expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Wikipedia

সার্চ ফলাফল

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস ও ইলমে হাদিসের কিছু পরিভাষা

 হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস ও ইলমে হাদিসের কিছু পরিভাষা



সন্মানিত আলেম সমাজের প্রতি শুরুতেই নিবেদন দয়া করে এই লেখায় কোনো পরিভাষাগত ও তথ্যগত ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন সংশোধনের উদ্দেশ্য এবং পাঠকদের নিকট অনুরোধ এটা হাদিস পাঠকে সহজ বোধ্য করার জন্য সংক্ষিপ্ত বিবরন, এই লেখা কোনো আলেম সমাজের ভুল ধরা কিংবা কারো প্রতি চ্যালেঞ্জ করার জন্য নয়। আমার লেখায়ও অনেক অজানা ভুল থাকতে পারে, তবে ভুল সংশোধনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।

সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) উম্মতের প্রথম শ্রেণীর লোক। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীসের সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারের নির্দেশকে কিভাবে গ্রহণ করেছেন তা উপলদ্ধি করার জন্য প্রথমেই জানা আবশ্যক যে, তাঁর প্রতি তাঁদের ভক্তি শ্রদ্ধা কেমন ছিল। বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) দের ভক্তি-শ্রদ্ধার নযীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায়ই কেবলমাত্র তাঁর হাদীসের সংরক্ষণ এবং প্রচার ও প্রসারে তৎপর ছিলেন না; বরং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁদের এই তৎপরতা আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এ সময়ে কোন কোন সাহাবী অপর সাহাবীর নিকট হতে হাদীস সংগ্রহ করার জন্য শত শত মাইল পর্যন্ত সফরের কষ্ট স্বীকার করতেন। অথচ সেকালের সফর এ কালের সফরের ন্যায় এত সহজ ছিল না।

নবুওয়াতের প্রথম যুগে কুরআনের সাথে হাদীস মিশ্রিত হওয়ার আশঙ্কায় হাদীস লিপিবদ্ধ করার অনুমতি ছিল না। এজন্য সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে নিজেদের স্মৃতি শক্তির উপরেই নির্ভর করতেন। তাঁদের স্মৃতি শক্তিও ছিল অসাধারণ। সেকালের আরবগণ বিরাট বিরাট কাব্যগ্রন্থ সহজেই মুখস্ত করে ফেলত। আরবী সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুখস্ত না করে কোন কিছু লিখে রাখা তারা লজ্জাকর বলে মনে করত। আরবের একজন সাধারণ লোক পর্যন্ত শত শত কবিতা, বক্তৃতা এবং বিরাট বিরাট নসবনামা (বংশক্রম) মুখস্ত করে রাখত। তাদের স্মৃতি শক্তি এতই সতেজ ছিল। সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) এবং পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ অনেকেই হাজার হাজার হাদীস মুখস্ত করে রাখতেন। প্রকৃত পক্ষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি জীবনের এমন কোন ঘটনা নেই যার অনুসন্ধান সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) করেন নি এবং তা হেফয করে রাখেন নি। আর এটা তাঁদের আগ্রহ ও স্মরণশক্তির তুলনায় কঠিন কিছুই ছিল না।

হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মৃত্যুর পর হতে হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শত বছরকাল সময়কে তিনটি যুগে ভাগ করা যায়। এ সময়ে কখন কিভাবে হাদীস সংরক্ষণ করা হয়েছে তার বিবরণ অতি সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হচ্ছেঃ

প্রথম যুগঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগ হতে হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকাল হাদীস সংরক্ষণের প্রথম যুগ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগ থেকেই তাঁর প্রতিটি হাদীস বিশেষভাবে সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) বিশেষ তৎপরতার সাথে হাদীস মুখস্ত করে সংরক্ষণের প্রতি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। বিশেষ কারণে এ যুগে ব্যাপকভাবে হাদীস লিপিবদ্ধ করা নিষিদ্ধ থাকলেও সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মধ্যে অনেকেই বিশেষ বিশেষ হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। হাদীস লিখে রাখার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও কোন কোন সাহাবীকে তিনি হাদীস লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখাপড়া জানা অনেক সাহাবীই হাদীস লিখে নিতেন। অনেকের নিকট বিভিন্ন বিষয়ের হাদীস লিখিত আকারে ছিল। এতদ্ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিভিন্ন লিখিত ফরমানও অনেকে সংরক্ষণ করে রাখতেন। সমকালীন রাজা-বাদশাহ এবং আমীর-উমরাদের নিকট লিখিত পত্রগুলিও সংরক্ষিত ছিল। মুসলিম সেনাপতি এবং শাসকদেরকেও তিনি লিখিত নির্দেশ প্রদান করতেন।

বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আমল হতেই হাদীস লেখার কাজ শুরু হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আবু হোরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু), জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আয়েশা সিদ্দীকা (রাযিয়াল্লাহু আনহা), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), সামুরা ইবনে জুনদুব (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আনাস ইবনে মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু), সাআদ ইবনে উবাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর নিকট লিখিত ও সংরক্ষিত কয়েক হাজার হাদীস ছিল। যা পরবর্তীতে মুসনাদে আহমদ, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থাবলীতে সংকলিত হয়েছে।

এ যুগে পবিত্র কুরআনের ন্যায় গুরুত্ব সহকারে হাদীস লিপিবদ্ধ না হলেও শক্তিশালী তিনটি সূত্রের মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষিত হয়ে এসেছেঃ

 (১) উম্মতের নিয়মিত আমল, 
(২) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর লিখিত ফরমান, সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সংরক্ষিত হাদীস ও পুস্তিকা এবং 
(৩) হাদীস কণ্ঠস্থ করে স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চয় এবং পরে বর্ণনা ও অধ্যাপনার মাধ্যমে লোক পরম্পরায় তা প্রচার। বস্তুতঃ মদীনা মুনাওয়ারা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনের শেষ দশ বছরের কর্মস্থল। সেখানে তিনি নিজেই ইসলামী সমাজ গঠন করেছিলেন। সেখানে তাঁর প্রত্যেকটি নির্দেশ হুবহু মেনে চলার মত এমন একদল সাহাবী প্রস্তুত ছিলেন, যাঁরা জীবনপণ করে হলেও যথাযথভাবে তাঁর নির্দেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সুতরাং মদীনার মুসলিম সমাজের আমলও হাদীসের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

হাদীস সংরক্ষণের এ প্রথম যুগে সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর অনেকেই জীবিত ছিলেন। এ যুগে ৪টি পদ্ধতিতে হাদীসের সংরক্ষণ করা হয়-
 (১) হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ ও হিফযকরণ, 
(২) হাদীসের লিখন, 
(৩) হাদীসের শিক্ষাদান এবং 
(৪) হাদীস মুতাবিক আমল-আচরণ।


দ্বিতীয় যুগ:
হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথম হতে তৃতীয় শতকের প্রথম পর্যন্ত অর্থাৎ এক শতাব্দীকাল সম্ভ্রান্ত তাবেয়ী এবং তাবে' তায়েবীগণের যুগ। এ যুগে হাদীস অনুযায়ী আমল করার রীতি বরাবর অব্যাহত থাকে এবং হাদীসের জ্ঞানার্জন, শিক্ষাদান, হিফযকরণ ও লিপিবদ্ধকরণের উৎসাহ-উদ্দীপনা বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এ যুগে কোন কোন ব্যক্তি এক একটি হাদীস জানার জন্য তৎকালীন হাদীসের কেন্দ্রভূমি মদীনা, বসরা, কৃষ্ণা, সিরিয়া এবং মিশর সফর করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এ যুগের প্রথম দিকে খলীফাতুল মুসলেমীন উমর বিন আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) সরকারীভাবে স্বীয় পরিচালনাধীনে হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করে একত্রিত করার কাযে অগ্রসর হন। তিনি ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ করার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের বিশিষ্ট কর্মচারী, প্রখ্যাত উলামাদের প্রতি সরকারী ফরমান জারী করে বলেনঃ

"আপনারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীস তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করুন এবং লিপিবদ্ধ করুন। আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, উলামায়ে কিরামের মৃত্যুর পর হাদীস বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। হাদীসের জ্ঞান-ভাণ্ডারের সংরক্ষক সাহাবায়ে কিরামগণ এবং সম্ভ্রান্ত তাবেয়ীগণ ইহজীবন ত্যাগ করে বিদায় গ্রহণ করছেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীস ব্যতীত অন্য কারোও হাদীস আপনারা গ্রহণ করবেন না। অধিকন্তু আপনারা সর্বত্র মজলিস কায়েম
 করে হাদীস শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যাতে অনবহিত লোকেরা অবহিত হতে পারে। কেননা জ্ঞানের বিষয় গোপন করে রাখা হলে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।"

এ সরকারী ফরমানের ফলশ্রুতিতে সারা দেশে হাদীস সংগ্রহ করার ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উলামাগণ হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার কাজে উঠে পড়ে লেগে যান। এ যুগে হাদীস নিয়মিতভাবে গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজ আরম্ভ না হলেও যে সকল হাদীস সাহাবায়ে কিরামগণের নিকট লিখিত আকারে ছিল না, তা তাঁরা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ তাবেয়ীগণ লিখে ফেলেন এবং সেগুলোর পঠন ও পাঠনের সিলসিলা চলতে থাকে। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরু হতেই এই প্রচষ্টা একটা নতুন মোড় গ্রহণ করে। সম্ভ্রান্ত তাবেয়ীগণের লিখিত হাদীসসমূহ ব্যাপকভাবে একত্রিত করতে থাকেন। হিজরী দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাদীস সংকলনের এই ধারা অব্যাহত থাকে।

সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর পক্ষে সনদবিহীন হাজার হাজার হাদীস হিফয করা কোন কঠিন ব্যাপার ছিল না; কিন্তু পরবর্তী যুগে সনদ মুখস্ত করা অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়ায় হাদীস হিফয করা কিছুটা কঠিন হয়ে উঠলেও হাদীসসমূহ সংকলিত এবং গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত মুসলিম জাহানে, আরবে আজমে এমন এমন তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের স্মরণশক্তির কথা শুনলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। আল্লামা হাফেয ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী প্রণীত বিশ্ববিখ্যাত রিজালগ্রন্থ 'তাযকিরাতুল হুফ্ফায' পাঠ করলে হাফেযুল হাদীস উলামাগণের বৃত্তান্ত জানতে পারা যায়।

তৃতীয় যুগ:

হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম হতে পঞ্চম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রায় তিন শতবৎসর হাদীস সংকলনের ইতিহাসের তৃতীয় যুগ। এ যুগটি সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত। এ যুগকে হাদীস সংকলনের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা যায়। এ যুগে হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ, হাদীসের শিক্ষাদান, হাদীস হিফযকরণ এবং হাদীস মোতাবেক আমল- আচরণের ধারা পূর্বানুরূপ অব্যাহত থাকে। তবে হাদীস লিপিবদ্ধকরণের ধারা অত্যন্ত জোরদার হয়ে ওঠে। এ যুগে অসংখ্য হাফেযে হাদীসের জন্ম হয়, যাঁদের নযীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ যুগে অগণিত হাদীস সংকলকের আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের সংকলিত গ্রন্থাবলী পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহরূপে পরিগণিত হয়। এ যুগেই সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি বিশ্ববিখ্যাত হাদীস গ্রন্থাবলীর স্বনামধন্য গ্রন্থকার মণ্ডলীর আবির্ভাব ঘটে। এ যুগেই সকল হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট হতে হাদীস সংগৃহীত হয়ে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়। অতঃপর এমন কোন হাদীস কারোও এ যুগে সংগৃহী কাজও নিকট সংরক্ষিত হয়েছে বলে অনুমান করা যায় না- যা কোন না কোন হাদীসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়নি।


এ যুগে নিয়মিতভাবে হাদীস লিপিবদ্ধ করার কাজ ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। এ যুগে সংগৃহীত হাদীসের বিপুলভান্ডার হতে সহীহ ও নির্ভুল হাদীস বাছাই এবং ছাঁটাইয়ের কাজও শুরু হয়। ইতিমধ্যে একদল লোক মিথ্যা ও মনগড়া হাদীস বর্ণনা করতে শুরু করলে হাদীস ছাঁটাই ও বাছাইয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে এধরণের মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। সহীহ হাদীস বাছাই করে যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এ যুগের মুহাদ্দিসগণ "আসমাউর রিজাল" শাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। বর্ণনাকারীগণের অবস্থা, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র ও কথা-কাজ সম্বলিত জীবনীকে "আসমাউর রিজাল" বা রিজাল শাস্ত্র বলা হয়।

রিজাল শাস্ত্রে হাদীস বর্ণনাকারীদের অবস্থা, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র, কথা-কাজ কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয়নি। যে সকল হাদীস শাস্ত্রবিদদের নির্ধারিত মূলনীতি বিরোধী সেগুলোকে নিঃসঙ্কোচে বাতিল করা হয়েছে। যে সকল বর্ণনাকারী জীবনে কখনও মিথ্যাচরণ করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং তাদের বিবেকের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়েছে, যারা এতটুকু অতিরঞ্জন প্রবণ মনে করা হয়েছে, যারা রাজশক্তি বা অন্য কোন পার্থিব শক্তি কর্তৃক প্রভাবিত হতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়েছে, তাদের উক্তি নির্দ্বিধায় বাতিল করা হয়েছে। রিজাল শাস্ত্রে হাদীস বর্ণনাকারীগণের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন, তাদের লেখাপড়া ও পান্ডিত্য, তাঁদের শিক্ষকমন্ডলীর বিদ্যাবুদ্ধি, তাঁদের শিষ্যবর্গের অবস্থা, জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁদের পরিশ্রম ও সফর, তাঁদের নৈতিক চরিত্র, তাঁদের সততার ব্যাপারে হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতামত ইত্যাদি বহু বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে।


এ যুগে একদিকে যেমন হাদীস যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলতেছিল, অন্যদিকে তেমনি সহীহ হাদীসসমূহ নিয়মিতভাবে লিপিবদ্ধ করার কাজও পুরোপুরি চলতেছিল। হাদীস লিপিবদ্ধ করার এ কাজটি এ যুগেই অত্যন্ত ব্যাপক আকারে সুসম্পন্ন হয়েছিল। শত শত মুহাদ্দিস নিজেদেরকে একাজে নিয়োজিত করেছিলেন। হাদীস সংগ্রহের জন্য তাঁরা হাজার হাজার মাইল সফর করতেন। তাঁরা শত শত উস্তাদগণের নিকট হতে পাঠ গ্রহণ করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীদের অবস্থা জানার জন্যও অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের মান অনুযায়ী হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। সত্য কথা এই যে, আমাদের মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য যা করেছেন, অন্য কোন জাতি তাদের আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব রক্ষার জন্য তার এক শতাংশ পর্যন্ত করতে পারেনি। প্রাচ্য বিদ্যাবিশারদ ডক্টর মার্গেলিউ সত্য বলেছেনঃ "হাদীসের জন্য মুসলিম জনতা যত ইচ্ছা গর্ব করতে পারে; এটা তাদের পক্ষেই শোভা পায়।"

এ যুগের হাদীস সংকলক মন্ডলীর মধ্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছেন- ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী, ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ নিশাপুরী, ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী, ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী, ইমাম আহমদ বিন শুআইব নাসায়ী এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইয়াযীদ বিন মাযাহ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসীনগণ রাহেমাহুমুল্লাহু তায়ালা আজমাঈন।

ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী, ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ নিশাপুরি এবং আরও অনেকে হাদীস যাচাই ও বাছাইয়ের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা তাঁদের সমগ্র জীবন এ মহৎ কাজে ব্যয় করেন। নির্ভুল ও শক্তিশালী সূত্রের দিক দিয়ে বিচার করলে মুহাদ্দিসগণের সংকলিত হাদীস গ্রন্থাবলীর মধ্যে মুয়াত্তা ইমাম মালিক, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমকে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করা যায়।

ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী (রাহেমাহুল্লাহ) হাদীস শাস্ত্রের বিশ্ব সম্রাট মহামতি ইমাম বুখারীর আসল নাম মুহাম্মাদ। তাঁর পিতার নাম ইসমাঈল। তাঁর ডাক নাম আবূ আব্দুল্লাহ। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ মুগীরা ইসলাম গ্রহণপূর্বক পারস্য হতে খোরাসানের বুখারা শহরে আগমন করে বসতি স্থাপন করেন।

ইমাম বুখারী হিজরী ১৯৪ সালের ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ জুম'আ বুখারা নগরে নাগ্রহণ করেন। শৈশব হতেই তাঁর উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত দেখা গিয়েছিল। ব তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সেজন্য তাঁর মহীয়সী মাতা আল্লাহর নিকট দু'আ থাকেন। একদিন তিনি আল্লাহর দোস্ত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে দেখতে পান। স্বপ্নযোগে তিনি তাঁকে বললেন, তোমার প্রাণঢালা দু'আ এবং করুণ কান্নার দরুণ আল্লাহ তোমার পুত্রধনের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। নিদ্রাভঙ্গের পর মাতা দেখলেন, স্বপ্ন সত্যরূপেই বাস্তবায়িত হয়েছে, তাঁর পুত্র বালক মুহাম্মাদ দৃষ্টিশক্তি লাভ করেছেন।

ইলমে হাদীসের কতিপয় পরিভাষা

পরিচিতি ও মান নির্ণয়:

১। হাদীসঃ শাব্দিক অর্থে হাদীস শব্দের অর্থ কথা, প্রাচীন ও পুরাতনের বিপরীত বিষয়। পরিভাষায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন, তাকে হাদীস বলে। এ হিসাবে হাদীসকে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ কাওলী হাদীস, ফেলী হাদীস ও তাকরীরী হাদীস।

প্রথমতঃ কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা বলেছেন, অর্থাৎ যে হাদীসে তাঁর কোন কথা উদ্ধৃত হয়েছে, তাকে কাওলী হাদীস বলে। দ্বিতীয়তঃ যে হাদীসে তাঁর কোন কাজের বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে তাকে ফেলী (কর্মমূলক) হাদীস বলে। তৃতীয়তঃ সাহাবীগণের যেসব কথা ও কাজ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুমোদন ও সমর্থনপ্রাপ্ত তাকরীরী (সমর্থনমূলক) হাদীস বলে।

২। খবরঃ খবর শব্দের অর্থ সংবাদ, এর তিনটি পরিভাষা রয়েছে। (ক) এটি হাদীসের মুরাদিফ অর্থাৎ খবর ও হাদীসের পরিভাষা একই। 
(খ) হাদীস বলা হয় যা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে এসেছে আর যা অন্যদের থেকে এসেছে তাকে )খবর বলে। 
(গ) যা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে এসেছে তাকে হাদীস বলে আর খবর বলা হয় যা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে এবং অন্যদের থেকে এসেছে।

৩। আসারঃ 
আসরের শাব্দিক অর্থ অবশিষ্ট থাকা। এর দু'টি পরিভাষা রয়েছে। (ক) এটা হাদীসের মুরাদিফ অর্থাৎ হাদীস ও আসারের পরিভাষা একই। (খ) সাহাবা ও তাবিঈনদের কথা এবং কার্যবলীকে আসার বলা হয়।

৪। সাহবীঃ 
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সহচার্য লাভ করেছেন বা তাঁকে জীবনে একবার দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে সাহাবী বলে।

৫। তাবেঈঃ 
যিনি ঈমানের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কোন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে তাকে দেখেছেন এবং মুসলিম হিসাবে মৃতুবরণ করেছেন, তাকে তাবেঈ বলে।

৬। সানাদঃ 
যে সুত্র পরস্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে সানাদ বলে। এতে হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে।

৭। মাতানঃ 
হাদীসের মূল কথা ও তার শব্দসমষ্টিকে মাতান বলে।

৮। মুহাদ্দিসঃ 
যে ব্যক্তি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সানাদ ও মাতান সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তাকে মুহাদ্দিস বলে।

৯। শাইখঃ 
হাদীসের শিক্ষাদাতা রাবীকে শাইখ বলে।

১০। শাইখানঃ 
সাহাবীগণের মধ্যে আবু বকর ও উমর (রাযিআল্লাহু আনহুমা) কে একত্রে বলা হয়; কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহঃ) কে একত্রে শাইখাইন বলা হয়।

১১। রাবীঃ 
যিনি হাদীস বর্ণনা করেন তাকে রাবী বা বর্ণনাকারী বলে।

১২। রিজালঃ 
হাদীসের রাবী সমষ্টিকে রিজাল বলে। যে শাস্ত্রে রাবীগণের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে আসমাউর রিজাল বলে।

১৩। রিওয়ায়াতঃ 
হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে।

১৪। মুতাওয়াতিরঃ 
যে হাদীস প্রতিটি যুগে এত অধিক সংখ্যক রাবী বর্ণনা করেছেন যাদের প্রতি মিথ্যার উপর একত্রিত হওয়া অসম্ভব। এরূপ বর্ণিত হাদীসকে মুতাওয়াতির বলা হয়।

১৫। আহাদঃ 
মুতাওয়াতির পর্যায়ের নয় এবং যার মধ্যে মুতাওয়াতিরের শর্ত একত্রিতভাবে পাওয়া যায় না তাকে আহাদ বা খবরে ওয়াহিদ বলে। খবরে ওয়াহিদ তিন প্রকারঃ

(ক) মাশহুরঃ 
যে হাদীস প্রতিটি যুগে তিনজন বা তার অধিক রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে মাশহুর হাদীস বলে। ঐরূপ হাদীসকে মুস্তাফীযও বলা হয়।

(খ) আযীযঃ 
যে হাদীস প্রতি যুগে দু'জন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে আযীয বলে।

(গ) গারীবঃ 
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কোন যুগে বা স্থানে মাত্র একজন রাবী বর্ণনা করলে তাকে গারীব বলে।


১৬। হাদীসে কুদসীঃ যে হাদীস নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন তাকে হাদীসে কুদসী বলে।


১৭। মারফুঃ 
যে সানাদের ধারাবাহিকতা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝখান থেকে কোন রাবীর নাম বাদ পড়ে নি তাকে মারফু হাদীস বলে।

১৮। মাশহুর আযীয ও গারীবঃ এ সকল হাদীস গ্রহণ ও বর্জন দু'প্রকারঃ 
(ক) মাকবুল
 (খ) মারদুদ।

মাককূল হাদীস চার প্রকারঃ

(ক) সহীহ লিযাতিহিঃ যে হাদীস সানাদের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পারয়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং পূর্ণাঙ্গ আয়ত্বশক্তি ও হিফযের গুণাবলী সম্বলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শায এবং ত্রুটিবিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয় 'সহীহ হাদীস'। এটিকে 'সহীহ লিযাতিহি'ও বলা হয়।

(খ) হাসান লিযাতিহিঃ যে হাদীস সানাদের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং কিছুটা ত্রুটিযুক্ত আয়ত্বশক্তি ও হিফযের গুণাবলী সম্বলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শায এবং ত্রুটিবিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয় 'হাসান হাদীস'। এটিকে 'হাসান লিযাতিহি'ও বলা হয়।

(গ) সহীহ লিগাইরিহিঃ 
(অন্যের কারণে সহীহ): এটি মূলত হাসান লিযাতিহি; কিন্তু হাসানের একাধিক সূত্র পাওয়া গেলে, সে সময় হাসান হতে সহীহার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তবে এর স্তরটি 'সহীহ লিযাতিহি'র চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের।

(ঘ) হাসান লিগাইরিহি (অন্যের কারণে সহীহ: এটি মূলত দুর্বল হাদীস; কিন্তু যখন তা একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয় এবং হাদীসটির বর্ণনাকারী ফাসিক বা মিথ্যার দোষে দুষিত হবার কারণে দুর্বল না হয়, তখন এটি অন্যান্য সূত্রগুলোর কারণে 'হাসান'-এর পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। তবে এর স্তরটি 'হাসান লিযাতিহি'র চেয়ে নিম্ন সহীহ আল-বুখারী (প্রথম খণ্ড)

১৯। মাওকুফঃ 
যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র উর্দ্ধদিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ যে সানাদ সূত্রে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে, তাকে মাওকুফ হাদীস বলে। এর অপর নাম আসার।

২০। মাকতুঃ 
যে হাদীসের সানাদ কোন তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাকতু হাদীস বলে।

২১। যঈফঃ 
যে সানাদে হাসান হাদীসের গুণাবলী একত্রিত হয় নি, হাসান- এর সানাদের শর্তগুলোর যে কোনটি অনুপস্থিত থাকার কারণে, সে সানাদের হাদীসটিকে 'যঈফ' বলা হয়।

এই 'যঈফ'-এর স্তরগুলো বিভিন্ন হতে পারে বর্ণনাকারীর মাঝের দুর্বলতা কম বেশি হবার কারণে। (যেমনভাবে সহীহ হাদীসের স্তরে পার্থক্য রয়েছে বর্ণনাকারী নির্ভরশীল হওয়ার কারণে)। দুর্বলের প্রকারগুলোর মধ্যে রয়েছে- যঈফ, যঈফ জিদ্দান (নিতান্তই দুর্বল), ওয়াহিন, মুনকার, মুযতারিব, মু'যাল, মুরসাল মু'য়াল্লাক ইত্যাদি। তবে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট প্রকার হচ্ছে মাওযু' (জাল)।

২২। তালীকঃ 
কোন কোন গ্রন্থকার কোন হাদীসের পূর্ণ সানাদকে বাদ দিয়ে কেবল মূল হাদীসটিই বর্ণনা করেছেন। এরূপ করাকে তালীক বলে। কখনো কখনো তালীকরূপে বর্ণিত হাদীসকেও 'তালীক' বলে। ইমাম বুখারী (রহঃ) এর সহীহ গ্রন্থে এরূপ বহু 'তালীক রয়েছে'; কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে যে, বুখারীর সমস্ত তালিক অপর সংকলনকারীগণ মুত্তাসিল সানাদে বর্ণনা করেছেন।

২৩। মুনকাতিঃ 
যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানের কোন এক স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি হাদীস বলে। আর এই বাদ পড়াকে বলে ইনকিতা।

২৪। মুদাল্লাসঃ 
যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শাইখ (উস্তাদ) এর নাম উল্লেখ না করে তার উপরস্থ শাইখের নামে এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উপরস্থ শাইখের নিকট তা শুনেছেন, অথচ তিনি তার নিকট সেই হাদীস শুনেন নাই, সে হাদীসকে হাদীসে মুদাল্লাস বলে এবং এমনরূপ করাকে 'তাদলীস' বলে। আর যিনি এমনরূপ করেন তাকে মুদাল্লিস বলে।

২৫। মুযতারাবঃ 
যে হাদীসের রাবী হাদীসের মতন বা সানাদকে বিভিন্ন প্রকার গোলমাল করে বর্ণনা করেছেন, সে হাদীসকে হাদীসে মুযতারাব বলে।

২৬। মুদরাজঃ 
যে হাদীসের মধ্যে রাবী নিজের অথবা অপরের উক্তিকে প্রক্ষেপ করেছেন, সে হাদীসকে মুদরাজ বলে এবং এমনরূপ করাকে ইদরাজ বলে। ইদরাজ হারাম, অবশ্য যদি এ দ্বারা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশ করা হয় এবং একে মুদরাজ বলে সহজে বুঝা যায়, তবে তা দোষণীয় নয়।

২৭। মুত্তাসিলঃ 

যে হাদীসের সানাদের ধারাবাহিকতা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই রাবীর নাম বাদ পড়ে নি, তাকে মুত্তাসিল বলে।

২৮। মু'যালঃ 
যে হাদীসের সানাদ থেকে পরপর দুইজন রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে 'হাদীসে মু'যাল' বলা হয়।

২৯। মুসনাদঃ 
যে হাদীসের সানাদ (কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতা ব্যতীতই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মুসনাদ বলা হয়। আমাদের নিকট পৌঁছার দিক দিয়ে হাদীস দু'প্রকার মুতাওয়াতির ও আহাদ।

৩০। মুরসালঃ 
যে হাদীসের সনদে সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবিঈ সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নামোল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাকে মুরসাল হাদীস বলে।

৩১। মুতাবি ও শাহিদঃ 
এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসটিকে প্রথম রাবীর হাদীসটির মুতাবি বলে, যদি উভয় হাদীসের মূল রাবী (অর্থাৎ সাহাবী) একই ব্যক্তি হন। আর এমনরূপ হওয়াকে মুতাবাআত বলে। যদি মূল রাবী একই ব্যক্তি না হন তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীসকে শাহিদ বলে। আর এমন রূপ হওয়াকে শাহাদাত বলে। মুতাবাআত ও শাহাদাত দ্বারা প্রথম হাদীসটির শক্তি বা প্রমাণ্যতা বৃদ্ধি পায়।

৩২। মুনকারঃ 
দুর্বল বর্ণনাকারী কর্তৃক নির্ভরশীল বর্ণনাকারীর বিরোধিতা করে বর্ণনা করাকেই বলা হয় মুনকার হাদীস। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

অন্য ভাষায় মুনকার বলা হয় সেই হাদীসকে যার সানাদে এমন এক বর্ণনাকারী আছেন যার বেশি ভুল হয় বা যার অসতর্কতা বৃদ্ধি পেয়েছে কিংবা পাপাচার প্রকাশ পেয়েছে।

৩৩। শাযঃ 
যে হাদীসটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তার মতই একাধিক বা তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তির বিরোধিতা করে বর্ণনা করেছে সেটিকে বলা হয় 'শাষ'। এরূপ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

৩৪। মাজহুলঃ 
যে বর্ণনাকারীর সত্ত্বা বা গুণাবলী সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না তাকেই বলা হয় 'মাজহুল'। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।


৩৫। মু'যালঃ 
যে সানাদের দুই বা ততোধিক বর্ণনাকারী পর্যায়ক্রমে উল্লেখিত হয় নি সেই সানাদের হাদীসকে বলা হয় 'মুযাল'। এরূপ হাদীস দুর্বলের পর্যায়ভুক্ত গ্রহণযোগ্য নয়।

৩৬। মাওযুঃ 
যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নামে মিথ্যা কথা রচনা করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদীসকে মাওযু বা বানোয়াট বা জাল হাদীস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

৩৭। মাতরূকঃ 
যে হাদীসের রাবী হাদীসের ক্ষেত্রে নয়; বরং সাধারণ কাজ-কর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে বলে খ্যাত, তার বর্ণিত হাদীসকে মাতরূক হাদীস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসও পরিত্যাজ্য।

৩৮। মুবহামঃ 
যে হাদীসের রাবীর উত্তম রূপে পরিচয় পাওয়া যায় নি, যার ভিত্তিতে তার দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে, এরূপ রাবীর বর্ণিত হাদীসকে মুবহাম হাদীস বলে। এই ব্যক্তি সাহাবী না হলে তার হাদীসও গ্রহণযোগ্য নয়।

৩৯। মুআল্লালঃ 
যে হাদীসের ভেতর অত্যন্ত সূক্ষ্ম ত্রুটি থাকে যা হাদীসের সাধারণ পণ্ডিতগণ ধরতে পারে না, একমাত্র সুনিপণ শাস্ত্র বিশারদ ব্যতিরেকে। এই প্রকার হাদীসকে মুআল্লাল বলে। এরূপ ত্রুটিকে 'ইল্লত' বলে। 'ইল্লত' হাদীসের পক্ষে মারাত্মক দোষ, এমনকি 'ইল্লত' যুক্ত হাদীস সহীহ হতে পারে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে!

  দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে! এক.   শুনতে খারাপ শোনালেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের...