পুরুষ মহিলার নামাযের অবশ্যই পার্থক্য : মহিলাদের নামাজ, সালাফ বনাম খালাফ
সতর্কতা : প্রবন্ধটিতে কিছু শাস্ত্রীয় কথা বার্তা রয়েছে, যা সাধারণ পাঠকদের বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। কোথাও না বুঝলে আলেমদের শরণাপন্ন হয়ে বুঝে নিন।
মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ
মহিলাদের নামাজ, পার্থক্য আছে? নাকি পুরুষের মতই?
এই বিষয়ে কিছু লেখার জন্যে বারবার তাগাদা দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়ক একটা রেসালাহ তৈরি করতে গিয়ে অনুভব করলাম এক পর্বে শেষ করা সম্ভব না। তাই, মোট ৪ পর্বে এই বিষয়ক প্রবন্ধটি শেষ করার ইচ্ছা। ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ!
প্রথম পর্বে কিছু উসূল বা মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত আলোচনা থাকছে। কারণ এই মৌলিক নীতিমালার উপর ভর করেই তর্ক বিতর্কের ডালপালা ছড়িয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বে নামাজের পার্থক্য সংক্রান্ত ৪ মাজহাবের দলীল ও পর্যালোচনা।
তৃতীয় পর্বে নামাজের পার্থক্য নেই মর্মে বর্তমান যামানার কিছু মুহাক্কিকদের দাবী, দলীল ও পর্যালোচনা।
চতুর্থ ও শেষ পর্বে, সালাফি আলেমদের মতামত ও অধমের কৈফিয়ত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
মহিলাদের নামাজ, যেভাবে পেলাম…
উম্মাহর নারীরা আজীবন যেভাবে নামাজ পড়ে এসেছে তা শতভাগ পুরুষের মত নয়। এভাবেই আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। সেই সাহাবী থেকে তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ক্রমধারায় কোটি কোটি মুসলিমাহ, পুণ্যবতী নারী নামাজ পড়ে আসছেন। তারপর?
কয়েক বছর আগে, আনুমানিক ২০/৩০ বছর আগে নতুন গবেষণা বের হলো। যার বক্তব্য হচ্ছে “নারী পুরুষের নামাজের কোন পার্থক্য নেই”! গবেষণার কেন প্রয়োজন হলো? কারণ, নতুন গবেষকরা হাদিসের শুদ্ধতা ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের উপর নামাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। তারপর যখন দেখলেন, নারীদের নামাজে যে পার্থক্যগুলো মেনে নামাজ পড়া হয়, সে হাদিসগুলোর সনদ মজবুত নয়। সুতরাং তারা বললেন নামাজে কোন পার্থক্য নেই।
এখানে গোঁড়ায় কিছু প্রশ্ন আসে। আপনারা যদি ‘তাদবীনে হাদিস’ (হাদিস সংকলনের ইতিহাস) নিয়ে পড়ে থাকেন, এই প্রশ্ন এতক্ষণে আপনার মাথায় চলে আসার কথা। আচ্ছা, হাদিসের প্রচলিত কিতাবগুলো লেখা হলো হিজরী ১৫০-২০০ বছর পর। এই হাদিস গ্রন্থগুলোর ভিত্তি করে নামাজকে পুনর্বিন্যাস যদি করা হয়, তাহলে এই গ্রন্থগুলো লেখার আগের যুগে যে সকল সাহাবী/তাবেয়ী/তাবে তাবেয়ী ছিলেন, তারা কীভাবে নামাজ পড়লেন? তখন তো এই কিতাবগুলো লেখা হয় নি। তাহলে নামাজটা শিখলেন কীভাবে? নিশ্চয় কেতাব পড়ে শিখেন নি? সাহাবীরা শিখেছেন, রাসূল সা. থেকে, তারপর তাবেয়ীরা শিখেছেন সাহাবীদের থেকে। নামাজ তো ইতোমধ্যেই পূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। হাদিসের গ্রন্থগুলো লেখার আগেই। সাহাবা থেকে নিয়ে পরবর্তী ৩ প্রজন্ম নামাজ শিখেছে “তা’আমুল ও তাওয়ারুছ” এর মাধ্যমে।
যদি মনে করা হয়, ইমাম বুখারীর বুখারী লেখার আগে কেও সহীহভাবে নামাজ পড়তে পারেন নি। মনগড়া নামাজ পড়েছেন, সুতরাং বোখারী লেখার পর সে নামাজকে বদলানো জরুরী। তাহলে ৪ মাজহাব ও লা মাজহাব এর সবারই একমত হওয়া উচিত, প্রচলিত হাদিসগ্রন্থগুলোর উপর ভিত্তি করে নামাজকে পুনর্বিন্যাস বা শুদ্ধিকরণ জরুরী।
কিন্তু যদি এর বিপরীত হয়, অর্থাৎ সাহাবারা নামাজ শিখেছেন রাসূল সা. থেকে। তারপর তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। সেখানে তারা নামাজ শিখিয়েছেন। তাদের থেকে তাদের ছাত্ররা.. এভাবে যুগ পরম্পরা। সুতরাং তাদের নামাজ ভুল হয় নি। কারণ তাদের নামাজ ছিল রাসূল সা. এরই নামাজ। উত্তর যদি এটা হয়, তাহলে প্রশ্ন হবে, এই নামাজ তো সাহাবাদের নামাজই ছিল। প্রচলিত কিতাবের আলোকে নামাজকে পুনর্বিন্যাস বা পুনরায় তাহকীক এর কি প্রয়োজন আছে?
প্রসঙ্গত না বললেই নয়, পূর্বসূরিদের বহু কিতাব এমন আছে যে এখনো ছাপার হরফে আসে নাই। অনেক পাণ্ডুলিপি আছে যা উদঘাটন করা হয় নাই। আমি যতদূর জানি, শায়খ আব্দুল মালিক হাফিজাহুল্লাহ ‘তাহকীকু তুরাছ’ বিষয়ে কাজ করছেন। হানাফী মাজহাবের প্রাণকেন্দ্র ছিল বাগদাদ নগরী। সেই বাগদাদ যখন তাতারিদের দ্বারা আক্রান্ত হলো, তখন পুরো নগরীর কিতাবগুলো পানিতে ডুবিয়ে দিল। ঐতিহাসিকদের মতে, কিতাবের পানিতে নদীর পানি স্ফীত হয়ে উঠেছিল। ‘রিসালাতুল মুস্তাতরাফা’ গ্রন্থটির নাম হয়ত শুনেছেন। এটি অনেকটা গ্রন্থপরিচিতি বা গ্রন্থসূচী জাতীয় কিতাব। সেখানে এমন হাজারো কিতাবের নাম পাবেন যা আজকের যুগে অনুপস্থিত। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ২০০ খণ্ডের একটি গ্রন্থ লিখেছেন। অথচ সেই গ্রন্থ আজকে নেই। এই কথা বলছি এই কারণে, অনেক আমল যা রাসূল সা. এর যুগ থেকে ক্রমধারায় প্রচলিত। যেমন মাথায় টুপি পরা। কিন্তু প্রচলিত হাদিস গ্রন্থে সহীহ সূত্রে তা বর্ণিত নয়। তাই দেখা যায়, হাল আমলের প্রচলিত কিতাবসর্বস্ব কিছু গবেষক টুপি পরার সুন্নাহ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। অবশ্য পরবর্তীতে শায়খ আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ একাধিক সহীহ সনদ দিতে টুপির সুন্নাহকে প্রমাণ করেছেন। কোন আমল যখন রাসূল সা. এর যুগ থেকে ধারাবাহিক চলে আসে, যেটাকে “আমালে মুতাওয়ারাসাহ বা সুন্নাতে মুতাওয়ারাসাহ” বলা হয়। সেটাকে প্রচলিত কিতাব নির্ভর গবেষণায় উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
আমলে মুতাওয়াতির / মুতাওয়ারাসাহ কী?
ইসলামের ব্যবহারিক অধিকাংশ আমল রাসূল স. থেকে সাহাবীগণ শিখেছেন। সাহাবীদের থেকে তাবেয়ীগণ, তাবেয়ীদের থেকে তাবে তাবয়ীগণ এবং তাদের থেকে পরবর্তীগণ শিখেছেন। একে পরিভাষায় আমলে মুতাওয়ারিসা বলে।
খবরে ওয়াহিদ অর্থাৎ কোন হাদিস যদি এমন হয়, যা কেবল একজনের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আর উক্ত সনদের সবাই নির্দিষ্ট মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। তাহলে সেটাকে গ্রহণ করা হয়। যদিও বর্ণনাকারী মাত্র একজন। তাহলে হাজার হাজার লোক দ্বারা প্রত্যহ পালিত আমলের ধারা কি একক রাবী বর্ণিত হাদীসের তুলনায় শক্তিশালী নয়? সালাফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত, তারা আমলে মুতাওয়ারিসকে খাবরে ওয়াহেদ সূত্রে বর্ণিত হাদীসের উপর প্রাধান্য দিতেন। অনেক ইমাম নিজে সহীহ সনদে হাদীস বর্ণনা করার পরও এর উপর আমল করতেন না। হাদীসটি রাসূল স. থেকে প্রচলিত আমলের বিপরীত হওয়ার কারণে।
ইমাম মালিক রহ. তার মুয়াত্তায় সহীহ সনদে অনেক হাদীস এনেছেন। কিন্তু মদীনাবাসীর আমল বিপরীত হওয়ার কারণে তিনি হাদীসগুলো পরিত্যাগ করে রাসূল স. থেকে প্রচলিত আমলকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এমনকি মালেকী মাজহাবে অন্যতম একটি দলিল হলো আমলে মুতাওয়ারিস বা মদীনাবাসীর আমল।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিজাহুল্লাহ রচিত “” আসারুল হাদীসিশ্ শরীফ ফী ইখতিলাফি আইম্মাতিল ফুক্বহা”” দেখুন। এছাড়াও আল্লামা হায়দার হাসান খান টুংকী রহ. এর লিখিত অনবদ্য দুটি রেসালাহ, ‘আত তায়ামুল’ ও “উসুলুত তাওয়ারুছ”, শায়খ আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. এর কিতাব ‘আল ইমামু ইবনু মাজাহ ও কিতাবুহুস সুনান’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
বর্তমানে অধিকাংশ অস্থিরতার মূল হল, সালাফের নীতি থেকে সরে যাওয়া। আমলে মুতাওয়ারিসের বিপরীতে খবরে ওয়াহিদকে প্রাধান্য দেয়া। একদিন ড. মানজুরে এলাহী দা.বা. এর সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘বর্তমান যামানার ইলমী অঙ্গনে সবচেয়ে বড় ফেতনা হচ্ছে সালাফে সালেহীন এর অনুসৃত পথ থেকে সরে গিয়ে নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করা।’
জয়ীফ বা দুর্বল হাদিস কি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়?
আমাদের মধ্যে যারা উলুমুল হাদিস পড়েন নি। কেবল আলেমদের বয়ান বা শায়েখদের লেকচার শুনেছেন। তাদের মধ্যে একটা বড় মিসকনসেপশন হচ্ছে, তারা ধারণা করেন হাদিস সহীহ মানে হচ্ছে এটা আমলযোগ্য হওয়া। আর জয়ীফ মানে হচ্ছে এটা পরিত্যাজ্য হওয়া।
কিন্তু বাস্তবতা তা না। সহীহ /জয়ীফ/ হাসান/ মুরসাল/ মুতাবে/ শাওয়াহেদ ইত্যাদি শাস্ত্রীয় পরিভাষা। কখনো একটা হাদিসের সূত্র শাস্ত্রীয় নীতিমালায় উত্তীর্ণ হলে সে হাদিস (কথা/কাজ/সম্মতির বিবরণ) সনদগত দিকে দিয়ে সহীহ হতে পারে, কিন্তু তার উপর আমল করা যাবে না। কেন? কারণ হাদিসের বিধান রহিত হয়ে গিয়েছে। এমনিভাবে একটা হাদিস এর সূত্র দুর্বল, কিন্তু সেটার উপর উম্মাহর ধারাবাহিক আমল চলে আসছে সাহাবীদের যুগ থেকেই। সে সূত্র যখন গ্রন্থিত হয়, তখন শাস্ত্রীয়ভাবে দুর্বল হলেও সেটা গ্রহণযোগ্য। এই প্রকারের জয়ীফের ক্ষেত্রে সূত্রগত দুর্বলতা কোন প্রভাব ফেলে না। এইটুকু পড়ে নিশ্চয় আপনাদের অবাক লাগছে। কারণ আপনারা যা ভেবে আসছেন, তার সাথে মিলছে না। তাহলে আসুন হাদিসবেত্তাদের কিছু শাস্ত্রীয় পর্যালোচনা জেনে নেই।
জয়ীফ হাদিস গ্রহণের ক্ষেত্রে শাস্ত্রজ্ঞদের মতামত —
বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ জয়ীফকে দুভাগে ভাগ করেছেন।
এক. এমন জয়ীফ হাদীস, যার সমর্থনে কোন শরয়ী দলিল নেই, বরং এর বক্তব্য শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। এ ধরণের জয়ীফ হাদীস আমলযোগ্য নয়।
দুই. সনদের বিবেচনায় হাদীসটি জয়ীফ বটে, তবে এর সমর্থনে শরয়ী দলিল প্রমাণ আছে, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ হাদীস অনুসারে আমল চলে আসছে। এমন জয়ীফ হাদীস শুধু আমলযোগ্যই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসের মানোত্তীর্ণ। এটাকে বলা হয় ‘জয়ীফ মুতালাক্কা বিল কাবুল’!
এ বিষয়ে ইমাম যারকাশী রহঃ তাঁর হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘আননুকাত’ এ বলেছেন,
ﺇﻥ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺍﻟﻀﻌﻴﻒ ﺇﺫﺍ ﺗﻠﻘﺘﻪ ﺍﻷﻣﺔ ﺑﺎﻟﻘﺒﻮﻝ ﻋﻤﻞ ﺑﻪ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺼﺤﻴﺢ ﺣﺘﻰ ﻳﻨﺰﻝ ﻣﻨﺰﻟﺔ ﺍﻟﻤﺘﻮﺍﺗﺮ
অর্থ, জয়ীফ হাদীসকে যখন উম্মাহ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে নেয়, তখন সঠিক মতানুসারে সেই হাদীসটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তা মুতাওয়াতির হাদীসের মানে পৌছে যায়।
(আননুকাতঃ ১/৩৯০)
২- একই বিষয়ে হাফেজ শামসুদ্দীন আসসাখাবী রহঃও তাঁর ‘ফাতহুল মুগীছ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
ﻭﻛﺬﺍ ﺇﺫﺍ ﺗﻠﻘﺖ ﺍﻷﻣﻪ ﺍﻟﻀﻌﻴﻒ ﺑﺎﻟﻘﺒﻮﻝ ﻳﻌﻤﻞ ﺑﻪ ﻋﻠﻰﺍﻟﺼﺤﻴﺢ ﺣﺘﻰ ﺃﻧﻪ ﻳﻨﺰﻝ ﻣﻨﺰﻟﺔ ﺍﻟﻤﺘﻮﺍﺗﺮ ﻓﻲ ﺃﻧﻪ ﻳﻨﺴﺦﺍﻟﻤﻘﻄﻮﻉ ﺑﻪ ﻭﻟﻬﺬﺍ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺸﺎﻓﻌﻲ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻲ ﺣﺪﻳﺚﻻ ﻭﺻﻴﺔ ﻟﻮﺍﺭﺙ ﺇﻧﻪ ﻻ ﻳﺜﺒﺘﻪ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﻟﻜﻦ ﺍﻟﻌﺎﻣﺔ ﺗﻠﻘﺘﻪ ﺑﺎﻟﻘﺒﻮﻝ ﻭﻋﻤﻠﻮﺍ ﺑﻪ ﺣﺘﻰ ﺟﻌﻠﻮﻩ ﻧﺎﺳﺨﺎ ﻵﻳﺔ ﺍﻟﻮﺻﻴﺔ
অর্থ, উম্মাহ যখন জয়ীফ হাদীসকে ব্যাপকহারে গ্রহণ করে নেয়, তখন সহীহ মত অনুসারে সেটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তার দ্বারা অকাট্য বিধান রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে সেটি মুতাওয়াতির দলীলের মানোত্তীর্ণ হয়। এ কারণেই ইমাম শাফেয়ী র.‘উত্তরাধিকারীর জন্যে কোন ওসিয়ত নেই’ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন, হাদীস বিশারদগণ এটিকে সহীহ মনে না করলেও ব্যাপকহারে আলেমগণ এটি গ্রহণ করে নিয়েছেন, এ অনুযায়ী আমল করেছেন, এমনকি তারা এটিকে ওসিয়ত সম্পর্কিত আয়াতটির বিধান রহিতকারী আখ্যা দিয়েছেন।
(ফাতহুল মুগীছঃ ১/ ৩৩৩)
৩- হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ লিখেন, যে হাদিস অনুযায়ী আমল করা উম্মতের কাছে গৃহীত হয়েছে এবং যে বিষয় অনুযায়ী আমল করার প্রতি উম্মতের ইজমা চলে আসছে,নিঃসন্দেহে তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক কারণ ও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদিস অপেক্ষাও শক্তিশালী।
(আন-নুকাত আলা কিতাবি ইবনে ছালাহ/আসকালানী ১/৪৯৪)
৪- হাফেজ ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ রহঃ একটি জয়ীফ হাদীস সম্পর্কে বলেছেন,
ﻓﻬﺬﺍ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﺇﻥ ﻟﻢ ﻳﺜﺒﺖ ﻓﺎﺗﺼﺎﻝ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺑﻪ ﻓﻲ ﺳﺎﺋﺮﺍﻷﻣﺼﺎﺭ ﻭﺍﻷﻋﺼﺎﺭ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺇﻧﻜﺎﺭ ﻛﺎﻑ ﻓﻲ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺑﻪ
অর্থাৎ এ হাদীসটি প্রমাণিত না হলে ও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শহরে কোন রূপ আপত্তি ছাড়া এ অনুযায়ী আমল চালু থাকাই হাদীসটি আমলযোগ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
(আর-রূহ লিল ইবনে কাইযুমঃ ১৬)
(জয়ীফ হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন আব্দুল হাই লখনবী রহঃ এর লিখিত কিতাব আল-আমলু বিল হাদীসিস যয়ীফাহ ও শায়েখ সাইদ মামদুহ এর ‘আততারীফু বি আউহামিন’। )
৫- ইমাম মালেক বলেন, ‘কোন হাদিস মদীনাবাসীর নিকট মাশহুর হয়ে গেলে তখন সেটা সনদগত হুকুমের ঊর্ধ্বে চলে যায়।
আল আজভিবাতুল ফাদিলাহ- শায়খ আবু গুদ্দাহর তালীক ২২৭-২৩৮ , আল হাদিসুস সহীহ ওয়া মানহাজুল উলামায়িল মুসলিমিন ফিত তাসহীহ- শায়খ আব্দুল কারীম ইসমাইল সাব্বাহ- ২১৫
৬- খতীবে বাগদাদী রাহ. লিখেন, “যখন উম্মাহ ধারাবাহিকভাবে কোন আমলকে গ্রহণ করে নেয়, তখন সেটার শুদ্ধতার জন্যে সনদ খোজার প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ সনদের মানগত শুদ্ধতার ঊর্ধ্বে চলে যায়।
আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কীহ- ১/১৯০
আল কিফায়াহ- ৫১
৭- ইমাম আহমদ বিন হামবলকে একটা হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো “আপনি এই হাদিস গ্রহণ করলেন, অথচ এই হাদিসটিকে আপনি জয়ীফ বলে থাকেন।” ইমাম আহমদ উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ! হাদিসটি জয়ীফ। কিন্তু এর উপর আমল করা হয়”!!
(আল উ’দ্দাতু ফি উসুলিল ফিকহ লি আবি ইয়া’লা আল ফাররা ৩/৯৩৮-৯৩৯)
৮- পূর্বসূরিদের কিতাব যাদের মোতালায়ার সুযোগ হয়েছে তারা এই বাক্যগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে থাকবেন নিশ্চয়,
تلقّته الأمّة بالقبول/ والعمل عليه عند أهل العلم”
ঘাটতে গিয়ে সালাফি শায়েখ, রাবী আল মাদখালী হাফি. এর একটা রেসালাহ পেয়ে গেলাম। তিনি সেখানে মুতালাক্কা বিল কবুল সম্পর্কে লিখেছেন।
والحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول ينجبر ويجب العمل به؛لأن الأمة لا تجتمع على ضلالة .
مثل يعني الماء الذي تقع فيه النجاسة هل ينجس أو لا ؟ إذا تغير طعمه أو لونه أو ريحه كثيرا كان أو قليلا فهو نجس بإجماع الأمّة.
অর্থাৎ, জয়ীফ হাদিসকে যখন উম্মাহ আমল করে তখন সেটার উপর আমল করা ওয়াজিব হয়ে যায়। ‘কারণ উম্মাহ কোন ভুলের উপর একমত হতে পারে না।’ ( এটি হাদিসের অংশ)
তিনি এর উদাহরণ স্বরূপ আবু উমামার হাদিসটি উল্লেখ করেন, “যখন পানিতে নাপাক পতিত হয় আর পানির স্বাদ, রঙ, ঘ্রাণ বদলে যায়, সে পানি বেশি হোক বা অল্প, উম্মাহর এজমা অনুযায়ী তা নাপাক বলে গণ্য হবে। যদিও হাদিসটি জয়ীফ!
জয়ীফ হাদিস যখন উম্মাহর আলেমদের নিকট সর্বতোভাবে গৃহীত হয়ে যায়, তখন সেটার সনদগত দুর্বলতা বিবেচ্য হয় না। এই বিষয়ে সম্পূর্ণ একটা গ্রন্থ লেখা সম্ভব। বিস্তারিত দেখুন, আন নুকাত লি ইবনে হাজার- ১/৪৯৪, আত তায়াক্কুবাত আলাল মাউযুয়াত লিস সুয়ুতী ১২; তাদরিবুর রাবী ৬৭, ফাতহুল মুগীছ ১২০-১২১, ফাতহুল কাদীর ৩/১৪৩, আল বুরহান ফি উছূলিল ফিক্বহ,আবুল মা’আলী আল জুয়াইনী ,ফাছলুন ফি তাক্বাসীমুল খাবর ১/৩৭৯; আল বায়েসুল হাসীস ফী ইখতেসারে উলূমুল হাদিস,ইমাম ইবনু কাসীর-সংকলক শায়খ আহমাদ শাকের পৃঃ১২৭-১২৮; তাওজীহুন নাজার ইলা উছূলিল আছার ১/২১৩ ইত্যাদি।
এই আলোচনার করার উদ্দেশ্য হলো, নারীদের নামাজের পার্থক্য সংবলিত কিছু হাদিসকে জয়ীফ বলে উম্মাহর হাজার বৎসর যাবত চলে আসা আমালে মুতাওয়ারাসাহকে অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ এই নামাজের পার্থক্য রাসূল সা. এর যামানা থেকেই ক্রমধারায় চলে আসছে। ১৫০ হিজরীর মধ্যে লেখা অনেক কিতাবে “নারীদের নামাজের পার্থক্য” শিরোনামে হাদিসও বর্ণিত হয়েছে।
নারী পুরুষের নামাজে ভিন্নতা আছে? নাকি অভিন্ন?
সাধারণত সবাই এভাবে শিরোনাম দিয়ে থাকে। এই শিরোনামকে কেন্দ্র করে নানা তর্ক বা বিতর্ক হয়। কেউ প্রমাণ করেন, নারী পুরুষের নামাজ একই। কেউ প্রমাণ করেন নারী পুরুষের নামাজে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। আমার দৃষ্টিতে এই শিরোনামটিই যথার্থ নয়। কারণ, নারী পুরুষের নামাজে যেমন রয়েছে কিছু পার্থক্য, তেমনি রয়েছে মিল ও অভিন্নতা! উভয়ধারার আলেমদের মতে, নারী পুরুষের নামাজের বিধানে বেশ কিছু পার্থক্য আছে।
যে পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে উভয়ধারার আলেমগণ একমত –
১- মেয়েদের নামাজে আযান বা একামত নেই
২- মেয়েরা উচ্চস্বরে কেরাত পড়বে না
৩- মেয়েদের নামাজে সতর ঢাকার পরিমাণ পুরুষের চেয়ে বেশি।
৪- মেয়েদের মাথা উন্মুক্ত থাকলে নামাজ হবে না।
৫- মেয়েরা জামাতে নামাজ আদায় করলে পুরুষের পিছনে দাঁড়াবে
৫- মেয়েদের জন্যে জুময়ায় যাওয়া ফরজ নয়।
৬- মেয়েদের জন্যে জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব নয়
৭- মেয়েদের সালাত আদায়ের উত্তম জায়গা মসজিদ নয়, বরং ঘরের কোণ। পুরুষের জন্যে মসজিদে জামাতে অংশ নেয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা ওয়াজিব।
৮- ইমামের ভুল হলে ছেলেদের মত তাসবীহ বা সুবহানাল্লাহ পড়বে না, বরং মেয়েরা নামাজে হাত চাপড়ে শব্দ করবে।
৯- ছেলেদের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে সর্বপ্রথম কাতার, আর মেয়েদের জন্যে উত্তম হচ্ছে সর্বশেষ কাতার।
১০- পুরুষ নারীর ইমাম হতে পারে, কিন্তু নারী পুরুষের ইমাম হতে পারে না।
১১- ছেলেরা জামাতে নামাজ আদায়কালে ইমাম সবার সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু মেয়েদের জামাতে মেয়ে ইমাম হলে সে সবার মাঝে সামান্য এগিয়ে দাঁড়াবে। (উল্লেখ্য, হাসান বসরী রহ., মালেকী ও হানাফী মাজহাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র মহিলাদের জামাত নেই)
১২- নারী পুরুষ জামাত আদায়কালে ছেলেরা মুকাব্বির হতে পারবে। মেয়েরা পারবে না।
১৩- মেয়েরা পুরুষের সাথে জামাত আদায়কালে জোরে আমীন বলবে না।
১৪- মহিলা মাথার চুল বেঁধে নামায পড়তে পারে, কিন্তু (লম্বা চুল হলে) পুরুষ তা পারে না।
১৫- সেজদার সময় মহিলারা পুরুষের পর মাথা উঠাবে।
১৬- মহিলারা জামাতে নামাজ আদায় করলে তারা নামাজ শেষ করেই বেড়িয়ে যাবে। আর পুরুষের জন্যে নামাজের পর কিছুক্ষণ মসজিদে অপেক্ষা করা মুস্তাহাব।
১৭- কাতারে একাকী কোন পুরুষের দাঁড়ানো সকল আইম্মাদের মতে মাকরুহ। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে জায়েজ।
১৮- মেয়েদের জন্যে মুস্তাহাব হচ্ছে ওয়াক্ত শুরু হলেই সালাত আদায় করে নেয়া। পুরুষ তা করবে না। বরং আযান হলে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করবে।
এই সমস্ত পার্থক্যগুলো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এতে সামান্য কমবেশ সবারই সহমত আছে। (প্রতিটা পার্থক্যের হাদিস উল্লেখ করতে গেলে নোট দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায়, শুধু মাসায়েল উল্লেখ করা হলো)বরং এই শিরোনামটাই আজকে যত তর্কের বিতর্কের উৎস। কারণ নারী পুরুষের নামাজ একই, এর পক্ষে যে সমস্ত বানী ও আছার পেশ করা হয়। তার মূল মর্ম হচ্ছে, নারী পুরুষের নামাজে যেসব ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য বর্ণিত নেই সেখানে উভয়ের নামাজ এক। এটাই যুক্তিসংগত। অর্থাৎ যেখানে পার্থক্য নেই সেখানে নারী পুরুষের নামাজ এক। এভাবে বলা হলে অর্ধেক বিতর্কই শেষ হয়ে যায়। বাস্তবতাও তাই।একটি হাদিস এই বিষয়কে আরো স্পষ্ট করে,
عن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن المرأة عورة فإذا خرجت استشرفها الشيطان وأقرب ما تكون من وجه ربها وهي في قعر بيتها
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন, নারী হচ্ছে ‘আউরাহ’ (যাকে লুকানো হয়)। যখন কোন মেয়ে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তাকে পুরুষের কাছে মোহনীয় করে তোলে। পক্ষান্তরে মহিলারা স্বীয় বাড়ীর সবচেয়ে গোপন স্থানে আল্লাহ পাকের অধিক নৈকট্য লাভ করে থাকে।
সহীহ ইবনে খুযাইমা- ১৬৮৫,
মুজামুল কাবীর- ৯৪৮১, তিরমিজি ১১৭৩, ইবনে হিব্বান -৫৫৯৯ (সহীহ)
এই হাদিসের শুরু অংশটুকু খেয়াল করুন। আল্লাহর নবী শরীয়তের মেজাজ বলে দিয়েছেন এক বাক্যে। “নারী হচ্ছে আউরাহ”! হজ্ব থেকে নিয়ে সালাহ, সফরসহ বহু বিধানের ক্ষেত্রে স্রেফ মেয়েদের পর্দার কারণেই এত এত পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু উভয়ধারার আলেমগণ একমত।
মেয়েদের নামাজের প্রচলিত আরো কিছু পদ্ধতি যাতে উভয়ধারার আলেমগণ একমত-
১- মহিলারা বুকে হাত বাধবে।
২- শেষ বৈঠকে দু পা ডানে বের করে বা পার্শ্বে ভর দিয়ে বসা।
এই ক্ষেত্রেও উভয়ধারার আলেমগণ একমত। আহলে হাদিস আলেমগণ একমত কারণ তারা এটাকেই কেবল সুন্নত মনে করেন। সেটা পুরুষের ক্ষেত্রে হোক বা নারীর ক্ষেত্রে। আর অন্যান্য আলেমগণ কেবল মহিলাদের ক্ষেত্রে এটাকে মুস্তাহাব মনে করেন।
তাহলে প্রকৃত এখতেলাফ কোন জায়গায়?
মাত্র কয়েকটি ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। এই কয়েকটি বিষয় রদ করতে গিয়েই শিরোনাম দেয়া হয় ‘নারী পুরুষের নামাজ একই’! যেমন,
১- মেয়েরা নামাজে হাত কোন পর্যন্ত তুলবে?
মাজহাব- কাঁধ পর্যন্ত বা বুক পর্যন্ত। আর সেটা ওড়নার নীচে।
ভিন্নমত – কান পর্যন্ত
২- মেয়েরা কীভাবে রুকু করবে?
মাজহাব- পুরুষের মত ঘাড় আর নিতম্ব সমান করে দিবে না। বরং অত্যন্ত সংকোচিতভাবে সামান্য ঝুঁকবে। যাতে হাত দিয়ে উরু নাগাল পাওয়া যায়।
ভিন্নমত- পুরুষের মতই পিঠ আর ঘাড় সমান করে দিবে।
৩- নারীরা কীভাবে সেজদা করবে?
মাজহাব – সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, কনুইসহ দু’হাত মাটিতে বিছিয়ে দেবেন। তাদের পেট দু’রানের সাথে মিলিয়ে দেবেন। উভয় বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন। হাত পায়ের আঙ্গুল কিবলামুখী রাখবেন। পা খাড়া করবেন না। মোটকথা সিজদা এমন ভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাযত হয়। পুরুষের মত কোমর উঁচু করে দু হাত ছড়িয়ে লম্বা হয়ে সেজদা করবে না।
প্রসঙ্গত, নারী পুরুষের নামাজের ভিন্নতা নেই, অথবা আছে। এই যে এখতেলাফ, এটা কেবল হানাফীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং বলতে গেলে ৪ মাজহাবের সবার সাথেই এই এখতেলাফ। সুতরাং মত বর্ণনার ক্ষেত্রে “মাজহাব ও ভিন্নমত” এভাবে লেখা হয়েছে।
নারীকে বলা হয়েছে ‘আওরাহ’। অর্থাৎ যাকে লুকোনো হয়, গোপন করা হয়। ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম দর্শন হচ্ছে এটাই। নারী তার সতর ও আওরাত এর ক্ষেত্রে যত্নশীল হবে, হওয়া উচিতও বটে । তাই অর্ধশত বছর আগ পর্যন্ত গত হওয়া প্রায় তাবৎ ফুকাহায়ে কেরাম নারীদের রুকু ও সেজদার পার্থক্য করেছেন। শালীনতা আর শরীয়তের মেজাজ “আওরাহ” এর প্রতি লক্ষ্য রেখে।
পুরুষের মত রুকু সেজদার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এতে ঐ মাত্রায় শালীনতা থাকে না যেটা পার্থক্য করার ক্ষেত্রে থাকে। যেমন, পুরুষের রুকু হচ্ছে এই পরিমাণ মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়া যাতে কোমর আর ঘাড় সমান হয়ে যায়। এভাবে রুকুতে নিতম্বের আকৃতি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেটা পুরুষের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেও নারীর ক্ষেত্রে মানানসই নয়।
পুরুষের সেজদার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, নিতম্ব উঁচিয়ে দেয়া। দু হাত বগল থেকে পৃথক করে ছড়িয়ে দেয়া। হাত যেন জমিনে না লাগে। আর পেট যেন হাঁটুতে না লাগে।
এই দু অবস্থা পুরুষের ক্ষেত্রে অবলীলায় মানানসই হলেও, মেয়েদের ক্ষেত্রে? নিঃসন্দেহে এটা শরীয়তের পর্দার মেজাজের সাথে যায় না। কারণ এভাবে মহিলারা রুকু বা সেজদায় গেলে, পিছনে মাহরাম অবস্থান করাও মুশকিল হয়ে যাবে। গায়রে মাহরাম তো কথাই নেই। যেমন ধরুন, হজ বা ওমরাহতে যেখানে খোলা জায়গায় নামাজ পড়তে হয়। সেখানে ঐভাবে পুরুষের মত রুকু সেজদা করা কি পর্দাপুশিদার সাথে মানানসই?
নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই-
এই মর্মে মোটা দাগে ৩ টা দলীল পেশ করা হয়।
১- হাদিস
২- আছারে সাহাবী
৩- আছারে তাবেয়ী
প্রথম দলীল
*// নারী-পুরুষ উভয় জাতির উম্মতকে সম্বোধন করে রাসূল(সা:) বলেছেন,“তোমরা সেইরূপ সালাত আদায় কর, যেইরুপ আমাকে করতে দেখেছ”। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৯ //
সাধারণত এই দলীলটি সবাই উল্লেখ করে থাকেন। শায়খ আলবানী রহ. তার সিফাতুস সালাহ গ্রন্থে এই হাদিসকে কেন্দ্র করেই বলেছেন, “এখানে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। সুতরাং উভয়ের নামাজে কোন ভিন্নতা নেই”!
**হাদিসে কি নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে? “রাসূল সা. নারী ও পুরুষকে সম্বোধন করে বলেছেন”, এই কথাটুকু বাড়তি সংযোজন। রাসূল সা. নারীদের সম্বোধন করে বলেন নি। যাদের বলেছেন, তারা নারী ছিলেন না। এই বাড়তি সংযোজন নিজস্ব ইজতেহাদ ও উপলব্ধি মাত্র। পূর্ণ হাদিস বিশ্লেষণ করলে এই দলীলের যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রথমে উক্ত হাদীসটির পূর্ণরূপ দেখে নেই: . ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﺳُﻠَﻴْﻤَﺎﻥَ ﻣَﺎﻟِﻚِ ﺑْﻦِ ﺍﻟﺤُﻮَﻳْﺮِﺙِ، ﻗَﺎﻝَ : ﺃَﺗَﻴْﻨَﺎ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲَّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ، ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﺷَﺒَﺒَﺔٌ ﻣُﺘَﻘَﺎﺭِﺑُﻮﻥَ، ﻓَﺄَﻗَﻤْﻨَﺎ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﻋِﺸْﺮِﻳﻦَ ﻟَﻴْﻠَﺔً، ﻓَﻈَﻦَّ ﺃَﻧَّﺎ ﺍﺷْﺘَﻘْﻨَﺎ ﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ، ﻭَﺳَﺄَﻟَﻨَﺎ ﻋَﻤَّﻦْ ﺗَﺮَﻛْﻨَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻫْﻠِﻨَﺎ، ﻓَﺄَﺧْﺒَﺮْﻧَﺎﻩُ، ﻭَﻛَﺎﻥَ ﺭَﻓِﻴﻘًﺎ ﺭَﺣِﻴﻤًﺎ، ﻓَﻘَﺎﻝَ : « ﺍﺭْﺟِﻌُﻮﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﻫْﻠِﻴﻜُﻢْ، ﻓَﻌَﻠِّﻤُﻮﻫُﻢْ ﻭَﻣُﺮُﻭﻫُﻢْ، ﻭَﺻَﻠُّﻮﺍ ﻛَﻤَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻤُﻮﻧِﻲ ﺃُﺻَﻠِّﻲ، ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺣَﻀَﺮَﺕِ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓُ، ﻓَﻠْﻴُﺆَﺫِّﻥْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ، ﺛُﻢَّ ﻟِﻴَﺆُﻣَّﻜُﻢْ ﺃَﻛْﺒَﺮُﻛُﻢْ » .
আবূ সুলাইমান মালিক ইবনু হুওয়ায়রিস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা কয়জন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকটে আসলাম। তখন আমরা ছিলাম প্রায় সমবয়সী যুবক। বিশ দিন তাঁর কাছে আমরা থাকলাম। তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের নিকট প্রত্যাবর্তন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। যাদের আমরা বাড়িতে রেখে এসেছি তাদের ব্যাপারে তিনি আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তা তাঁকে জানালাম। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও দয়ার্দ্র। তাই তিনি বললেন: তোমরা তোমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যাও। তাদের (কুরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ কর এবং যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনভাবে সালাত আদায় কর। সালাতের ওয়াক্ত হলে, তোমাদের একজন আযান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামত করবে। . বুখারী, হাদীস নং-৬০০৮
উক্ত হাদীসে খেয়াল করুন!
* কতিপয় যুবক সাহাবী এসেছেন। তাদের সবাই যুবক। তাদের মাঝে কোন নারী ছিল না।
* বাড়িতে গিয়ে স্বীয় এলাকাবাসীকে কুরআন শিক্ষা সৎ কাজের আদেশের নির্দেশনা দিলেন।এরপর তোমরা বলে পরপর তিনটি নির্দেশনা দিলেন।
যথা-
১/আমাকে যেভাবে দেখেছো সেভাবে তোমরা নামায পড়বে।
২/নামাযের সময় হলে তোমাদের মধ্য হতে একজন আযান দিবে।
৩/নামাযের জন্য তোমাদের থেকে যে বড় সে ইমাম হবে।
পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ –
** প্রথমত হাদিসে উল্লেখই আছে, যারা রাসূল সা. এর সামনে ছিলেন। তারা পুরুষ। সম্বোধন তাদেরকেই ছিল।
** দ্বিতীয়ত হাদীসটির শেষ দিকে নবীজী সা. আযান ও ইমামতের নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশটি আরো স্পষ্ট করে, এখানে নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করার দাবী সঠিক নয়।
** তৃতীয়ত এই হাদিসটি বুখারী, মুসলিমসহ আরো অন্যান্য গ্রন্থে ১০ টি রেওয়ায়ত, সহীহ সনদে এসেছে। অর্থাৎ মালেক বিন হুয়াইরিস রা. এর মদীনায় এসে রাসূল সা. এর কাছ থেকে ইসলাম শেখার বিবরণ। সেখানে মাত্র একটি বর্ণনায় আছে যে রাসূল সা. বলেছেন “সাল্লু কামা রায়াইতুমুনি উসাল্লি” অর্থাৎ আমাকে যেভাবে দেখছ সেভাবে নামাজ আদায় করো। এছাড়া অন্য বর্ণনাগুলোতে এই কথাটা নেই। সেখানে কোথাও আছে, “তোমরা নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তাদের নামাজ শেখাবে। তারা যেন নামাজ পড়ে এই এই ওয়াক্তে। আর নামাজের সময় এলে একজন আযান দেয়, আর বয়োজ্যেষ্ঠ যে সে ইমামতি করে।” বুখারী (৬৫৩) অন্য রেওয়াতে আছে, মালেক বিন হুয়াইরিস ও তার চাচাত ভাই রাসূল সা. এর কাছে এলেন। তিনি বললেন, যখন তোমরা দুজন সফরে যখন বের হবে তখন আযান একামত দিবে। আর তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমাম হবে। (তিরমিজী – ২০৫, সহীহ) এই হাদিসে একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এখানে নির্দেশ পুরুষদেরকে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য রেওয়ায়ত গুলো চেক করতে চাইলে, মুসলিম – ২৯২/৬৭৪, বায়হাকী ২২৩৭, ২২৩৮, ২৬৬৭ ইত্যাদি।
তদুপরি যদি মেনে নেয়া হয় যে মহিলাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছ। তারপর যে প্রশ্নগুলো আসবে…
১- রাসূল সা. কে মত নামাজ পড়ার মর্ম কী?এর মর্ম কী এই, রাসূল সা. এর মত আরকান ও আমলগুলো আদায় করা? নাকি এর মর্ম এই, রাসূল সা. এর মত খুশু খুজু স্থিরতা আনার চেষ্টা করা?
২- হুবহু রাসূল সা. এর মত নামাজ আদায় করতে যদি মহিলাদের নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে নামাজে রাসূল সা. এর অন্যান্য আমল, যেমন টাখনু খোলা রেখে নামাজ আদায়। ইত্যাদি। এগুলোও কি রাসূল সা. মালেক বিন হুয়াইরিসকে বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের শিখাতে বলেছেন? মহিলাদের আযান একামত ও উচ্চস্বরে কেরাত পড়তে বলেছেন? যেভাবে রাসূল সা. পড়তেন। আর উক্ত সাহাবীও রাসূল সা. কে পড়তে দেখেছেন!যদি উত্তর হয়, না এইগুলা রাসূল সা. বলেন নি। তাহলে বোঝা যাবে হাদিসে মহিলাদের নামাজ নিয়ে কিছুই বলা হয় নাই। বলা হলে পার্থক্যের ক্ষেত্রগুলো রাসূল সা. কেন বলে দিলেন না? যে মহিলারা আস্তে কেরাত পড়বে, টাখনু ঢাকবে। চুল খোলা রাখবে না। কারণ এগুলো তো রাসূলের নামাজের বিপরীত চিত্র। মালেক বিন হুয়াইরিসের যত রেওয়ায়েত আছে একটা রেওয়াতেও নেই কেন, ঐ পার্থক্যগুলোর কথা। যেগুলোর ব্যাপারে সবাই একমত।
তবে, দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম, স্বতঃসিদ্ধ মত হচ্ছে, যেসব বিধানে নারীদের ব্যাপারে ভিন্ন কিছু কুরআন বা হাদিসের মাধ্যমে অথবা ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, সেক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যেই শামিল। এটা প্রমাণে বিস্তর দলীল দস্তাবেজ এর প্রয়োজন নেই। কারণ এতে সবাই একমত।কিন্তু নারীদের নামাজে রুকু সেজদার পার্থক্য তো, হাদিস, আছার ও ইজমা, কেয়াস দ্বারা প্রমাণিত।
এমনকি, শায়খ আলবানি রহ. তার কিতাবে এক ইবনে হাজাম জাহেরী ছাড়া জমহুরের মতের বিপরীত আর কারো মত উপস্থাপন করেন নি। ইবনে হাজাম জাহেরী ছিলেন জাহেরী সম্প্রদায়ের মতবাদপ্রবর্তক। যাদের মূল কথা হচ্ছে, হাদিস কুরআনে বাহ্যিক যা অর্থ, তাই মানব। এই নীতির আলোকে দেয়া তার কিছু উদ্ভট ফতোয়ার কারণে তাকে একাধিকবার দেশ ছাড়তে হয়েছে। ইবনে হাজাম যাহেরী রহ. এর ভুলভ্রান্তি বিস্তারিত আলোচনা করা এখানে সম্ভব না। তার কয়েকটি মাসআলা উল্লেখ করছি,
১- কুরআনে বলা আছে, মা বাবাকে ‘উফ’ বলো না। সুতরাং তাদের গালি দেয়া জায়েজ। গালি তো উফ না।
২- হাদিসে বলা আছে, বিয়ের আগে কনেকে দেখে নিতে, যাতে বিয়েতে উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়। তিনি ফতোয়া দিলেন, কনেকে এমনকি উলঙ্গ করেও দেখা যাবে। কারণ তা আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করবে।
৩- হাদিসে এসেছে, কুকুর মুখ দিলে ৭ বার ধৌত করতে। কিন্তু শুয়োর এর ব্যাপারে কিছু বলা হয় নাই। সুতরাং শুয়োর মুখ দিলে তা পান করা ও উজু করা বৈধ।
৪- আয়াতে বলা আছে, দারিদ্রতার ভয়ে সন্তানকে হত্যা করো না। তিনি ফতোয়া দিলেন, এখানে দারিদ্র্যতার কথা বলা আছে। সুতরাং ধনী হলে হত্যা করতে অসুবিধে নাই। কারণ তার দারিদ্রতার ভয় নেই।
“ইবনে হাজাম এর ভিন্নমত সম্পর্কে ইমামদের অভিমত”
হাফেজ ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন- যাহেরীদের সম্পর্কে আমার মত হলো, তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ থেকে বের হয়ে গেছে। (আল ইস্তেযকার – ৩০৯)
ইমাম নববী বলেন, বাহ্যিকবাদী তথা যাহেরী মতবাদ এক আজীব মাজহাব। যা চূড়ান্ত পর্যায়ের ভ্রান্ত। ইবনে হাজাম যাহেরী থেকে বর্ণিত মতটি (কোন এক মাসআলায়) নিকৃষ্টতম মাসআলার একটি। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। (আল মাজমূ ১/১১৮) –
ইবনে তায়মিয়া রহ. ইবনে হাজাম যাহেরীর হাদিস বিষয়ক জ্ঞানের কথা স্বীকার করে তার ভুলভ্রান্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এবং তিনি যাহেরীদেরকে ভ্রান্ত ফেরকা জাহমিয়াদের মধ্যে শামিল করেছেন। ( মিনহাজুস সুন্নাহ ২/৫৮৩, দারউ তায়া’রুজিল আকলি ওয়ান নাকল ৫/২৪৯)
সুতরাং ইবনে হাজাম যাহেরী যদিও হাদিস বিশারদ ছিলেন। কিন্তু তার ফিকহের অবস্থা ছিল করুণ! তাই, উম্মাহর সকল আয়িম্মাহর বিপরীতে গিয়ে তার উদ্ভট ফতোয়াকে সমর্থন হিসেবে পেশ করা মানানসই না। উল্লেখ্য, ইবনে হাজাম রহ. খায়রুল কুরুনের কেও নন। তার জন্ম ৩৯৪ হি, স্পেনে। ইন্তেকাল ৪৪৬ হি।
শায়খ আলবানি নিঃসন্দেহে বড় মাপের মুহাদ্দিস ছিলেন। শায়খ আলবানির এই মতকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে অনেকেই বলেছেন নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই। কিন্তু এখানে যে কথাটা না বললেই নয়, হাদিস বিশারদ হওয়া আর ফিকহ বিশারদ হওয়া এক নয়। শায়খ আলবানির অনেক ফতোয়াই উম্মাহ গ্রহণ করে নাই। যেমন, মহিলাদের স্বর্ণ ব্যবহার হারাম, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে হিজরত করা ওয়াজিব, তিনি আরো বলেছেন, “সবাইকে সালাফী পরিচয় দিতে হবে”, নাপাক থাকা অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা জায়েজ ইত্যাদি। এই মতগুলো কেও গ্রহণ করে নি।
এগুলো শায়খ আলবানির মত। কিন্তু গ্রহণ করেন না অনেকেই। উল্লেখ্য, শায়খ আলবানি ও শায়খ বিন বাজ, সালেহ আল উসাইমিনের ভিন্নমত বা ইখতেলাফ নিয়ে দুই খণ্ডে ৮০০ শত পৃষ্ঠারও বেশি একটি কিতাব রয়েছে। যেটা লিখেছেন ড. সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল বারীক। যার নাম হচ্ছে “আল ইজাযু ফি বাদি মা ইখতালাফা ফীহী আলবানি ওয়া ইবনু উছাইমিন ওয়া ইবনু বায রাহিমাহুমুল্লাহু তায়লা”!
দ্বিতীয় দলীল
//উম্মে দারদা (রা:) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন। (আত-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ১/৩৫৫ পৃঃ, ফাৎহুল বারী ২/৩৫৫)।//
বিশ্লেষণ-
প্রথমত, উম্মে দারদা তিনি একজন ফকীহ তাবেয়ী। উপরে দেখতে পাচ্ছেন, যারা এই দলীল উপস্থাপন করেছেন, তারা ফাতহুল বারী (বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ) এর উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে, ফাতহুল বারীতে স্পষ্ট করে লেখা আছে, এই উম্মে দারদা সাহাবী নন। তিনি তাবেয়ী! শুধু ফাতহুল বারী কেন, তারীখের কিতাব তাহযীবুত তাহযীব, তাহযীবুল কামাল, সিয়ারু আলামিন নুবালা ইত্যাদি গ্রন্থগুলো চেক করলেই বুঝতে পারবে, এখানে উম্মে দারদা সুগরা উদ্দেশ্য। কারণ মাকহুল এর সাথে উম্মে দারদা কুবরা যিনি সাহাবী, তার সাথে কখনো দেখাই হয় নি । তাহলে মাকহুল কীভাবে উম্মে দারদা (সাহাবী) থেকে বর্ণনা করবেন? এ বিষয়টা জানার পরেও তাবেয়ীর কথাকে সাহাবীর কথা বলে প্রচার করা দুঃখজনক। (তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৫)
দ্বিতীয়ত, উম্মে দারদা হুবহু পুরুষের মত বসতেন না। ইবনে রজব হামবলী রহ. ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন, হাদিসের বাকী অংশ যেটা হারব আল কিরমানি সূত্রে বর্ণিত, উম্মে দারদা পুরুষের মত বসতেন তবে তিনি বাম নিতম্বের দিকে ঝুঁকে বসতেন। এতে বরং পুরুষের নামাজের চেয়ে ভিন্নতাই প্রমাণিত হয়।
قال الحافظ ابن رجب في فتح الباري(7/299) قال حرب الكرماني : نا عمرو بن عثمان : نا الوليد بن مسلم ، عن ابن ثوبان ، عن أبيه ، عن مكحول ، أن أم الدرداء كانت تجلس في الصلاة جلسة الرجل إلا إنها تميل على شقها الأيسر ، وكانت فقيهةً
তাছাড়া ইমাম বুখারীর বাক্য প্রয়োগ “পুরুষের মত বসতেন আর তিনি ফকীহ ছিলেন” দ্বারা অনেকে বলেন, এখানে তার বসাটা অন্যান্য তাবেয়ীদের তুলনায় ব্যতিক্রম ছিল। আর তাই ইমাম বুখারী সেটার প্রতি জোর দিতে গিয়ে ‘তিনি ফকীহ ছিলেন’ কথাটা যুক্ত করেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে এর মর্ম দাঁড়ায় খায়রুল কুরুনে মহিলাদের বসার পদ্ধতি পুরুষের চেয়ে ভিন্ন ছিল। কেবল একজন তাবেয়ী ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি কিছুটা পুরুষের মত বসতেন। তাহলে এর দ্বারা বরং ভিন্নতাই প্রমাণিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত: তারীখের কিতাবগুলোতে রয়েছে, উম্মে দারদা খুব অল্প বয়সী ও ইয়াতীমাহ ছিলেন। তাই তিনি পুরুষের কাতারে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন এবং পুরুষদের ক্বেরাতের মজলিশেও বসতেন। এরপর তিনি বড় হলে একদিন তাকে আবু দারদা মহিলাদের কাতারে যুক্ত হতে বলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি নামাজে যদি পুরুষদের মত বসেও থাকেন, তবে সেটা পুরুষদের দেখে দেখে করতেন ঐ বয়সে , যখন তিনি সাবালিকা হন নি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/২৭৮, তারীখুল ইসলাম ২/১০২৫, তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৪) ৪/
তদুপরি যদি তাবেয়ীর আমলটাকে ঐভাবে ধরে নেই যে নামাজে পুরুষ আর মহিলাদের বসার ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই। তবে এর বিপরীতে সহীহ সনদে সাহাবীর আমল আছে..
ইমাম তাহাবী, (শারহু মুশকিলিল আছার ১৩/২৪৩ ও আহকামুল কুরআনের ১/১৬৪ হা. ২৬৬) একটি হাদিস সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন। হাসান বসরী রহ. তার মা এর সূত্রে, (যিনি উম্মে সালামার খাদেমা ছিলেন) উম্মুল মুমীনীন উম্মে সালামা থেকে বর্ণনা করেন যে, উম্মে সালামা দু পা ডানে দিয়ে বসতেন, অর্থাৎ মেয়েরা যেভাবে সালাতে বসে। উল্লেখ্য তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. নিজেও উম্মে সালামার দুধসন্তান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শাইখ কামালুদ্দীন জাফরী এক টিভি আলোচনায় বলে বসলেন, “সহীহ বুখারীতে আছে, নবীজীর স্ত্রী সম্ভবত উম্মুল মুমীনীন সওদা রা. صلت صلاة الرجل و كانت فقيهة অর্থাৎ সাওদা রা. পুরুষের মত নামাজ আদায় করলেন আর তিনি ফকীহ ছিলেন।” তিনি যা বললেন, তার আরবী বা ভাবার্থ কোনটাই বুখারীতে নেই। এমনকি আমি অনুসন্ধান করে অন্য কোন হাদিস গ্রন্থেও এই হাদিস দেখি নি, বা যারা উনার মত বলেন যে নারীদের নামাজ অভিন্ন, তাদের কাউকে এমনটা লিখতে দেখি নি। সুতরাং আমার খেয়াল, তিনি এক্ষেত্রে ভুল করে উম্মে দারদার হাদিসের অর্থকে সামান্য বদলে, বানিয়ে সেটাকে আরবীতে বলেছেন। এটা একটা তাসামুহ বা মিস্টেক। আল্লাহ ভালো জানেন। সাহাবী ও সালাফের নীতি হলো, তারা হাদিস বর্ণনায় আরো বেশি সতর্কতার পরিচয় দিতেন।
তৃতীয় দলীল
ইবরাহীম নাখয়ী (র:) বলেন, ‘সালাতে মহিলারা ঐরূপ করবে, যেরূপ পুরুষরা করে থাকে। (ইবনে আবি শাইবা ১/৭৫/২, সিফাতু সালাতুন্নবী ১৮৯ পৃঃ)। ইবরাহীম নাখয়ীর আছারটি শায়খ আলবানি রহ. সিফাতুস সালাতে উল্লেখ করেছেন। তিনি সেটাকে সহীহ সনদও বলেছেন। তিনি যে আরবী বাক্য দিয়েছেন المرأة تفعل في صلاتها كما يفعل الرجل কিন্তু উক্ত আছার মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে পাওয়া যায় না। তাই শায়খের দাবীকে অনেকে “শিবহুত তাহরীফ” (বিকৃত কথার অনুরূপ) বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
অধমের খেয়াল হচ্ছে, ইবরাহীম নাখয়ীর যে আছারটি শায়েখ উল্লেখ করেছেন, তা সম্ভবত শায়েখ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার মুখতাসার, যাতে প্রচুর মিস্টেক আছে। সেই গ্রন্থ থেকেই শায়েখ তুলে দিয়েছেন। যার কারণে ভুলটা হয়েছে। ইবরাহীম নাখয়ী বলেন নি যে, “মহিলারা নামাজে তাই করবে যা পুরুষরা করে”! তবে একটা আছার আছে, যেখানে ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন ‘মহিলারা পুরুষের মত বসবে।” عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : تَقْعُدُ الْمَرْأَةُ فِي الصَّلاَةِ كَمَا يَقْعُدُ الرَّجُلُ এতে শুধু বসার ক্ষেত্রে অভিন্নতা প্রমাণ হয়। কিন্তু রুকু সেজদার ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই, এটা প্রমাণ হয় না।
বরং অন্য বর্ণনায় আছে,ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন-মহিলা যখন সেজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৫) তাছাড়া কথা হচ্ছে, শায়খ আলবানি রহ. যখন বসার ক্ষেত্রে অভিন্নতা প্রমাণ করতে তাবেয়ীর আছার দিয়ে দলীল পেশ করলেন, তাহলে নারী পুরুষের নামাজে ভিন্নতা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এত এত বিপুল পরিমাণ আছারকে কেন গ্রহণ করা হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ