expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Wikipedia

সার্চ ফলাফল

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

ইসলামে সূফীবাদ নামক কুফুরী ভ্রান্তি

 ইসলামে সূফিবাদ নামক কুফুরী  ভ্রান্তি

সূফীবাদ একটি কুফুরী মতবাদ



কম বেশী সকল মুসলমান সুফিবাদ শব্দটি সথে পরিচিত। সুফিবাদ বা সুফি দর্শন যাকে আরবিতে বলা হয় সুফিয়াত বা তাসাউফ, আসলে এটি একটি মনগড়া আধ্যাত্মিক দর্শন। প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা বৈরাগ্যবাদের সাথে ইসলামের কিছু লেবাস লাগিয়ে সুফিবাদ বা সুফি দর্শন ইসলামের অংশ হিসাবে চালান হচ্ছে।

সূফীবাদ মূলত, ইরানী দর্শনবেদান্ত দর্শনগ্রীক দর্শনজরথ্রোষ্ট দর্শন, হিন্দু দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন ইত্যাদির সংমিশ্রন থেকে ইসলামে অনুপ্রবেশ করেছে।

 দর্শনগুলোর সাথে ইসলামের আধ্যাত্মিকতার বিষয়গুলি মিলিয়ে তৈরি করা হয় সুফিবাদ।

 সূফীবাদ কুরআন  সুন্নাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করে নাই, শুধু মাত্র উপর কুরআন  সুন্নাহর লেবাস লাগান হয়েছে মাত্র। তাই তো আলোচনায় দেখবেন সুফিবাদতো দুরের কথা সুফি শব্দটিও কুরআন  সুন্নাহর কোথাও উল্লেখ নাই

দুনিয়া ত্যাগের প্রেরণা থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর দিকে মা‘রেফাতের নামে ছূফীবাদের সূচনা হয় প্রবল আল্লাহভীতি ও দুনিয়াত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনই হল প্রাথমিক সুফিবাদের মুল ভিত্তি। তারা ইবাদতে খুবই বাড়াবাড়ি করে। 


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবায়ে কেরামের ও তাবেঈন যুগে যে সকল কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক আমল ছিল তা ছূফীদের নিকট পর্যাপ্ত মনে হয়নি, তাই তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন এই তিনটি স্বর্ণযুগের আমলের চেয়েও শরীরকে অধিত কষ্ট দিয়ে, অধিক আমল করতে থাকে। 

তারা ইহাকে অতি পরহেযগারীর নামে প্রকাশ করতে শুরু করে এবং তাবেঈগণ এসবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে তারা মুলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে ইসলামের মৌলিক আক্বীদা ও আমলে বিচ্যুত ঘটে। কুরআন সুন্নাহর আমলকে পর্যাপ্ত মনে না করে তারা ইসলাম বহির্ভুত আমলে প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বৈরাগ্যতা অর্জনের জন্য তৎকালীন রোমান ও পার্শিকদের রেখে যাওয়া ধর্ম বিশ্বাস কে পুঁজি করে নতুন আমল শুরু করে এবং পরবর্তীতে গ্রীসদের যুক্তিবিদ্যা, হিন্দু সন্ন্যাসীবাদ, খ্রিষ্টানদের বৈরাগ্যবাদ, বৌদ্ধ ধ্যানের সংমিশ্রনে তৈরি হয় সুফিবাদ।

সুফিবাদ শব্দটি কোন ইসলামিক গ্রন্থ বা কোন সুফিদের কাছ থেকে আসেনি। কারো কারো মতে শব্দটি এসেছে প্রাচ্যের ভাষা বিষয়ক বিট্রিশ গবেষকদরে থেকে। সাধারনত সুফিদের আধ্যাত্বিক সাধনাকে কেন্দ্র করে যে সকল আমল এবং আকিদার জম্ম হয়েছে তাকে সুফিবাদ বলে আবার সুফিদের আধ্যাত্বিক সাধনাকে প্রকাশ করার জন্য তাসাউফ শব্দটিও ব্যবহার করে থাকি। তাসাউফ বা আধ্যাত্বিকতা ইসলামেরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সুফিদের বিকৃত উপস্থনা ইহার আমল ও বিশ্বাস কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।


সূফী শব্দের অর্থঃ

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কেউ বলেন, ‘সূফী’ শব্দটি আহলে সুফ্ফাহ’-এর সাথে জড়িত। এটা ভুল। কারণ তাই যদি হতো তাহলে সুফ্ফী’ বলা হতো। কেউ বলেনএটা আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো প্রথম সফ বা কাতারএর      সাথে সম্পর্কিত। এটাও বিশ্বাস ভুল। কারণ তাই যদি হতো সফ্ফী’ বলা হতো। কারো মতে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে ছাটাইকৃত সাফ্ফাহ’-এর সাথে এই শব্দটি জড়িত । এটাও ভুল। কারণ যদি তাই হতো তাহলে সাফভী’ বলা হতো। কেউ বলেনএটা আরবের এক গোত্র সূফাহ ইবনু বিশ্র ইবনু উদ্দ ইবনে তাবিখাত’-এর সাথে সম্পৃক্ত। এরা প্রাচীন যুগ থেকে মাক্কার আশেপাশে থাকতেন। অধিক ইবাদাতকারীগণ এদেরই সাথে সম্পর্কিত হতেন। শব্দের সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে এই সম্পর্কটা ঠিক মনে হলেও এটা দুর্বল অভিমত। কারণ ঐ গোত্রটি অধিক ইবাদাতকারীদের অধিকাংশের নিকট অখ্যাত ও অপ্রসিদ্ধ। কারণ ইবাদাতকারীগণ যদি তদের সাথে সম্পর্কিত হতেন তাহলে এই সম্পর্কটা সহাবী ও তাবিয়ী এবং তাবি-তাবিয়ীদের যুগে উত্তম হতো। তদুপরি ঐ গোত্রের কেউই সূফী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। আর কেউ ঐ কাফিরী যুগের গোত্রের সাথে সম্পর্কিত হতে রাযীও হবে না।  (ইবনু তাইমিয়াহ মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ১১ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৫)।

 

মোল্লা জামী বলেনশব্দটি صفاء (পবিত্রতা ও স্বচ্ছতাথেকে নির্গত হয়েছে। কেননা তারা পূতপবিত্র ও স্বচ্ছ জীবন যাপন করতেন। সুফীর সংজ্ঞায় বর্ণিত এই কথাটি ঠিক নয়। কারণ সুফীরা নিজেদের কে صوفي বলে উল্লেখ করেন।  صفاء শব্দ থেকে সুফীর উৎপত্তি হয়ে থাকলে তারা নিজেদেরকে صفائي সাফায়ী বলতেন। অথচ এই মতবাদে বিশ্বাসী কোন লোক নিজেকে সাফায়ী বলেন না, বরং সুফী বলেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারিসুফী হচ্ছেন ঐ ব্যক্তিযিনি পশমী ও মোটা কাপড় পরিধান করেন এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস পরিহার করে সরল সোজা ও সাদামাটা জীবন যাপন করেন।আবার কেউ কেউ মনে করেন, 'সূফীশব্দটি সাফ (পবিত্রতাঅথবা সূফ (পশমঅথবা সূফফা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাসাউফ পন্থীদেরকে সূফী বলা হয়। এরা আধ্যাত্মিকতাবাদীও বটে। এদের গুরুকে পীর নামে অভিহিত করা হয়। (সূফী তত্বের অন্তরালেঅধ্যাপক আব্দু নূর সালাফী  পৃষ্ঠা)


শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ আরও বলেন, আল সুফিয়াহ বা সুফিবাদ শব্দটি দ্বারা ওলেন তৈরি পোশাক পরিধান করাকে নির্দেশ করে, আর এটাই সঠিক অর্থ।  (ইবনু তাইমিয়াহ মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ১১/১৬৮)।


পারিভাষিক অর্থঃ  

অধুনিক কালের সুফিগন বলেনঃ সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হল নিজ নফসের সঙ্গে আপন প্রানের, জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার যে মিল আছে তা থেকে মুক্তি লাভ করা। তাদের মতে আল্লাহ যে শয়তানটিকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছের তার সাথে জিহাদ করে এ জড় জগত থেকে মুক্তি পাওয়াই মুল লক্ষ। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হল এই দর্শনের মর্মকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহকে জানার এবং আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান  জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়। হযরত ইমাম গাজ্জালি (রহঃ) এর মতে, আল্লাহর ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ বলে। 

তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ বা আল্লায় বিলীন হয়ে যাওয়া। এর পরের স্তর হল বাকাবিল্লাহ বা আল্লার সঙ্গে স্থায়ীভাবে অবস্থান করা। সুফিদের বিশ্বাস আল্লাহ নিরাকার (বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহ আকার আছে কিন্তু ধরণ জানিনা), তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম।

 তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে “তরিকত” বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। আর এই মুর্শিদের অনুগত্যের মাধ্যমে তার একনিষ্ট অনুসরন কে বলা হয় ফানাফিস শাইখ। ফানাফিস শাইখ এর মাধ্যমে প্রথম স্তর অর্জিত হয় এবং এর পরই আসে ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহ। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। 


সুফিগণের মতে, মুহম্মাদ (সাঃ) স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। এর সপক্ষে সুফিগণ রাসুল (সাঃ) একটি হাদিস উল্লেখ করেন যা হল, মানব দেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে যা সুস্থ থাকল সমগ্র দেহ সুস্থ থাকবেআর যা অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অসুস্থ থাকবে। আর তা হল অস্তকরণ বা কলব। জেনে রেখ এই কলব আল্লাহ স্মরনে কলুষমুক্ত হয় সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যারা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন তাদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।

 (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

সুফিবাদ বা বৈরাগ্যবাদ যাকে মহান আল্লাহ আল কুরআনে “রুহবানিয়াত” বলে উল্লেখ করছেন। মহান আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেন,

 ثُمَّ قَفَّيۡنَا عَلَىٰٓ ءَاثَـٰرِهِم بِرُسُلِنَا وَقَفَّيۡنَا بِعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَ وَءَاتَيۡنَـٰهُ ٱلۡإِنجِيلَ وَجَعَلۡنَا فِى قُلُوبِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ رَأۡفَةً۬ وَرَحۡمَةً۬ وَرَهۡبَانِيَّةً ٱبۡتَدَعُوهَا مَا كَتَبۡنَـٰهَا عَلَيۡهِمۡ إِلَّا ٱبۡتِغَآءَ رِضۡوَٲنِ ٱللَّهِ فَمَا رَعَوۡهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا‌ۖ فَـَٔاتَيۡنَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنۡہُمۡ أَجۡرَهُمۡ‌ۖ وَكَثِيرٌ۬ مِّنۡہُمۡ فَـٰسِقُونَ (٢٧

অর্থঃ তাদের পর আমি একের পর এক আমার রসূলগণকে পাঠিয়েছি৷ তাদের সবার শেষে মারয়ামের পুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছিতাকে ইনজীল দিয়েছি বং তার অনুসারীদের মনে দয়া  করুণার সৃষ্টি করেছি৷ আর বৈরাগ্যবা তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে৷ আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেইনি৷ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তারা নিজেরাই  বিদয়াত বানিয়ে নিয়েছে৷  তারপর সেটি যেভাবে মেনে চলা দরকারসেভাবে মেনেও চলেনি  তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিলতাদের প্রতিদান আমি দিয়েছি৷ তবে তাদের অধিকাংশই পাপী৷  (সুরা হাদিদ ৬৭:২৭)

 

উক্ত আ্য়াতে মহান আল্লাহ রুহবানিয়াত' বা বৈরাগ্যবাদ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন খ্রিষ্টানগন (ঈসা আলাইহিস সালাম এর অনুসারী) নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় উদ্ভাবন করে নিয়েছে রুহবানিয়াত' বা বৈরাগ্যবাদ কারো জুলুম নির্যাতনের ভয়ে, দুনিয়ার ফিতনার ভয়ে, নিজের প্রবৃত্তির দুর্বলতার ভয়ে বা অন্য কোন ভয়ের কারণে দুনিয়াত্যাগী হয়ে যাওয়া এবং দুনিয়ার জীবন থেকে পালিয়ে বন-জংগলে বা পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া কিংবা নির্জন নিভৃতে কোন স্থানে বসে থাকা হল রুহবানিয়াত' বা বৈরাগ্যবাদ

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে তাফহিমুল কুরআনে লিখেন, আল্লাহ বলেন, আমি তাদের জন্য রাহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদ ফরয করেছিলাম না। বরং আমি তাদের ওপর যা ফরয করেছিলাম তা ছিলো এই যেতারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে। আর অপর অর্থটি হচ্ছেএ বৈরাগ্যবাদ আমার ফরযকৃত ছিল না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে তারা তা নিজেরাই নিজেদের ওপর ফরয করে নিয়েছিলো। দুটি অবস্থাতেই এ আয়াতটি একথা স্পষ্ট করে তুলে ধরছে যেবৈরাগ্যবাদ একটি অনৈসলামিক রীতি। এটি কখনো দীনে ইসলামের অংগীভূত ছিল না।

 তাই বলা যায় ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের আগেই এ পৃথিবীতে সুফিবাদ ছিল। আর আস্তে আস্তে ইসলামের ভিতর ঢুকে পড়েছে। এই মতবাদ প্রথমে পারস্য এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় সভ্যতার অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল এই দুই অঞ্চলের সুফিবাদে বিভিন্ন আকিদা আমল ইসলামের নামে সফিবাদে ঠুকে পরে। যার ফলে সুফিরা ইসলামী বিশ্বাস থেকে বহু দুরে সরে এসেছে। তাই সুফিবাদের বিরুদ্ধে ইসলাম মুজতাহিদ আলেম ওলেমাগন সংস্কার অন্দোলন গড়ে তোলে। আলেম ওলামাদের এ  সংস্কার অন্দোলন আরবের অধিকাংশ দেশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও সিরিয়া ও ইরানে (পারশ্যে) প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। আর উপমহাদেশে রাজনৈতিক কারনে সুফিদের প্রধান্য বেশী থেকে যায় যা আজও বিদ্যমান। তাই বলা যায় আমাদের দেশে সুফিবাদের অগ্রগতি  বিস্তার রো করা সম্ভব হয়নি। তবে সুফিবাদ নিয়ে বির্তকও কম নেই এসব সত্ত্বেও বাংলার জনসমাজে প্রায় হাজার বছর ধরে মতবাদটি দারুন জনপ্রিয়  গ্রহণীয় গ্রামে গজ্ঞে আজও এ  মতবাদে বিশ্বাসিদের মিথ্যা এবং ইসলাম বিরোধী কল্পকাহিনীর মাধ্যমে সাধারন অজ্ঞ লোকদের বিমোহিদ করে ধোকা দিচ্ছে। আজও বাঙালি মুসলমানদের মনের গভীরে সুফি-দরবেশদের চিন্তাধারার প্রভাব বিস্তার করে আছে। ইতিহাস গবেষনা করে জানা যায় এই সুফিবাদী দর্শন তিনটি উত্স থেকে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে।

 

। দক্ষিন এশীয় হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখদের থেকে

। খ্রিষ্টানদের নিকট থেকে

। মধ্যপ্রাচ্য থেকে।


। দক্ষিন এশীয় হিন্দু বৌদ্ধ এবং শিখদের থেকেঃ দক্ষিণ এশীয় হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখদের নিকট থেকে এসেছে প্রাচ্য দর্শনভিত্তিক সুফিবাদ। এই অঞ্চলের সুফিগণ মারেফাত হাছিল করার জন্য দেহকে চরমভাবে কষ্ট দিয়ে স্বীয় ক্বলবকে তাদের ধারণা মতে জ্যোতির্ময় করার চেষ্টা করে থাকে। প্রায় প্রায় সকল সুফিই এরূপ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন।  সাধারনত হিন্দু ও বৌদ্ধ সন্নাসীগন ধ্যানের মাধ্যমে সুদ্ধি লাভের আশা করে। তারা বছরের পর বছর বনে জঞ্চলে নির্জনে বসে ধ্যান করে যা আজও তাদের মধ্যে বিদ্ব্যমান আছে। হিন্দুধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম তথা একটি দেশীয় ধর্মবিশ্বাস হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ স্বীয় ধর্মমতকে সনাতন ধর্ নামেও অভিহিত করেনহিন্দুধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম বে হিন্দু নামটি আধুনিকালের দেওয়া এর প্রাচীন নাম হল সনাতন ধর্ম আবার এই ধর্ম বৈদিক ধর্ম নামেও পরিচিত বৈদিক ধর্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে ৫০০ অব্দ মাঝে সৃষ্টি হয়। লৌহযুগীয় ভারতের ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্মে এই ধর্মের শিকড় নিবদ্ধ এই ধর্ম বেদ এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল মানুষ দেবতার কাছ থেকে অধিক সন্তান, বৃষ্টিপাত, গবাদি পশু, দীর্ঘায়ু ও মৃত্যুর পর স্বর্গ কামনা করত। আধুনিক হিন্দুধর্মেও পুরোহিতরা বৈদিক স্তোত্র পাঠ করে উন্নতি, ধনসম্পত্তি ও সর্বসাধারণের কল্যাণ প্রার্থনা করেন। তবে বৈদিক দেবদেবীদের গুরুত্ব কমে পৌরণিক দেবদেবীদের গুরুত্ব আধুনিক হিন্দুধর্মে বেড়ে গিয়েছে। এ ধর্মত্ত্বের মূল কথা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বেই সকল কিছুর অস্তিত্ব এবং সকল কিছুর মূলেই স্বয়ং ঈশ্বর হিন্দুধর্ম একাধিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত এই ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই হিন্দুধর্মকে বিশ্বের “প্রাচীনতম জীবিত ধর্মবিশ্বাস” তবাদ আখ্যা দেওয়া হয় অনেকের মতে হিন্দু শব্দটি আর্যদেরকে আফগানিস্তানের বাসিন্দা বা আফগানেরা দিয়েছে তারা সিন্দু নদের তীরবর্তী সনাতন ধর্মের সাধু সন্ন্যাসিদেরকে হিন্দু বলতআর এই ভাবেই হিন্দু নামটি এসেছে এই ধর্মের উপসনার পদ্দতি বলে দিবে তাদের ধর্মের মুল হল সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসবাদ যাকে ইসলামে সুফিবাদ বলে। ইসলামে উপমহাদেশে এসে এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সুফিবাদের বহু আকিদা গ্রহন করেছে। হিন্দুদের নিজেস্ব কোন ধর্ম বিশ্বাস না থাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সন্নাসী নামে তাদের ধর্মমত পাল্টিয়ে তাদের নামে এই প্রাচিন ধর্ম প্রবর্তিত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধান তিনটি ধর্মমতের এখনও ব্যাপক হারে উপমহাদেশে প্রচলিত।  

যেমনঃ

১। শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য দ্বারা বৈষ্ণব ধর্ম,

২। মহা বীরে দ্বারা জৈন ধর্ম এবং

৩। গুরু নানক দ্বারা শিখ ধর্ম

এই সকল ধর্ম এখনও প্রচলিত আছে। তাদের সম্পর্কে একটু ধারনা দিলেই বুঝতে পারবেন। এদের সকলের মুলনীতি ছিল দুনিয়া ত্যাগ করে সন্নাসীভাবে জীবন যাপন করা। তাদের প্রতিটির ধর্মের মুলে ছিল বৈরাগ্যবাদ যা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। আসুন তা হলে হিন্দুদের থেকে উৎপন্ন এই তিনটি ও বৌদ্ধ ধর্মমত সম্পর্কে একটু ধারনা নেই। তা হলে বুঝে আসবে সুফিবাদ কিভাবে ভারতে এসে ইসলামি স্বকীয়তা হারিয়ে সন্নাসবাদ বা বৈরাগ্যবাদে পরিনত হল।


জৈন ধর্মমতঃ উপমহাদেশের হিন্দুরে একটা বিরাট অংশ জৈন ধর্মের অনুসারী। এই জৈন ধর্মের মুল বিষয় বস্তু তাদের সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের আচারণবিধি কেমন হবে, তা তাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ থেকে সংস্কৃত আকারে বা সরাসরি গৃহীত হয়েছে। আপনি  যদি তাদের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থগুলি নিয়ে গবেষনা করেন তবে দেখবেন। সন্ন্যাসীদের সম্পূর্ণ নির্জনবাসের বিধান দেওয়া হয়েছে। সেখানে আত্মা ও অনাত্মার বিচ্ছেদকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সন্ন্যাসীরা ধ্যান, আত্ম-জ্ঞান অনুসন্ধান ও আত্ম-শৃঙ্খলা অর্জনের মতো কাজে নিযুক্ত থাকেন। প্রাচীন কাল থেকে জৈন অনুসারীগন দুটি ভাগে বিবক্ত ইতিহাসবিদগণ মনে করেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ অব্দের পূর্বে (মহাবীরের মোক্ষ লাভের ১৬০ বছর পর) একটি ঐক্যবদ্ধ জৈন সংঘ (সম্প্রদায়) বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে সেই সংঘ দুটি পৃথক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যথাঃ

১। দিগম্বর।

। শ্বেতাম্বর

দিগম্বরঃ দিগম্বর সম্প্রদায় যাদের ভট্রারক সন্ন্যাসী বলা হয়। এই দিগম্বর সন্ন্যাসীরা একেবারেই পোষাক পরিধান করেননা। আর্যিকারা পাড়বিহীন সাদা সাধারণ শাড়ি পরেন। সকল দিগম্বর সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা তিনটি প্রথাগত দ্রব্য বহন করেন। এগুলি হলঃ একটি ‘মোর-পিচ্ছি’ (ময়ূরপুচ্ছ), একটি কমনগুলু (জলপাত্র) ও শাস্ত্র। তারা  পরিব্রাজকতা করেন না। তাঁরা সাধারণত মন্দিরে বাস করেন এবং দৈনিক ক্রিয়াকাণ্ড অনুষ্ঠান করেন।

জৈন ধর্মের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব দিগম্বর সন্ন্যাসী মহাবীরের জীবনের ঘটনা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে এভাবে বিবৃত হয়েছেঃ সম্মানীয় সন্ন্যাসী মহাবীর এক বছর এক মাস বস্ত্র পরিধান করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি নগ্নই থাকতেন এবং খালি হাতে ভিক্ষা গ্রহণ করতেন। বারো বছরেরও বেশি সময় সম্মানীয় সন্ন্যাসী মহাবীর নিজের শরীরকে উপেক্ষা করেন। তিনি শরীরের যত্ন নিতেন না। তিনি শান্ত ও নির্লিপ্তভাবে দিব্য শক্তিমানুষ ও পশুপ্রাণীদের থেকে উদ্ভুত সকল সুখকর ও কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান এবং তা সহ্য করেন। এরপর থেকে সম্মানীয় সন্ন্যাসী মহাবীর ছিলেন গৃহহীন। তিনি হাঁটাচলায়কথা বলায়ভিক্ষা করায়, (কোনও কিছুগ্রহণ করায়তাঁর বহিরাবরণ ও পানপাত্র বহনেমলমূত্রনিষ্ঠীবনশ্লেষ্মা ও শরীরের বর্জ্য পদার্থ ত্যাগেচিন্তায়বাক্যে ও কাজকর্মে সাবধানী থাকতেন। তিনি নিজের চিন্তাবাক্যকাজকর্মইন্দ্রিয় ও পবিত্রতা রক্ষা করতেন। ক্রোধগর্বঅহংকার ও লোভ পরিত্যাগ করেন। শান্তনির্লিপ্তআত্ম-সমাহিত, মুক্তপ্রলোভন-মুক্তঅহংবোধহীনসম্পদহীন অবস্থায় তিনি সকল জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করেন এবং কোনও জাগতিকতা দ্বারা স্পর্শিত হননি। জল যেমন তাম্রপাত্রে নির্লিপ্ত থাকে বা কাজল যেমন মুক্তামাতৃকাকে স্পর্শ করে না (তেমন পাপ্ত তাঁর চরিত্রে স্থান পায়নি)। তাঁর পথ ছিল তাঁর জীবনের মতো অবারিত। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি কোনও অবলম্বন চাইতেন না। বায়ুর মতো তিনি বাধা কাকে বলে জানতেন না। তাঁর হৃদয় ছিল শরতের (নদী বা পুষ্করিণীরজলের ন্যায় পবিত্র। পদ্মপত্রের মতো তাঁকেও কোনও কিছু অপবিত্র করতে পারত না। তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ছিল কচ্ছপের ইন্দ্রিয়গুলির মতো সুরক্ষিত। গণ্ডারের শৃঙ্গের ন্যায় তিনি ছিলেন একক ও একাকী। তিনি ছিলেন পাখির মতো মুক্ত। সুন্দর পাখি ভারুন্দলের মতো তিনি হেঁটে চলতেন। তিনি ছিলেন হাতির মতো সাহসীষাঁড়ের মতো শক্তিশালীসিংহের মতো অপ্রতিরোধ্যমন্দার পর্বতের মতো দৃঢ়মহাসমুদ্রের মতো গভীরচাঁদের মতো স্নিগ্ধসূর্যের মতো দীপ্তিমান এবং নিখাদ সোনার মতো খাঁটি। পৃথিবীর মতো তিনি সবকিছু শান্তভাবে সহ্য করতেন। প্রজ্বালিত অগ্নির ন্যায় তিনি নিজ সৌন্দর্যে দীপ্ত হতেন।(সূত্র: উইকিপিডিয়া)


শ্বেতাম্বরঃ  

মহাবীরের মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকেই জৈন সন্ন্যাসীরা গোষ্ঠীতে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। জৈন সন্ন্যাসীরা সামাজিক ও সাংসারিক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা শুধু আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধির সহায়ক কাজগুলিই সম্পাদনা করেন। তাঁর দৈনিক পূজা ও তপস্যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশিকা অনুসরণ করে চলেন। শ্বেতাম্বর সন্ন্যাসীদের বাড়ি বা সম্পত্তি থাকে না। তাঁরা তপস্যা করেন এবং পার্থির কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন কিন্তু তারা দিগম্বর থাকেন না। সমাজে বসবাস করেও যারা নির্জন বাস করে এবং নগ্নাতা অবলম্ভন করা না তাদের শ্বেতাম্বর বলা হয়। এদের সাধনা পদ্দতি দিগম্বর সন্ন্যাসীদের মত পার্থক্য শুধু পোশাক পরিধানে। শ্বেতাম্বর সন্ন্যাসীরা সূর্যোদয়ের আগে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোর ৫টায়) ঘুম থেকে ওঠেন। তবে কেউ কেউ গভির রাতেও ওঠেন। তাঁরা ‘উৎসর্গ-সমিতি’ অনুষ্ঠান করেন। অর্থাৎ, এমন স্থানে মলত্যাগ করেন, যেখান মলত্যাগ করলে কোনও জীব আহত হবে না। এছাড়া তাঁরা একটি খালি পাত্রে মুত্রত্যাগ করেন এবং শুকনো মাটির গর্তে সেই পাত্রটি খালি করেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মন্তব্যঃ এ থেক বুঝা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ অব্দের পূর্বেই এই সন্ন্যাসবাদ বা ইসলামে যাকে সুফিবাদ বলি তার অস্তিত্ব এই উপমাহাদেশে ছিল।

বৈষ্ণব ধর্মঃ

হিন্দুদের এই ধর্মমত সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক কালে। এই ধর্মমদের জম্ম দেন ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালী ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক একজন হিন্দু সন্ন্যাসী তার নাম ছিল নিমাই (১৪৮৬ খ্রিঃ – ১৫৩৩ খ্রিঃ) পরে শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন। তিনি চব্বিশ বছর বয়সে কাটোয়ায় কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান যথা: নীলাচল, দাক্ষিণাত্য, গৌড়, বৃন্দাবন পর্যটন করেন। পথে সত্যবাই, লক্ষ্মীবাই নামে বারাঙ্গনাদ্বয় এবং ভীলপন্থ, নারেজী প্রভৃতি দস্যুগণ তাঁর শরণ গ্রহণ করে। এইসব স্থানে ভ্রমণের সময় তিনি এতদাঞ্চলের ভাষা  বিশেষভাবে শিক্ষা করেন। এই সময় তিনি অশ্রুসজল নয়নে অবিরত কৃষ্ণনাম জপ ও কঠোর বৈরাগ্য সাধন অর্থাৎ আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে বসবাস করতেন। ভক্তদের মতে, জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন। ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে রবিবারে পুরীধামে মাত্ৰ ৪৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

মন্তব্যঃ মুগোল আমলে উপমহাদেশে যখন ব্যাপক হারে সুফিদের দ্বারা ইসলাম প্রচারিত হত তখন বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী হিন্দুরা আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে কঠোর বৈরাগ্য সাধন করতেন। তাদরের একটা অংশ ইসলাম গ্রহণ করলে বৈরাগ্যবাদের একটা প্রভাব তাদের মাঝে থেকে যায়।

শিখধর্মঃ  খ্রিস্টীয় ১৫শ শতাব্দীতে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে গুরু নানক এই ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৪৬৯ থেকে ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দশ জন নির্দিষ্ট শিখ গুরু শিখধর্মের প্রথা ও দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্যেক গুরু পূর্বতন শুরুর শিক্ষার সঙ্গে নতুন কথা যোগ করেন এবং সেগুলি কার্যে পরিণত করেন। এভাবে শিখ ধর্মের জন্ম হয়।‘গুরু’ শব্দের অর্থ শিক্ষক, সহায়ক বা উপদেশদাতা। শিখধর্মের প্রথম গুরু নানক তাঁর এক শিষ্যকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছিলেন। গুরু গোবিন্দ সিং ছিলেন সর্বশেষ মানব গুরু। মৃত্যুর পূর্বে তিনি গুরু গ্রন্থ সাহিবকে শিখদের সর্বশেষ এবং চিরকালীন গুরু ঘোষণা করে যান। তাই দশ জন গুরুর পাশাপাশি তাদের গ্রন্থ সাহিব কেও একাদশ শিখ গুরু বলে মনে করেন। পরবর্তীকালে শিখ গুরুদের কর্তৃক এই ধর্ম প্রসার লাভ করে। তাদের গ্রন্থ সাহিব প্রথম পাঁচ জন শিখ গুরু তা সংকলন করেছিলেন।

কিভাবে একজন মানুষ শিখ ধর্মী হবেন?

যখনস কেউ শিখ ধর্ম ও বিশ্বাসকে গ্রহণ করেন এবং শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিবের শিক্ষা অনুসরণ করেন এবং ঘন চুল রাখেন এবং মুখে বলবেন, “আমি একান্তভাবে জানাচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে আমি একজন ‘কেশধারী’ শিখ এবং আমি শ্রীগুরু গ্রন্থ সাহিব ও দশ জন শিখ গুরুর শিক্ষায় বিশ্বাস ও সেই অনুসরণ করছি এবং আমার অন্য কোনো বিশ্বাস নেই।

শিখরা মনে করেন, জাগতিক মায়া হল একটি সাময়িক কল্পনা বা ‘অসত্য’। এটি হল ঈশ্বর ও মোক্ষলাভের প্রচেষ্টার পথে অন্যতম প্রধান বিচ্যুতি। জাগতিক আকর্ষণ শুধুমাত্র কাল্পনিক সাময়িক দুঃখ ও তুষ্টিবিধান করতে পারে এবং তা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে। নানক অবশ্য মায়াকে শুধুমাত্র জগতেরই অসত্যতা বলেননি, জগতের মূল্যেরও অসত্যতা বলেছেন। শিখধর্মে অহংকার, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও কাম – এই পাঁচটি “পাঞ্জ চোর” (পাঁচ চোর) হিসেবে পরিচিত। শিখরা মনে করেন, এগুলি মানুষকে বিচ্যুত করে এবং এগুলি ক্ষতিকারক। শিখদের মতে, জগতে এখন কলিযুগ অর্থাৎ অন্ধকারের যুগ চলছে। কারণ, জগত মায়াকে ভালবেসে মায়ার প্রতি আসক্ত হয়ে সত্যভ্রষ্ট হয়েছে। মানুষের ভাগ্য ‘পাঞ্জ চোরে’র কাছে পরাহত হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের থেকে মানুষের বিচ্যুতি ঘটে এবং একমাত্র গভীর ও নিরন্তর ভক্তির মাধ্যমেই সেই অবস্থার উন্নতি সম্ভব। গুরু নানকের শিক্ষা স্বর্গকে সর্বশেষ গন্তব্য বলে না। তাঁর মতে অকালের সঙ্গে মিলনের ফলে মানুষ মুক্তি পায় বা জীবন্মুক্ত হয়। গুরু নানক লিখেছেন, “কর্মের প্রভাবে দেহের জন্ম হয়, কিন্তু মুক্তিলাভ হয় করুণায় ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে শিখরা মায়ার কুপ্রভাবকে এড়িয়ে যাবে। মনকে চিরন্তন সত্যে স্থির রাখার জন্য শব্দ কীর্তন, ধ্যান, নাম ও মানবজাতির সেবা করবে। শিখরা বিশ্বাস করেন সৎসঙ্গ হল পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি লাভের একটি অন্যতম প্রধান পন্থা।

মন্তব্যঃ ধ্যান করা এই ধর্মমতের প্রদার উপসনা যা আজকের সুফিবাদের প্রদান আমলে পরিনত হয়েছে। অনেক কে এই ধ্যান করাকে মোরাকাবা বলতে শুনা যায়।

গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রকিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্মঃ বৌদ্ধ ধর্ম একজন সন্নাসী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি ধ্যান করে এই ধর্ম আবিস্কার করেছেন। তিনি ২৯ বছর বয়সে বৈরাগ্যতা অর্জনের জন্য গৃহ্ত্যাগ করে, দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর ধ্যান সাধনা করে এই ধর্মমত সৃষ্টি করেন। কাজের তার ধর্মের মূল বিষয় হয় বৈরাগ্যতা অবলম্ভন করে পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে ধ্যান করে আত্মাকে আলোকময় করে তোলা। তার এর দর্শণ সুফবাদের সাথে সম্পুর্ণ মিলে যায়। তার সুফিদর্শণ জানতে তার সম্পর্কে জানতে হবে। তাই সংক্ষেপে তার জীবনি উল্লেখ করব।

গৌতম বুদ্ধঃ উত্তর-পূর্ব ভারতের কপিলাবাস্তু নগরীর রাজা শুদ্ধোধন এর পুত্র ছিলেন সিদ্ধার্থ (গৌতম বুদ্ধ)। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনি কাননে (নেপাল) জন্ম নেন সিদ্ধার্থ (গৌতম বুদ্ধ)। তাঁর জন্মের ৭ দিন পর তাঁর মা, রানি মহামায়া মারা যান। তাঁর জন্মের অব্যাবহিতকাল পর জনৈক কপিল নামক সন্ন্যাসী কপিলাবাস্তু নগরীতে আসেন। তিনি সিদ্ধার্থকে দেখে ভবিষ্যৎবানী করেন যে, সিদ্ধার্থ ভবিষ্যতে হয় চারদিকজয়ী রাজা হবেন, নয়ত একজন মহান মানব হবেন। মা মারা যাবার পর সৎ মা মহাপ্রজাপতি গৌতমী তাকে লালন পালন করেন, তাই তার অপর নাম গৌতম। ছোটোবেলা থেকেই সিদ্ধার্থ সব বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন বলে তাঁকে সংসারী করানোর লক্ষ্যে ১৬ বছর বয়সে রাজা শুদ্ধোধন যশোধরা মতান্তরে যশোধা বা গোপা দেবী নামক এক সুন্দরী রাজকন্যার সাথে তার বিয়ে দেন। রাহুল নামে তাদের একটি ছেলে হয়। ছেলের সুখের জন্য রাজা শুদ্ধোধন চার ঋতুর জন্য চারটি প্রাসাদ তৈরি করে দেন। কিন্তু উচুঁ দেয়ালের বাইরের জীবন কেমন তা জানতে তিনি খুবই ইচ্ছুক ছিলেন। একদিন রথে চড়ে নগরী ঘোরার অনুমতি দেন তার পিতা। নগরীর সকল অংশে আনন্দ করার নির্দেশ দেন তিনি, কিন্তু সিদ্ধার্থের মন ভরল না। প্রথম দিন নগরী ঘুরতে গিয়ে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি, দ্বিতীয় দিন একজন অসুস্থ মানুষ, তৃতীয় দিন একজন মৃত ব্যক্তি এবং চতুর্থ দিন একজন সন্ন্যাসী দেখে তিনি সারথি ছন্দককে প্রশ্ন করে জানতে পারেন জগৎ দুঃখময়। তিনি বুঝতে পারেন সংসারের মায়া, রাজ্য, ধন-সম্পদ কিছুই স্থায়ী নয়। তাই দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে ২৯ বছর বয়সে গৃহ্ত্যাগ করেন। দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর সাধনার পর তিনি বুদ্ধগয়া নামক স্থানে একটি বোধিবৃক্ষের নিচে বোধিজ্ঞান লাভ করেন। সবার আগে বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচার করেন পঞ্চ বর্গীয় শিষ্যের কাছে; তাঁরা হলেন কৌন্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম এবং অশ্বজিত। এরপর দীর্ঘ ৪৫ বছর বুদ্ধ ভারতের বিভিন্ন স্থানে তার বৌদ্ধ ধর্মের বানী প্রচার করেন। এবং তাঁর প্রচারিত বানী ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশে ও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে তিনি কুশীনগর নামক স্থানে ৮০ বছর বয়সে মৃত্যু বরন করেন। গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত বানীর মূল অর্থ হল অহিংসা।



বুদ্ধের দর্শনঃ বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ  তা নিরসনের উপায় বাসনা হল র্ব দুঃখের মূল বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্যএটাকে নির্বা বলা হয় নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া (দীপনির্বাণনির্বাণোন্মুখ প্রদীপ), বিলুপ্তিবিলয়অবসান এই নির্বান অর্জনের জন্য তারা সাধু সন্ন্যাসীদের মত জীবন যাপন করা। যারা নির্বাণ অর্জণ তারা তারাই বৌদ্ধ ভিক্ষূ। আমাদের সামাজের তথা কথিত সুফিরা যেমন সাধারণ জীবন যাপন করে এই  বৌদ্ধ ভিক্ষূগণ ও ঠিক তেমনিভাবে জীবন যাপন করে। তাদের ধর্মের প্রধান লক্ষ হল দুঃখ জয় করা আর এর জন্য তারা নির্বাণ অর্জনের চেষ্টা করে। কারন নির্বাণ অর্জণ করলেই দুঃখ জয় হবে এবং দুঃখের অবসান ঘটবে কামনা-বাসনা নিস্তারের মাঝে অজ্ঞানের অবসা ঘটে এতেই পূর্ণ শান্তি অর্জি হয়

 

মন্তব্যঃ খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দের দিকে বৌদ্ধ ধর্মমত উপমহাদেশে প্রচলিত আর অদ্য অবধী চলছে। তাদের ধর্মমত সৃষ্টি হয় ধ্যানের মাধ্যমে আর এ ধ্যানের দ্বারাই তারা সিদ্ধলাভ করে। এই ধ্যানই হল সুফিদের মোরাকাবা।

উপরের আলোচনার মাধ্যমে এ কথা ষ্পষ্ট যে দক্ষিন এশীয় হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখদের থেকে তাদের মন গড়া বৈরাগ্যবাদ, নির্জনবাস, ধ্যান, সংসারের মায়া ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ান, শরীর কে কঠোর কষ্টদানের মাধ্যমে আত্মাকে আলোকিত করা সুফিবাদে প্রবেশ করেছে। তাদের এই সকল শ্রমের (আমল নয়)  উপর ইসলামের লেবেল লাগিয়ে তৈরি হয়েছে সুফিবাদ।


খ্রিষ্টানদের নিকট থেকেঃ

তাফসিরে তাফহিমুল কুরআনের সুরা হাদিদ এর ২৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় ৫৪ নম্বর টিকায় খ্রিষ্টানদের  সুফিবাদ বা বৈরাগ্যবাদের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তাপহিমুল কুরআনের লেখক বলেন,

 ঈসা আলাইহিস সালামের পর খৃস্টান গীর্জাসমূহ দুই’শ বছর পর্যন্ত বৈরাগ্যবাদের সাথে অপরিচিতি ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই খৃস্টান ধর্মে এর বিষাক্ত জীবাণু বিদ্যমান ছিল এবং যেসব ধ্যান ধারণা এর জন্ম দেয়া তাও এর মধ্যে বর্তমান ছিল। সংসার বর্জন ও নিসঙ্গ জীবন যাপনকে নৈতিক আদর্শ মনে করা এবং বিয়ে শাদী ও প্রার্থিব কায় কারবারমূলক জীবনের তুলনায় দরবেশী জীবন ধারাকে অধিক উন্নত ও ভাল মনে করাই বৈরাগ্যবাদের ভিত্তি। খৃস্টান ধর্মে এ দুটি জিনিস শুরু থেকেই ছিল। বিশেষ করে কৌমার্য বা নিসঙ্গ জীবন যাপনকে পবিত্রতার সম পর্যায়ের মনে করার কারণে গীর্জায় ধর্মীয় কাজ কর্ম সম্পাদনকারী ব্যক্তিদের জন্য বিয়ে করা, তাদের সন্তানাদি থাকা এবং সাংসারিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়াকে অপছন্দনিয় মনে করা হতো। তৃতীয় শতাব্দীর আগমনের পূর্বেই এটি একটি ফিতনার রূপ ধারণা করে এবং বৈরাগ্যবাদ মহামারীর আকারে খৃষ্ট ধর্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঐতিহাসিক ভাবে এর তিনটি বড় কারণ ছিল।

প্রথম কারনঃ  প্রাচীন মুশরিক সমাজে যৌনতাচরিত্রহীনতার ও দুনিয়া পূজা যে চরম আকারে বিস্তার লাভ করেছিল তা উচ্ছেদ করার জন্য খৃস্টান পাদ্রীরা মধ্যপন্থা অবলম্বনের পরিবর্তে চরম পন্থার নীতি গ্রহণ করে। তারা সতীত্ব ও পবিত্রতার ওপর এমন গুরুত্ব আরোপ করে যেবিয়ের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক হলেও তা মূলত অপবিত্র বলে গণ্য হয়। তারা দুনিয়া পূজার বিরুদ্ধে এমন কঠোরতা অবলম্বন করে যেএকজন দীনদার ও ধর্মভীরু লোকের পক্ষে কেন প্রকার সম্পদের মালিক হওয়া গোনাহর কাজ বলে গণ্য হয় এবং একেবারে নিসম্বল ও সব দিক দিয়ে দুনিয়াত্যাগী হওয়াটাই ব্যক্তির জন্য নৈতিক মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপ মুশরিক সমাজের ভোগবাদী নীতির প্রতিবাদ তারা এমন চরম পন্থার আশ্রয় নেয় যেভোগ সুখ বর্জনযৌন বাসনাকে হত্যা করা এবং প্রবৃত্তির মূলোৎপাটন করাই নৈতিকতার উদ্দেশ্য হয়ে যায় এবং নানা রকম সাধনা দ্বারা শরীরকে কষ্ট দেয়ার ব্যক্তির আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও তার প্রমাণ হিসেবে মনে করা হতে থাকে। (তাফহিমুল কুরআন খন্ড-১৬, পৃষ্ঠা-১৫১)

 

দ্বিতীয় কারণঃ  খৃস্ট ধর্ম যখন সফলতার যুগে প্রবেশ করে জনগণের মধ্যে বিস্তার লাভ করতে থাকেগীর্জা তখন তার ধর্মের প্রসার ও প্রচারের আকাংখায় জনপ্রিয় প্রতিটি খারাপ জিনিসকেও তার গণ্ডিভুক্ত করতে থাকে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের পূজা প্রাচীন উপাস্যদের স্থান দখল করে নেয়। হোরাস (HORUS) ও আইসিস (ISIS) এর মূর্তির বদলে যীশু ও মারয়ামের মূর্তির পূজা শুরু হয়। স্যাটারনেলিয়া (Saturnalia) এর পরিবর্তে বড় দিনের উৎসব পালন শুরু হয়। খৃস্টান দরবেশগণ প্রাচীন যুগের তাবিজ ও বালা পরাআমল-তদবীর করাশুভ-অশুভ লক্ষণ নির্ণয় ও অদৃশ্য বলাজিন ভূততাড়ানোর আমল সব কিছুই করতে শুরু করে। অনুরূপ যে ব্যক্তি নোংরাঅপরিস্কার ও উলঙ্গ থাকতো এবং কোন কুঠরি বা গুহায় বসবাস করতো জনগণ যেহেতু তাকে ধার্মিক মনে করতো তাই খৃস্টান গীর্জাসমূহ এটাই আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী বা ওলী হওয়ার একমাত্র পথ বলে ধরে নেয়া হয়। এ ধরনের লোকদের 'কারামত'বা অলৌকিক ক্রিয়া কাণ্ডের কাহিনী দ্বারা খৃস্টানদের মধ্যে তাযাকিরাতুল আওলিয়া ধরনের প্রচুর বই -পুস্তক বহুল প্রচারিত হয়।

তৃতীয় কারণঃ ধর্মের সীমা নির্ণয়ের জন্য খৃস্টানদের কাছে কোন বিস্তারিত শরীয়াত এবং কোন সুস্পষ্ট 'সুন্নাত' বর্তমান ছিল না। মূসার শরীয়াতকে তারা পরিত্যাগ করেছিলকিন্তু এককভাবে শুধু ইনজীলের মধ্যে কোন পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনামা ছিল না। এ কারণে খৃষ্টান পণ্ডিতগণ কিছুটা বাইরের দর্শন ও রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং কিছুটা নিজেদের মানসিক প্রবণতার কারণে ধর্মের মধ্যে নানা ধরনের বিদআতকে অন্তরভুক্ত করতে থাকে। বৈরাগ্যবাদ ও সব বিদআতেরই একটি। খৃস্টান ধর্মের পণ্ডিত পুরোহিত ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এ ধর্মের দর্শন ও এর কর্মপদ্ধতি বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুহিন্দু যোগী-সন্নাসীপ্রাচীন মিসরীয় সংসার ত্যাগী (Anchorits) সন্নাসী পারস্যের মানেবীয়া এবং প্লেটো ও প্লেটোনিক দর্শনের অনুসারীদের থেকে গ্রহণ করেছে এবং একেই আত্মার পরিশুদ্ধির পন্থাআধ্যাত্মিক উন্নতির উপায় ও আল্লাহর নৈকট্যলাভের অসীলা হিসেবে গণ্য করেছে। যারা এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছিল তারা কোন সাধারণ লোক ছিল না। খৃস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে সপ্তম শতাব্দী (অর্থাৎ কুরআন নাযিল হওয়ার সময়পর্যন্ত তারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে খৃস্ট খর্মের বড় বড় পণ্ডিত-পুরোহিত এবং ধর্মীয় নেতা ও পথ প্রদর্শক ছিল । অর্থাৎ সেন্ট আথানাসিউয়াসসেন্ট বাসেলসেন্ট গ্রগারী নাযিয়ানযিনসেন্ট করাই সুষ্টামসেন্ট আয়ম ব্রোজসেন্ট জিরুমসেন্ট অগাষ্টাইনসেন্ট বেনডিক্টমহান গ্রেগরী। এঁরা সবাই ছিলেন সংসার বিরাগী দেরবেশ এবং বৈরাগ্যবাদের বড় প্রবক্তা। এদের প্রচেষ্টায়ই গীর্জাসমূহে বৈরাগ্যবাদ চালু হয়। (তাফহিমুল কুরআন খন্ড-১৬, পৃষ্ঠা-১৫২)


খ্রিষ্টানদের বৈরাগ্যবাদের সংক্ষিপ্ত কতিপয় বৈশিষ্টঃ

। কঠোর সাধনা  নিত্য নতুন পন্থা নিজের দেহকে চরম কষ্ট দেয়াঃ    

কঠোর সাধনা ও নিত্য নতুন পন্থায় নিজের দেহকে নানা রকম কষ্ট দেয়া। এ ব্যাপারে প্রত্যেক দরবেশেই অন্যদের পেছনে ফেলার চেষ্টা করতো। খৃস্টান আওলিয়া দরবেশদের কিস্সা-কাহিনীতে তাদের কামালিয়াতের যেসব বর্ণনা আছে তা কতকটা এখানে বর্ণনা করা হলোঃ

আলেকজান্দ্রিয়ার সেন্ট মাকারিউস তার দেহের ওপর সব সময় ৮০ পাউণ্ড ওজনের বোঝা বহন করতো। ৬ মাস পর্যন্ত সে কর্দমাক্ত মাটিতে শয়ন করতে থাকে এবং বিষাক্ত মক্ষিকাসমূহ তার উদোম শরীরে দংশন করতে থাকে। তার সাগরেদ সেন্ট ইউসিবিউস গুরুর চেয়েও অধিক সাধনায় মগ্ন হয়। সে সব সময় ১৫০ পাউণ্ড ওজনের বোঝা বহন করতো এবং তিনবছর পর্যন্ত এটি শুষ্ক কূপের মধ্যে অবস্থান করেছিলো। সেন্ট সাবিউস শুধু এমন জোয়ারের রুটি খেতেন যা গোটা মাস পানিতে ভিজে থাকার কাণে গন্ধযুক্ত হয়ে যেতো। সেন্ট বাইসারিউন ৪০ দিন পর্যন্ত কন্টকাকীর্ণ ঝোপের মধ্যে পড়েছিলো এবং ৪০ বছর পর্যন্ত সে মাটিতে পিঠ ঠেকায়নি। সেন্ট পাখোমিউস ১৫ বছর অপর একটি বর্ণনা অনুসারে পঞ্চাশ বছর মাটিতে পিঠ না ঠেকিয়ে অতিবাহিত করেছে। সেন্ট জন নামক একজন ওলী তিন বছর পর্যন্ত উপাসনারত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। পুরো এই সময়টাতে সে কখনো বসেও নাই কিংবা শয্যা গ্রহণও করে নাই। আরাম করার জন্য একটি বড় পাথরে হেলান দিত এবং প্রতি রবিবারে তার জন্য 'তাবাররুক'হিসেবে যে খাদ্য আনা হতো কেবল তাই ছিল তার খাদ্য। সেন্ট সিমিউন স্টায়লাইট (৩৯০-৪৪০ খৃঃখৃস্টানদের বড় বড় ওলী দরবেশের অন্যতম। প্রত্যেক ইস্টারের আগে সে পুরা চল্লিশ দিন না খেয়ে কাটিয়ে দিত। একবার সে পুরো এক বছর পর্যন্ত এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝে মধ্যে সে তার খানকাহ থেকে বেরিয়ে একটি কূপের মধ্যে গিয়ে থাকতো। অবশেষ সে উত্তর সিরিয়ার সীমান দূর্গের সন্নিকটে ৬০ ফূট উঁচু একটি স্তম্ভ নির্মাণ করিয়ে নেয় যার ওপরের অংশের পরিধি ছিল মাত্র তিন ফুট। এরই উপরে তার জন্য একটি ঘেরা নির্মাণ করে দেয়া হয়েছিল। এই স্তম্ভটির ওপরে সে পুরো তিনটি বছর কাটিয়ে দেয়। রোদ-বৃষ্টি ও শীত-গ্রীষ্ম সব কিছুই তার ওপর দিয়ে চলে যেতো কিন্তু স্তম্ভ থেকে সে কখনো নিচে নামতো না। তার শিষ্য সিড়ি লিগিয়ে তাকে লাগিয়ে তাকে খাবার পৌছাতো এবং তার ময়লা অবর্জনা সাফ করতো। তার পর সে রশি দিয়ে নিজেকে স্তম্ভের সাথে বেঁধে নেয়। এমনকি রশি তার শরীরের মাংসের মধ্যে ঢুকে যায়্ এতে মাংসে পচন ধরে এবং তাতে পোকা পড়ে। তার ফোঁড়া থেকে যখনই কোন পোকা নীচে পড়ে যেতো তখনই সে তা উঠিয়ে ফোঁড়ার মধ্যে রাখতো এবং বলতোঃ"আল্লাহ তোকে যা খেতে দিয়েছেন খা"। সাধারণ খৃস্টানরা বহুদূর দূরন্ত থেকে তার সাক্ষাত লাভের জন্য আসতো। সে মারা গেলে খৃস্টান জনতা তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয় যেসে খৃস্টান অলী দরবেশেদের মধ্যে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত।

এ যুগের খৃস্টান আওলিয়াদের যেসব গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে তা এ ধরনের দৃষ্টান্তে ভরা। অলীদের মধ্য কারো পরিচয় ছিল এই যেসে ৩০ বছর পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিশ্চুপ ছিলতাকে কখনো কথা বলতে দেখা যায়নি। কেউ নিজেকে একটি বড় পাথরের সাথে বেঁধে রেখেছিল। কেউ জংগলে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতো এবং ঘাস ও লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতো। কেউ সব সময় ভারী বোঝা বহন করে বেড়াতো। কেউ শৃঙ্খল নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁধে রাখতো। কিছু সংখ্যক অলী আবার জীব-জন্তুর গুহায়, শুষ্ক বিরান কূপে কিংবা পুরনো করবে গিয়ে বাস করতো। আরো কিছু সংখ্যক বুর্যগ সব সময় উলঙ্গ থাকতোলম্বা চুল দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান ঢাকতো। এবং বুজে হেঁটে চলতো। সবখানে এ ধরনের ওলী দরবেশদের কারামতের চর্চা হতো এবং মৃত্যুর পর তাদের হাড্ডিসমূহ খানকাহসমূহে সংরক্ষণ করা হতো। আমি নিজে সিনাই পর্বতের পাদদেশে সেন্ট ক্যাথারইনের খানকায় এ ধরনের হাড় গোড়ে সজ্জিত গোটা একটা লাইব্রেরী দেখেছি সেখানে এক জায়গায় ওলীদের মাথারখূলীএক জায়গায় পায়ের হাড় এবং এক জায়গায় হাতের হাড় সাজানো ছিল। একজন ওলীর গোটা কংকালই কাঁচের আলমারীতে রাখা ছিল।


 নোংরা  অপরিচ্ছন্ন থাকা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে চরমভাবে বর্জন করাঃ

এই সময় তারা নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন থাকতো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে চরমভাবে বর্জন করে চলতো। তাদের দৃষ্টিতে গোসল করা বা শরীরে পানি লাগানো আল্লাহ ভীরুতার পরিপন্থী। দেহের পরিচ্ছন্নতাকে তারা আত্মার অপবিত্রতা বলে মনে করতো। সেন্ট আথানাসিউস অত্যন্ত ভক্তির সাথে সেন্ট ত্র্যানথোনীর এই বৈশিষ্টটি বর্ণনা করেছেন যেমৃত্যু পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সে তার নিজের পা ৫০ বছর পর্যন্ত সে মুখ বা পা কিছুই ধোয়নি। এক বিখ্যাত খৃস্টান সন্ন্যাসীনী কুমারী সিলভিয়া আঙ্গুল ছাড়া জীবনভর দেহের অন্য কোন অংশ পানি লাগাতে দেয়নি। একটি কনভেন্টের ১৩০ জন সন্ন্যাষিনীর প্রশংসায় লেখা হয়েছে যেতারা কখনো নিজেদের পা ধোয়নি। আর গোসলের তো নাম শুনলেই তাদের দেহে কম্পন সৃষ্টি হতো।

 

। দাম্পত্য জীবনকে পুরোপুরি হারাম করাঃ

তাদের এ বৈরাগ্যবাদ দাম্পত্য জীবনকে কার্যত পুরোপুরি হারাম করে দেয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলার ব্যপারে অত্যন্ত নির্মমভাবে কাজ করে। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর সমস্ত ধর্মীয় রচনাবলী এ ধারণায় ভরা যেনিসঙ্গ জীবন বা কৌমার্য সর্বাপেক্ষা বড় নৈতিক মূল্যবোধ। পবিত্রতার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি যৌন সম্পর্ককে একেবারেই বর্জন করবে। এমনকি তা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার যৌন সম্পর্কে হলেও। এমন একটি অবস্থাকে পুতঃপবিত্র আধ্যাত্মিক জীবনের পরিপূর্ণতা মনে করা হতোযে ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি হত্যা করে এবং তার মধ্যে দৈহিক ভোগাকাংখার লেশ মাত্রও অবশিষ্ট না থাকে। প্রবৃত্তিকে হত্যা করা তাদের দৃষ্টিতে এজন্য জরুরী ছিল যেতা দ্বারা পশুত্ব শক্তি লাভ করে। তাদের কাছে ভোগ এবং গোনাহ ছিল সমার্থক। এমনকি তাদের দৃষ্টিতে আনন্দ প্রকাশ করাও আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার নামান্তর ছিল। সেন্ট বাসেল শব্দ করে হাসা এমনকি মুচকি হাসা পর্যন্ত নিষেধ করেছেন। এসব ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে তাদের কাছে নারী ও পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক একেবারেই অপবিত্র বলে গণ্য হয়েছিলো। বিয়ে তো দূরের কথা নারীর চেহারা না দেখা এবং বিবাহিত হলে স্ত্রীকে ফেলে চলে যাওয়া সন্ন্যাসীর জন্য অত্যন্ত জরুরী ছিল। পুরুষদের মত নারীদের মনেও একথা বদ্ধমুল করে দেয়া হয়েছিল যেতারা যদি আসমানী বাদশাহীতে প্রবেশ করতে চায় তাহলে যেন চির কুমারী থাকে এবং বিবাহিতা হলে স্বামীদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেন্ট জিরুমের মত বিশিষ্ট খৃস্টান পণ্ডিত বলেনযে নারী যীশু খৃস্টের কারণে সন্ন্যাসীনী হয়ে সারা জীবন কুমারী থাকবে সে খৃস্টান সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আর সেই নারীর মাখোদা অর্থাৎ খৃস্টের শ্বাশুড়ী, (Mother in law of god) হওয়ার মর্যাদা লাভ করবে। সেন্ট জিরুম অন্য একস্থানে বলেনঃ "পবিত্রতার কুঠার দিয়ে দাম্পত্য বন্ধনের কাষ্ঠ খন্ড কেটে ফেলাই আধ্যাত্মিক পথের অনুসারীর সর্ব প্রথম নারীর মধ্যে এর সর্ব প্রথম যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হচ্ছেতার মধুর দাম্পত্য জীবন চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে যায়। আর খৃস্টান ধর্মে যেহেতু তালাক ও বিচ্ছেদের কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাই বৈবাহিক বন্ধনের মধ্য থেকেই স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। সেন্ট নাইলাস (St. Nilus) ছিল দুই সন্তানের পিতা। সে বৈরাগ্যবাদের খপ্পরে পড়লে তার স্ত্রী কাঁদতে শুরু করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেন্ট আম্মুন (St. Ammon) বিয়ের রাত বাসর শয্যায়ই তার নব বধুকে দাম্পত্য সম্পর্কের অপবিত্রতা সম্পর্ক উপদেশ দেয় এবং উভয়ে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যেতারা আজীবন পরস্পর আলাদা থাকবে। সেন্ট ত্র্যালেক্সিসও (St. Alexis) এই একই কাজ করেছিলো। খৃস্টান আওলিয়া -দরবেশদের জীবন -কথা এ ধরনের কাহিনীতে ভরপুর।


নিকট আত্মীয় স্বজন থেকে দুরে রাখাঃ


তাদের  বৈরাগ্যবাদের সব চাইতে বেদনাদায়ক দিক ছিল এই যেতা মা-বাপভাইবোন ও সন্তানদের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল। খৃস্টান আওলিয়া দরবেশের দৃষ্টিতে সন্তানদের জন্য মা বাবার স্নেহ-ভালবাসাভাইয়ের জন্য ভাই-বোনের স্নেহ-ভালবাসা এবং বাপের জন্য ছেলেমেয়ের ভালাবাসাও ছিল একটি পাপ। তাদের মতে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য এসব সম্পর্ক ছিন্ন করা অপরিহার্য। খৃস্টান আওলিয়া দরবেশদের জীবন কথায় এর এমন সব হৃদয় বিদারক কাহিনীদেখা যায় যা পাঠ করে কোন মানুষের পক্ষে ধৈর্যধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একজন সন্ন্যাসী ইভাগ্রিয়াস (Evagrius) বছরের পর বছর মরুভূমিতে গিয়ে সাধনা করছিল। তার বাবা মা বহু বছর ধরে তার জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করেছিল। একদিন হঠাৎ তার কাছে তার মা বাবার পত্র পৌছলো। এ পত্র পাঠ করে তার মনে মানবিক ভালবাসার আবেগ উদ্বেলিত হয়ে উঠতে পারে এ আংশকা দেখা দিল। তাই সে ঐ পত্রগুলো না খুলেই আগুনে নিক্ষেপ করলো। সেন্ট থিউডোরসের মা ও বোন বহুসংখ্যক পাদ্রীর সুপারিশ পত্র নিয়ে যে খানকায় সে অবস্থান করতো সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো এবং পুত্র ও ভাইকে এক নজর দেখার আকাংখা প্রকাশ করলো। কিন্তু সে তাদের সস্মুখে আসতে পর্যন্ত অস্বীকার করলো। সেন্ট মার্কাসের (St. Marcus) মা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য তার খানকায় যায় এবং খানকায় প্রধানকে অনুনয় বিনয় করে ছেলেকে মায়ের সামনে আসার নির্দেশ দিতে রাজি করায়। কিন্তু ছেলে কোনক্রমেই মায়ের সাথে সাক্ষাত করতে চাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত সে খানকা প্রধানের নির্দেশ পালন করে এভাবে যেবেশভুষা পরিবর্তন করে মায়ের সামনে যায় এবং চোখ বন্ধ করে থাকে। এভাবে মাও ছেলেকে চিনতে পারেনিছেলেও মায়ের চেহারা দেখতে পারেনি। আরো একজন অলী সেন্ট পোমেন (St. Poemen) ও তার ৬ ভাই মিসরের একটি মরু খানকায় থাকতো। বহু বছর পর তাদের বৃদ্ধা মা তা খোঁজ পায় এবং তাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হয়। ছেলে দূর থেকে মাকে দেখা মাত্রই দৌড়িয়ে গিয়ে তার হুজরায় প্রবেশ করে এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। মা বাইরে বসে কাঁদতে থাকলো এবং চিৎকার করে বললোঃ এই বৃদ্ধাবস্থায় এত দীর্ঘ পথ হেটে আমি কেবল তোমাকে দেখতে এসেছি। আমি যদি তোমার চেহারা দেখি তাহলে তোমার কি ক্ষতি হবে৷ আমি কি তোমার মা নই৷ কিন্তু সেসব অলী-দরবেশরা দরজা খুললো না। তারা মাকে বলে দিল যেআমারা আল্লাহর কাছে তোমার সাথে সাক্ষাত করবো। সেন্ট সিমিউন স্টায়লাইটসের (St. Simeon Stylites) কাহিনী এর চেয়েও বেদনাদায়ক। সে তার মাকে ছেড়ে ২৭ বছর নিরুদ্দেশ থাকে। বাপ তার বিচ্ছেদে মারা যায়। মা জীবিত থাকে। ছেলের আল্লাহর অলী হওয়ার কথা যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তখন মা ছেলের অবস্থান জানতে পারে। বেচারী মা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য তার খানকায় গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু কোন নারীর জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। ছেলে হয় তাকে ভেতরে ডেকে নিক কিংবা বাইরে এসে তাকে দর্শন দিক এ ব্যপারে মা অশেষ-কাকুতি-মিনুতি জানায়। কিন্তু সেই অলী তা করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকৃতি জানায়। এ অবস্থায় হতভাগিনী মা তিনদিন তিন রাত খানকার দরজার সামনে পড়ে থাকে এবং শেষ সেখানেই শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তখন অলী সাহেব বেরিয়ে এসে মায়ের লাশের পাশে অশ্রুপাত এবং তার ক্ষমার জন্য দোয়া করে।

এসব অলীরা তাদের বোন ও সন্তানদের সাথেও এ ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে। এক ব্যক্তি মিউটিয়াসের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন যেসে ছিল একজন সুখী -স্বচ্ছল মানুষ। হঠাৎ তাকে ধর্মীয় আবেগে পেয়ে বসে এবং সে তার ৮ বছর বয়সের একমাত্র পুত্রকে নিয়ে এক খানকায় গিয়ে হাজির হয়। সেখানে তার আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য মন থেকে পুত্রের প্রতি স্নেহ -ভালবাসা দুর করা একান্ত আবশ্যক ছিল। সেজন্য প্রথমে তাকে পুত্রের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অতপর তার চোখের সামনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার সে নিষ্পাপ শিশু সন্তানকে নানাভাবে নির্মম কষ্ট দেয়া হতে থাকে এবং সে তার দেখতে থাকে এরপর খানকায় পুরোহিত তাকে তার ঐ সন্তানকে নিজ হাতে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেয়। সে যখন এ নির্দেশও পালন করতে প্রস্তুত হয় এবং শিশুটিকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয় ঠিস সে মুহুর্তে সন্ন্যাসীরা এসে তার জীবন রক্ষা করে । এরপর স্বীকৃতি দেয়া হয় যেসত্যিই সে অলী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছে।

এসব ব্যাপারে খৃস্টীয় বৈরাগ্যবাদের দৃষ্টিকোণ ছিল এই যেআল্লাহর ভালবাসা যে ব্যক্তি চায় তাকে মানবীয় ভালবাসা সেসব শৃঙ্খল কেটে ফেলতে হবে যা পৃথিবীতে তাকে তার মা বাবাভাইবোন এবং সন্তান -সন্তুতির সাথে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে। সেনট জিরুমবলেনঃ "তোমার ভাজিতা যদি তোমার গলায় বাহু জগিয়েও থাকেতোমার মা যদি তোমাদের দুধের দোহাই দিয়ে বিরত রাখতে চায়তোমাকে বিরত রাখার জন্য তোমার বাবা যদি সামনে লুটিয়ে পড়েতারপরও তুমি সবাইকে পরিত্যাগ করে এবং বাবার দেহকে পদদলিত করে এক ফোটাও অশ্রুপাত না করে ক্রুশের ঝাণ্ডার দিকে ছুটে যাও। এ ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতাই তাকওয়া। সেন্ট গ্রেগরী লিখেছেনঃ "এক যুবক সন্ন্যাসী মন থেকে মা বাবার প্রতি ভালবাসা দূর  করতে পারেনি। সে এক রাত চুপে চুপে তাদের সাথে সাক্ষাত করতে যায়। আল্লাহ তাকে এ অপরাধের সাজা দেন। সে খানকায় ফিরে আসা মাত্রই মারা যায়। তার লাশ দাফন করা হলে মাটি তা গ্রহণ করে না। কবরে বার বার তার লাশ রাখা হয় কিন্তু মাটি তা বাইরে নিক্ষেপ করে। অবশেষে সেন্ট বেনডিক্ট তার বুজের ওপর তাবাররুক রাখলে কবর তাকে গ্রহণ করে। এক সন্ন্যাসীনী সম্পর্কে লিখেছেন যেসে মারা যাওয়ার পর তিনদিন পর্যন্ত আযাব হতে থাকে। কারণ সে মন থেকে তাঁর মায়ের ভালবাসা দূর করতে পারেনি। একজন অলীর প্রশংসায় লিখেছেন যেনিজের আত্মীয় -স্বজন ছাড়া সে কখনো অন্য কারো সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেনি।


নিকট আত্মীয়সহ নিজেদের মাঝে নির্দয় এবং নিষ্ঠুর ব্যবহার করাঃ

 

নিজের নিকটাত্মীয়দের সাথে নির্দয়তানিষ্ঠুরতাএবং কঠোরতা প্রদর্শনের যে অনুশীলন তারা করতো তাতে তাদের মানবিক আবেগ-অনুভূতি মরে যেতো। এর স্বাভাবিক ফল দাঁড়িয়েছিল এই যেযাদের সাথে তাদের ধর্মিয় বিরোধ দেখা দিতো এরা তাদের ওপর জুলুম -অত্যাচারের চরম পন্থা গ্রহণ করতো

চতুর্থ শতাব্দীর আগমন পর্যন্ত খৃস্টবাদের মধ্য ৮০-৯০ টি ফিরকা সৃষ্টি হয়েছিল। সেন্ট আগাস্টাইন তার সময়ে ৮৮টি ফিরকা গণনা করেছেন। এসব ফিরকা পরস্পরের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা ও হিংসা বিদ্বেষ পোষন করতো। হিংসা বিদ্বেষের এ আগুণের ইন্ধন যোগানদাতাও ছিল সন্ন্যাসীরা। এ আগুনে বিরোধী ফিরকাসমূহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রচেষ্টায়ও এসব খানকাবাসী সন্ন্যাসীরাই অগ্রনী ভূমিকা পালন করতো। এ সম্প্রদায়িক সংঘাতের একটি বড় আখড়া ছিল আলোকজান্দ্রিয়া। সেখানে প্রথমে এরিয়ান ফিরকাহ বিশপ আথানিসিউসের দলের ওপর হামলা করে। তার খানকা থেকে কুমারী সন্ন্যাসীদের ধরে ধরে বের করে আনা হয়। তাদেরকে উলংগ করে কাঁটা যুক্ত ডাল পালা দিয়ে প্রহার করা হয় এবং শরীরে দাগ লাগানো হয় যাতে তারা নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস বর্জন করে তাওবা করে । এর পর মিসরে ক্যাথলিক গোষ্ঠী বিজয় লাভ করলে এরিয়ান ফিরকার সাথে একই আচরণ করে। এমনকি খুব সম্ভবত খোদ এরিয়াস (Arius) কেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। আলোকজান্দ্রিয়াতেই সেন্ট সাইরিল (Cyril) এর মুরীদ সন্ন্যাসীরা ব্যপাক হাংগামার সৃষ্টি করে। এমনকি তারা বিরোধী ফিরকার এক সন্ন্যাসীকে ধরে তাদের গীর্জায় নিয়ে হত্যা করে এবং লাশ টুকরো টুকরো করে কেটে আগুনে নিক্ষেপ করে। রোমের পরিস্থিতিও এর থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না। ৩৬৬ খৃস্টাব্দে পোপ লিবিরিয়াস (Liberius) এর মৃত্যু হলে দুই গোষ্ঠীই পোপের পদের জন্য নিজ নিজ প্রার্থী দাঁড় করায়। উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক খুনাখুনি ও রক্তপাত হয়। এমনকি একটি চার্চ থেকে একদিনে ১৩৭ টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। (তাফহিমুল কুরআন খন্ড-১৬, পৃষ্ঠা-১৫৩-১৫৮)

০৩। মধ্যপ্রাচ্য থেকেঃ

আমরা জানি মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং চার খলিফার শাসনব্যবস্থার অবসানের পর ইসলামী বিশ্বে মুসলীদের রাষ্ট্র পরিচানায় আস্তে আস্তে ইসলামি আদর্শ থেকে দুরে সরতে থাকে। দিন যতই বাড়তে থাকে ইসলামি শাসন ততই দুর্বল হতে থাকে। এক সময় রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়, তার সাথে সাথে শাসকদের বিলাসিতা, আড়ম্বর ও ধনদৌলতের প্রতি আসক্তি অত্যধিক বেড়ে যায় সেই সময়ই একদল সৎ, উদাসীন ও আল্লাহভক্ত মানুষ নিজেদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন তাঁরা সাদাসিদে পোশাক পরতেন তারা অনেকটা নিরবেই বিলাসিতা, আড়ম্বর ও সংসার আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মূখর হয়ে উঠেছিলেন ইসলামী সমাজে আগের যুগের সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণা ফিরিয়ে আনার জন্যেই তারা এই কাজ করে সেই সব ত্যাগী আর সৎ মানুষগুল অনেকটা ইসলামের আদর্শ সমুন্নত রাখার জন্য বাধ্য হয়েই এমন সততা ধর্মী আদর্শ গ্রহন করেছিল সে সময় যারা সাদাসিদে ‘পশমী’ পোশাক পড়ত এবং নিজেদের দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মু্ক্ত রাখতে চাইতেন সুফিবাদে বিশ্বাসি  লেখকহগন এই সকল আল্লাহ ভক্ত সাধারন সাদাসিদে মুসলিমদের সুফি হিসাবে উল্লেখ করেছেন তাই তাদের সুফি বলা যাবে না তারা দুনিয়া ত্যাগি হলেও তারা মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং চার খলিফার সাদাসিদে জীবনাদর্শ অনুসরণ করতেন এবং তাদের জীবন খুবই পবিত্র ছিল এই জন্য বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক ও আলেম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হিজরীর প্রথম সোনালী তিন যুগে সূফী শব্দটি প্রসিদ্ধ ছিল না। যেই তিন প্রজন্মের প্রশংসা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানব জাতির শেষ্ঠতম প্রজন্ম হল আমার প্রজন্ম, এরপরে আছে যারা তাদের পরে আসবে, এরপর তাদের পরবর্তী যারা আসবে...”(বুখারী,২৬৫২,২৫৩৩)। কিন্তু  তখনকার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য আবেদ যাদের সুফিসাধক হিসাবে সুফিবাদিরা উল্লেখ করেছেন, তারা হলঃ হাসান বসরি (মৃত্যু ৭২৮:খ্রিস্টাব্দ), ইব্রাহীম ইবনে আদম (মৃত্যু: ৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ),  আবু হাশিম (মৃত্যু ৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ), মারূফ করখী (মৃত্যু: ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রমূখ এদের নাম আজও ইসলামি বিশ্বে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় এবং তাদের নাম আসলে চোখের সামনে এক পবিত্র ছবি ভেসে ওঠে এরা সবাই ছিলেন আরববাসী এবং এরা  ইসলামের আওতার মধ্যে থেকেই ইসলামের ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন হয়েছিলেন হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ তো একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন তারা কর্ম কোলাহল মূখর কর্মমুখী জীবন পরিত্যাগ করে নিরবে ইবাদতের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন তাদের মাঝে নতুন কোনও চিন্তার স্ফূরণ ঘটেনি

ইসলামে প্রবেশের আগে পারশ্যের অধিকাংশ মানুষ কুসংস্কার ও সুফিবাদের নানা ধ্যান ধারনায় নিমজ্জিত ছিল ওমর (রাঃ) সময়ে পারশ্য বিজয় হয়। তাতে বসবাসকারী সাধারণ লোকদের অন্তর সাবেক আকিদার ভ্রান্তি থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার আগেই ইসলামি খেলাফ নিয়ে মুসলিমদের মাঝে বিরোধ বাধে যার ফলে সিফ্ফিন এবং ঙ্গে জামালের’ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলে ইসলামি খেলাফতে নতুন প্রবেশে কারি পারশ্যের জনগন আসল ইসলামি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় আলী বাঃ এর খেলাফত কালে মুনাফিক শিয়ামতবাদের প্রতিষ্ঠাতা সাহাবি বিদ্ধেসি আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাকে তর বিতর্কিত আকিদা কাজের জন্য পারশ্যে বহিস্কার করা হয় তখন তাদের ইসলাম গ্রহনের বয়স দশ/বার ছিল। তারা ইবনে সাবার দাওয়াত কে আসল ইসলাম মনে করে অকপটে গ্রহণ করে। ইবনে সাবার তার ভ্রান্ত বিশ্বাস ছড়ানোর জন্য  সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। এই জন্য অনেকে মনে করে ইসলামি সুফিবাদ পারশ্য থেকে শুরু হয় আর শেষ হয় উপমহাদেশে।

             এভাবে আস্তে আস্তে ইসলামের নামে সংসার বিরাগীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যখন ইসলমি আমল আখলাকের সাথে সংসার বিরাগীদের আমল আখলাকের তালগোল মিলান শুরু হয়, তখন তাহাকে সুফিবাদ বলে চালিয়ে দেয়া হল। এভাবে ইসলামি আবরনে অনেক সুফিবাদির আবির্ভাব ঘটে, তাদের মাঝে মোহাম্মদ ইবনে আরাবী (মৃত্যু ৬৩৮ হিজরি) যাকে সকলে  ইবনে আরাবী বলে চিনেন, তিনি ছিলেন অন্যতম। উপমহাদের অনেক সুফিবাদি বা পীরপন্থী তাকে শায়েখে আকবর বলে চিনে। বর্তমানে আমাদের সমাজে যে সুফিবাদি আকিদা বিশ্বাস চালু আছে তার প্রতিষ্ঠার হল এই ইবনে আরাবী। বর্তমান স্পেনের মূর্সিয়া নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে মারা যান। তিনি ছিলেন একজন আরব ছুফি সাধক লেখক ও দার্শনিক তিনি সূফীবাদের মুখ্য বুজুর্গদের একজন ছিলেন, যিনি পৃথিবীর সকল সূফীদের দ্বারা সম্মানিত। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘’স্রষ্টা মানুষের মাঝেই বিদ্যমান’’ (ইবন আরাবী, আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়াহ ২য় খণ্ড; পৃষ্ঠা নঃ ৬০৪; আব্দুর রাহমান আল-ওয়াকিল, হাযিহী হিয়া আস-সুফীয়াহ পৃষ্ঠা নঃ ৩৫; বিলাল ফিলিপস, তাওহীদের মুল নীতিমালা; পৃষ্ঠা নঃ ১৫৩)

        ছুফিতত্ত্বে তার অনবদ্য অবদানের কারনে তিনি শেখ আল আকবর মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি সংসার ত্যাগী ছিলেন। যারা মনে করে পাপের অনিবার্য ফল দোজখের শাস্তি, আর এই শাস্তি হতে মুক্তি লাভের আশায় যারা পার্থিব সুখ ও ভোগকে পরিত্যাগ করতেন, তিনি তাদের দলভুক্ত হলেন। পরকালে স্বর্গীয় সুখের আশায় আল্লাহর দাসত্ব করার চাইতে তিনি খোদার প্রেমে বিলীন হয়ে যাওয়ার আসায় সবকিছুকে পরিত্যাগ করেন খোদার সান্নিধ্যেই বেহেশ্ত এটাই তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি সিরিয়ায় তার আদর্শ প্রচার করতেন। শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনত। কেউ বুঝত, কেউ বুঝত না। তারপর একাধিক শত্রু তৈরি হয়ে গেল। তিনি সিরিয়া ত্যাগ করলেন, চলে এলেন মক্কা নগরীতে। সেখানে এসে তিনি সাধনার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেলেন। শেষ পর্যন্ত রচনা করলেন  পুস্তক ফতুহাতে মক্কী। অর্থাৎ মক্কার প্রত্যাদেশ। স্রষ্টার সাথে তার সংলাপ ফতুহাতে মক্কী পুস্তকে বর্ণনা করা হয়েছে। এই পুস্তকে নবী করিমের (স) শান-মর্যাদা যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি খোদাপ্রেমিক একজন মানুষের কথাও বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ওয়াহদাতুল ওজুদ মতবাদ প্রচার করেন। তার এই মতবাদ সবাই মেনে নিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কা থেকে সিরিয়ার আলেপ্প্য নগরীতে ফিরে আসেন।

তিনি সৃষ্টি মাত্রই আল্লাহর সন্ধান করেছেন ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ বা স্ববেশ্বরবাদ প্রচার করে। এই আকিদা বিশ্বাসে খালিক্ব (সৃষ্টিকর্ত) এবং মাখলুক (সৃষ্টি) আলাদা কোন কিছু নয় বরং এক। সৃষ্টিকর্তা এবং সমগ্র সৃষ্টির অস্বিত্ব এক ও অভিন্ন, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মাঝেই অবস্থান করেন। তিনি   এই আকিদা হাজার হাজার মুসলমানদেরকে এই শির্কি মতবাদ শিক্ষা দিয়ে তাদের ঈমান নষ্ট করেছে। ইবনে আরাবী বিশ্বাস করতো, “স্রষ্টা মানুষের মাঝে বসবাস করেন।’’  (ইবন আরাবীর লেখা আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়াহঃ ২য় খণ্ড; ৬০৪ পৃষ্ঠ্)।

 

তিনি হুলুলিয়্যাহ বিশ্বাসি ছিলেন। আরবীতে বলা হয়, হুলুলিয়্যাহ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘অনুপ্রবেশবাদ’। হুলুল কথাটির সাধারণ ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ আল্লাহ কোনো কিছুর মধ্যে ‘হুলুল’ করে অর্থাৎ প্রবেশ করেন। এই মতবাদ প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মাঝে বিদ্যমান, তবে বিশেষ করে খৃষ্টানদের মাঝে এই আক্বীদাহ লক্ষ্য করা যায়। খ্রীস্টানরা মনে করে আল্লাহ ঈসা (আ:) এর মধ্যে প্রবেশ করে এক হয়ে গেছেন। এই কারণে হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ নামে একজন পথভ্রষ্ট সূফী যখন বলেছিল, আনাল হক্ব (আমিই আল্লাহ)। তখন এই কথাটিকে খৃষ্টানরাই বেশী পছন্দ করেছিল, কারণ এই কথার সাথে তাদের আক্বীদার মিল ছিলো। জালালুদ্দিন রুমিও হুলুল আকিদায় বিশ্বাসি ছিলেন। এই জন্য তিনি তার মছনবী শরীপে হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ প্রসংশাসহ ঊল্লেখ করেছেন। হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ জীবন ও দর্শন পরে আলোচনা করা হবে। তিনি হুলুল বা মানুষে ঐশীরুপ দেখেছেন। এবং বিশ্বাস করেছেন যে, ইলাহীয়তে বা ঐশী সত্তার বিকাশ স্ফুরন হয় আদামিয়াত বা মানবত্বে। আর ইত্তিহাতের ভিত্তিমূলে তিনি আদম (আ) কে সর্বপ্রথম আল্লাহর শারীরিক বিকাশ হিসাবে ধরেছেন। মানবীয় দৈহিক সত্তায় ঐশী সত্তার পূর্ণতম প্রকাশই আল্লাহর এক চিরন্তন রহস্য মানুষের মাঝে নিজেরই মধুরতম বিকাশ বাসনার খেয়ালে সৃষ্টি লোকের সম্ভব হয়েছে। আল্লাহর দীদার বা দর্শন অশরীরী অবস্থায় সম্ভব নয় এবং রমনী রুপে আল্লাহর বিকাশই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ।

ইত্তেহাদ বা ওয়াহদাতুল উজূদ বলতে অদ্বৈতবাদী দর্শন বুঝায়, যা ‘হুলূল’-এর পরবর্তী পরিণতি হিসাবে রূপ লাভ করে। এর অর্থ হ‘ল আল্লাহর অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। অস্তিত্ব জগতে যা কিছু আমরা দেখছি, সবকিছু একক এলাহী সত্তার বহিঃপ্রকাশ। এই আক্বীদার অনুসারী ছূফীরা স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য করে না। এদের মতে মূসা (আঃ) -এর সময়ে যারা বাছুর পূজা করেছিল, তারা মূলতঃ আল্লাহকে পূজা করেছিল। কারণ তাদের দৃষ্টিতে সবই আল্লাহ। আল্লাহ আরশে নন, বরং সর্বত্র ও সবকিছূতে বিরাজমান। যে ব্যক্তি মুর্তিপুজা করে বা পাথর, গাছ, মানুষ, তারকা ইত্যাদি পুজা করে, সে মূলতঃ আল্লাহকেই পুজা করে। সবকিছুর মধ্যে মুমিন আল্লাহর নূর বা জ্যোতির প্রকাশ রয়েছে। তাদের ধারণায় খৃষ্টানরা কাফের এজন্য যে, তারা কেবল ঈসা (আঃ)-কেই প্রভূ বলেছে। যদি তারা সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ বলত, তাহ’লে তারা কাফের হ’ত না। বলা বাহুল্য এটাই হ‘ল হিন্দুদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’। বর্তমানে এই আক্বীদাই মা‘রেফাতপন্থী ছূফীদের মধ্যে ব্যপকভাবে প্রচলিত। এদের দর্শন হ‘ল এই যে, প্রেমিক ও প্রেমাষ্পদের মধ্যকার সম্পর্ক এমন হ’তে হবে যেন উভয়ের অস্তিত্বের মধ্যে কোন ফারাক না থাকে’। বলা বাহুল্য ‘ফানাফিল্লাহ’-র উক্ত আক্বীদা সম্পূর্ণরূপে কুফরী আক্বীদা। এই আক্বীদাই বর্তমানে চালু আছে।


সর্বোপরি ইসলামী আক্বীদার সাথে মা‘রেফাতের নামে প্রচলিত সুফীবাদি আকিদার কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম ও সুফিদর্শন সরাসরি সংঘর্ষশীল। সুফিবাদের ভিত্তি হ‘ল আউলিয়াদের কাশ্ফ, স্বপ্ন, মুরশিদের ধ্যান ও ফয়েয ইত্যাদির উপরে। পক্ষান্তরে ইসলামের ভিত্তি হ‘ল আল্লাহর প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে। ছূফীদের আবিস্কৃত তরীকা সমূহ তাদের কপোলকল্পিত। এর সাথে কুরআন, হাদীছ, ইজমায়ে ছাহাবা, ক্বিয়াসে ছহীহ কোন কিছুরই দূরতম সম্পর্ক নেই। ছূফীদের ইমারত খৃষ্টানদের বৈরাগ্যবাদ-এর উপরে দন্ডায়মান। ইসলাম যাকে প্রথমেই দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে (হাদীদ ২৭)। (দ্রঃ দরসে কুরআন, মা‘রেফতে দ্বীন, ২য় বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, জানুয়ারী ১৯৯৯)।

এই ইবনে আরাবীর পথ ধরে সুফিবাদের রঙ্গমঞ্চে আসের মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি, শামতবরেজি, হুসাইন বিন মানসুল হাল্লাজ তারা শুধু আমল আর বিশ্বাস করে খ্যান্ত হননি, লিখুনি দ্বারা সুফিবাদের স্থায়ী ভীত রচন করে গেছেন। এর মধ্যে ইবনে আরাবির “ফতুহাতে মক্কী” জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী শরীফ” অন্যতম।

মন্তব্যঃ সুফিদের মধ্যে যারা হুলূল ও ইত্তেহাদ তথা অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী আক্বীদা পোষণ করে এবং সেমতে আমল করে, যা কুফরীর পর্যায়ভুক্ত। এই সকল আকিদা প্রশণকালী সুফি ইমামের পিছনে জেনে শুনে সালাত আদায় করা সিদ্ধ হবে না। এই সকল সুফিদের সাথে ইসলাম ও মুসলিমের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।  (সর্বোচ্চ ওলামা পরিশদ সৌদি আরর)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে!

  দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে! এক.   শুনতে খারাপ শোনালেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের...