expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Wikipedia

সার্চ ফলাফল

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

শেখ মুজিবের অপশাসন

 

শেখ মুজিবের অপশাসন
 

 
অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক জন পিলজার একটা মেয়ের আঙুল ধরলেন। মানুষ তো জন্মের পর বড় হয়, তার মনে হলো, এই মেয়েটা জন্মের পর বড় হয়নি। বরং দিন দিন আরো ছোট হতে হতে মায়ের পেটের সাইজে ফিরে গেছে।
হাজার হাজার মহিলা অর্ধনগ্ন। বাংলাদেশের মতো কনজার্ভেটিভ একটা দেশে মেয়েদের গায়ের পোশাক কই? শুনলেন, এসব মানুষ খাবার কিনে খাওয়ার জন্য নিজের গায়ের কাপড় পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মীরা ব্যস্ততার ঠেলায় চোখে দেখছেন না। আগে যেখানে কয়েকটা লাশ তাদের কুড়াতে হতো, এখন কুড়াতে হচ্ছে ৬০০। সবটাই অনাহারে মৃত্যু।
গায়ের কাপড় বিক্রি করে খাবার কিনে খেয়েছিলেন বাসন্তী। এরপর জাল দিয়ে জড়িয়ে নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করলেন। সেই ছবি প্রকাশ হলো দৈনিক ইত্তেফাকে।
মানুষ ঘাস খেতে শুরু করলো।
কবি রফিক আজাদ লিখলেন, ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো।
যতটুকু যা সাহায্য আসতো, সব লুট করে ফেলতো আওয়ামীলীগের লোকজন। ফলাফল হলো, কোন দেশ সাহায্যও করতে চাইতো না আর।
মুজিব এসময় ঢং করে সবাই পেয়েছে সোনার খনি আমি পেলাম চোরের খনি টাইপের কথা বলার চেষ্টা করেন। তার মেয়ের মতোই ভিক্টিম কার্ড খেলার চেষ্টা করলেন। যাতে সবাই তাকে দোষী না ভেবে দোষী ভাবে অন্যান্য লোকজনকে।
কিন্তু সোনার খনি আসলে কোথায় ছিলো জানেন?মুজিবের বাসায়। গণভবনে।
১৯৭৪ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত যে দেশের মহিলারা পরনের কাপড় বিক্রি করে ভাত কিনে খেলো, সেই দেশেই মুজিবের দুই ছেলের বিবাহ হলো সোনার মুকুট পরে।
না না। মেটাফোরিক না। আসলেই মুজিবের দুই ছেলে শেখ কামাল আর শেখ জামালের মাথায় সোনার মুকুট ছিলো।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হুমায়ূন আহমেদ কী লিখেছেন, মনে আছে? জিয়া মানুষটা সৎ ছিলেন। লোক দেখানো সৎ না। সত্যি সত্যি সৎ। মৃত্যুর পর সম্পদের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, জিয়া তাঁর পরিবারের জন্য কোন অর্থ সম্পদ রেখে যান নাই।
হুমায়ূন আহমেদ এখানে জিয়ার কথা বললেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরের কথা এড়িয়ে গেছেন।শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তাঁর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ৫০৩ ভরি সোনা। আর ৪ হাজার ভরি রূপা। নগদ টাকা তো ছিলোই।
শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার পর জিয়াউর রহমান এই ৫০৩ ভরি সোনাই শেখ হাসিনার হাতে বুঝিয়ে দেন। শেখ হাসিনাও বুঝিয়া পাইলাম সাইন করে ৫০৩ ভরি সোনা আর ৪ হাজার ভরি রূপা বুঝে নেন।

শেখ মুজিবের সেই সময়কার বক্তব্য অনেকেই শেয়ার দেন। সবাই পেল সোনার খনি, আমি পেলাম চোরের খনি টাইপের চটুল বক্তব্য। শুনে অনেকেই গলে যান। অথচ মুজিবও সোনার খনিই পেয়েছিলেন।
না হলে যেই সময়টাতে এই দেশের লাখ লাখ নারী তাদের পরনের কাপড় বিক্রি করে চাল কিনছেন, রংপুরের কবি রফিক আজাদ লিখলেন, ভাত দে হারামাজাদা, নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো, সেমসময়ে সোনার মুকিট পড়িয়ে ছলের বিয়ে দিলো কোন বিবেকে?
ঐ সময় এই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসায় সোনার খনি না থাকলে কোথায় হতে ছেলের জন্য মুকুট তৈরীর সোনা পেলো?
শেখ মুজিব শুধু দূর্নীতিবাজ ছিলো না, স্বৈরাচারও ছিলো,নীচে তার প্রমান দেওয়া হলো:

১. একদলীয় শাসন:
মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই পদক্ষেপের ফলে রাজনৈতিক মতভেদ দূর করার চেষ্টার পরিবর্তে বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে যায়। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার ফলে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সুসম্পর্ক রক্ষার সম্ভাবনা কার্যত অবসান ঘটে।

২. বিরোধী দলের দমন-পীড়ন:
মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বিরোধী দলগুলোর প্রতি কঠোর দমন-পীড়ন চালানো হয়। বিশেষ করে, বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের উপর নিপীড়ন এবং গ্রেপ্তারের হার বেড়ে যায়। এই দমন-পীড়ন রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে।

৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ:
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বাংলাদেশ একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে শুরু করে। দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব এবং দুর্নীতির মতো সমস্যাগুলো জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংকটগুলি রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে এবং সরকার বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।

৪. নেতৃত্বের অভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা:
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাব ছিল একটি বড় সমস্যা। প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও, বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে বিরোধী দলগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়।

৫. সামরিক অভ্যুত্থান:
মুজিবুর রহমানের শাসনের শেষ পর্যায়ে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার শাসনের অবসান ঘটে। এই সামরিক অভ্যুত্থানের মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ। সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে দেশ রাজনৈতিকভাবে আরও বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে।
এই সমস্ত কারণগুলির মিলিত প্রভাবের ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে আন্তর দলীয় রাজনৈতিক সুসম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত তার শাসনের করুণ পরিণতি ঘটে।
 
 
পনেরোই আগস্টের অন্যতম নায়ক শহীদ কর্ণেল সৈয়দ ফারুক রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমরা যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষমতা গ্রহণ করে সেই তিনিই কেমন বদলে যেতে লাগলেন! শেখ মুজিব যদি আমাদেরকে ঘাস খেতে বলতেন, আমরা তা-ই করতাম। অথচ সেই লোকটি আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করল দেখুন!' [১] আগস্টের এই সাহসী পুরুষকে ২০১০ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করে হাসিনা।

২.
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং লেখক আহমদ ছফার মধ্যকার সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। মুজিব আমলের কোনো এক সময়ে রাজ্জাক স্যারের বাসায় হাজির হলেন আহমদ ছফা। আলাপ জমে উঠল এবং তা একপর্যায়ে রাষ্ট্রপ্রধান ইস্যুতে টার্ন করল। শেখ মুজিবের মতো নেতার একনায়ক হয়ে ওঠার কাণ্ডকারখানায় তাঁরা হতভম্ব। অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, 'ইতিহাস শেখ মুজিবকে স্টেটসম্যান হইয়া ওঠার একটা সুযোগ দিছিলো, কিন্তু তিনি সেটা হেলায় হারাইলেন।' [২]

৩.
একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের ভূমিধস পতন হয়েছে। সপরিবারে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারের সিঁড়িতে পড়ে আছে তার দীর্ঘদেহী লাশ। ইতিহাসের এক নির্মম অথচ অনিবার্য দৃশ্য– ঢাকা শহরের মানুষ আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করছে।[৩] জনতা সেই মুজিবের পতনে আনন্দিত; যে মুজিব বাকশাল কায়েম করে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন, সিরাজ শিকদারকে এন কাউন্টার দিয়ে মেরেছিলেন, জহির রায়হানকে গু ম করেছিলেন। বাহাত্তরের আগের মুজিব আর এই মুজিব এক নন।

৪.
পনেরোই আগস্ট সংঘটিত না হলে এখনও হয়তো রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলরা থাকতো। গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠত আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র সাম্রাজ্য, যার অনেকাংশই আমরা বিগত পনেরো বছরের হাসিনা শাসনামলে দেখেছি। তৈরি হতো হাজার হাজার আয়নাঘর, সহস্র মা-বোন সম্ভ্রম হারাতো প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ আওয়ামী লুটতরাজের এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতো। যে নায়করা আমাদের মুক্তি এনে দিলেন, চোখের সামনে তাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। কিছুই করতে পারলাম না আমরা! এ ব্যর্থতা লুকাবো কোথায়?
'সেই আগস্ট এই আগস্ট'/ Labib Ahsan লাবিব আহসান

তথ্যসূত্র :
১. বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ– অ্যান্থনি মাসকারেনহাস।
২. যদ্যপি আমার গুরু– আহমদ ছফা।
৩. দেয়াল– হুমায়ূন আহমেদ।


দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিব এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের যা ক্ষতি করেছেন তা আর পূরণ করার মতো নয়।
ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারি শেখ মুজিব একটি ভাষণে বলে ছিলেন, "ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠার কারণে এই দেশের শাসন ব্যাবস্থার মধ্যে কোন প্রকার ইসলাম থাকতে পারে না। এমন কি এই দেশে কেউ আর ইসলামী রাজনীতি ও ইসলমী দল করে পারবে না। আজ থেকে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামা ইসলামী সহ সকল ইসলামী দল সমূহ নিষিদ্ধ করা হল। এদেশে তাদের ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হল।
“শেখ মুজিব একবার দুজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপ কালে (সৈয়দ মুজতবা আলী ও সন্তোষ কুমার ঘোষ) বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ও সেক্যুলার বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষাকারী হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ। আমি এই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের চারা বাংলাদেশের মাটিতে পুঁতে দিলাম। যদি কেউ এই চারা উৎপাটন করে, তাহলে বাঙালি জাতির স্বাধীন অস্তিত্বই সে বিপন্ন করবে’ (২৯ নভেম্বর, ১৯৭২, দৈনিক যুগান্তর-কলকাতা)।

শেখ মুজিব ইসলাম ও মুসলিম শব্দটি মোটেই পছন্দ করতে না। যে কারণে তিনি নিজ দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেন। এমন কি দেশ স্বাধীনের পর তিনি প্রধান মন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম এবং মুসলিম শব্দটি বাদ দেন।

[১] প্রতিষ্ঠাকালীন সময় নিজ দলের নাম ছিল ''আওয়ামী মুসলিম লীগ'' পাকিস্তান আমলেই মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ''আওয়ামী লীগ'' করা হয়।

[২] ছাত্রলীগের পূর্ব নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর 'মুসলিম' শব্দ বাদ দিয়ে শুধু 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ' করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নাম রাখা হয় !

[৩] পাকিস্তান আমলে কুরআন তেলোয়াত করে আঃ লীগের মিটিং শুরু করা হত আর খোদা হাফেজ বলে মিটিং শেষ করা হত। দেশ স্বধীনের পর তারা দলীয় সংগীত গেয়ে মিটিং শুরু করেন আর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে মিটিং শেষ করেন !

[৪] ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিতিষ্ঠা করার পর বঙ্গবন্ধু রেডিও, টেলিভশন ও জনসমাবেশের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দেন। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর খোন্দকার মোস্তাক আহমদ তা পূণরায় চালু করেন !

[৫] স্বাধীনের পর মুসলমানের দূরভাগ্যের কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' শিরকী গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা হয়। এই গানটি অথচ একটি শিরিক এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের শুরু দিকে বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধী।
 
ইতিহাস রচনার নামে বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু যে মিথ্যাচার ঢুকানো হয়েছে তা নয়,মুজিব ও তার দলের দুঃশাসনের বিবরণগুলো ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে অতি সতর্কতার সাথে বাদ দেয়া হয়েছে এবং তা ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির স্বার্থে। তবে কোন অপরাধী তার অপরাধ কর্মগুলো লুকানোর যত চেষ্টাই করুক না কেন,সম্পূর্ণ লুকাতে পারে না। সাক্ষী রেখে যায়। শেখ মুজিবও তার সহচরগণও অসংখ্য সাক্ষী রেখে গেছে। আর সেগুলি হলো,সে সময়ের দেশী ও বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মুজিব আমলের বিবরণ। আগামী দিনের ইতিহাস রচনায় এ বিবরণগুলোই গণ্য হবে গুরুত্বপূর্ণ দলিল রূপে। শেখ মুজিব ও তার দল বাংলাদেশকে যে কতটা বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল সে পরিচয় পাওয়া যাবে সে আমলের ঢাকার পত্রিকাগুলো পড়লে। নিজ ঘরে নিরাপত্তা না পেয়ে বহু মানুষ তখন বনজঙ্গলে লুকিয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১৭ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, “নিরাপত্তার আকুতি গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘর”। মূল খবরটি ছিল এরূপ,“সমগ্র দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবণতির ফলে এবং মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে গ্রাম-গঞ্জ ও শহরবাসীর মনে হতাশার মাত্রা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে এবং আইন রক্ষাকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা লোপ পাইতেছে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে,চুরি-ডাকাতি,লুটতরাজ তো আছেই,রাজনৈতিক,সামাজিক ও বৈষয়িক কারণে শত্রুতামূলক হত্যাকান্ডের ভয়ে মানুষ বাড়ীঘর ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লইতেছে। যাহারা বিত্তশালী তাহারা শহরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে এমনকি শহরের আবাসিক হোটেলগুলিতে পর্যন্ত আসিয়া উঠিতেছেন। যাঁহাদের শহরে বাস করিবার সঙ্গতি নাই,তাহার বনে-জঙ্গলে অথবা এখানে-ওখানে রাত্রি কাটাইতেছেন”।
১৯৭৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের কিছু খবরের শিরোনাম ছিলঃ “ঝিনাইদহে এক সপ্তাহে আটটি গুপ্তহত্যা”(০১/০৭/৭৩);“ঢাকা-আরিচা সড়কঃ সূর্য ডুবিলেই ডাকাতের ভয়” (০২/০৭/৭৩) “বরিশালে থানা অস্ত্রশালা লুটঃ ৪ ব্যক্তি নিহত” (৪/০৭/৭৩); “পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্তঃ সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র লুট” (১২/০৭/৭৩); “লৌহজং থানা ও ব্যাঙ্ক লুট”(২৮/০৭/৭৩); “দুর্বৃত্তের ফ্রি স্টাইল” (০১/০৮/৭৩); “পুলিশ ফাঁড়ি ও বাজার লুটঃ লঞ্চ ও ট্রেনে ডাকাতি”(৩/০৮/৭৩); “এবার পাইকারীহারে ছিনতাইঃ সন্ধা হইলেই শ্মশান”(১১/০৮/৭৩);”চট্টগ্রামে ব্যাংক ডাকাতি,লালদীঘিতে গ্রেনেড চার্জে ১৮ জন আহত, পাথরঘাটায় রেঞ্জার অফিসের অস্ত্র লুট” (১৫/০৮/৭৩); “খুন ডাকাতি রাহাজানিঃ নোয়াখালীর নিত্যকার ঘটনা,জনমনে ভীতি” (১৬/০৮/৭৩);“২০ মাসে জামালপুরে ১৬১৮টি ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড” (১৭/১১/৭৩);“আরও একটি পুলিশক্যাম্প লুটঃ সুবেদরসহ ৩ জন পুলিশ অপহৃত” (১৩/০৭/৭৩);”যশোরে বাজার লুটঃ দুর্বৃত্তের গুলীতে ২০ জন আহত” (১৮/০৪/৭৪);“রাজশাহীতে ব্যাংক লুট” (২১/৪/৭৪) মুজিব আমলের পত্রিকাগুলো পড়লে চোখে পড়বে এরূপ হাজার হাজার ঘটনা ও বহু হাজার বিয়োগান্ত খবর। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে দুর্বৃত্তির যত না ঘটনা ঘটেছে মুজিবের ৪ বছরে তার চেয়ে বহু গুণ বেশী ঘটেছে। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে “ভিক্ষার ঝুলী”-এ খেতাব জুটিনি, কিন্তু মুজিব সেটি অর্জন করেছেন। অথচ কিছু কাল আগেও গ্রামবাংলার অধিকাংশ মানুষের গৃহে কাঠের দরজা-জানালা ছিল না। ঘরের দরজায় চট বা চাটাই টানিয়ে অধিকাংশ মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে রাত কাটাতো। কিন্তু মুজিব শুধু খাদ্যই নয়,সে নিরাপত্তাটুকুও কেড়ে নেন। নিরাপত্তার খোঁজে তাদেরকে ঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় খুঁজতে হয়। থানা পুলিশ কি নিরাপত্তা দিবে? তারা নিজেরাই সেদিন ভুগেছিল চরম নিরাপত্তাহীনতায়। দুর্বৃত্তদের হাতে তখন বহু থানা লুট হয়েছিল। বহু পুলিশ অপহৃত এবং নিহতও হয়েছিল। মুজিবের নিজের দলীয় কর্মীদের সাথে তার নিজের পুত্রও নেমেছিল দুর্বৃত্তিতে। সে সময় দৈনিক পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিলঃ “স্পেশাল পুলিশের সাথে গুলী বিনিময়ঃ প্রধানমন্ত্রীর তনয়সহ ৫ জন আহত”। মূল খবরটির ছাপা হয়েছিল এভাবেঃ “গত শনিবার রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকার কমলাপুর স্পেশাল পুলিশের সাথে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রধানমন্ত্রী তনয় শেখ কামাল,তার ৫ জন সাঙ্গপাঙ্গ ও একজন পুলিশ সার্জেন্ট গুলীবিদ্ধ হয়েছে। শেখ কামাল ও তার সঙ্গীদেরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নয়,দশ ও তেত্রিশনম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে। আহত পুলিশ সার্জেন্ট জনাব শামীম কিবরিয়াকে ভর্তি করা হয় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে।” -(গণকন্ঠ,১৯/১২/৭৩)।

ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ প্রকাশ্য মানুষ খুন করত -সে বিবরণ বহু পত্রিকায় বহু ভাবে এসেছে। যাদেরকে আওয়ামী লীগ বাঙালীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে তুলে ধরছে এ ছিল তাদের আসল চরিত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বা মনন্তর এসেছে তিনবার। এর মধ্যে দুই বার এসেছে ব্রিটিশ আমলে। এবং তা ১৭৬১ সালে এবং ১৯৪৩ সালে। তৃতীয়বার এসেছে মুজিব আমলে। পাকিস্তানী আমলে একবারও আসেনি। অথচ এ পাকিস্তান আমলটিকেই আওয়ামী-বাকশালী বুদ্ধিজীবী ও নেতা-কর্মীগণ চিত্রিত করেছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঔপনিবেশিক শোষণ কাল রূপে। অথচ ১৯৪৭-এ পাকিস্তান আমলের শুরুটি হয়েছিল অনেকটা শূন্য থেকে। তখন অফিস আদালত ছিল না,কলকারখানা ছিল না। সহযোগী প্রতিবেশী রাষ্ট্রও ছিল না। বরং ছিল ভারত থেকে তাড়া খাওয়া লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের ভিড়। মুজিবামলের ন্যায় সে সময় বিদেশ বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকার সাহায্যও আসেনি। কিন্তু সে দিন কোন দুর্ভিক্ষ আসেনি।অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশী সাহায্য সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ এসেছিল মুজিবামলে। দুর্ভিক্ষ এসেছিল শেখ মুজিবের দুর্নীতি পরায়ন প্রশাসন এবং তাঁর দলের নেতাকর্মী ও ভারতীয় সরকারি ও বেসরকারি দুর্বৃত্তদের দ্বারা লুটপাটের কারণে। সে সময়ে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবরের দিকে নজর দেয়া যাক। বাংদেশের ৭০ জন বিশিষ্ঠ সাংবাদিক,সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে দেশের পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যাভাব ও অর্থনৈতিক সঙ্কট অতীতের সর্বাপেক্ষা জরুরী সঙ্কটকেও দ্রুতগতিতে ছাড়াইয়া যাইতেছে এবং ১৯৪৩ সনের সর্বগ্রাসী মনন্তর পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গিয়াছে। তাঁহারা সরকারের লঙ্গরখানার পরিবেশকে নির্যাতন কেন্দ্রের পরিবেশের শামিল বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন,“দুর্ভিক্ষ মানুষ দ্বারা সৃষ্ট এবং একটি বিশেষ শ্রেণীর অবাধ লুন্ঠন ও সম্পদ-পাচারের পরিণতি”। তাঁরা বলেন,“খাদ্য ঘাটতি কখনও দুর্ভিক্ষের মূল কারণ হইতে পারে না। সামান্যতম খাদ্য ঘাটতির ক্ষেত্রেও শুধু বণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা যায়। যদি দেশের উৎপাদন ও বণ্টন-ব্যবস্থা নিম্নতম ন্যায়নীতি উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিত,দেশের প্রশাসন,ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিচারকে নিশ্চিত করার সামান্যতম আন্তরিক চেষ্টাও থাকিত তাহা হইলে যুদ্ধের তিন বছর পর এবং দুই হাজার কোটি টাকারও বেশী বৈদেশিক সাহায্যের পর ১৯৭৪ সনের শেষার্ধে আজ বাংলাদেশে অন্ততঃ অনাহারে মৃত্যুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হইত না।”
 (ইত্তেফাক,অক্টোবর ১,১৯৭৪) সে সময়ের পত্রিকার কিছু শিরোনাম ছিলঃ “চালের অভাবঃ পেটের জ্বালায় ছেলে মেয়ে বিক্রি”-(গণকন্ঠ আগস্ট ২৩,১৯৭২);“লাইসেন্স-পারমিটের জমজমাট ব্যবসা;যাঁতাকলে পড়ে মানুষ খাবি খাচ্ছে;সিরাজগঞ্জ,ফেনী,ভৈরব,ইশ্বরগঞ্জ ও নাচোলে তীব্র খাদ্যাভাব,অনাহারী মানুষের আহাজারীঃ শুধু একটি কথা,খাবার দাও”- (গণকণ্ঠ আগস্ট ২৯,১৯৭২)।“গরীব মানুষ খাদ্য পায় নাঃ টাউটরা মজা লুটছে;গুণবতীতে চাল আটা নিয়ে হরিলুটের কারবার”-(গণকন্ঠ সেপ্টেম্বর ১৯,১৯৭২);“একদিকে মানুষ অনাহারে দিন যাপন করিতেছেঃ অপরদিকে সরকারি গুদামের গম কালোবাজারে বিক্রয় হইতেছে”-(ইত্তেফাক এপ্রিল ৭,১৯৭৩);“এখানে ওখানে ডোবায় পুকুরে লাশ।”-(সোনার বাংলা এপ্রিল ১৫,১৯৭৩);“চালের অভাবঃ পেটের জ্বালায় ছেলে মেয়ে বিক্রি;হবিগঞ্জে হাহাকারঃ অনাহারে এ পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ,মে ৩,১৯৭৩);“কোন এলাকায় মানুষ আটা গুলিয়া ও শাক-পাতা সিদ্ধ করিয়া জঠর জ্বালা নিবারণ করিতেছে”-(ইত্তেফাক,মে ৩,১৯৭৩);“অনাহারে দশজনের মৃত্যুঃ বিভিন্ন স্থানে আর্ত মানবতার হাহাকার;শুধু একটি ধ্বনিঃ ভাত দাও”-(গণকন্ঠ মে ১০,১৯৭৩);“লতাপতা,গাছের শিকড়,বাঁশ ও বেতের কচি ডগা,শামুক, ব্যাঙার ছাতা,কচু-ঘেচু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যে পরিণতঃ গ্রামাঞ্চলে লেংটা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি”-(ইত্তফাক মে ১০,১৯৭৩); “পটুয়াখালীর চিঠিঃ অনাহারে একজনের মৃত্যু;সংসার চালাতে না পেরে আত্মহত্যা”-(গণকন্ঠ মে ১০, ১৯৭৩); “ওরা খাদ্যভাবে জর্জরিতঃ বস্ত্রাভাবে বাহির হইতে পারে না”-(ইত্তেফাক,মে ৩০,১৯৭৩);“আত্মহত্যা ও ইজ্জত বিক্রির করুণ কাহিনী”-(গণকন্ঠ,জুন ১,১৯৭৩);“স্বাধীন বাংলার আরেক রূপঃ জামাই বেড়াতে এলে অর্ধ-উলঙ্গ শ্বাশুরী দরজা বন্ধ করে দেয়”- (সোনার বাংলা,জুলাই ১৫,১৯৭৩);“গ্রামবাংলায় হাহাকার,কচু-ঘেচুই বর্তমানে প্রধান খাদ্য”-(ইত্তেফাক,এপ্রিল,১৯৭৪);“দুঃখিনী বাংলাকে বাঁচাও”-(ইত্তেফাক আগস্ট ৪,১৯৭৪);“জামালপুরে অনাহারে ১৫০ জনের মৃত্যুর খবর”-(ইত্তেফাক আগস্ট ১৩,১৯৭৪);“১০দিনে জামালপুর ও ঈশ্বরদীতে অনাহার ও অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে ৭১ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ আগস্ট ২৭,১৯৭৪)।
১৯৭২ সনের ২১ অক্টোবর তারিখে দৈনিক গণকন্ঠে একটি খবর ছিলঃ “পেটের দায়ে কন্যা বিক্রি”। ভিতরে সংবাদটি ছিল এরকম- “কিছুদিন পূর্বে কুড়িগ্রাম পৌরসভার সন্নিকটস্থ মন্ডলের হাটনিবাসী রোস্তম উল্লাহর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন তার আদরের দুলালী ফাতেমা খাতুনকে (৭ বছর) পৌরসভার জনৈক পিয়ন জমির উদ্দীনের কাছে মাত্র ছয় টাকায় বিক্রি করে দেয়”। ১৯৭৩ সালে ৮ই জুলাই সোনার বাংলা “ফেন চুরি” শিরোনামায় এ খবরটি ছাপে- “বাঁচার তাগিদে এক মালসা ফেন। দু’দিন না খেয়ে থাকার পর এক বাড়ীর রান্না ঘর থেকে ফেন চুরি করলো সে। চুরি করে ধরা পড়লো। শুকনো মুখো হাড্ডীসার ছেলেটির গালে ঠাস ঠাস পড়লো সজোরে থাপ্পর। চোখে অন্ধকার দেখলো সে এবং মাথা ঘুরে পড়ে গেল। গ্রামের নাম দরগাপুর,থানা আশাশুনি,জেলা খুলনা। গাজী বাড়ির বাচ্চা। বয়স সাত-আট বছর। গুটি বসন্তে পিতা মারা গেছে। মা কাজ করে যা পায় তাতে কোলের ভাই-বোন দুটোর হলেও বাকী দুই বোন আর বাচ্চার হয় না। বাচ্চা তাই প্রতিদিন একটা ভাড়া নিয়ে বের হয়। দ্বারে দ্বারে ফেন মাগে, এই ভাবেই তিন ভাই বোন চলে”। ১৯৭৪ সনের ২৩শে মার্চ ইত্তেফাক খবর ছাপে,“মরা গরুর গোশত খাইয়া ভোলা মহকুমার বোরহানু্‌দ্দিন থানার ১০ ব্যক্তি মারা গিয়াছে এবং ৬০ জন অসুস্থ্ হইয়া পড়িয়াছে” -এই খবরে বিস্মিত হইবার বা ইহাতে বিশ্বাস স্থাপন না করিবার কিছু নাই। স্বয়ং সরকারদলীয় স্থানীয় এম. পি.সাংবাদিকদের এই খবর দিয়াছেন। জান বাঁচানোর জন্য মানুষ মরা গরু খাইতে আরম্ভ করিয়াছে,তবু বাঁচিতে পারিতেছে না,বরং মরা গরুর গোশত খাইয়া আরও আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িতেছে। এ খবর বড় মর্মান্তিক,বড় সাংঘাতিক”। ১৯৭৪ সালের ৪ আগস্ট সোনার বাংলায় ছাপা হয়, “ঢোল পিটিয়ে মানুষ বিক্রিঃ মানবশিশু আজ নিত্য দিনের কেনা-বেচার পণ্য”। মূল খবরটা ছিল এরূপঃ “হাটের নাম মাদারীগঞ্জ। মহকুমার নাম গাইবান্ধা। সেই মাদারীগঞ্জ হাটে ঘটেছে একটা ঘটনা। একদিন নয়, দু'দিন। ১০ই এবং ১৩ই জুলাই। ১০ই জুলাই এক হাটে এক ব্যক্তি মাত্র একশ টাকার বিনিময়ে তার ৬/৭ বছরের শিশু পুত্রকে বিক্রি করে। দ্বিতীয় দিনে ১৩ জুলাই একই হাটে ৫-৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৮ টাকায়। প্রথমে বাজারে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয় মেয়ে বিক্রি করার ঘোষণা। ঢোল পিটানোর মেয়ে কিনতে ও দেখতে অনেক লোক জমা হয়। অবশেষে আটাশ টাকা দামে মেয়েটি বিক্রি হয়।”
সে সময়ে প্রকাশিত বহু খবরের মধ্যে এ খবরগুলিও ছাপা হয়,“ঈশ্বরদীতে ৬ কোটি টাকার তামার তার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দু'চার জন যারা ধরা পড়েছে,এবং তারা সবাই মুজিব বাহিনীর লোক। তারা পুলিশ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী”-(পূর্বদেশ,১১ মে ১৯৭২)।পটুয়াখালী থানার বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির হিড়িক পড়ে গেছে। কোন গ্রাম-বন্দরে দিনের বেলা ডাকাতি হয়। পুলিশকে খবর দিলে শেষ করে দেব বলে ভয় দেখায়। ফলে থানায় খুব কমই এজাহার হয়। ডাকাতদের দু'একজন এলএমজি হাতে থানার গেটে মোতায়েন থাকে যাতে দারগা-পুলিশ ডাকাতদের জারিক্রিত কারফিউ লংঘন করতে না পারে। -(পূর্বদেশ,৩১ মে ১৯৭২)। সম্প্রতি পাবনার সুজানগর থানাধীন ছয়টি গ্রামের ১১৮টি বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হয়। পাবনার পল্লীর লোকগুলো বাড়ি-ঘর ছেড়ে জঙ্গলে রাত কাটায়। -(দৈনিক বাংলা,৩০ আগস্ট ১৯৭২)। দিনমজুর ছাবেদ আলীর স্ত্রী মাত্র ৫ টাকা দামে পেটের দায়ে তার সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। -(সাপ্তাহিক বিচিত্রা,২০ জুলাই ১৯৭৩)। শেষ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলের হেদায়েত উল্লাহকে কাফন ছাড়াই কলাপাতার কাফনে কবরখানায় যেতে হলো।-(বঙ্গবার্তা,৪ অক্টোবর ১৯৭৩)।দেশের ঘরে ঘরে যখন বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তখন বৈদেশিক মুদ্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের তাস আমদানি করা হয়েছে। -(বঙ্গবার্তা,১২ ডিসেম্বর,১৯৭৩)। স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই ১৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভারতে পাচার হয়ে গেছে। -(জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানের বক্তৃতা,২৭ জানুয়ারি ১৯৭৪)। কয়েকদনি আগে জয়পুরহাটের মাংলীপাড়া গ্রামের আব্দুল কাদেরের কবর থেকে কাফন চুরি হয়ে গেছে। -(সাপ্তাহিক অভিমত,২৭ মে ১৯৭৪)। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের সচিব বলেছেন,১৯৭৩ সালের জুন থেকে ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ঢাকা শহরে তারা ১৪০০ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। আর ১৯৭৪ এর জুলাই হতে ১৯৭৫ এর জুলাই পর্যন্ত দাফন করেছে ৬২৮১টি বেওয়ারিশ লাশ। -(ইত্তেফাক,২১ অক্টোবর ১৯৭৫)।সারা দেশে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একজনের আত্মহ্ত্যা। -(হক কথা,১৯ মে ১৯৭৪)।গাইবা্ন্ধায় ওয়াগন ভর্তি ৬শ'মণ চাল লুট। রংপুরে ভুখা মিছিল।-(আমাদের কথা,১৯ এপ্রিল ১৯৭৪)। ক্ষুধার্ত মানুষের ঢলে ঢাকার রাজপথ নরকতুল্য। -(হলিডে,২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)।
১৯৭৪ সালে ৮ই সেপ্টেম্বর সোনার বাংলা আরেকটি ভয়ানক খবর ছাপে। খবরের শিরোনাম ছিলঃ “রেকর্ড সৃষ্টিকারী খবরঃ জঠর জ্বালায় বমি ভক্ষণ”। খবরে বলা হয়,একজন অসুস্থ্ ব্যক্তি গাইবান্ধার রেলওয়ে স্টেশনে প্রচুর পরিমাণে বমি করে। বমির মধ্যে ছিল ভাত ও গোশত। দু’জন ক্ষুধার্থ মানুষ জঠর জ্বালা সংবরণ করতে না পেয়ে সেগুলো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেছে। ১৯৭৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম ছিলঃ “রাজধানীর পথে পথে জীবিত কংকাল।” উক্ত শিরোনামে ভিতরের বর্ণনা ছিলঃ “শীর্নকায় কঙ্কালসার আদম সন্তান। মৃত না জীবিত বুঝিয়া ওঠা দুস্কর। পড়িয়া আছে রাজধানী ঢাকা নগরীর গলি হইতে রাজপথের এখানে সেখানে। হাড় জিরজিরে বক্ষে হাত রাখিয়াই কেবল অনুভব করা যায় ইহারা জীবিত না মৃত।”

১৯৭৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক খবরের শিরোনাম দেয়,“ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তচিৎকারে ঘুম ভাংগে”। খবরটি ছিল,“নিরন্ন, অভুক্ত,অর্ধভুক্ত,অর্ধনগ্ন ও কঙ্কালসার অসহায় মানুষের আহাজারি ও ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তচিৎকারে এখন রাজধানীর সমস্যা পীড়িত মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। অতি প্রত্যুষে হইতে গভীর রাত্রি পর্যন্ত দ্বারে দ্বারে করুণ আর্তি,“আম্মা! একখানা রুটি দ্যান। গৃহিনীর কখনো বিরক্ত হন,আবার কখনও আদম সন্তানের এহেন দুর্দশা দেখিয়া অশ্রুসজল হইয়া ওঠেন।” এ এক হৃদয়বিদারক চিত্র! বাংলাদেশের হাজারো বছরের ইতিহাসে বহু শাসক,বহু রাজা-বাদশাহ ক্ষমতায় বসেছে। সুলতানী আমল এসেছে,মোঘল আমল এসেছে,এসেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল। কিন্তু কোন আমলেও কি মানুষকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতটা নীচে নামতে হয়েছে যা হয়েছে মুজিব আমলে? বাংলা এক কালে সোনার বাংলা রূপে পরিচিত ছিল। দেশটিতে এক সময় প্রচুর প্রাচুর্য ছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে প্রশ্ন তুলেছেন,“সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” পাকিস্তানী শাসকবর্গ সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে -এ অভিযোগ এনে লাখো লাখো পোস্টার ছেপে ১৯৭০-এর নির্বাচন কালে দেশ জুড়ে বিতরন করা হয়েছিল। আর এভাবে পরিকল্পিত ভাবে মানুষকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপানো হয়েছিল। প্রশ্ন হলো,পাকিস্তান আমলে অভাবের তাড়নায় কোন মহিলাকে কি মাছধরা ঝাল পড়তে হয়েছে? কাউকে কি ক্ষুধার তাড়নায় বমি খেতে হয়েছে? কাউকে কি নিজ সন্তান বিক্রি করতে হয়েছে? এরূপ কোন ঘটনা পাকিস্তান আমলে হয়নি। সে সময় দেশ শ্মশান ছিল না,বরং সেরূপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে খোদ মুজিবের শাসনামলে। দেশবাসীকে তিনি অসহনীয় যাতনার মাঝে ফেলেছিলেন। সে যাতনার জিন্দান থেকে তিনি মুক্তির কোন রাস্তাও খোলা রাখেননি। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা আসলেও সে পথে বিদায়ের রাস্তাটি নিজের জন্যও খোলা রাখেননি। ফলে তাকে বিদায় নিতে সহিংসতার মধ্য দিয়ে। এজন্যই মুজিবের মৃত্যুতে ঢাকায় সেদিন শোক মিছল হয়নি। মুজিব ভক্তরাও সেদিন কালো ব্যাজও ধারণ করেনি। বরং তাঁর নিজ দলের প্রথম সারির নেতারাও সেদিন মুজিবের লাশ সিড়িঁর নীচে ফেলে মন্ত্রীত্বের শপথ নিয়েছেন।
 
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের আমলের খুন-গুম নিয়ে আহমদ মূসার লেখা ‘স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সূচনা পর্ব: ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’’ নামক বই থেকে পাঠকদের অবগতির জন্য এখানে মাত্র তিনটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো।

এক.
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার ইকোরটিয়াই মুজিব বাহিনীর হাতে নিহত আববাস উদ্দিনের ভাই সামসুদ্দিন বলেছেন, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে শাহজাহান, আজিজ ও বাচ্চুর নেতৃত্বে একদল মুজিব বাহিনীর লোক এসে আমার মায়ের সামনে আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করল। ওরা যাওয়ার সময় বলে গেছে ওর লাশ শৃগাল কুকুরে খাবে, কেউ কবর দিলে তাকেও হত্যা করা হবে। কেউ কাঁদলে তাকেও হত্যা করা হবে। সকালে মেরে ওরা আবার বিকালে এসে দেখে গেছে লাশ কেউ কবর দিয়েছে কি না। কেউ কান্নাকাটি করছে কি না। পরে রাতের আঁধারে গ্রামবাসী বিলে নিয়ে লাশটি পুঁতে রাখে। এই হলো আওয়ামী লীগের মানবাধিকার রক্ষার শ্লোগানের বাস্তব চিত্র।

দুই.
একই এলাকায় মুজিব বাহিনীর নির্মম বুলেটের আঘাতে নিহত হয় রশিদ। রশিদের বাবা আব্দুল আলী বললেন, ওরা আমার কাছে এক হাজার টাকা চাঁদা চাইছিল। আমি গরীব মানুষ। টাকা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিছুদিন পর শাহজাহানের নেতৃত্বে একদল লোক এসে আমার সামনে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল মাথা কেটে দে, ফুটবল খেলব। আমি কি তা করতে পারি? আমি যে তার বাপ। অত্যাচার আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়? সহ্য করতে না পেরে অবশেষে নিজ হাতে ছেলের মাথা কেটে দিলাম। আমার ছেলে আওয়ামী লীগ করত না। এটাই ছিল তার অপরাধ।
পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আর কী হতে পারে? ওরা হত্যা করে আবার বাবাকে বাধ্য করেছে ছেলের মাথা কেটে দিতে। ওরা কি মানুষ ছিল?

তিন.
ভেড়ামারার কামালপুর কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ফজিলাতুন্নেসাকে গুলি করে হত্যা করে মুজিববাহিনীর লোকেরা। নিহতের ভাই ফিরোজ আহসান বললেন, তারা আমার বোনকে হত্যা করে আমাদের কাউকে লাশটি দাফন করতে দেয়নি। আমার বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের একটি মিটিং হয়েছিল। এটাই আমার বোনের অপরাধ।
শুধু তাই নয় ইতিহাস বলছে শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে শেখ কামালের কুকর্মেরও সীমা ছিলো না। ডাকাতি থেকে শুরু করে ধর্ষণ ছিলো খুব সামান্য বিষয়। মেজর ডালিমের বউকেও তুলে নিয়েগিয়ে ধর্ষণেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া ইতিহাস বলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ধর্ষণ করেই কালের বিবর্তনে আজ সে দেশপ্রেমিক।
১৯৭৪ সাল। তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন শিশু রাষ্ট্র। যুদ্ধ পরবর্তী একটি দেশের অবস্থা যতটা নাজুক থাকতে পারে, দেশের ও জনগণের অবস্থা একদম ঠিক তাই। দেশের সর্বময় ক্ষমতা তখন শেখ সাহেবের হাতে। তার কথাই আইন, তার কথাই বিচার। এখন যেমন হাজারও অন্যায় অত্যাচার দেখার পরেও কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। কেউ সাহস করে মুখ খুলতে তার অবস্থা হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মত। ঠিক তখনও কারও মুখে কোনো রা শব্দটি নেই। তেমনই এক সময়ে এক নবদম্পতি গাড়ীতে করে যাচ্ছিল গাজিপুর থেকে ঢাকার দিকে। স্বভাবতই চাঁদা কিংবা কে যায় দেখার জন্য গাড়ি থামায় জনৈক মোজাম্মেল। এই থামানোর অধিকার মোজাম্মেলের আছে। কারণ তিনি শেখ মুজিবের লোক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ বানিয়েছেন। গাড়ি থামিয়ে তিনি দেখতে পান সেখানে নতুন বউ। মেয়েটিকে দেখে পছন্দ হয় স্বয়ং মোজাম্মেলের!

তারপরের কাহিনী নিয়মিত ঘটনার মতোই। টঙ্গীর আওয়ামীলীগ নেতা ও দেশপ্রেমিক মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়িটি আটক করে। ড্রাইভার আর নববধূর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে, অতঃপর তিনদিন পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় টঙ্গী ব্রিজের নিচে।
পৈশাচিক এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় সর্বত্র। বিশেষ অভিযানে দায়িত্বরত মেজর নাসেরের হাতে মোজাম্মেল ধরা পড়ে। মোজাম্মেল মেজরকে বলে- ঝামেলা না করে আমাকে ছেড়ে দিন, আপনাকে তিন লাখ টাকা দেবো। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাবো। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না। মেজর নাসের হুঙ্কার ছাড়লেন, এটা তুচ্ছ বিষয়? আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করবো। তোমার তিনলাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখো।

এরপরের কাহিনী অতি সরল। কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোজাম্মেলের বাবা, দুই ভাই গেল শেখ সাহেবের কাছে। তিনি ঢোকা মাত্র মোজাম্মেল এর বাবা ও দুই ভাই কেঁদে তার পায়ে পড়লো। টঙ্গী আওয়ামী লীগ এর সভাপতিও পায়ে ধরার চেষ্টা করলেন। পা খুঁজে পেলেন না। শেখ সাহেবের পা তখন মোজাম্মেল এর আত্মীয় স্বজনের দখলে।
শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কি? টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, আমাদের সোনার ছেলে মোজাম্মেলকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। মেজর নাসির তাকে ধরে নিয়ে গেছে। বলেছে তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিবে। কাঁদতে কাঁদতে আরো বললো, এই মেজর আওয়ামী লীগের নাম শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, টঙ্গীতে আমি আওয়ামী লীগের কোন শূয়োর রাখবো না। বঙ্গবন্ধু, আমি নিজেও এখন ভয়ে অস্থির! টঙ্গীতে থাকি না। ঢাকায় চলে আসছি। (ক্রন্দন)
এবার হুঙ্কার ছাড়লেন মুজিব, কান্দিস না। কান্দার মত কিছু ঘটে নাই। আমি এখনো বাইচ্যা আছি তো, মইরা তো যাই নাই। এখনি ব্যবস্থা নিতাছি। অতঃপর মোজাম্মেলকে তাৎক্ষণিক ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মেজর নাসেরকে টঙ্গী থেকে সরিয়ে দেয়ার জরুরী আদেশ দেওয়া হলো। মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঁঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রন করেছিল।
এছাড়া, সিরাজ শিকদারকে কারা গুলি করে হত্যা করেছে? শেখ মুজিবের গুন্ডা বাহিনীই সিরাজ শিকদারকে হত্যা করেছি। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিব দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেছিল-কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?
কিন্তু, সেই গুম-খুন- ধর্ষণের নায়ক শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা আজ বড় গলায় বলছেন যে, তাদের আমলে দেশে কোনো গুম-খুনে ও ধর্ষণের মত কোন ঘটনা ঘটেনি। যা রীতিমত হাস্যকর।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুমের শিকার হয়েছেন ৫২০ জন।অথচ, শেখ হাসিনা বলছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোন গুমের ঘটনা ঘটেনি। এমনকি খুন-গুমের সকল দায়ভার তিনি বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছেন।
এছাড়া অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায় ২০১৩ সালে সারাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছিল ৩৬৫০টি। পরের বছর মামলা সংখ্যা আরও ৪৫টি বেড়ে হয় ৩৬৯৫টি। ২০১৫ সালে ধর্ষণের মামলা আরও বেড়ে হয় ৩৯৩০টি। ২০১৬ সালে এটা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৭২৮টি। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৯৫ টি। আর ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৫৯২ টি অর্থাৎ দিনে প্রায় ১২ টি ধর্ষণের মামলা হচ্ছে দেশে। দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছেই। শেখ হাসিনা সরকারের ২য় মেয়াদে বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২১৫৯০ টি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।

আসক এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অথচ ধর্ষণের শতকরা মাত্র তিন ভাগ মামলার অপরাধীরা শাস্তি পায়। আসকের হিসেব মতে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ৫৯টি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন।
 
 
১৯৭৪ সালের ৩০ শে মার্চ গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছিল, “আলীমুদ্দিন ক্ষুধার্ত। সে ছেঁড়া ছাতা মেরামত করে। বলল, যেদিন বেশী কাজ মেলে, সেদিন এক বেলা ভাত খাই। যেদিন তেমন কাজ পাই না সেদিন ভাতের বদলে চাপাতি খাই। আর এমন অনেক দিন যায় যেদিন কিছুই খেতে পাই না।” তার দিকে এক নজর তাকালে বুঝা যায় সে সত্য কথাই বলছে। সবুজ লুঙ্গির নীচে তার পা দু'টিতে মাংস আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার ৪০ মাইল উত্তরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ। ১৫ হাজার লোকের বসতি। তাদের মধ্যে আলীমুদ্দিনের মত আরো অনেকে আছে। কোথাও একজন মোটা মানুষ চোখে পড়ে না। কালু বিশ্বাস বলল, “আমাদের মেয়েরা লজ্জায় বের হয় না-তারা নগ্ন।” আলীমুদ্দিনের কাহিনী গোটা মানিকগঞ্জের কাহিনী। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাহিনী,শত শত শহর বন্দরের কাহিনী। এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে ৫০ লাখ টনেরও বেশী খাদ্যশস্য বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য পাঠানো হয়েছে তারা পায়নি।”
১৯৭৪ সালের ২৭ সেপ্টম্বর তারিখে লন্ডনের নিউ স্টেট্সম্যান লিখেছিল,
“বাংলাদেশ আজ বিপদজনক ভাবে অরাজকতার মুখোমুখি। লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত। অনেকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। .. ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে।.. বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া। গত আঠার মাসে চালের দাম চারগুণ বেড়েছে। সরকারি কর্মচারিদের মাইনের সবটুকু চলে যায় খাদ্য-সামগ্রী কিনতে। আর গরীবরা থাকে অনাহারে। কিন্তু বিপদ যতই ঘনিয়ে আসছে শেখ মুজিব ততই মনগড়া জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবছেন, দেশের লোক এখনও তাঁকে ভালবাসে;সমস্ত মুসিবতের জন্য পাকিস্তানই দায়ী। আরো ভাবছেন, বাইরের দুনিয়ী তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ উদ্ধার পাবে। নিছক দিবাস্বপ্ন.. দেশ যখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে,তখনও তিনি দিনের অর্ধেক ভাগ আওয়ামী লীগের চাঁইদের সাথে ঘরোয়া আলাপে কাটাচ্ছেন। .. তিনি আজ আত্মম্ভরিতার মধ্যে কয়েদী হয়ে চাটুকার ও পরগাছা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।.. সদ্য ফুলে-ফেঁপে ওঠা তরুণ বাঙালীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভীড় জমায়। তারা বেশ ভালই আছে। এরাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা- বাংলাদেশের বীর বাহিনী। .. এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য। আওয়ামী লীগের ওপর তলায় যারা আছেন তারা আরো জঘন্য। .. শুনতে রূঢ় হলেও কিসিঞ্জার ঠিকই বলেছেনঃ “বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি।”
১৯৭৪ সালে ২রা অক্টোবর,লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় জেকুইস লেসলী লিখেছিলেন,
“একজন মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আর অসহায় দুষ্টিতে তার মরণ-যন্ত্রণাকাতর চর্মসার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হতে চায় না, তাই কথাটি বোঝাবার জন্য জোর দিয়ে মাথা নেড়ে একজন ইউরোপীয়ান বললেন, সকালে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন,এমন সময় এক ভিখারি এসে হাজির। কোলে তার মৃত শিশু। ..বহু বিদেশি পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান দুর্ভিক্ষের জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী। “দুর্ভিক্ষ বন্যার ফল ততটা নয়,যতটা মজুতদারী চোরাচালানের ফল”-বললেন স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ।.. প্রতি বছর যে চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ ১০ লাখ টন।”
১৯৭৪ সালের ২৫ অক্টোবর হংকং থেকে প্রকাশিত ফার ইষ্টার্ণ ইকনমিক রিভিয়্যূ পত্রিকায় লরেন্স লিফঅসুলজ লিখেছিলেন,
সেপ্টেম্বর তৃতীয় সপ্তাহে হঠাৎ করে চাউলের দাম মণ প্রতি ৪০০ টাকায় উঠে গেল। অর্থাৎ তিন বছরে আগে -স্বাধীনতার পূর্বে যে দাম ছিল - এই দাম তার দশ গুণ। এই মূল্যবৃদ্ধিকে এভাবে তুলনা করা যায় যে, এক মার্কিন পরিবার তিন বছর আগে যে রুটি ৪০ সেন্ট দিয়ে কিনেছে,তা আজ কিনছে ৪ পাউন্ড দিয়ে। কালোবাজারী অর্থনীতির কারসাজিতেই এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।.. ২৩শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন, “প্রতি ইউনিয়নে একটি করে মোট ৪,৩০০ লঙ্গরখানা খোলা হবে।" প্রতি ইউনিয়নের জন্য রোজ বরাদ্দ হল মাত্র দুমন ময়দা। যা এক হাজার লোকের প্রতিদিনের জন্য মাথাপিছু একটি রুটির জন্যও যথেষ্ট নয়।”
নিউয়র্ক টাইমস পত্রিকা ১৯৭৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর তারিখে লিখেছিলঃ
জনৈক কেবিনেট মন্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে একজন বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ বললেন,“যুদ্ধের পর তাঁকে (ঐ মন্ত্রীকে) মাত্র দুই বাক্স বিদেশি সিগারেট দিলেই কাজ হাসিল হয়ে যেত, এখন দিতে হয় অন্ততঃ এক লাখ টাকা।” ব্যবসার পারমিট ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আওয়ামী লীগারদের ঘুষ দিতে হয়। সম্প্রতি জনৈক অবাঙ্গালী শিল্পপতী ভারত থেকে ফিরে আসেন এবং শেখ মুজিবের কাছ থেকে তার পরিত্যক্ত ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানাটি পুরনরায় চাল করার অনুমোদন লাভ করেন। শেখ মুজিবের ভাগিনা শেখ মনি -যিনি ঐ কারখানাটি দখল করে আছেন-হুকুম জারি করলেন যে তাকে ৩০ হাজার ডলার দিতে হবে। শেখ মুজিবকে ভাল করে জানেন এমন একজন বাংলাদেশী আমাকে বললেন, “লোকজন তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করুক, এটা তিনি পছন্দ করেন। তাঁর আনুগত্য নিজের পরিবার ও আওয়ামী লীগের প্রতি। তিনি বিশ্বাসই করেন না যে, তারা দুর্নীতিবাজ হতে পারে কিংবা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।”
দেখা যাক, প্রখ্যাত তথ্য-অনুসন্ধানী সাংবাদিক জন পিলজার ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সম্পর্কে কি বলেছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর লন্ডনের ডেইলী মিরর পত্রিকায় লিখেছেনঃ
“একটি তিন বছরের শিশু -এত শুকনো যে মনে হল যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম। মনে হল তার চামড়া আমার আঙ্গুলে মোমের মত লেগে গেছে। এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্বস্বাস্থ্ সংস্থার মতে ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে।”
পিলজারের সে বক্তব্য এবং বিশ্বস্বাস্থ সংস্থার সে অভিমতের প্রমাণ মেলে ইত্তেফাকের একটি রিপোর্টে। উত্তর বংগের এক জেলেপাড়ার বস্ত্রহীন বাসন্তি জাল পড়ে লজ্জা ঢেকেছিল। সে ছবি ইত্তেফাক ছেপেছিল। পিলজার আরো লিখেছেন,
“সন্ধা ঘনিয়ে আসছে এবং গাড়ী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম-এর লরীর পিছনে পিছনে চলেছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন,“স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়ত কয়েক জন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি- সবই অনাহার জনিত মৃত্যু।”
লন্ডনের “ডেইলী টেলিগ্রাফ” ১৯৭৫ সালের ৬ই জানুয়ারী ছেপেছিল,
“গ্রাম বাংলায় প্রচুর ফসল হওয়া সত্ত্বেও একটি ইসলামিক কল্যাণ সমিতি (আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম) গত মাসে ঢাকার রাস্তা,রেল স্টেশন ও হাসাপাতালগুলোর মর্গ থেকে মোট ৮৭৯টি মৃতদেহ কুড়িয়ে দাফন করেছে। এরা সবাই অনাহারে মরেছে। সমিতিটি ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে ২৫৪৩টি লাশ কুড়িয়েছে- সবগুলি বেওয়ারিশ। এগুলোর মধ্যে দেড় হাজারেরও বেশী রাস্তা থেকে কুড়ানো। ডিসেম্বরের মৃতের সংখ্যা জুলাইয়ের সংখ্যার সাতগুণ।.. শেখ মুজিবকে আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বোঝা বলে আখ্যায়ীত হচ্ছে। ছোট-খাটো স্বজনপ্রাতির ব্যাপারে তিনি ভারী আসক্তি দেখান। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বাকী পড়ে থাকে।.. অধিকাংশ পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস, আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট রোধ করার কোন সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম এ সরকারের নেই। রাজনৈতিক মহল মনে করেন, মুজিব খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ আরো নষ্ট করে দেবেন। তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার পরিকল্পনা করছেন। ডেইলী টেলিগ্রাফের আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। জরুরী অবস্থা জারি করেছেন, আরো বেশী ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। অবশেষে তাতেও খুশি হননি, সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে তিনি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আওয়ামী লীগ যাকে নিয়ে গর্ব করে, এ হল তার অবদান।
১৯৭৫ সালের ২১শে মার্চ বিলেতের ব্রাডফোর্ডশায়র লিখেছিল,
“বাংলাদেশ যেন বিরাট ভূল। একে যদি ভেঙ্গে-চুরে আবার ঠিক করা যেত। জাতিসংঘের তালিকায় বাংলাদেশ অতি গরীব দেশ। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে যখন বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দেশের দক্ষিণ অঞ্চল ডুবে যায় তখন দুনিয়ার দৃষ্টি এ দেশের দিকে - অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নিবদ্ধ হয়। রিলিফের বিরাট কাজ সবে শুরু হয়েছিল। এমনি সময়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুণ জ্বলে উঠল। --কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ যখন শুরু হল, তখন জয়ের কোন সম্ভাবনাই ছিল না। একমাত্র ভারতের সাগ্রহ সামরিক হস্তক্ষেপের ফলেই স্বল্পস্থায়ী-কিন্তু ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী- যুদ্ধের পর পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।” পত্রিকাটি লিখেছে, “উড়োজাহাজ থেকে মনে হয়, যে কোন প্রধান শহরের ন্যায় রাজধানী ঢাকাতেও বহু আধুনিক অট্রালিকা আছে। কিন্তু বিমান বন্দরে অবতরণ করা মাত্রই সে ধারণা চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। টার্মিনাল বিল্ডিং-এর রেলিং ঘেঁষে শত শত লোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে,কেননা তাদের অন্য কিছু করার নাই। আর যেহেতু বিমান বন্দর ভিক্ষা করবার জন্য বরাবরই উত্তম জায়গা।”
পত্রিকাটি আরো লিখেছে,“আমাকে বলা হয়েছে,অমুক গ্রামে কেউ গান গায়না। কেননা তারা কি গাইবে? আমি দেখেছি, একটি শিশু তার চোখে আগ্রহ নেই,গায়ে মাংস নেই। মাথায় চুল নাই। পায়ে জোর নাই। অতীতে তার আনন্দ ছিল না, বর্তমান সম্পর্কে তার সচেতনতা নাই এবং ভবিষ্যতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না সে।”
দেশে তখন প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ চলছিল। হাজার হাজার মানুষ তখন খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছিল। মেক্সিকোর “একসেলসিয়র” পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবকে যখন প্রশ্ন করা হল, খাদ্যশস্যের অভাবের ফলে দেশে মৃত্যুর হার ভয়াবহ হতে পারে কিনা,শেখ মুজিব জবাব দিলেন,
“এমন কোন আশংকা নেই।”
প্রশ্ন করা হল, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টে বিরোধীদল বলেন যে, ইতিমধ্যেই ১৫ হাজার মানুষ মারা গেছে।”
তিনি জবাব দিলেন, “তারা মিথ্যা বলেন।”
তাঁকে বলা হল,“ঢাকার বিদেশি মহল মৃত্যু সংখ্যা আরও বেশী বলে উল্লেখ করেন।” শেখ মুজিব জবাব দিলেন,
“তারা মিথ্যা বলেন।”
প্রশ্ন করা হল, দূর্নীতির কথা কি সত্য নয়? ভূখাদের জন্য প্রেরিত খাদ্য কি কালোবাজারে বিক্রী হয় না..?
শেখ বললেন, “না। এর কোনটাই সত্য নয়।”(এন্টার প্রাইজ,রিভার সাইড,ক্যালিফোর্নিয়া, ২৯/০১/৭৫)
বাংলাদেশ যে কতবড় মিথ্যাবাদী ও নিষ্ঠুর ব্যক্তির কবলে পড়েছিল এ হল তার নমুনা। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে,সে দুর্ভিক্ষে হাজার মানুষ মরছে সেটি তিনি মানতে রাজী নন। দেশে কালোবাজারী চলছে, বিদেশ থেকে পাওয়া রিলিফের মাল সীমান্ত পথে ভারতে পাড়ী জমাচ্ছে এবং সীমাহীন দূর্নীতি চলছে সেটি বিশ্ববাসী মানলেও তিনি মানতে চাননি। অবশেষে পত্রিকাটি লিখেছে,
"যে সব সমস্যা তার দেশকে বিপর্যস্ত করত সে সবের কোন জবাব না থাকায় শেখের একমাত্র জবাব হচ্ছে তাঁর নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা বৃদ্ধি। জনসাধারণের জন্য খাদ্য না হোক,তার অহমিকার খোরাক চাই।" (এন্টার প্রাইজ,রিভার সাইড, ক্যালিফোর্নিয়া, ২৯/০১/৭৫)
শেখ মুজিব যখন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন তখন লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফে পীটার গীল লিখেছিলেন,
“বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দেশ থেকে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। গত শনিবার ঢাকার পার্লামেন্টের (মাত্র) এক ঘন্টা স্থায়ী অধিবেশনে ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে ক্ষমতা অর্পণ করেছে। অনেকটা নিঃশব্দে গণতন্ত্রের কবর দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদল দাবী করেছিল,এ ধরণের ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তিন দিন সময় দেওয়া উচিত। জবাবে সরকার এক প্রস্তাব পাশ করলেন যে,এ ব্যাপারের কোন বিতর্ক চলবে না। .. শেখ মুজিব এম.পি.দের বললেন, পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র ছিল “ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান”। তিনি দেশের স্বাধীন আদালতকে “ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যহতকারী” বলে অভিযুক্ত করলেন।”
অথচ পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব ও তাঁর আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পদ্ধতির গণতন্ত্রের জন্য কতই না চিৎকার করেছেন। তখন পাকিস্তানে আইউবের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গনতন্ত্রই তো ছিল। গণতন্ত্রের নামে আওয়ামী লীগের পতাকা তলে যে কতটা মেরুদন্ডহীন ও নীতিহীন মানুষের ভীড় জমেছিল সেটিও সেদিন প্রমাণিত হয়েছিল। এত দিন যারা গণতন্ত্রের জন্য মাঠঘাট প্রকম্পিত করত তারা সেদিন একদলীয় স্বৈরাচারি শাসন প্রবর্তনের কোন রূপ বিরোধীতাই করল না। বরং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এতবড় গুরুতর বিষয়ে যখন সামান্য তিন দিনের আলোচনার দাবী উঠল তখন সেটিরও তারা বিরোধীতা করল। সামান্য এক ঘন্টার মধ্যে এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিল। অথচ গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে এক টাকা ট্যাক্স বৃদ্ধি হলে সে প্রসঙ্গেও বহু ঘন্টা আলোচনা হয়। ভেড়ার পালের সব ভেড়া যেমন দল বেঁধে এবং কোন রুপ বিচার বিবেচনা না করে প্রথম ভেড়াটির অনুসরণ করে তারাও সেদিন তাই করেছিল। আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রের দাবী যে কতটা মেকী,সেটির প্রমাণ তারা এভাবেই সেদিন দিয়েছিল। দলটির নেতাকর্মীরা সেদিন দলে দলে বাকশালে যোগ দিয়েছিল,এরকম একদলীয় স্বৈরচারি শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের বিবেকে সামান্যতম দংশনও হয়নি।
১৯৭৪ সালে ১৮ অক্টোবর বোষ্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে ডানিয়েল সাদারল্যান্ড লিখেছিলেন,
“গত দুই মাসে যে ক্ষুধার্ত জনতা স্রোতের মত ঢাকায় প্রবেশ করেছে,তাদের মধ্যে সরকারের সমর্থক একজনও নেই। বন্যা আর খাদ্যাভাবের জন্য গ্রামাঞ্চল ছেড়ে এরা ক্রমেই রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এদেরকে রাজপথের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে না দিতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যককে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সারাদিন দুই এক টুকরা রুটি খেতে পাওয়া যায, মাঝে মাঝে দুই-একটা পিঁয়াজ ও একটু-আধটু দুধ মেলে। ক্যাম্পে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। “যে দেশে মানুষকে এমন খাঁচাবদ্ধ করে রাখা হয় সেটা কি ধরনের স্বাধীন দেশ”- ক্রোধের সাথে বলল ক্যাম্পবাসীদেরই একজন। ক্যাম্পের ব্লাকবোর্ডে খড়িমাটি দিয়ে জনৈক কর্মকর্তা আমার সুবিধার্থে প্রত্যেকের রুটি খাওয়ার সময়সূচীর তালিকা লিখে রেখেছেন। “তালিকায় বিশ্বাস করবেন না”-ক্যাম্পের অনেকেই বলল। তারা অভিযোগ করল যে, রোজ তারা এক বেলা খেতে পায়- এক কি দুই টুকরা রুটি। কোন এক ক্যাম্পের জনৈক স্বেচ্ছাসেবক রিলিফকর্মী জানাল যে, “সরকারী কর্মচারীরা জনসাধারণের কোন তোয়াক্কা করে না। তারা বাইরের জগতে সরকারের মান বজায় রাখতে ব্যস্ত। এ কারণেই তারা লোকদেরকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাচেছ। বিদেশিরা ভূখা-জনতাকে রাস্তায় দেখুক এটা তারা চায় না।”
১৯৭৪ সালে ৩০ অক্টোবর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় পিটার প্রেসটন লিখেছিলেন,
“এই সেদিনের একটি ছবি বাংলাদেশের দৃশ্যপট তুলে ধরেছে। এক যুবতি মা -তার স্তন শুকিয়ে হাঁড়ে গিয়ে লেগেছে,ক্ষুধায় চোখ জ্বলছে - অনড় হয়ে পড়ে আছে ঢাকার কোন একটি শেডের নীচে,কচি মেয়েটি তার দেহের উপর বসে আছে গভীর নৈরাশ্যে। দু’জনাই মৃত্যুর পথযাত্রী। ছবিটি নতুন,কিন্তু চিরন্তন। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা দুনিয়ার সবচেয়ে -কলিকাতার চেয়েও -বীভৎস শহরে পরিণত হয়েছে। সমস্ত বীভৎসতা সত্ত্বেও কোলকাতায় ভীড় করা মানুষের যেন প্রাণ আছে, ঢাকায় তার কিছুই নাই। ঢাকা নগরী যেন একটি বিরাট শরাণার্থী-ক্যাম্প। একটি প্রাদেশিক শহর ঢাকা লাখ লাখ জীর্ণ কুটীর, নির্জীব মানুষ আর লঙ্গরখানায় মানুষের সারিতে ছেয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে যখন খাদ্যাভাব দেখা দেয়, ভূখা মানুষ ঢাকার দিকে ছুটে আসে। ঢাকায় তাদের জন্য খাদ্য নেই। তারা খাদ্যের জন্য হাতড়ে বেড়ায়, অবশেষে মিলিয়ে যায়। গেল সপ্তাহে একটি মহলের মতে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই মাসে ৫০০ লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে। এর বেশীও হতে পারে, কমও হতে পারে। নিশ্চিত করে বলার মত প্রশাসনিক যন্ত্র নাই।.. জন্মের পর পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাহায্যের এক অভূতপূর্ব ফসল কুড়িয়েছিলঃ ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড। আজ সবই ফুরিয়ে গেছে। কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। রাজনীতিবিদ, পর্যবেক্ষক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান -সবাই একই যুক্তি পেশ করছে যা অপরাধকে নিরাপদ করছে, দায়িত্বকে করছে অকেজো। তাদের মোদ্দা যুক্তি হল এই যে, বাংলাদেশের ঝুলিতে মারাত্মক ফুটো আছে। যত সাহায্য দেওয়া হোক না কেন, দূর্নীতি, আলসেমী ও সরকারী আমলাদের আত্মঅহমিকার ফলে অপচয়ে ফুরিয়ে যাবে। বেশী দেওয়া মানেই বেশী লোকসান।”
পাত্রের তলায় ফুটো থাকলে পাত্রের মালামাল বেড়িয়ে যায়,তবে তা বেশী দূর যায় না। আশে পাশের জায়গায় গিয়ে পড়ে। তেমনি বাংলাদেশের তলা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সম্পদ হাজার মাইল দূরের কোন দেশে গিয়ে উঠেনি,উঠেছিল প্রতিবেশী ভারতে। আর এ ফুটোগুলো গড়ায় ভারতীয় পরিকল্পনার কথা কি অস্বীকার করা যায়? শেখ মুজিব সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারি বন্ধ না করে ভারতের সাথে চুক্তি করে সীমান্ত জুড়ে বাণিজ্য শুরু করেন। এভাবে সীমান্ত বাণিজ্যের নামে দেশের তলায় শুধু ফুটো নয়, সে তলাটিই ধ্বসিয়ে দিলেন। তলা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া সম্পদ তখন ভারতে গিয়ে উঠল। ভারত বস্তুতঃ তেমন একটি লক্ষ্য হাছিলের কথা ভেবেই সীমান্ত বাণিজ্যের প্রস্তাব করেছিল। মুজিব সেটাই বিনা দ্বিধায় ভারতের হাতে তুলে দিলেন। বাংলাদেশের বাজারে তখন আর রাতের আঁধারে চোরাচলানকারী পাঠানোর প্রয়োজন পড়েনি। দিনদুপুরে ট্রাক-ভর্তি করে বাংলাদেশের বাজার থেকে সম্পদ তুলে নিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা তখন পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানার যন্ত্রাংশ খুলে নামে মাত্র মূল্যে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়। তলাহীন পাত্র থেকে পানি বেরুতে সময় লাগে না, তেমনি দেশের তলা ধ্বসে গেলে সময় লাগে না সে দেশকে সম্পদহীন হতে। ভারতের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যের দাড়িয়েছিল,ত্বরিৎ বেগে দূর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল বাংলাদেশে।

শেখ মুজিবের বর্বরতার নমুনাঃ

কোনো কালেই আওয়ামীদের বর্বর নির্যাতন অত্যাচার থেকে দেশের জনগণ রক্ষা পাইনি । একাত্তরে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানীদের বর্বরতা ও নৃশংসতার কাহিনী শুনলে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভের পরও বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকে। বাহাত্তর থেকে পচাত্তর এ কয়েক বছরে ২৫ হাজার বিরোধী বামপন্থী রাজনীতিক, পরাজিত বিহারী, রাজাকার ও শান্তি কমিটি, ইসলামপন্থী এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদেরকেও পাকিস্তানীদের মতোই পাশবিক কায়দায় হত্যা করে রক্ষী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের খবর ব্যাপকভাবে জাতির সামনে আসেনি। কেউ ভোলে কেউ ভোলে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মতপার্থক্যজনিত বিরোধের ফল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থীরা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হত্যার শিকারে পরিণত হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রশক্তি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় শক্তি ব্যবহার করা হয়।

আহমদ মুসা তার ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ বইয়ে লিখেছেন, “আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, সেসব দলের মতে, সে আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে- যে নৃশংসতা অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানী সৈন্যদেরও ছাড়িয়ে গেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, হয়রানি, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন কোনো কিছুই বাদ রাখা হয়নি।”

বামপন্থীদের ওপর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর হক কথা লিখে, “একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ প্রোগ্রামে এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের হিসেব হলো, বাংলাদেশে সোয়া লক্ষ বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করতে হবে। তা না হলে শোষণের হাতিয়ার মজবুত করা যাবে না।” (২৬ মে-১৯৭২ : সাপ্তাহিক হক কথা)

স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞে শেখ মুজিবের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং সিআইএ’ গ্রন্থে। ঐ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।

সুতরাং মুজিব আমলে এসব হত্যাকাণ্ড যে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার আমরা আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনীর নির্মমতার কিছু কাহিনী তুলে ধরবো।

মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর: ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিএ হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন।(২ জুন-১৯৭২ : সাপ্তাহিক হক কথা )।

তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে’। আহমেদ মুসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’ গ্রন্থের উৎসর্গনামায় আওয়ামী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আব্দুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘….ঐখানে আমাকে (আব্দুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো। রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুঠার দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল তারা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরল। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে?”

ময়মনসিংহে এক হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা: “….রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙ্গালী যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন… বস্তুত বাংলাদেশে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতার অভাব নেই।”(ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ :আহমেদ মুসা, পৃষ্ঠা-১৩৬)

রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া

‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুন্ডামি এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়-যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনীর উপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হল এবং তারা তিনদিন তিনরাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হল।’ (বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা’ -হায়দার আকবার খান রনো)।


জাসদ নেতাদের গনহত্যাঃ
আজ ১৭ মার্চ, ১৯৭৪ইং, এই দিন এদেশে বিরোধী মতের রাজনীতি দমনে সৃষ্টি হয় এক ন্যক্কারজনক অধ্যায়। এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে গনতন্ত্রের দাবীতে এক বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় প্রায় অর্ধশত জাসদের রাজনৈতিক কর্মী। দেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় এক কালো অধ্যায়ের।

তৎকালীন মুজিব সরকারের আমলে টেন্ডার ও পারমিটবাজি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার ইত্যাদির প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এ লক্ষ্যে দলটি ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ পল্টনে এক জনসমাবেশের আয়োজন করে। এদিন সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে হাজার হাজার মানুষের একটি মিছিল স্মারকলিপি দেয়ার জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন মিন্টু রোডের দিকে রওনা দেয়। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা মেজর জলিল, আসম আবদুর রব, নূর-ই-আলম জিকু, কাজী আরিফ আহমেদ, মির্জা সুলতান রাজা, আফম মাহবুবুল হক, হাসানুল হক ইনু, শরিফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ। মিছিলটি পল্টন থেকে রওনা হয়ে মিন্টু রোডের কাছে পৌঁছলে পুলিশ বিনা উস্কানিতে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রায় আধাঘণ্টা একটানা চলে এ গুলি। পুলিশের গুলিতে ছাত্রলীগ নেতা (জাসদ) জাফর, জাহাঙ্গীরসহ প্রায় পঞ্চাশজন নিহত হন। আহত হন আরও কয়েকশ’ জাসদ নেতাকর্মী। নিহতদের বেশিরভাগের লাশ পুলিশ গুম করে বলে জাসদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এ দিনের মিছিল থেকে শত শত জাসদ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। জাসদ নেতা মেজর জলিল এবং আসম আবদুর রবকে গ্রেফতার করা হয় গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। এখানেই শেষ নয়, এ ঘটনার জের ধরে এদিন আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী জাসদের তত্কালীন মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের অফিসে ব্যাপক ভাংচুর চালায় এবং জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়। 
 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

শেখ মুজিবের অপশাসন

  শেখ মুজিবের অপশাসন     অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক জন পিলজার একটা মেয়ের আঙুল ধরলেন। মানুষ তো জন্মের পর বড় হয়, তার মনে হলো, এই মেয়েটা জন্মের ...