارث عن علي قال إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها (مصنف عبد الرزاق، كتاب الصلاة، باب تكبير المرأة بيديها وقيام المرأة و ركوعها وسجودها، رقم الحيث-5072)
হযরত আলী রা. বলেছেন-মহিলা যখন সেজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৮, হাদিস নং-৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে শাইবা-২/৩০৮, হাদিস নং-২৭৯৩, সুনানে কুবরা বায়হাকী-২/২২২)
মান- হাসান
হাদিস -২
حَدَّثَنَا أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْمُقْرِئ ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي أَيُّوبَ ، عَنْ يَزِيدَ بْنِ أَبِي حَبِيبٍ ، عَنْ بُكَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ الأَشَجِّ ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؛ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ صَلاَةِ الْمَرْأَةِ ؟ فَقَالَ : تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ. (مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2794)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করা হল-মহিলারা কিভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন-“খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৪)
এই সনদের সকল রাবী নির্ভরযোগ্য!
হাদিস -৩
عن ﺍﻣﺎﻣﻨﺎ ﺍﻻﻋﻈﻢ ابي حنيفة النعمان ﻋﻦ ﻧﺎﻓﻊ ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ ﺍﻧﻪ ﺳﺌﻞ ﻛﻴﻒ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ ﻳﺼﻠﻴﻦ ﻋﻠﻰ ﻋﻬﺪ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ . ﻗﺎﻝ :ﻛﻦ ﻳﺘﺮﺑﻌﻦ ﺛﻢ ﺍﻣﺮﻥ ﺍﻥ ﻳﺤﺘﻔﺰﻥ . ﺍﺧﺮﺟﻪ ﺍﺑﻮ ﻣﺤﻤﺪ ﺍﻟﺤﺎﺭﺛﻲ ﻭﺍﻻﺷﻨﺎﻧﻰ ﻭﺍﺑﻦ ﺧﺴﺮﻭ ﻣﻦ ﻃﺮﻳﻘﻪ ﻋﻦ ﺳﻔﻴﺎﻥ ﺍﻟﺜﻮﺭﻱ ﻋﻨﻪ . (ﺭﺍﺟﻊ ﺟﺎﻣﻊ ﺍﻟﻤﺴﺎﻧﻴﺪ ﺝ١ﺹ٤٠٠ )
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: কে জিজ্ঞেস করা হল,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মহিলারা কীভাবে নামায পড়তেন?তিনি বললেন,আগে তারা চারজানু হয়ে বসতেন,পরে তাদেরকে জড়সড় হয়ে বসতে বলা হয়েছে।
(জামিউল মাসানীদ-ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) খ: ১/৪০০, মুসনাদে আবী হানীফা বিরিওয়াতিল হাসকাফী-৩৭ )
সনদের মান- হাদিসটি সম্পূর্ণ সহীহ। এটি ইমাম আবু হানীফা সরাসরি নাফে’ থেকে, তিনি ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন।
হাদিস -৪
ইবনে রাজাব হামবলী, তার লিখিত বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল বারী”তে, সুনানে সাইদ ইবনে মানসুর এর উদ্ধৃতিতে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন,
وروى سعيد بن منصور بإسناده ، عن عبد الرحمن بن القاسم ، قال كانت عائشة تجلس في الصلاة عن عرقيها وتضم فخذيها، وربما جلست متربعة .
“আয়েশা রা. বৈঠকে দুই উরু একদম মিলিয়ে রাখতেন এবং প্রায়শই দু পা ডানদিকে বের করে নিতম্বের উপর বসতেন।”
ফাতহুল বারী ৭/৩০০- উল্লেখ্য আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেও এই হাদিসের সনদ খুঁজে পাই নি। সুনানে সাইদ ইবনে মানসুর এর প্রচলিত নুসখা যার আংশিক ৫ খণ্ডে প্রকাশিত। তাতেও নেই। প্রথম পর্বে বলেছিলাম, এমন বহু কিতাব বিলুপ্ত, অনেক কিতাব আজও অনুদ্ঘাটিত ও অপ্রকাশিত। ইবনে রাজাব হামবলী (মৃ ৭৯৫ হি.) এর মত ব্যক্তিত্ব বিনা তাহকীকে আন্দাজে লিখে দিবেন, ভাবা মুশকিল। আল্লাহ ভালো জানেন, হয়ত তার কাছে ছিল, মূল নুসখাতে আছে। কিন্তু আমাদের নুসখাতে (কপি) নেই!
তাবেয়ীদের আমল ও ফতওয়া:-
আছার – ১
حدثنا هشيم ، قال : أخبرنا شيخ لنا ، قال : سمعت عطاء ؛ سئل عن المرأة كيف ترفع يديها في الصلاة ؟ قال : حذو ثدييها(مصنف ابن ابى شيبه، كتاب الصلاة، باب من كان يتم التكبير ولا ينقصه في كل رفع وخفض،)
হযরত আতা বিন আবী রাবাহ কে জিজ্ঞেস করা হল-“নামাযে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে?” তিনি বললেন-“বুক বরাবর”। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,-১/২৭০, হাদিস নং-২৪৮৬)
আছার- ২
– حدثنا محمد بن بكر ، عن ابن جريج ، قال : قلت لعطاء : تشير المرأة بيديها بالتكبير كالرجل ؟ قال : لا ترفع بذلك يديها كالرجل ، وأشار فخفض يديه جدا ، وجمعهما إليه جدا ، وقال : إن للمرأة هيئة ليست للرجل ، وإن تركت ذلك فلا حرج.
হযরত ইবনে জুরাইজ রহ. বলেন-“আমি আতা বিন আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করলাম-“মহিলা তাকবীরের সময় পুরুষের সমান হাত তুলবে?” তিনি বললেন-“মহিলা পুরুষের মত হাত তুলবে না। এরপর তিনি তার উভয় হাত (পুরুষ অপেক্ষা) অনেক নিচুতে রেখে শরীরের সাথ খুব মিলিয়ে রাখলেন এবং বললেন-মহিলাদের পদ্ধতি পুরুষ থেকে ভিন্ন। তবে এমন না করলেও অসুবিধা নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/২৭০, হাদিস নং-২৪৮৯, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক,হাদিস নং-৫০৬৬,৬২৫১)।
আছার -৩
حدثنا جرير ، عن ليث ، عن مجاهد ؛ أنه كان يكره أن يضع الرجل بطنه على فخذيه إذا سجد كما تصنع المرأة.
হযরত মুজাহিদ বিন জাবর যিনি মক্কাবাসীদের ইমাম ছিলেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী, তার থেকে বর্ণিত। তিনি পুরুষের জন্য মহিলার মত উরুর সাথে পেট লাগিয়ে সেজদা করাকে অপছন্দ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৮৯৬)
আছার – ৪
– حدثنا رواد بن جراح ، عن الأوزاعي ، عن الزهري ، قال : ترفع يديها حذو منكبيها.
হযরত যুহরী রহ. যিনি মদীনাবাসীদের ইমাম, তিনি বলেন-“মহিলা কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/২৭০, হাদীস নং-২৪৮৭)
আছার – ৫
– عبد الرزاق عن معمر عن الحسن وقتادة قالا إذا سجدت المرأة فإنها تنضم ما استطاعت ولا تتجافى لكي لا ترفع عجيزتها
হযরত হাসান বসরী যিনি বসরাবাসীদের ইমাম, ও কাতাদা রহ. বলেন-“মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সেজদা দেবে না যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে”। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৭, হাদিস নং-৫০৬৮, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০৩)
আছার – ৬
– حَدَّثَنَا أَبُو الأَحْوَصِِ ، عَنْ مُغِيرَةَ ، عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : إذَا سَجَدَتِ الْمَرْأَةُ فَلْتَضُمَّ فَخِذَيْهَا ، وَلْتَضَعْ بَطْنَهَا عَلَيْهِمَا.(مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2795)
হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন-মহিলা যখন সেজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৫)।
আছার – ৭
– عبد الرزاق عن معمر والثوري عن منصور عن إبراهيم قال كانت تؤمر المرأة أن تضع ذراعها وبطنها على فخذيها إذا سجدت ولا تتجافى كما يتجافى الرجل لكي لا ترفع عجيزتها
হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ. আরো বলেন-“মহিলাদের আদেশ করা হত তারা যেন সেজদা অবস্থায় হাত ও পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। পুরুষের মত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা না রাখে। যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৭, হাদিস নং-৫০৭১)
আছার -৮
– حَدَّثَنَا إسْمَاعِيلُ ابْنُ عُلَيَّةَ ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ ، عَنْ زُرْعَةَ بْنْ إِبْرَاهِيمَ ، عَن خَالِدِ بْنِ اللَّجْلاَجِ ، قَالَ : كُنَّ النِّسَاءُ يُؤْمَرْنَ أَنْ يَتَرَبَّعْنَ إذَا جَلَسْنَ فِي الصَّلاَةِ ، وَلاَ يَجْلِسْنَ جُلُوسَ الرِّجَالِ عَلَى أَوْرَاكِهِنَّ ، يُتَّقي ذَلِكَ عَلَى الْمَرْأَةِ ، مَخَافَةَ أَنْ يَكُونَ مِنْهَا الشَّيءُ.
হযরত খালেদ বিন লাজ্জাজ, যিনি সিরিয়াবাসীদের ইমাম, তিনি বলেন-“মহিলাদেরকে আদেশ করা হত যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে। আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় মহিলাদেরকে এমনি করতে হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০৩, হাদিস নং-২৭৯৯)
আছার – ৯
– حَدَّثَنَا خَطَّابُ بْنُ عُثْمَانَ , عَنْ إِسْمَاعِيلَ , عَنْ عَبْدِ رَبِّهِ بْنِ سُلَيْمَانَ بْنِ عُمَيْرٍ قَالَ: رَأَيْتُ أُمَّ الدَّرْدَاءِ «تَرْفَعُ يَدَيْهَا فِي الصَّلَاةِ حَذْوَ مَنْكِبَيْهَا»اخرجه البخاري في جزء رفع اليدين في الصلاة برقم 50
উম্মে দারদা যিনি তাবেয়ীদের মধ্যে বিখ্যাত ফকীহ ছিলেন, তিনি নামাজে কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলতেন। (বুখারী- জুযউ রাফয়িল ইয়াদাইন- ৫০, সনদ সহীহ)
আছার – ১০
প্রখ্যাত তাবেঈ ইমাম ইবনু সীরিন (রহঃ) এর কন্যা হাফসা (রহঃ) থেকেও উক্ত আমল প্রমাণিত । ইমাম ইবনু শাইবা (রহঃ) বর্ণনা করেন
হাফসা বিনতে সীরিন (রহঃ) বুক বরাবর হস্তদ্বয় উঠিয়ে তাকবীর বললেন ।
— মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবা , হাদিস নং ২৪৭৫,
পূর্বে আলোচনা গিয়েছে, সুন্নাতে মুতাওয়ারিসাহ নিয়ে। সুন্নাতে মুতাওয়ারিসাহ খাবরে ওয়াহেদ এর চেয়েও শক্তিশালী। খাবরে ওয়াহেদ সহীহ হলে সেটা যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে অনায়াসে সুন্নাতে মুতাওয়ারিসাহ গ্রহণীয় হবে। নামাজ মুসলমানের জীবনের একটি প্রাত্যহিক স্বাভাবিক আমল। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবায়ে কেরাম যে দীন শিখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে তা শিখেছেন তাবেয়ীগণ। তাঁদের এসমস্ত ফতোয়া থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয়—নারীদের রুকু সেজদা পুরুষের মত নয়। ইমাম বুখারী রহ.এর শায়েখ ইমাম ইবনে আবী শায়বা রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলন ‘আলমুসান্নাফ’-এ তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইবনে জুরাইজ, ইবরাহীম নাখায়ী, মুজাহিদ, যুহরী, হাসান বসরী, কাতাদা রাহিমাহুমুল্লাহু তায়ালা প্রমুখের ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই নারীদের জন্যে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নামাজ আদায়ের পদ্ধতির ফতোয়া দিয়েছেন। আগ্রহী পাঠকগণ সেখানে দেখে নিতে পারেন।
নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই-
এই মর্মে মোটা দাগে ৩ টা দলীল পেশ করা হয়।
১- হাদিস
২- আছারে সাহাবী
৩- আছারে তাবেয়ী
প্রথম দলীল:
নারী-পুরুষ উভয় জাতির উম্মতকে সম্বোধন করে রাসূল(সা:) বলেছেন,“তোমরা সেইরূপ সালাত আদায় কর, যেইরুপ আমাকে করতে দেখেছ”। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৯ //
সাধারণত এই দলীলটি সবাই উল্লেখ করে থাকেন। শায়খ আলবানী রহ. তার সিফাতুস সালাহ গ্রন্থে এই হাদিসকে কেন্দ্র করেই বলেছেন, “এখানে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। সুতরাং উভয়ের নামাজে কোন ভিন্নতা নেই”!
**হাদিসে কি নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে? “রাসূল সা. নারী ও পুরুষকে সম্বোধন করে বলেছেন”, এই কথাটুকু বাড়তি সংযোজন। রাসূল সা. নারীদের সম্বোধন করে বলেন নি। যাদের বলেছেন, তারা নারী ছিলেন না। এই বাড়তি সংযোজন নিজস্ব ইজতেহাদ ও উপলব্ধি মাত্র। পূর্ণ হাদিস বিশ্লেষণ করলে এই দলীলের যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রথমে উক্ত হাদীসটির পূর্ণরূপ দেখে নেই: . ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﺳُﻠَﻴْﻤَﺎﻥَ ﻣَﺎﻟِﻚِ ﺑْﻦِ ﺍﻟﺤُﻮَﻳْﺮِﺙِ، ﻗَﺎﻝَ : ﺃَﺗَﻴْﻨَﺎ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲَّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ، ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﺷَﺒَﺒَﺔٌ ﻣُﺘَﻘَﺎﺭِﺑُﻮﻥَ، ﻓَﺄَﻗَﻤْﻨَﺎ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﻋِﺸْﺮِﻳﻦَ ﻟَﻴْﻠَﺔً، ﻓَﻈَﻦَّ ﺃَﻧَّﺎ ﺍﺷْﺘَﻘْﻨَﺎ ﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ، ﻭَﺳَﺄَﻟَﻨَﺎ ﻋَﻤَّﻦْ ﺗَﺮَﻛْﻨَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻫْﻠِﻨَﺎ، ﻓَﺄَﺧْﺒَﺮْﻧَﺎﻩُ، ﻭَﻛَﺎﻥَ ﺭَﻓِﻴﻘًﺎ ﺭَﺣِﻴﻤًﺎ، ﻓَﻘَﺎﻝَ : « ﺍﺭْﺟِﻌُﻮﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﻫْﻠِﻴﻜُﻢْ، ﻓَﻌَﻠِّﻤُﻮﻫُﻢْ ﻭَﻣُﺮُﻭﻫُﻢْ، ﻭَﺻَﻠُّﻮﺍ ﻛَﻤَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻤُﻮﻧِﻲ ﺃُﺻَﻠِّﻲ، ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺣَﻀَﺮَﺕِ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓُ، ﻓَﻠْﻴُﺆَﺫِّﻥْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ، ﺛُﻢَّ ﻟِﻴَﺆُﻣَّﻜُﻢْ ﺃَﻛْﺒَﺮُﻛُﻢْ » .
আবূ সুলাইমান মালিক ইবনু হুওয়ায়রিস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা কয়জন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকটে আসলাম। তখন আমরা ছিলাম প্রায় সমবয়সী যুবক। বিশ দিন তাঁর কাছে আমরা থাকলাম। তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের নিকট প্রত্যাবর্তন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। যাদের আমরা বাড়িতে রেখে এসেছি তাদের ব্যাপারে তিনি আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তা তাঁকে জানালাম। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও দয়ার্দ্র। তাই তিনি বললেন: তোমরা তোমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যাও। তাদের (কুরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ কর এবং যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনভাবে সালাত আদায় কর। সালাতের ওয়াক্ত হলে, তোমাদের একজন আযান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামত করবে। . বুখারী, হাদীস নং-৬০০৮
উক্ত হাদীসে খেয়াল করুন!
* কতিপয় যুবক সাহাবী এসেছেন। তাদের সবাই যুবক। তাদের মাঝে কোন নারী ছিল না।
* বাড়িতে গিয়ে স্বীয় এলাকাবাসীকে কুরআন শিক্ষা সৎ কাজের আদেশের নির্দেশনা দিলেন।এরপর তোমরা বলে পরপর তিনটি নির্দেশনা দিলেন।
যথা-
১/আমাকে যেভাবে দেখেছো সেভাবে তোমরা নামায পড়বে।
২/নামাযের সময় হলে তোমাদের মধ্য হতে একজন আযান দিবে।
৩/নামাযের জন্য তোমাদের থেকে যে বড় সে ইমাম হবে।
পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ –
** প্রথমত হাদিসে উল্লেখই আছে, যারা রাসূল সা. এর সামনে ছিলেন। তারা পুরুষ। সম্বোধন তাদেরকেই ছিল।
** দ্বিতীয়ত হাদীসটির শেষ দিকে নবীজী সা. আযান ও ইমামতের নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশটি আরো স্পষ্ট করে, এখানে নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করার দাবী সঠিক নয়।
** তৃতীয়ত এই হাদিসটি বুখারী, মুসলিমসহ আরো অন্যান্য গ্রন্থে ১০ টি রেওয়ায়ত, সহীহ সনদে এসেছে। অর্থাৎ মালেক বিন হুয়াইরিস রা. এর মদীনায় এসে রাসূল সা. এর কাছ থেকে ইসলাম শেখার বিবরণ। সেখানে মাত্র একটি বর্ণনায় আছে যে রাসূল সা. বলেছেন “সাল্লু কামা রায়াইতুমুনি উসাল্লি” অর্থাৎ আমাকে যেভাবে দেখছ সেভাবে নামাজ আদায় করো। এছাড়া অন্য বর্ণনাগুলোতে এই কথাটা নেই। সেখানে কোথাও আছে, “তোমরা নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তাদের নামাজ শেখাবে। তারা যেন নামাজ পড়ে এই এই ওয়াক্তে। আর নামাজের সময় এলে একজন আযান দেয়, আর বয়োজ্যেষ্ঠ যে সে ইমামতি করে।” বুখারী (৬৫৩) অন্য রেওয়াতে আছে, মালেক বিন হুয়াইরিস ও তার চাচাত ভাই রাসূল সা. এর কাছে এলেন। তিনি বললেন, যখন তোমরা দুজন সফরে যখন বের হবে তখন আযান একামত দিবে। আর তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমাম হবে। (তিরমিজী – ২০৫, সহীহ) এই হাদিসে একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এখানে নির্দেশ পুরুষদেরকে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য রেওয়ায়ত গুলো চেক করতে চাইলে, মুসলিম – ২৯২/৬৭৪, বায়হাকী ২২৩৭, ২২৩৮, ২৬৬৭ ইত্যাদি।
তদুপরি যদি মেনে নেয়া হয় যে মহিলাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছ। তারপর যে প্রশ্নগুলো আসবে…
১- রাসূল সা. কে মত নামাজ পড়ার মর্ম কী?এর মর্ম কী এই, রাসূল সা. এর মত আরকান ও আমলগুলো আদায় করা? নাকি এর মর্ম এই, রাসূল সা. এর মত খুশু খুজু স্থিরতা আনার চেষ্টা করা?
২- হুবহু রাসূল সা. এর মত নামাজ আদায় করতে যদি মহিলাদের নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে নামাজে রাসূল সা. এর অন্যান্য আমল, যেমন টাখনু খোলা রেখে নামাজ আদায়। ইত্যাদি। এগুলোও কি রাসূল সা. মালেক বিন হুয়াইরিসকে বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের শিখাতে বলেছেন? মহিলাদের আযান একামত ও উচ্চস্বরে কেরাত পড়তে বলেছেন? যেভাবে রাসূল সা. পড়তেন। আর উক্ত সাহাবীও রাসূল সা. কে পড়তে দেখেছেন!যদি উত্তর হয়, না এইগুলা রাসূল সা. বলেন নি। তাহলে বোঝা যাবে হাদিসে মহিলাদের নামাজ নিয়ে কিছুই বলা হয় নাই। বলা হলে পার্থক্যের ক্ষেত্রগুলো রাসূল সা. কেন বলে দিলেন না? যে মহিলারা আস্তে কেরাত পড়বে, টাখনু ঢাকবে। চুল খোলা রাখবে না। কারণ এগুলো তো রাসূলের নামাজের বিপরীত চিত্র। মালেক বিন হুয়াইরিসের যত রেওয়ায়েত আছে একটা রেওয়াতেও নেই কেন, ঐ পার্থক্যগুলোর কথা। যেগুলোর ব্যাপারে সবাই একমত।
আগেই বলা হয়েছে যে,স্বতঃসিদ্ধ মত হচ্ছে, যেসব বিধানে নারীদের ব্যাপারে ভিন্ন কিছু কুরআন বা হাদিসের মাধ্যমে অথবা ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, সেক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যেই শামিল। এটা প্রমাণে বিস্তর দলীল দস্তাবেজ এর প্রয়োজন নেই। কারণ এতে সবাই একমত।কিন্তু নারীদের নামাজে রুকু সেজদার পার্থক্য তো, হাদিস, আছার ও ইজমা, কেয়াস দ্বারা প্রমাণিত।
এমনকি, শায়খ আলবানি রহ. তার কিতাবে এক ইবনে হাজাম জাহেরী ছাড়া জমহুরের মতের বিপরীত আর কারো মত উপস্থাপন করেন নি। ইবনে হাজাম জাহেরী ছিলেন জাহেরী সম্প্রদায়ের মতবাদপ্রবর্তক। যাদের মূল কথা হচ্ছে, হাদিস কুরআনে বাহ্যিক যা অর্থ, তাই মানব। এই নীতির আলোকে দেয়া তার কিছু উদ্ভট ফতোয়ার কারণে তাকে একাধিকবার দেশ ছাড়তে হয়েছে। ইবনে হাজাম যাহেরী রহ. এর ভুলভ্রান্তি বিস্তারিত আলোচনা করা এখানে সম্ভব না। তার কয়েকটি মাসআলা উল্লেখ করছি,
১- কুরআনে বলা আছে, মা বাবাকে ‘উফ’ বলো না। সুতরাং তাদের গালি দেয়া জায়েজ। গালি তো উফ না।
২- হাদিসে বলা আছে, বিয়ের আগে কনেকে দেখে নিতে, যাতে বিয়েতে উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়। তিনি ফতোয়া দিলেন, কনেকে এমনকি উলঙ্গ করেও দেখা যাবে। কারণ তা আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করবে।
৩- হাদিসে এসেছে, কুকুর মুখ দিলে ৭ বার ধৌত করতে। কিন্তু শুয়োর এর ব্যাপারে কিছু বলা হয় নাই। সুতরাং শুয়োর মুখ দিলে তা পান করা ও উজু করা বৈধ।
৪- আয়াতে বলা আছে, দারিদ্রতার ভয়ে সন্তানকে হত্যা করো না। তিনি ফতোয়া দিলেন, এখানে দারিদ্র্যতার কথা বলা আছে। সুতরাং ধনী হলে হত্যা করতে অসুবিধে নাই। কারণ তার দারিদ্রতার ভয় নেই।
ইবনে হাজাম এর ভিন্নমত সম্পর্কে ইমামদের অভিমত”
হাফেজ ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন- যাহেরীদের সম্পর্কে আমার মত হলো, তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ থেকে বের হয়ে গেছে। (আল ইস্তেযকার – ৩০৯)
ইমাম নববী বলেন, বাহ্যিকবাদী তথা যাহেরী মতবাদ এক আজীব মাজহাব। যা চূড়ান্ত পর্যায়ের ভ্রান্ত। ইবনে হাজাম যাহেরী থেকে বর্ণিত মতটি (কোন এক মাসআলায়) নিকৃষ্টতম মাসআলার একটি। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। (আল মাজমূ ১/১১৮) –
ইবনে তায়মিয়া রহ. ইবনে হাজাম যাহেরীর হাদিস বিষয়ক জ্ঞানের কথা স্বীকার করে তার ভুলভ্রান্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এবং তিনি যাহেরীদেরকে ভ্রান্ত ফেরকা জাহমিয়াদের মধ্যে শামিল করেছেন। ( মিনহাজুস সুন্নাহ ২/৫৮৩, দারউ তায়া’রুজিল আকলি ওয়ান নাকল ৫/২৪৯)
সুতরাং ইবনে হাজাম যাহেরী যদিও হাদিস বিশারদ ছিলেন। কিন্তু তার ফিকহের অবস্থা ছিল করুণ! তাই, উম্মাহর সকল আয়িম্মাহর বিপরীতে গিয়ে তার উদ্ভট ফতোয়াকে সমর্থন হিসেবে পেশ করা মানানসই না। উল্লেখ্য, ইবনে হাজাম রহ. খায়রুল কুরুনের কেও নন। তার জন্ম ৩৯৪ হি, স্পেনে। ইন্তেকাল ৪৪৬ হি।
শায়খ আলবানি নিঃসন্দেহে বড় মাপের মুহাদ্দিস ছিলেন। শায়খ আলবানির এই মতকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে অনেকেই বলেছেন নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই। কিন্তু এখানে যে কথাটা না বললেই নয়, হাদিস বিশারদ হওয়া আর ফিকহ বিশারদ হওয়া এক নয়। শায়খ আলবানির অনেক ফতোয়াই উম্মাহ গ্রহণ করে নাই। যেমন, মহিলাদের স্বর্ণ ব্যবহার হারাম, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে হিজরত করা ওয়াজিব, তিনি আরো বলেছেন, “সবাইকে সালাফী পরিচয় দিতে হবে”, নাপাক থাকা অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা জায়েজ ইত্যাদি। এই মতগুলো কেও গ্রহণ করে নি।
এমনকি অনেক মত খোদ আহলে হাদিস/সহীহ আকীদার ভাইরাও গ্রহণ করেন নাই।
- যেমন, বেতর ৩ রাকাত পড়া।
- এক রাকাতের বেতর না থাকা,
- শবে বরাতের হাদিস সহীহ হওয়া,
- ইমাম জোরে কেরাত পড়লে মুক্তাদি সুরা ফাতেহা পড়বে না।
- রুকু থেকে উঠে হাত বাধা বেদাত হওয়া ইত্যাদি।
এগুলো শায়খ আলবানির মত। কিন্তু গ্রহণ করেন না অনেকেই। উল্লেখ্য, শায়খ আলবানি ও শায়খ বিন বাজ, সালেহ আল উসাইমিনের ভিন্নমত বা ইখতেলাফ নিয়ে দুই খণ্ডে ৮০০ শত পৃষ্ঠারও বেশি একটি কিতাব রয়েছে। যেটা লিখেছেন ড. সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল বারীক। যার নাম হচ্ছে “আল ইজাযু ফি বাদি মা ইখতালাফা ফীহী আলবানি ওয়া ইবনু উছাইমিন ওয়া ইবনু বায রাহিমাহুমুল্লাহু তায়লা”!
দ্বিতীয় দলীল
//উম্মে দারদা (রা:) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন। (আত-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ১/৩৫৫ পৃঃ, ফাৎহুল বারী ২/৩৫৫)।//
বিশ্লেষণ-
প্রথমত, উম্মে দারদা তিনি একজন ফকীহ তাবেয়ী। উপরে দেখতে পাচ্ছেন, যারা এই দলীল উপস্থাপন করেছেন, তারা ফাতহুল বারী (বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ) এর উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে, ফাতহুল বারীতে স্পষ্ট করে লেখা আছে, এই উম্মে দারদা সাহাবী নন। তিনি তাবেয়ী! শুধু ফাতহুল বারী কেন, তারীখের কিতাব তাহযীবুত তাহযীব, তাহযীবুল কামাল, সিয়ারু আলামিন নুবালা ইত্যাদি গ্রন্থগুলো চেক করলেই বুঝতে পারবে, এখানে উম্মে দারদা সুগরা উদ্দেশ্য। কারণ মাকহুল এর সাথে উম্মে দারদা কুবরা যিনি সাহাবী, তার সাথে কখনো দেখাই হয় নি । তাহলে মাকহুল কীভাবে উম্মে দারদা (সাহাবী) থেকে বর্ণনা করবেন? এ বিষয়টা জানার পরেও তাবেয়ীর কথাকে সাহাবীর কথা বলে প্রচার করা দুঃখজনক। (তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৫)।
দ্বিতীয়ত, উম্মে দারদা হুবহু পুরুষের মত বসতেন না। ইবনে রজব হামবলী রহ. ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন, হাদিসের বাকী অংশ যেটা হারব আল কিরমানি সূত্রে বর্ণিত, উম্মে দারদা পুরুষের মত বসতেন তবে তিনি বাম নিতম্বের দিকে ঝুঁকে বসতেন। এতে বরং পুরুষের নামাজের চেয়ে ভিন্নতাই প্রমাণিত হয়।
قال الحافظ ابن رجب في فتح الباري(7/299) قال حرب الكرماني : نا عمرو بن عثمان : نا الوليد بن مسلم ، عن ابن ثوبان ، عن أبيه ، عن مكحول ، أن أم الدرداء كانت تجلس في الصلاة جلسة الرجل إلا إنها تميل على شقها الأيسر ، وكانت فقيهةً
তাছাড়া ইমাম বুখারীর বাক্য প্রয়োগ “পুরুষের মত বসতেন আর তিনি ফকীহ ছিলেন” দ্বারা অনেকে বলেন, এখানে তার বসাটা অন্যান্য তাবেয়ীদের তুলনায় ব্যতিক্রম ছিল। আর তাই ইমাম বুখারী সেটার প্রতি জোর দিতে গিয়ে ‘তিনি ফকীহ ছিলেন’ কথাটা যুক্ত করেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে এর মর্ম দাঁড়ায় খায়রুল কুরুনে মহিলাদের বসার পদ্ধতি পুরুষের চেয়ে ভিন্ন ছিল। কেবল একজন তাবেয়ী ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি কিছুটা পুরুষের মত বসতেন। তাহলে এর দ্বারা বরং ভিন্নতাই প্রমাণিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত: তারীখের কিতাবগুলোতে রয়েছে, উম্মে দারদা খুব অল্প বয়সী ও ইয়াতীমাহ ছিলেন। তাই তিনি পুরুষের কাতারে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন এবং পুরুষদের ক্বেরাতের মজলিশেও বসতেন। এরপর তিনি বড় হলে একদিন তাকে আবু দারদা মহিলাদের কাতারে যুক্ত হতে বলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি নামাজে যদি পুরুষদের মত বসেও থাকেন, তবে সেটা পুরুষদের দেখে দেখে করতেন ঐ বয়সে , যখন তিনি সাবালিকা হন নি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/২৭৮, তারীখুল ইসলাম ২/১০২৫, তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৪) ৪/
তদুপরি যদি তাবেয়ীর আমলটাকে ঐভাবে ধরে নেই যে নামাজে পুরুষ আর মহিলাদের বসার ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই। তবে এর বিপরীতে সহীহ সনদে সাহাবীর আমল আছে..
ইমাম তাহাবী, (শারহু মুশকিলিল আছার ১৩/২৪৩ ও আহকামুল কুরআনের ১/১৬৪ হা. ২৬৬) একটি হাদিস সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন। হাসান বসরী রহ. তার মা এর সূত্রে, (যিনি উম্মে সালামার খাদেমা ছিলেন) উম্মুল মুমীনীন উম্মে সালামা থেকে বর্ণনা করেন যে, উম্মে সালামা দু পা ডানে দিয়ে বসতেন, অর্থাৎ মেয়েরা যেভাবে সালাতে বসে। উল্লেখ্য তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. নিজেও উম্মে সালামার দুধসন্তান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শাইখ কামালুদ্দীন জাফরী এক টিভি আলোচনায় বলে বসলেন, “সহীহ বুখারীতে আছে, নবীজীর স্ত্রী সম্ভবত উম্মুল মুমীনীন সওদা রা. صلت صلاة الرجل و كانت فقيهة অর্থাৎ সাওদা রা. পুরুষের মত নামাজ আদায় করলেন আর তিনি ফকীহ ছিলেন।” তিনি যা বললেন, তার আরবী বা ভাবার্থ কোনটাই বুখারীতে নেই। এমনকি আমি অনুসন্ধান করে অন্য কোন হাদিস গ্রন্থেও এই হাদিস দেখি নি, বা যারা উনার মত বলেন যে নারীদের নামাজ অভিন্ন, তাদের কাউকে এমনটা লিখতে দেখি নি। সুতরাং আমার খেয়াল, তিনি এক্ষেত্রে ভুল করে উম্মে দারদার হাদিসের অর্থকে সামান্য বদলে, বানিয়ে সেটাকে আরবীতে বলেছেন। এটা একটা তাসামুহ বা মিস্টেক। আল্লাহ ভালো জানেন। সাহাবী ও সালাফের নীতি হলো, তারা হাদিস বর্ণনায় আরো বেশি সতর্কতার পরিচয় দিতেন।
তৃতীয় দলীল
ইবরাহীম নাখয়ী (র:) বলেন, ‘সালাতে মহিলারা ঐরূপ করবে, যেরূপ পুরুষরা করে থাকে। (ইবনে আবি শাইবা ১/৭৫/২, সিফাতু সালাতুন্নবী ১৮৯ পৃঃ)। ইবরাহীম নাখয়ীর আছারটি শায়খ আলবানি রহ. সিফাতুস সালাতে উল্লেখ করেছেন। তিনি সেটাকে সহীহ সনদও বলেছেন। তিনি যে আরবী বাক্য দিয়েছেন المرأة تفعل في صلاتها كما يفعل الرجل কিন্তু উক্ত আছার মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে পাওয়া যায় না। তাই শায়খের দাবীকে অনেকে “শিবহুত তাহরীফ” (বিকৃত কথার অনুরূপ) বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
অধমের খেয়াল হচ্ছে, ইবরাহীম নাখয়ীর যে আছারটি শায়েখ উল্লেখ করেছেন, তা সম্ভবত শায়েখ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার মুখতাসার, যাতে প্রচুর মিস্টেক আছে। সেই গ্রন্থ থেকেই শায়েখ তুলে দিয়েছেন। যার কারণে ভুলটা হয়েছে। ইবরাহীম নাখয়ী বলেন নি যে, “মহিলারা নামাজে তাই করবে যা পুরুষরা করে”! তবে একটা আছার আছে, যেখানে ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন ‘মহিলারা পুরুষের মত বসবে।” عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : تَقْعُدُ الْمَرْأَةُ فِي الصَّلاَةِ كَمَا يَقْعُدُ الرَّجُلُ এতে শুধু বসার ক্ষেত্রে অভিন্নতা প্রমাণ হয়। কিন্তু রুকু সেজদার ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই, এটা প্রমাণ হয় না।
বরং অন্য বর্ণনায় আছে,ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন-মহিলা যখন সেজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৫) তাছাড়া কথা হচ্ছে, শায়খ আলবানি রহ. যখন বসার ক্ষেত্রে অভিন্নতা প্রমাণ করতে তাবেয়ীর আছার দিয়ে দলীল পেশ করলেন, তাহলে নারী পুরুষের নামাজে ভিন্নতা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এত এত বিপুল পরিমাণ আছারকে কেন গ্রহণ করা হবে না?
৪ ইমামের দৃষ্টিতে মহিলারা যেভাবে নামাজ পড়বে
ফিক্বহে ইসলামীর চারটি সংকলন মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রচলিত। হিজরী শতক এর কিছু পর থেকে এই মাজহাবগুলোর উপর উম্মাহ ১৩০০ বছর যাবত আমল করে আসছে। নারীদের নামাজের ভিন্নতা সম্পর্কে চার মাজহাবের ইমামদের মতামত তুলে ধরা হলো। যথা-
১. ইমাম আবূ হানীফা রহ.
احب الينا ان تجمع رجليها من جانب ولا تنتصب انتصاب الرجل، (كتاب الآثار-1/609)
ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর অন্যতম সাগরীদ ইমাম মুহাম্মদ রহঃ বলেন-“ আমাদের নিকট পছন্দনীয় হল, মহিলারা নামাযে উভয় পা একপাশে মিলিয়ে রাখবে। পুরুষের মত এক পা দাঁড় করিয়ে রাখবে না। {কিতাবুল আসার, ইমাম মুহাম্মদ রহঃ-১/৬০৯}
روى امامنا الأعظم عن نافع عن ابن عمر رضى الله عنهما أنه سئل كيف كان النساء يصلين على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ قال كن يتربعن أمرن أن يحتفزن،
أخرجه أبو محمد الحارثى والأشنانى وابن خسرو من طريقه عن سفيان الثورى عنه، راجع جامع الماسانيد-1/400، وهذا أقوى واحسن ما روى فى هذا الباب، ولذا احتج به امامنا وجعله مذهبه وأخذ به،
ইমামে আজম আবু হানীফা র: নাফে রহঃ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন-“হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা: কে জিজ্ঞেস করা হল-“রাসূল সা: এর যুগে মহিলারা কিভাবে নামায পড়তেন?” তিনি বললেন-“আগে তারা চারজানু হয়ে বসতেন, পরে তাদেরকে জড়সড় হয়ে বসতে বলা হয়েছে”। {জামিউল মাসানীদ-১/৪০০}
উক্ত হাদিসটি এ বিষয়ে বর্ণিত দলীলগুলোর মধ্যে শক্তিশালী। এ কারণেই ইমাম আবু হানীফা এর দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। এ অনুযায়ী আমল করেছেন। এবং এটিকে নিজের মাযহাব বানিয়েছেন। {কিতাবুল আসার এর টিকা-১/৬০৭}।
মহিলাদের ক্ষেত্রে পার্থক্যের বর্ণনা হানাফী ফিক্বহের যে কিতাবগুলোতে রয়েছে–
১-বাদায়িউস সানায়ে-১/৪৬৬
২-হেদায়া-১/১০০-১১০
৩-আল মাবসূত লিস সারাখসী-১/৪৬৬
৪-ফতওয়ায়ে শামী-১/৫০৪
৫-ফতওয়ায়ে আলমগীরী-১/৭৩-৭৫
ইত্যাদি —
২- ইমাম মালেক রহ.
মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফক্বীহ ইমাম আবুল আব্বাস আল কারাফী র: ইমাম মালিক রহঃ এর মত উল্লেখ করেন-
وأما مساواة النساء للرجال ففي النوادر عن مالك تضع فخذها اليمنى على اليسرى وتنضم قدر طاقتها ولا تفرج في ركوع ولا سجود ولا جلوس بخلاف الرجل
নামাযে মহিলা পুরুষের মত কিনা? এ বিষয়ে ইমাম মালিক রহঃ থেকে বর্ণিত। মহিলা ডান উরু বাম উরুর উপর রাখবে এবং যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে বসবে। রুকু সেজদা ও বৈঠকে কোন সময়ই ফাঁক ফাঁক হয়ে বসবে না। পক্ষান্তরে পুরুষের পদ্ধতি হল ভিন্ন। {আয যাখীরা-২/১৯৩}
وقال الإمام مالك رحمه الله كما في النوادر لابن أبي زيد 1/186: «تجلس المرأة على وركها الأيسر، وتضع فخذها اليمنى على اليسرى، تضم بعضها إلى بعض، بقدر طاقتها، ولا تفرج في ركوع ولا سجود، ولا جلوس بخلاف الرجل».
ইমাম মালেক বলেন, মহিলারা তার বাম নিতম্বের উপর বসবে। আর ডান উরুকে বা উরুর উপর রাখবে। একটিকে অপরটির সাথে যথাসম্ভব মিলিয়ে রাখবে। রুকু, সেজদা ও বৈঠকে পুরুষের মত ফাঁকা ফাঁকা করে থাকবে না। অর্থাৎ মিলিয়ে রাখবে।
আননাওয়াদের লি ইবনে আবী যায়দ ১/১৮৬৬-
৩- ইমাম শাফেয়ী রহ.
( قال الشافعي ) وقد أدب الله تعالى النساء بالاستتار وأدبهن بذلك رسوله صلى الله عليه وسلم وأحب للمرأة في السجود أن تضم بعضها إلى بعض وتلصق بطنها بفخذيها وتسجد كأستر ما يكون لها وهكذا أحب لها في الركوع والجلوس وجميع الصلاة أن تكون فيها كأستر ما يكون لها (كتاب الأم، باب الذكر في السجود)
ইমাম শাফেয়ী রহঃ বলেন-“আল্লাহ পাক মহিলাদেরকে পুরোপুরি আবৃত থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। তার রাসূল সা: ও অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হল-সেজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গ মিলিয়ে রাখবে। পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে। আর সেজদা এমনভাবে করবে যাতে সতরের চূড়ান্ত হেফাযত হয়। অনুরূপ রুকু, বৈঠক ও গোটা নামাযে এমনভাবে থাকবে যাতে সতরের পুরোপুরি হেফাযত হয়। {কিতাবুল উম্ম-১/১৩৮)
وقال الإمام الشافعي رحمه الله كما في مختصر المزني 8/109: «ولا فرق بين الرجال والنساء في عمل الصلاة إلا أن المرأة يستحب لها أن تضم بعضها إلى بعض وأن تلصق بطنها في السجود بفخذيها كأستر ما يكون وأحب ذلك لها في الركوع وفي جميع عمل الصلاة».
ইমাম শাফেয়ী বলেন, পুরুষ আর মহিলার নামাজে আমলগত ভিন্নতা নেই, তবে মহিলাদের জন্যে মুস্তাহাব হচ্ছে সেজদায় এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গ মিলিয়ে রাখবে। আর পেটকে উরু থেকে পৃথক করবে না। যাতে অধিক সতর রক্ষা হয়। এটা রুকুর ক্ষেত্রেও, বরং নামাজের সব আমল আদায়ের ক্ষেত্রে (সতর হেফাজত করাটা অধিক পছন্দনীয়)!
وينظر المغني لابن قدامة 1/403 والمجموع للنووي 3/526 وحاشية العدوي 1/270 وحاشية الدسوقي 1/249
— ইমাম নববী লিখেন
“ইমাম শাফেয়ী আল মুখতাসার গ্রন্থে বলেন, পুরুষ মহিলার নামাজে পার্থক্য নেই, তবে মেয়েদের জন্যে মুস্তাহাব হলো, তারা এক অঙ্গের সাথে অন্য অঙ্গ মিলিয়ে রাখবে। আর সেজদায় পেটকে উরুর সাথে সম্পৃক্ত করবে। যা সতরের অধিক রক্ষাকারী! এটা রুকুর ক্ষেত্রেও মুস্তাহাব।
৪- ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.
ইমাম আহমদ রহঃ এর ফতওয়া উল্লেখ আছে ইমাম ইবনে কুদামা রহঃ এর আল মুগীনী কিতাবে।
فأما المرأة فذكر القاضي فيها روايتين عن أحمد إحداهما ترفع لما روى الخلال بإسناده عن أم الدرداء وحفصة بنت سيرين أنهما كانتا ترفعان أيديهما وهو قول طاوس ولأن من شرع في حقه التكبير شرع في حقه الرفع كالرجل فعلى هذا ترفع قليلا قال أحمد رفع دون الرفع والثانية لا يشرع لأنه في معنى التجافي ولا يشرع ذلك لها بل تجع نفسها في الركوع والسجود وسائر صلاتها
তাকবীরের সময় মহিলারা হাত উঠাবে কি উঠাবে না? এ বিষয়ে কাজী [আবু ইয়াজ] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ থেকে দু’টি মত উল্লেখ করেছেন। প্রথম মত হল হাত উঠাবে। কেননা খাল্লাল হযরত উম্মে দারদা এবং হযরত হাফসা বিন সীরীন থেকে সনদসহ বর্ণনা করেন যে, তারা হাত উঠাতেন। ইমাম তাউসের বক্তব্যও তাই। উপরন্তু যার ব্যাপারে তাকবীর বলার নির্দেশ রয়েছে তার ব্যাপারে হাত উঠানোরও নির্দেশ রয়েছে। যেমন পুরুষ করে থাকে। এ হিসেবে মহিলারাও হাত উঠাবে। তবে সামান্য। আহমাদ রহঃ বলেন-“তুলনামূলক কম উঠাবে”।
দ্বিতীয় মত হল-“মহিলাদের জন্য হাত উঠানোরই হুকুম নাই। কেননা হাত উঠালে কোন অঙ্গকে ফাঁক করতেই হয়, অথচ মহিলাদের জন্য এর বিধান দেওয়া হয়নি। বরং তাদের জন্য নিয়ম হল রুকু সেজদাসহ পুরো নামাযে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখবে। {আল মুগনী-২/১৩৯}।
ইবনে কুদামা হামবলী, আল মুগনীতে আরো বলেন, “নামাজে মহিলা পুরুষ এর বিধান একই। তবে মহিলারা রুকু ও সেজদাতে নিজেদের অঙ্গগুলোকে মিলিত রাখবে। বসার ক্ষেত্রে দু পা ডানে বের করে দিয়ে বসবে। নামাজের ক্ষেত্রে মৌলিক নির্দেশে নারী পুরুষ উভয়েই শামিল। তবে যেহেতু নারীকে হাদিসে ‘আওরাহ’ বলা হয়েছে। তাই তারা পুরুষের রুকু সেজদায় সটান হওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা অবলম্বন করবে। কারণ এভাবে সতর রক্ষা হয়! কারণ পুরুষের মত রুকুর সেজদা করতে গেলে আপনি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না যে মেয়েদের সতরের সমস্যা হবে না।
আলী রা. বলেছেন, যখন মহিলারা সালাত আদায় করবে তখন যেন জড়সড় হয়ে থাকে, আর উরুকে পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তার ঘরের মহিলাদেরকে নির্দেশ দিতেন, দু পা মিলিত করে ডানে বের করে দিয়ে বসবে।
হামবলী মাজহাবের অপর গ্রন্থ- আল ইনসাফে আছে।
“নামাজের মহিলারা পুরুষের মতই, তবে তারা রুকু ও সেজদায় নিজদেরকে গুটিয়ে রাখবে। অনুরূপ নামাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। এতে কারো দ্বিমত নেই।”
আল ইনসাফ ফি মারিফাতির রাজিহী মিনাল খেলাফ- ২/৯০।
হাদিস বিশারদদের অভিমত –
১/ ইমাম আবু বকর আব্দুর রাজ্জাক আসসানআনী! (২১১ হি.)
ইমাম আব্দুর রাজ্জাক আসসানআনী তার গ্রন্থে “আল মুসান্নাফ” যা মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক নামে প্রসিদ্ধ, এই গ্রন্থের ৩/১২৬-১৩৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত, তিনি নারীদের নামাজ ভিন্নতা প্রমাণে ‘মেয়েদের নামাজে দাঁড়ানো/রুকু করা/বৈঠকে মেয়েরা যেভাবে বসবে’ ইত্যাদি শিরোনামে হাদিস ও আছার উল্লেখ করেছেন।
২/ ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা- (২৩৫ হি.)
ইবনে আবী শাইবা তার হাদিস গ্রন্থ ‘আল মুসান্নাফে’ নারীদের নামাজের ভিন্নতার সপক্ষে বিভিন্ন আছার পেশ করেছেন। তার শিরোনামগুলো খেয়াল করলেই স্পষ্ট হয়, সালাফে সালেহীন মহিলাদের নামাজে ভিন্নতার প্রবক্তা ছিলেন। যেমন তিনি শিরোনাম দিয়েছেন “মহিলারা সেজদারত অবস্থায় যেভাবে থাকবে”, “অধ্যায়: নামাজে মেয়েরা যেভাবে বসবে” ইত্যাদি। (১/২৪২ বা ২/৫০৩-৫০৮)
এই দুই বিদগ্ধ হাদিসের ইমাম, যারা ইমাম বুখারীর পূর্বসূরি, বুখারী তাদের সূত্রে হাদিস বর্ণনাও করেছেন । তাদের কিতাবে আলাদাভাবে শিরোনামই দিয়েছেন, নারীদের নামাজের পার্থক্য প্রমাণ করে।
৩/ ইমাম আহমদ বিন হামবল
ففي مسائل أبي داود ص75 قال:
«سألت أحمد عن المرأة، كيف تسجد؟ قال: تضم فخذيها، قلت لأحمد: فجلوسها مثل جلوس الرجل؟ قال: لا».
ইমাম আবু দাউদ বলেন, আমি আহমদ বিন হামবলকে জিজ্ঞেস করলাম, মহিলারা কীভাবে সেজদা করবে? তিনি বললেন, উরুর সাথে মিলিয়ে জড়সড় হয়ে। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারা কি পুরুষের মতই বসবে? তিনি বললেন, না পুরুষের মত বসবে না।
মাসায়েলে আবী দাউদ- ৭৫
৪/ ইমাম আবু দাউদ
ইমাম আবু দাউদ, তার মারাসীলে একাধিক হাদিস দিয়ে প্রমাণ করেন যে নারীদের নামাজে রুকু সেজদাতে ভিন্নতা রয়েছে।
৫/ ইমাম তিরমিজী
‘সালাত অধ্যায়’ এর “রুকু অবস্থায় উভয় হাত পেটের পার্শ্বদেশ হতে পৃথক রাখা” শিরোনামে এই হাদিসটি উল্লেখ করেন।
”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকুর সময় দুই হাত দুই হাঁটুতে রাখলেন। তিনি হাত দু’টোকে টানা তীরের মত (সোজা) রাখলেন এবং পার্শ্বদেশ হতে পৃথক (ফাঁক) করে রাখলেন।”
এরপরে ইমাম তিরমিজী বলেন, “এই আমল আহলে ইলম গ্রহণ করেছেন। যে “পুরুষরা” রুকু ও সেজদাতে তাদের দুহাত পার্শ্বদেশ (পেট) থেকে পৃথক রাখবে।” (হাদিস- ২৬০)
শায়খ আলবানী রহ, ‘আসলু সিফাতিস সালাহ’ গ্রন্থের ২/৬৩৭ পৃষ্ঠায় লিখেন, “ইমাম তিরমিজীর এভাবে পুরুষের সাথে এই বিধানকে খাস করে দেয়ার দ্বারা বোঝা যায়, মহিলারা নামাজে তাদের অঙ্গগুলো পৃথক করবে না। বরং একটি অঙ্গ অপর অঙ্গের সাথে মিলিয়ে রাখবে। এটা হানাফী, শাফেয়ী ও অন্যান্যদের মাজহাব। ইবনে হাজাম এর বিপরীত মত দিয়েছেন।”
(উল্লেখ্য শায়খ রহ. ইবনে হাজামের মতকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ইবনে হাজামের অবস্থা সম্পর্কে ইতোপূর্বে যা আলোচনা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় সকল ইমামের বিপরীতে ইবনে হাজামের মত গ্রহণ করা যায় না)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হাদিস বিডি অ্যাপসে ইমাম তিরমিজীর বক্তব্যের যে অনুবাদ দেয়া হয়েছে, তাতে “পুরুষ” শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা ভুলবশত বাদ পরে গেছে।
৬/ ইমাম তাহাবী (৩২১হি.)
শারহু মুশকিলিল আছার ও আহকামুল কুরআন গ্রন্থে বিভিন্ন দলীল দিয়ে প্রমাণ করেছেন, নারীদের নামাজে রুকুর সেজদা ও বৈঠকে পার্থক্য রয়েছে।
৭/ ইমাম বায়হাকী। (৪৫৮ হি.)
তিনিও তার কিতাব, সুনানে বায়হাকী তে (২/২২২) বলেন,
“নামাজে বিভিন্ন বিধানে মহিলাদের ভিন্নতার ক্ষেত্রে মূলত বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে সতর। অর্থাৎ, মহিলারা নামাজ ঐভাবে আদায় করতে আদিষ্ট, যেভাবে আদায় করলে অধিক আব্রু হেফাজত হবে। সামনের অধ্যায়গুলোতে এর বিস্তারিত আলোচনা আসছে…”
আহলে হাদিস ও সমধারার আলেমগণ, যাদের মতে নারীদের নামাজ ভিন্ন —
মহিলাদের নামাযের পদ্ধতিতে ইতোপূর্বে যা কিছু উল্লেখ করা হল তথা হাদিস, আসারে সাহাবা, তাবেঈনদের ইজমা, এবং চার ইমামের ঐক্যমত্যের আলোকে যুগ যুগ ধরে অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় যেই পার্থক্যের আমল চলে আসছে, সেটাকে গায়রে মুকাল্লিদ (যারা ৪ মাজহাব এর অনুসারী নন) নেতৃস্থানীয় আলেমগণ ও তাদের নিকট যারা বরেণ্য ও গ্রহণযোগ্য আলেম, তারাও স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সেই আলোকে ফতওয়া দিয়েছেন। যেমন,
১/ শায়খুস ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রহ. বলেন
. كَذَلِكَ الْمَرْأَةُ أُمِرَتْ أَنْ تَجْتَمِعَ فِي الصَّلَاةِ وَلَا تُجَافِيَ بَيْنَ أَعْضَائِهَا وَأُمِرَتْ أَنْ تُغَطِّيَ رَأْسَهَا فَلَا يَقْبَلُ اللَّهُ صَلَاةَ حَائِضٍ إلَّا بِخِمَارِ وَلَوْ كَانَتْ فِي جَوْفِ بَيْتٍ لَا يَرَاهَا أَحَدٌ مِنْ الْأَجَانِبِ فَدَلَّ ذَلِكَ عَلَى أَنَّهَا مَأْمُورَةٌ مِنْ جِهَةِ الشَّرْعِ بِسَتْرِ لَا يُؤْمَرُ بِهِ الرَّجُلُ حَقًّا لِلَّهِ عَلَيْهَا وَإِنْ لَمْ يَرَهَا بَشَرٌ.
এমনিভাবে মহিলাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নামাজে জড়সড় হয়ে থাকতে, অঙ্গগুলোকে পুরুষের মত সমান না করে দিতে। আরো আদেশ দেয়া হয়েছে মহিলারা যেন মাথার চুল ঢেকে রাখে। কারণ হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা কোন নারীর নামাজ কবুল করবেন না মাথা আবৃতকরণ ব্যতীত। যদিও সে ঘরের এমন কোণে থাকে, যেখানে কেও তাকে দেখছে না।
এই হাদিসটি এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, শরীয়ত নারীকে সতর এর কারণে কিছু হুকুম দিয়েছে যা পুরুষকে দেয় নি।
( মজমুয়ায়ে ফতওয়া ২২/১৫০)
يَأْمُرُونَ الْمَرْأَةَ فِي الصَّلَاةِ أَنْ تَجْمَعَ وَلَا تُجَافِيَ بَيْنَ أَعْضَائِهَا وَتَتَرَبَّعَ وَلَا تَفْتَرِشَ وَفِي الْإِحْرَامِ لَا تَرْفَعَ صَوْتَهَا إلَّا بِقَدْرِ مَا تَسْمَعُ رَفِيقَتُهَا وَأَنْ لَا تَرْقَى فَوْقَ الصَّفَا والمروة. كُلُّ ذَلِكَ لِتَحْقِيقِ سَتْرِهَا وَصِيَانَتِهَا وَنُهِيَتْ أَنْ تُسَافِرَ إلَّا مَعَ زَوْجٍ أَوْ ذِي مَحْرَمٍ
নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে তারা যেন নামাজে জড়সড় হয়ে থাকে, অঙ্গগুলোকে পুরুষের মত সমান করবে না। পুরুষের মত পায়ের উপর বসবে না। বরং দু পা বের করে দিয়ে বসবে। এমনিভাবে এহরামেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে, নারী কণ্ঠ উঁচু করবে না। তবে এই পরিমাণ উচ্চ আওয়াজে তালবিয়া পড়তে পারবে, যাতে কেবল তার সঙ্গী ব্যক্তি শুনতে পায়। মহিলারা সাফা ও মারওয়াতেও দৌড়াবে না। (কারণ দৌড়ালে শরীরের ভাজ স্পষ্ট হয়ে যায়) আর এর প্রত্যেকটি করা হয়েছে, নারীর সতর রক্ষাকে নিশ্চিত করতে।
(মাজমুয়ায়ে ফতওয়া ৩৪/১৩০)
২/ ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ রহ. বলেন,
وَلِهَذَا شُرِعَ فِي حَقِّ الْإِنَاثِ مِنَ السِّتْرِ وَالْخَفَرِ مَا لَمْ يُشْرَعْ مِثْلُهُ لِلذُّكُورِ فِي اللِّبَاسِ وَإِرْخَاءِ الذَّيْلِ شِبْرًا أَوْ أَكْثَرَ، وَجَمْعِ نَفْسِهَا فِي الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ دُونَ التَّجَافِي، وَلَا تَرْفَعُ صَوْتَهَا بِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ، وَلَا تَرْمُلُ فِي الطَّوَافِ
এই কারণেই শরীয়তে নারীদেরকে সতর ও নম্র-লজ্জা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেটা পুরুষকে দেয়া হয় নাই। যেমন পোশাকের ক্ষেত্রে, আচলের নিম্নভাগ এক বিঘত বা তার চেয়ে বেশি ঝুলিয়ে দেয়া , রুকু সেজদার ক্ষেত্রে জড়সড় হয়ে থাকা, পুরুষের মত অঙ্গগুলোকে পৃথক রাখবে না, ক্বেরাতের সময় কণ্ঠস্বর উঁচু করবে না। তওয়াফের সময় দ্রুত চলবে না।
(যাদুল মায়াদ ৫/৪৪২)
৩/ ইবনে কুদামা হামবলী!
হামবলী ফিকহের শীর্ষ ফকীহদের একজন। সালাফী ও আহলে হাদিস আলেমদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও উদ্ধৃতিযোগ্য গ্রন্থ আল মুগনীর মুসান্নিফ। তার মতামত উপরেই উল্লেখ হয়েছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, নারীদের নামাজে পার্থক্য নেই প্রমাণ করতে আল মুগনীর উদ্ধৃতিতে ইবনে কুদামার বক্তব্য পেশ করেছেন কোন এক ভাই বা শায়েখ। তিনি সেখানে অনুবাদ করতে গিয়ে যা করেছেন তা অনেকটা “ওয়ালা তাকরাবুস সালাহ” অর্থ তোমরা নামাজের কাছেও যেয়ো না এর মত হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন “তোমরা নামাজের কাছে যেও না যখন মাতাল থাকো”, মাতাল থাকো এই অংশ বাদ দিয়ে অনুবাদ করলে যা হয়, ইবনে কুদামা হামবলীর অনুবাদের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে
//ইবনে কুদামাহ (রহঃ) বলেন “প্রকৃতপক্ষে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য নামাযের পদ্ধতি এক বলেই প্রমাণিত হয়েছে শুধুমাত্র এটা ছাড়া যে তার জন্য রুকু এবং সিজদার সময় নিজেকে আবৃত রাখা মুস্তাহাব” [আল মুগনি ২/২৫৮]।
ইবনে কুদামার বক্তব্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে কেবল আরবীটুকু দেয়া হচ্ছে, যাতে অনুবাদের বাস্তবতাটা স্পষ্ট হয়।
[مَسْأَلَة يَثْبُتَ فِي حَقِّ الْمَرْأَةِ مِنْ أَحْكَامِ الصَّلَاةِ مَا يَثْبُتُ لِلرِّجَالِ]
(783) مَسْأَلَةٌ: قَالَ وَالرَّجُلُ وَالْمَرْأَةُ فِي ذَلِكَ سَوَاءٌ، إلَّا أَنَّ الْمَرْأَةَ تَجْمَعُ نَفْسَهَا فِي الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ وَتَجْلِسُ مُتَرَبِّعَةً أَوْ تَسْدُلُ رِجْلَيْهَا فَتَجْعَلُهُمَا فِي جَانِبِ يَمِينِهَا. الْأَصْلُ أَنْ يَثْبُتَ فِي حَقِّ الْمَرْأَةِ مِنْ أَحْكَامِ الصَّلَاةِ مَا يَثْبُتُ لِلرِّجَالِ؛ لِأَنَّ الْخِطَابَ يَشْمَلُهَا، غَيْرَ أَنَّهَا خَالَفَتْهُ فِي تَرْكِ التَّجَافِي، لِأَنَّهَا عَوْرَةٌ، فَاسْتُحِبَّ لَهَا جَمْعُ نَفْسِهَا، لِيَكُونَ أَسْتَرَ لَهَا، فَإِنَّهُ لَا يُؤْمَنُ أَنْ يَبْدُوَ مِنْهَا شَيْءٌ حَالَ التَّجَافِي. وَكَذَلِكَ فِي الِافْتِرَاشِ، قَالَ أَحْمَدُ: وَالسَّدْلُ أَعْجَبُ إلَيَّ. وَاخْتَارَهُ الْخَلَّالُ.
قَالَ عَلِيٌّ، كَرَّمَ اللَّهُ وَجْهَهُ: إذَا صَلَّتْ الْمَرْأَةُ فَلْتَحْتَفِزْ وَلْتَضُمَّ فَخِذَيْهَا. وَعَنْ ابْنِ عُمَرَ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا -، أَنَّهُ كَانَ يَأْمُرُ النِّسَاءَ أَنْ يَتَرَبَّعْنَ فِي الصَّلَاةِ.
৪/ দাউদ গজনবী ও আব্দুল জাব্বার গজনবী রহ. (আহলে হাদিস আলেম)
মাওলানা মুহাম্মদ দাউদ গযনবী র: এর পিতা আল্লামা আব্দুল জাব্বার গযনবী রহঃ কে যখন জিজ্ঞেস করা হল-“মহিলাদের নামাযে জড়সড় হয়ে থাকা কি উচিত?” জবাবে তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করার পর লেখেন-“এর উপরই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের চার মাযহাব ও অন্যান্যের মাঝে আমল চলে আসছে”।
এরপর তিনি চার মাযহাবের কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করার পর লিখেন-“মোটকথা মহিলাদের জড়সড় হয়ে নামায পড়ার বিষয়টি হাদীস ও চার মাযহাবের ইমামগণ ও অন্যান্যের সর্বসম্মত আমলের আলোকে প্রমাণিত। এর অস্বীকারকারী হাদীসের কিতাবসমূহ ও উম্মতে মুসলিমার সর্বসম্মত আমল সম্পর্কে বেখবর ও অজ্ঞ”। (ফতওয়ায়ে গযনবীয়্যা-২৭-২৮, ফতওয়ায়ে ওলামায়ে আহলে হাদিস—৩/১৪৮-১৪৯, মাযমুয়ায়ে রাসায়েল-মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর-১-৩১০-৩১১)।
৫/ মাওলানা আলী মুহাম্মদ সাঈদ (আহলে হাদিস আলেম)
তিনিও “ফতওয়ায়ে ওলামায়ে আহলে হাদিস” এ এই পার্থক্যের কথা স্বীকার করেছেন। (মাজমুয়ায়ে রাসায়েল-১/৩০৫)
৬/ নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান রহ. (আহলে হাদিস আলেম)
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, আহলে হাদিস ও সালাফী ঘরানার বরেণ্য আলেম, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “আওনুল বারী” (১/৫২০) তে নারীদের নামাজের পার্থক্য বিভিন্ন হাদিস এর আলোকে প্রমাণ করেছেন।
৭/ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী রহ.
একইধারার অপর মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলুগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) বিভিন্ন হাদিসের আলোকে পুরুষ ও মহিলার সেজদার পার্থক্য করেছেন।
৮/ শাইখ ইসহাক (সালাফি আলেম)
পাকিস্তান এর বিখ্যাত সালাফি ও আহলে হাদিস শায়েখ, মৌলভী ইসহাক সাহেব বলেন “মাগার ইয়ে বাত পুরি উম্মাত কা ইজমা কী খেলাফ… অর্থাৎ নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই, এমনটা বলা হয়। কিন্তু এই কথাটা পুরো উম্মাহর ইজমার বিপরীত। সমস্ত উম্মাত, সাহাবা তাবেয়ী থেকে নিয়ে যত আলেম অতিবাহিত হয়েছেন, কারো এ ব্যাপারে দ্বিমত ছিল না যে মহিলাদের নামাজ পুরুষের চেয়ে ভিন্ন। মহিলাদের নামাজ তো ঐভাবেই পড়া উচিত যেভাবে পড়লে পর্দা রক্ষা হবে, সতর অস্পষ্ট থাকবে। কোন অঙ্গ পুরুষের মত উঁচিয়ে থাকবে না।”
শায়খ ইসহাক এর ভাষায়, পুরো উম্মাহর হাজার বৎসর যাবত চলে আসা আমলের বিপরীত ফতোয়া দেয়াটা “একটা ফিতনা”!
তিনি আরো বলেন, “দেখুন। আপনারা যখন হজ্বের ক্ষেত্রে মেয়েদের তালবিয়া পাঠের ক্ষেত্রে বলেন যে মেয়েরা অনুচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করে। তখন আপনারা বলেন যে “এভাবেই আহলে ইলমরা বলে আসছেন”! এক্ষেত্রে তো আহলে ইলম এর কথাকে মানছেন। অথচ রাসূল সা. উঁচু আওয়াজে তালবিয়া পাঠের নির্দেশ দেয়ার সময় কি বলে দিয়েছেন, যে এটা কেবল পুরুষের জন্যে? তিনি তো ঐভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন ব্যাপকভাবে। যেমনটা নামাজে বলেছেন। তাহলে তালবিয়ার ক্ষেত্রে নারীকে আলাদা করছেন কেন? আর নামাজের ক্ষেত্রে একসাথে গুলিয়ে ফেলছেন। সাফা মারওয়াতে কি মেয়েরা দৌড়াবে? সেখানে তো বলেন মেয়েরা দৌড়াবে না। কারণ দৌড়ালে পর্দার খেলাফ হবে। দেহের আকৃতি ফুটে উঠবে। অথচ রাসূল সা. তো সেখানে নারী পুরুষকে আলাদাভাবে কিছু বলেন নাই। সেখানে কেন নারীকে পৃথক করা হলো?
শেষ ও সারসংক্ষেপঃ
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ একটি ধর্ম। ইসলামের সব বিষয়ে নির্দিষ্ট হুকুম রয়েছে। অন্য বিষয়গুলোর মতো পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতিগত পার্থক্যের বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়।
নবীজি সা.-এর সময় থেকে সবাই এ পার্থক্য মেনে নামাজ আদায় করতেন। ঐকমত্যে পার্থক্যের বিপরীতে নতুন পদ্ধতি সামনে এলে তা নিঃসংকোচে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, যাতে মানুষ ধোঁকায় না পড়ে। মূলকথা হলো, পুরুষ-নারীর মাঝে মৌলিক যে তিনটি পার্থক্য করা হয় তার মধ্যে অন্যতম অবস্থান ও কর্মস্থলের পার্থক্য।
পুরুষের কর্মস্থল বাইরে আর নারীর অন্দরে। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে মূলত নারীর নামাজ পুরুষ থেকে ভিন্ন রাখা হয়েছে। নবীজি সা.-এর সময় থেকে সাহাবা, তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িনগণ বিষয়টি খুব সহজভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং নবীজি সা. নির্দেশিত নারীদের নামাজের পার্থক্য অকপটে মেনে নিয়েছেন। এমনকি চার ইমামও এই পার্থক্যের ব্যাপারে একমত।
ইমাম বাইহাকী রহ. বিষয়টি সুনানে কুবরায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, নামাজের বিভিন্ন বিধানের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর নামাজে পদ্ধতিগত ভিন্নতার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো ‘সতর’, অর্থাৎ নারীর জন্য শরিয়তের হুকুম হলো এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা, যা তাকে সর্বোচ্চ পর্দায় রাখে।
নিম্নে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হলো-
সালাত পদ্ধতিতে নারীদের ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে দুটি পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো- ১. সতর বা পর্দাকেন্দ্রিক পার্থক্য : অর্থাৎ যতটুকু সম্ভব গোপনীয়তার মাধ্যমে নারীরা সালাত আদায় করবে।
এই মর্মে আল্লাহ মহান পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
তোমরা গৃহাভন্তরে অবস্থান করবে-মুর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। [সুরা আল আহযাব, আয়াত ৩৩]
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, হুজুর সা. এরশাদ করেন, নারীদের নিজকক্ষে নামাজ পড়া বাড়িতে নামাজ পড়ার তুলনায় উত্তম, আর নির্জন ও অন্দরকক্ষে নামাজ পড়া ঘরের সমুখকক্ষে নামাজ পড়া থেকে উত্তম। [হাদিসটি সহিহ, আবু দাউদ ১/৩৮৩, মুসতাদরাকে হাকেম ১/৩২৮]
হজরত আয়েশা রা. রাসুল সা. থেকে বর্ণনা করেন, ওড়না বা চাদর ছাড়া নারীদের নামাজ কবুল হবে না। [আবু দাউদ ১/৪২১ তিরমিজী ২/২১৫-মুসতাদরাকে হাকিম ১/৫১]
উল্লেখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, নারীদের সব সময় পর্দার আড়ালেই থাকা প্রয়োজন। আর নামাজ ইসলামের অন্যতম একটি বিধান সুতরাং নারীর নামাজ অধিক পর্দায় হবে- এটাই বিবেকের দাবী।
আমরা দেখলাম পর্দার ক্ষেত্রে নামাজ পড়ার সময় পুরুষ ও নারীদের কি পার্থক্য আছে, এখন আমরা দেখব নামাজের রুকন বা পড়ার পদ্ধতির ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের নামাজের মাঝে কি পার্থক্য আছে।
রোকন বা পদ্ধতিতে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য : চার ধরনের দলীলের আলোকে সংক্ষিপ্তভাবে পদ্ধতিগত এই পার্থক্য তুলে ধরা হলো-
১. হাদিসের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
নামাজি নারীর সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তিকে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে করণীয় কি?
রাসুল সা. এ প্রসঙ্গে বলেন, পুরুষদের জন্য হলো তাসবিহ বলা আর নারীদের জন্য হাতে আওয়াজ করা। [সহীহ বুখারী ১/৪০৩]
ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবীব রা. বলেন, একবার রাসুল সা. নামাজরত দুই নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন, যখন সিজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে দিবে, কেননা নারীরা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। [কিতাবুল মারাসিল-ইমাম আবু দাউদ : পৃঃ১১৭] হাদিসটি “সহীহ”। [তালীক আলা মারাসিলে আবী দাউদ পৃঃ ১১৭]
উল্লেখ্য, এইসব হাদিসের সমর্থনে নারী ও পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতিগত পার্থক্য ও ভিন্নতাকে নির্দেশ করে । এমন আরো অনেক হাদিস রয়েছে। পক্ষান্তরে এগুলোর সাথে বিরোধ পুর্ন একটি হাদিসও কোথাও পাওয়া যাবে না, যাতে বলা রয়েছে যে, পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য নেই।
২. সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্যের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
হজরত নাফেয় রহ. ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন, তাকে রাসুল সা. -এর সময়ে নারীদের নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, প্রথমত তারা চার পা হয়ে বসত অতপর এক পক্ষ হয়ে বসার জন্য বলা হলো। আসারটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহীহ। [জামেউল মাসানীদ-ইমাম আবু হানীফা [রহ.], খণ্ড ১/৪০০]
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তাকে নারীদের নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নারীরা বৈঠকে আংগুলসমূহ মিলিয়ে ও সমবেতভাবে বসবে। [এই হাদিসের সমস্ত রাবী সিকাহ- সুতারাং হাদিস সহীহ, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-খণ্ড ১/২৪২]
৩. তাবেয়ী ইমামগণের ঐক্যমতের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
হজরত হাসান বসরী ও হজরত কাতাদা রহ. বলেন, নারীরা যখন সিজদা করবে তখন তারা যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সিজদা দেবে না, যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে। [ হাদিসটি সহীহ, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, খণ্ড ৩/১৩৭-ইবনে আবী শাইবা ১/৪২]
কুফাবসীদের ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন, নারীরা বসা অবস্থায় এক পক্ষ হয়ে বসবে । [সহীহ, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, খণ্ড ১/৪৩]
মক্কা বাসীদের ইমাম আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. বর্ণনা করেন, নারী যখন রুকুতে যাবে অত্যন্ত সংকুচিতভাবে যাবে এবং হাতদ্বয় পেটের সাথে মিলিয়ে রাখবে। [সহীহ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৩/১৩৭]
খালেদ ইবনে লাজলাজ সিরিয়া বাসীদের ইমাম , তিনি বলেন নারীদের আদেশ করা হতো, তারা যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মতো না বসে । আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় নারীদেরকে এমনটি করতে হয়। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/৫০৫]
মোট কথা তাবেয়ীদের যুগে যারা ইমাম এবং ইসলামি বিধি বিধানের ক্ষেত্রে অনুসরনীয় তাদের মতামত থেকে প্রমানিত হয় যে, নারী ও পুরুষের নামাযের পদ্ধতি অভিন্ন মনে করা সম্পুর্ন ভুল । সাহাবি ও তাবেয়ীদের মতামতের সাথে এই ধারনার কোনই মিল নেই।
৪. ইমামদের ফিকহের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
ফিকহে হানাফি : ইমাম আবু হানিফা রহ. -এর অন্যতম শাগরেদ ইমাম মুহাম্মদ রহ. বলেন, আমাদের নিকট নারীদের নামাজে বসার পছন্দনীয় পদ্ধতি হলো, উভয় পা এক পাশে মিলিয়ে রাখবে, পুরুষের মতো এক পা দাঁড় করিয়ে রখবে না। [কিতাবুরল আসার ১/৬০৯, আরো দ্রষ্টব্য- হিদায়াঃ ১/১০০-১১০-১১১- ফাতওয়ায়ে শামী ১/৫০৪- ফাতওয়ায়ে আলমগীরি-১/৭৩]
ফিকহে শাফেয়ি : ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, আল্লাহ পাক নারীদেরকে পুরোপুরি পর্দায় থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। এবং রাসুলও সা. অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হলো, সিজদা অবস্থায় নারীরা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সিজদা এমনভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাজত হয়। [যাখীরা, ইমাম কারাফী ২/১৯৩]
ফিকহে হাম্বলি : তাকবিরে নারীদের হাত ওঠানো সম্পর্কে ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, হাত তুলনামূলক কম ওঠাবে। [আল মুগনী -২/১৩৯]
এ পর্যন্ত হাদিস, আসারে সাহাবা, আসারে তাবেয়ীন ও ইমামদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতির অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন।।
মৌলিকভাবে নারী ও পুরুষের নামাজের মাঝে পাঁচটি ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে-
১. তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত ওঠানো। ২. হাত বাঁধার স্থান। ৩. রুকুতে সামান্য ঝোঁকা। ৪. সিজদা জড়সড় হয়ে করা। ৫. বৈঠকে পার্থক্য।
১. হাদিসের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
নামাজি নারীর সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তিকে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে করণীয় কি?
রাসুল সা. এ প্রসঙ্গে বলেন, পুরুষদের জন্য হলো তাসবিহ বলা আর নারীদের জন্য হাতে আওয়াজ করা। [সহীহ বুখারী ১/৪০৩]
ইয়াজিদ ইবনে আবি হাবীব রা. বলেন, একবার রাসুল সা. নামাজরত দুই নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন, যখন সিজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে দিবে, কেননা নারীরা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। [কিতাবুল মারাসিল-ইমাম আবু দাউদ : পৃঃ১১৭] হাদিসটি “সহীহ”। [তালীক আলা মারাসিলে আবী দাউদ পৃঃ ১১৭]
উল্লেখ্য, এইসব হাদিসের সমর্থনে নারী ও পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতিগত পার্থক্য ও ভিন্নতাকে নির্দেশ করে । এমন আরো অনেক হাদিস রয়েছে। পক্ষান্তরে এগুলোর সাথে বিরোধ পুর্ন একটি হাদিসও কোথাও পাওয়া যাবে না, যাতে বলা রয়েছে যে, পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য নেই।
২. সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্যের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
হজরত নাফেয় রহ. ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন, তাকে রাসুল সা. -এর সময়ে নারীদের নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, প্রথমত তারা চার পা হয়ে বসত অতপর এক পক্ষ হয়ে বসার জন্য বলা হলো। আসারটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহীহ। [জামেউল মাসানীদ-ইমাম আবু হানীফা [রহ.], খণ্ড ১/৪০০]
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তাকে নারীদের নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নারীরা বৈঠকে আংগুলসমূহ মিলিয়ে ও সমবেতভাবে বসবে। [এই হাদিসের সমস্ত রাবী সিকাহ- সুতারাং হাদিস সহীহ, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-খণ্ড ১/২৪২]
৩. তাবেয়ী ইমামগণের ঐক্যমতের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
হজরত হাসান বসরী ও হজরত কাতাদা রহ. বলেন, নারীরা যখন সিজদা করবে তখন তারা যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সিজদা দেবে না, যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে। [ হাদিসটি সহীহ, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, খণ্ড ৩/১৩৭-ইবনে আবী শাইবা ১/৪২]
কুফাবসীদের ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন, নারীরা বসা অবস্থায় এক পক্ষ হয়ে বসবে । [সহীহ, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, খণ্ড ১/৪৩]
মক্কা বাসীদের ইমাম আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. বর্ণনা করেন, নারী যখন রুকুতে যাবে অত্যন্ত সংকুচিতভাবে যাবে এবং হাতদ্বয় পেটের সাথে মিলিয়ে রাখবে। [সহীহ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৩/১৩৭]
খালেদ ইবনে লাজলাজ সিরিয়া বাসীদের ইমাম , তিনি বলেন নারীদের আদেশ করা হতো, তারা যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মতো না বসে । আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় নারীদেরকে এমনটি করতে হয়। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/৫০৫]
মোট কথা তাবেয়ীদের যুগে যারা ইমাম এবং ইসলামি বিধি বিধানের ক্ষেত্রে অনুসরনীয় তাদের মতামত থেকে প্রমানিত হয় যে, নারী ও পুরুষের নামাযের পদ্ধতি অভিন্ন মনে করা সম্পুর্ন ভুল । সাহাবি ও তাবেয়ীদের মতামতের সাথে এই ধারনার কোনই মিল নেই।
৪. ইমামদের ফিকহের আলোকে নারী ও পুরুষের নামাজের পার্থক্য :
ফিকহে হানাফি : ইমাম আবু হানিফা রহ. -এর অন্যতম শাগরেদ ইমাম মুহাম্মদ রহ. বলেন, আমাদের নিকট নারীদের নামাজে বসার পছন্দনীয় পদ্ধতি হলো, উভয় পা এক পাশে মিলিয়ে রাখবে, পুরুষের মতো এক পা দাঁড় করিয়ে রখবে না। [কিতাবুরল আসার ১/৬০৯, আরো দ্রষ্টব্য- হিদায়াঃ ১/১০০-১১০-১১১- ফাতওয়ায়ে শামী ১/৫০৪- ফাতওয়ায়ে আলমগীরি-১/৭৩]
ফিকহে শাফেয়ি : ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, আল্লাহ পাক নারীদেরকে পুরোপুরি পর্দায় থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। এবং রাসুলও সা. অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হলো, সিজদা অবস্থায় নারীরা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সিজদা এমনভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাজত হয়। [যাখীরা, ইমাম কারাফী ২/১৯৩]
ফিকহে হাম্বলি : তাকবিরে নারীদের হাত ওঠানো সম্পর্কে ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, হাত তুলনামূলক কম ওঠাবে। [আল মুগনী -২/১৩৯]
এ পর্যন্ত হাদিস, আসারে সাহাবা, আসারে তাবেয়ীন ও ইমামদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতির অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন।।
মৌলিকভাবে নারী ও পুরুষের নামাজের মাঝে পাঁচটি ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে-
১. তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত ওঠানো। ২. হাত বাঁধার স্থান। ৩. রুকুতে সামান্য ঝোঁকা। ৪. সিজদা জড়সড় হয়ে করা। ৫. বৈঠকে পার্থক্য।
প্রথম পার্থক্য : তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত ওঠানো ।
এক. ‘ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজি সা.-এর নিকট এলাম, তিনি আমাকে বললেন, হে ওয়ায়েল ইবনে হুজর! যখন তুমি নামাজ পড়বে তখন তুমি তোমার হাত কান পর্যন্ত ওঠাবে আর নারীরা তাদের হাত বুকের ওপর বাঁধবে।
হাইসামি রহ. বলেন, ‘এই হাদিসের সমস্ত রাবী নির্ভরযোগ্য, উম্মে ইয়াহইয়া ব্যতীত। কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের নিকট উম্মে ইয়াহইয়াও প্রসিদ্ধ।
দুই. ইমাম যুহরী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নারীরা কাঁধ পর্যন্ত হাত ওঠাবে। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/২৭০]
দ্বিতীয় পার্থক্য: হাত বাঁধা ।
ইমাম তহাবী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নারীরা তাদের উভয় হাতকে বুকের ওপর রেখে দেবে, আর এটাই তাদের জন্য যথোপযুক্ত সতর। (আসসিআয়া : ২/১৫৬, ফাতাওয়ায়ে শামী : ১/৫০৪, আল মাবসুত সারাখসী : ১/২৫)
তৃতীয় পার্থক্য: রুকুতে কম ঝোঁকা।
যখন নারী রুকুতে যাবে তখন হাতদ্বয় পেটের দিকে উঠিয়ে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে, আর যখন সিজদা করবে তখন হাতদ্বয় শরীরের সাথে এবং পেট ও সিনাকে রানের সাথে মিলিয়ে দেবে এবং যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে।
চতুর্থ পার্থক্য: সিজদা জড়সড় হয়ে করা ।
বিখ্যাত তাবেঈ ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব বলেন, একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজরত দুই নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন, যখন সিজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিশিয়ে দেবে। কেননা নারীরা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। [কিতাবুল মারাসীল ইমাম আবু দাউদ হা. নং ৮০]
আবু দাউদ রহ.-এর উক্ত হাদিস সম্পর্কে গায়েবে মুকাল্লিদদের বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ‘আউনুল বারী’ ১/৫২০-এ লিখেছেন, এই মুরসাল হাদিসটি সকল ইমামের উসুল ও মূলনীতি অনুযায়ী দলিল হওয়ার যোগ্য।
হজরত মুজাহিদ ইবনে জাবর রহ. পুরুষদের জন্য নারীদের মতো ঊরুর সাথে পেট লাগিয়ে সিজদা করাকে অপছন্দ করতেন। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০৩]
হজরত হাসান বসরী ও কাতাদাহ রহ. বলেন, নারী যখন সিজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সিজদা করবে না, যাতে কোমর উঁচু হয়ে থাকে। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০৩]
পঞ্চম পার্থক্য: বৈঠকের ক্ষেত্রে নারীগণ উভয় পা বাঁ পাশ দিয়ে বের করে দিয়ে বসা।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সা. বলেছেন, নারী যখন নামাজের মধ্যে বসবে তখন যেন এক ঊরু (ডান ঊরু) আরেক ঊরুর ওপর রাখে, আর যখন সিজদা করবে তখন যেন পেট ঊরুর সাথে মিলিয়ে রাখে, যা তার সতরের জন্য অধিক উপযুক্ত হয়। [সুনানে কুবরা বাইহাকী : ২/২২৩]
হজরত খালেদ ইবনে লাজলাজ রহ. বলেন, নারীদেরকে আদেশ করা হতো তারা যেন নামাজে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের ওপর বসে, পুরুষদের মতো না বসে, আবরণীয় কোনো কিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নারীদেরকে এমনটি করতে হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০৩)
ইবনে আব্বাস রা.-কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, নারীরা কিভাবে নামাজ আদায় করবে? তিনি বললেন, খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামাজ আদায় করবে। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০২]
উপর্যুক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা একটু মনোযোগের সাথে পাঠ করলে একজন ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের পাঠক সহজে অনুমান করতে সক্ষম হবেন যে, নারীদের নামাজের পার্থক্যের বিষয়টি নবীজি সা. এবং সাহাবীদের যুগ থেকেই চলে আসছে এবং -এর পক্ষে অনেক শক্তিশালী দলিল রয়েছে।
সুতরাং নামাযের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মহিলারা পুরুষদের থেকে আলাদা এটাই দলীল দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সত্যকে সত্য হিসেবে মেনে নেবার তৌফিক দান করুন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ