"ইসলামি দৃষ্টিকোণে ফ্রিম্যাসন ও তার অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হওয়া জায়েজ নয়"
আল-মাজমাউল ফিকহিল ইসলামির ফতোয়াঃ
আল-মাজমাউল ফিকহির গবেষকবৃন্দ ফ্রিম্যাসন নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন। এরপর তাদের সম্পর্কিত লেখাজোখা, প্রাপ্ত নতুন-পুরাতন বইপত্র, প্রকাশিত নথিপত্র, ফাঁস হওয়া চিঠিপত্রসমূহ বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তাদের সেই দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনায় সামগ্রিক যেই চিত্রটি ফুটে উঠেছে, তার সারসংক্ষেপ এমন—
এক.
ফ্রিম্যাসন হলো আগাগোড়া গুপ্ত একটি গোষ্ঠী। অঞ্চল ও পরিস্থিতিভেদে কখনো তারা নিজেদের সাংগঠনিক পরিচয়কে লুকিয়ে রাখে। কখনো বা প্রকাশ করে; তবে তাদের মৌলিকতা গোপনয়ীতা রক্ষা করেই চলা। এমনকি কখনো খোদ ম্যাসনরাই আপন সংঘের হালহাকিকত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে।
দুই.
ম্যাসনদের আত্মপরিচয় হলো, তারা ভ্রাতৃত্ববাদী। ভ্রাতৃত্ববোধ এমন এক চেতনা, যা সমস্ত মত-পন্থা, ধর্ম-বর্ণ, দেশ-অঞ্চলকে ফিকে করে দেয়।
তিন.
ম্যাসনরা ব্যক্তিগত স্বার্থের লোভ দেখিয়ে জনগণকে লজমুখী করে থাকে। তাদের বলা হয়, যে যেখানেই থাকুক না কেন, এক ম্যাসন আরেক ম্যাসনের পাশে দাঁড়াবে। তার প্রয়োজন উদ্ধার করবে। তার অভিপ্রায় পূরণ করবে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসন, বা যেকোনো সংকট মোকাবিলায় কাঁধে কাঁধ রেখে একে অপরকে সাহায্য করে যাবে। কে জালেম আর কে মাজলুম—এটা দেখা হবে না। মুখ্য ওই সহযোগিতাই ।
চার.
লজের ছাড়পত্র পেতে একজন সদস্যকে ভুতুরে কায়দায় উদ্ভট সব কৃত্য পালন করে প্রথমে মুরুব্বিদের আস্থা অর্জন করতে হয়। শুরুতে ওসব কাণ্ড-কারখানা করে তাকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, আইন আমনা করলে তার আর রক্ষা হবে না ।
পাঁচ.
নিম্ন ডিগ্রির সাধারণ সদস্যদের প্রথমে আপন ধর্মীয় রুসুম-রেওয়াজ পালন করতে সুযোগ দেওয়া হয় ঠিকই; তবে তা হুমকিমুক্ত পরিসরে। পাশাপাশি তখন লজের নানা দিক-নির্দেশনা ও শিক্ষাও চলতে থাকে; তবে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারীরা খোল্লামখোলা নাস্তিক হয়ে থাকে। এই নাস্তিকতার পর্যায়ে যেতে হয় ধীরে ধীরে, লজের আচার-আচরণ ও মতবাদগুলো আত্মস্থ করার পর।
ছয়.
সোজা কথা, ফ্রিম্যাসন হলো একটি রাজনৈতিক সংগঠন। বিশ্ব জুড়ে গঠিত নানা রাজনৈতিক ও সামরিক অভ্যুত্থানে তাদের দৃশ্য ও অদৃশ্য হাত ছিল ।
সাত.
মৌলিকতা ও গঠনতন্ত্রে ফ্রিম্যাসন হলো ইহুদিবাদী। চিন্তাচেতনায় জায়োনবাদী। বৈশ্বিক অদৃশ্য সুপার গভর্নমেন্টের অংশ মাত্র ফ্রিম্যাসন।
আট.
ফ্রিম্যাসনের মূলমন্ত্র হলো সকল ধর্মীয় শক্তিকে অপসরাণ করতে হবে। বিশেষভাবে ইসলামি শক্তি । নয়. পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, ধানাঢ্য শিল্পপতি, জাঁদরেল জ্ঞানীগুণী
নয়
মানুষ সর্বদাই ম্যাসনদের শিকারের বস্তু। সমাজের মিসকিন শিবিরের দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। বহু রাষ্ট্রনায়ক, সরকারি আমলা-মন্ত্রী, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশিষ্টরা ফ্রিম্যাসনের গর্বিত সদস্য ছিল।
দশ.
সময়ে সময়ে ছদ্মবেশে তাদের কার্যক্রম চালাতেও দেখা গেছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে তারা নানা নামে, নানা পরিচয় ধারণ করে থাকে। ম্যাসনবাদী অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রোটারি, লায়ন্স ইত্যাদি নাস্তিক্যবাদী সংগঠন।
এগারো.
গোষ্ঠীটির সামগ্রিক রূপকে সামনে রেখে আমরা এ সিদ্ধান্ত দিতে পারি যে, বিশ্বব্যাপী জায়োনবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ফ্রিম্যাসনের গভীর যোগসাজশ রয়েছে। জায়োনিস্টরা ফিলিস্তিন সংকটে ম্যাসনদের ব্যবহার করেই অধিকাংশ আরব-অনারব রাষ্ট্রে তৎপরতা চালিয়ে থাকে।
জায়োনবাদী চিন্তাচেতনা, ভয়াবহ মতবাদ, প্রতারণামূলক স্বভাব এবং অজানা দূরভিসন্ধির কারণে আল-মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছে যে,
√ক. ফ্রিম্যাসন হলো ইসলাম-বিধ্বংসী ইহুদিবাদী সংগঠন।
√খ. কোনো মুসলিম ফ্রিম্যাসনের বাস্তবতা এবং উদ্দেশ্য জানা সত্ত্বেও সদস্য পদ গ্রহণ করে থাকলে সে কাফের হয়ে যাবে (ফাতাওয়ি ইসলামিয়্যা বিন রাজ, বিন উসাইমিন, আবদুল্লাহ আল-জিবরিন: ১/১৫০-১৫২)
জামিআতুল আজহারের ফতোয়া:
শত্রুরা আজ চারিদিক থেকে বস্তু ও চিন্তাগত—সর্ব প্রকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ঘিরে রেখেছে। তারা আসলে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে চায়; তবে চিন্তার কিছু নেই। আল্লাহ তাআলাই মুসলিমদের প্রকৃত সাহায্যকারী এবং ইজ্জতদাতা। যেমনটা তিনি কুরআনে বলেছেন—
الْأَشْهَادُ إِنَّا لَتَنصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيا ويوم يقوم
নিশ্চয় আমি আমার রাসুলদেরকে ও মুমিনদের সাহায্য করব পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দণ্ডায়মান হবে। (সূরা মুমিন, আয়াতঃ ৫১)।
ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ এমন একটি শক্তপোক্ত হাতিয়ার হলো ভ্রাতৃত্ববাদী ও মানবতাবাদী ম্যাসনিক সংগঠনগুলো। এই সমস্ত সংগঠনের রয়েছে গোপন উদ্দেশ্য ও অভিলাষ।
ম্যাসনবাদী বহু অঙ্গ সংগঠন আজ দেশে দেশে খুব তৎপর। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো লায়ন্স ক্লাব, রোটারি ক্লাব ইত্যাদি। গোষ্ঠীগুলোর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে ইহুদি জায়োনিস্টদের। তাদের উদ্দেশ্য হলো, ধর্মীয় শক্তিকে নির্মূলকরণ, চারিত্রিক পদস্খলন সৃষ্টি এবং মানবতার নামে জনগণকে জোটবদ্ধ গুপ্তচর বানিয়ে বৈশ্বিক ক্ষমতার আসনে অধিশ্বর করে তাদেরকে হওয়া।
মুসলিমরা কখনোই এ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত মুসলমানের পক্ষে নৈতিকভাবে কারও চাটুকরিতা করা না; বরং এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিক- অনুসরণের অধিক প্রাধান্যযোগ্য।
তিনি বলেন—
ঠিক এ কারণে না। একজন নির্দেশনাই কেউ যেন চাটুকার না হয়, যে বলবে আমরা মানুষের সঙ্গেই আছি। মানুষ ভালো করলে আমরাও ভালো করব। মানুষ মন্দ করলে আমরাও মন্দ করব; বরং তোমরা হও। মানুষ ভালো করলে তো ভালো করবে তবে মন্দ করলে কখনো মন্দ করতে যেয়ো না আবার মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব হলো, সজাগ দৃষ্টি রেখে তোমাদের স্বেচ্ছাচারী আছে; তাই একজন ঠিক+জামি তিরমিজি ২০০৭)পথ চলতে থাকা। যেন কোনো ধোঁকাবাজ তাকে ধোঁকায় ফেলতে না পারে। মুসলিম সংগঠনের কি অভাব পড়েছে? আমাদের সংগঠনগুলো যেমন প্রকাশ্য। ওগুলোর উদ্দেশ্যও তেমন স্পষ্ট। কেনই-বা আমাদের লুকোচুরি খেলতে হবে? ইসলামে এমন কিছু নেই, যার ব্যাপারে আমরা ভয় করি এবং তা লুকিয়ে বেড়াই।
শাইখ মুহাম্মাদ রশিদ রেজার ফতোয়াঃ
রাজনৈতিক সংগঠন। ইউরোপের আঞ্চলিক দাবি ও তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ইউরোপের মাটিতেই ঠিক এই কারণেই তার গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়েছে। দেখা গেছে, ম্যাসনবাদী মহানায়কদের সর্বদাই কর্তৃত্ববাদীদের হুমকি-ধমকি শুনতে হতো।
ম্যাসনরা চাইত—স্বৈরশাসনের মাথা চূর্ণ করে দিয়ে এমন এক গণতান্ত্রিক ফ্রিম্যাসন একটি
অপরাসণের স্বৈরশাসনের যার সৃষ্টি(আল-মাসুনিয়্যা সারাতানুল উমাম ১২৫-১২৬, আল-মাউসুআতুল মুয়াসসারা: ৫১৭-৫১৮)হতে পারে শোভা পায় তো।
শাসন ব্যবস্থা চালু করা, যেখানে যে কেউ চাইলেই শাসককে বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। ঠিক এ কারণেই ইউরোপে সংঘটিত ফ্রেঞ্চ বিপ্লব, আধুনিকবাদী তুর্কি বিপ্লব, পর্তুগিজ বিপ্লব ——ইত্যাদি রাজনৈতিক বিপ্লবে ফ্রিম্যাসনের গভীর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকবৃন্দ ইহুদি-খ্রিষ্টান মিলিয়েই ফ্রিম্যাসনের আছে; তবে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ববাদী হলো ইহুদিরা। ইহুদিরা তো হবেই। কারণ, ইউরোপে খ্রিষ্টানদের চাইতে ইহুদিরাই বেশি জুলুমের শিকার হয়েছিল। এ কারণে ম্যাসনবাদী রাজনৈতিক অভ্যুত্থান থেকে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে ওই ইহুদিদেরই। ম্যাসনদের হাতে উসমানি সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোর কর্তৃত্ব স্থায়ী হতে পারলে এবং সাম্রাজ্যজনিত সংকট আরও ঘনীভূত হতে থাকলে ওই ইহুদিরাই তুর্কি বিপ্লব থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
বলশেভিক বিপ্লবে প্রভাব সৃষ্টি করতেও ইহুদিরা কম চেষ্টা করেনি আগে থেকেই ইহুদিদের গ্যারাকলে বন্দি ছিল। তাই সহজেই রাজনৈতিক হুলুস্থুল সৃষ্টি করতে পেরেছে প্রাচ্যের মিসর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশগুলোতে ম্যাসনদের নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। কেউ বলেছে, তারা ধর্ম ও রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। প্রাচ্যে শুধু সামাজিক কর্মকাণ্ড চালায় ম্যাসনরা। কেউ আবার বলেছে,তবে রাশিয়ান যুগ যুগ ধরে ম্যাসনরা।
সরকার সেখানে খুব ম্যাসনদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রমাণিত একটা বিষয়। আমি বলি, এ দুটো মতের মাঝে আসলে কোনো বৈপরিত্ব নেই। ব্যাখ্যাটা বলছি, ধর্মীয় অনুশাসনের মূলোৎপাটন করতেই ফ্রিম্যাসনের সৃষ্টি একথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এতদাঞ্চলে ম্যাসনরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলে পরোক্ষভাবে নিশ্চিত জড়িত। যেমন: প্রভাবশালীদের ঐক্যবদ্ধকরণ, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ, তাদেরকে ধীরে ধীরে অধার্মিক বানিয়ে তোলার ফন্দি-ফিকির ইত্যাদি কাজগুলো ম্যাসনরা ঠিকই করে থাকে। ঠিক এ পথ ধরেই ম্যাসনরা প্রাচ্য দেশের নেতৃত্বের অবকাঠামো একদম বদল দিতে চায়। মোটকথা তাদের পরোক্ষ মনোভাব হলো, ধর্মীয় অনুশাসনের গোড়া কেটে ফেলা। যদিও তা যুদ্ধবিগ্রহ অথবা বিপ্লব সৃষ্টির মাধ্যম হোক না কেন।
তাহলে বলা যাচ্ছে, ফ্রিম্যাসন মৌলিকভাবে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। প্রাচ্যে আজ রাজতন্ত্র বা ধর্মীয় সেসব শাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত আছে, সেগুলোকে ধর্মের রং থেকে মুক্ত করাই হলো ম্যাসনদের রাজনৈতিক এজেন্ডা।
লেখক: চিকিৎক,জার্নালিস্ট ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ