expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Wikipedia

সার্চ ফলাফল

রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী মোরংদের জীবন কথা

 বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী মোরংদের জীবন কথা

মোরং জাতি

মুরং বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। মুরুং শব্দটি বহুবচন যার একবচন হল ‘ম্রো’। ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ, মানব জাতি, মানব সত্ত্বা। ম্রো ভাষায় ‘ম্রো’রা নিজেদের ‘ম্রোচ্য’ বলে থাকে। মুরুংদের ভাষা মৌখিক, বর্তমানে ‘ম্রোচ চা’ বা ম্রো বর্ণমালা আবিষ্কৃত হওয়ায় তাদের নিজস্ব লিখিত ভাষা রয়েছে।

মোরং নামের ইতিহাসঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম মুরুং উপজাতীয় সম্প্রদায়ের বানান ও উচ্চারণ নিয়ে ইদানীং বেশ তারতম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সঠিক উচ্চারণ ‘মুরুং’ নাকি ‘ম্রো কিংবা ম্রু’? এ নিয়ে সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন জনের উচ্চারণ ও লেখনীতে বেশ তারতম্য দেখা গেছে। উপমহাদেশের বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ, জার্নাল ও দলিল দস্তাবেজে পাওয়া গেছে এ উপজাতির নানারূপ বানান। নিন্মে এর সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।



বাংলাদেশ সরকারের ১৯৯১ সনের পরিসংখ্যানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২২,০০১ জন উপজাতি নিজেদের নামের পর “মুরুং” এবং মাত্র ১৬৬ জন নিজেদের নামে পরে “ম্রো” লিখেন। ঐতিহাসিক Arthur P. Phayre তাঁর রচনায় মুরুংদের নামের বানান ‘ম্রো’ (Mro) ও ‘ম্রু’(Mru) লিখেছেন (দেখুন- History of Burma (1883), পৃষ্ঠা ৪৩, ৪৭)। Traditional occupations of indigenous and tribal peoples: emerging trends, By- International Labour Office এর রচনায় “Mrung” লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।



The tribes and castes of Bengal: Ethnographic glossary, Volume 2 (1992), By- Sir Herbert Hope Risley তাঁর লেখায় ‘Mrung’ লিখেছেন। এছাড়াও Population Census of Pakistan, 1961- এ ‘Mrung’ লেখা হয়েছে।



Journal of the Indian Anthropological Society, Volume 28, Issues 1-2 এর ৪৬ পাতায় যথাক্রমে ‘Mrung’, ‘Murung’, ‘Murong’ লেখা হয়েছে।



বাংলাপিডিয়াতে ‘মুরং’ এবং ‘ম্রো’ বানান লেখা হয়েছে এবং সেখানে তাদেরকে আলাদা দু’টি সম্প্রদায় হিসেবে তুলে ধরা হয়।
স্বল্প বসনা মোরং


আদি ইতিহাসঃ
ম্রো পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিসত্বা। ম্রোদের আদি নিবাস মায়নামারের আরাকান রাজ্য। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ম্রোরা মূলতঃ প্রকৃতি পূজারী হলেও অধিকাংশই 'বৌদ্ধ' ধর্মাবলম্বী এবং 'খিস্টান' ধর্ম পালন করে। তবে কয়েক বছর আগে ম্রোদের মধ্যে একটা নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’ আর্বিভাবের ফলে বর্তমানে ম্রোদের একটি অংশ ক্রামা ধর্মের অনুসারি। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মুরং উপজাতিরা আরকান থেকে পালিয়ে আলীকদমের বিভিন্ন পাহাড়ী উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে বার্মার আকিয়াব জেলায় এখনো মুরং উপজাতীয় বসতি বিদ্যমান বলে জানা যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট মুরুং নেতা, সাবেক স্থানীয় সরকার পরিষদ সদস্য ও মুরুং বাহিনীর ভূতপূর্ব কমান্ডার প্রয়াত বাবু মেনলে মুরুং এক আলাপচারিতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক আতিকুর রহমানকে বলেন, “যদি প্রকৃত চরিত্রের ভিত্তিতে উপজাতি নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অন্য অনেকের চেয়ে বাস্তব উপজাতি আমরাই। আমাদের সরাসরি উপজাতি স্বীকৃতি না দিয়ে ‘ম্রু’ দের দলে ব্রাকেটভূক্ত করা সঠিক মূল্যায়ন নয়।”

আরো অসংখ্য প্রাচীন জার্নাল, সাময়িকী ও দলিল ছাড়াও সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন সংবাদপত্র, সাময়িকী ও ব্লগে ‘মুরুং’ নামের বানান নিয়ে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। এখনো বিভিন্ন সংবাদপত্রে ‘ম্রো, ম্রু, মুরং ও মুরুং বানান লেখা হচ্ছে। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আমরা এসব চিত্র তুলে ধরা থেকে বিরত থাকলাম।
মোরং বাড়ি



পার্বত্যঞ্চলে মোরংদের আগমনঃ
মুরুং বা ‘ম্রো পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন উপজাতি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। ম্রোদের আদি নিবাস মায়নামারের আরাকান রাজ্যে। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার সর্বত্র এ সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। এককালে তারা আরাকানের অধিবাসী ছিল। যার বর্তমান নাম মিয়ানমার। পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের আগমন কয়েকশ’ বছর আগে। ‘আরাকানিরা তাদের ইতিহাসে মুরুং বা ম্রো সম্প্রদায়কে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ও অভিজাত জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। এক সময় আরাকানের কোলডান নদীর উপত্যকায় খুমিদের সঙ্গে ম্রোদের প্রচ- সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে ম্রোরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়’। 

“সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মুরুং উপজাতিরা আরাকান থেকে পালিয়ে আলীকদমের পাহাড়ী উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৭৮৭ সালের ২৪ জুন তারিখে চট্টগ্রামের তদানিন্তন শাসনকর্তাকে লিখিত বার্মা সম্রাটের একখানা চিঠিতে মুরুং উপজাতি কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিল সে সম্বন্ধে উল্লেখ আছে”।

মিয়ানমারের আকিয়াব জেলায় এখনো মুরুং উপজাতির বসতি রয়েছে। উল্লেখ্য, আরাকানের প্রাচীন জনগণ বলতে মোঙ্গলীয়, ভোট চীনা, মুরুং (ম্রো), খুমী, চাক, সিন, সেন্দুজ, খ্যাং (খিয়াং), উইনাক, মারূ, পিউ প্রভৃতি উপজাতি জনগোষ্ঠীকে বুঝায়।

আরাকান রাজাদের ধারাবিবরণী রাজওয়াং-এ বলা হয়েছে দ্বাদশ শতাব্দীতে আরাকানের রাজা দা থা রাজাকে (১১৫৩-১১৬৫) ‘মহামুনি মূর্তির’ অবস্থান খুঁজে বের করতে দু’জন মুরুং সাহায্য করেছিলেন। চতুর্থদশ শতকে খুমি নামে একটি শক্তিশালী উপজাতি মুরুংদের আরাকান থেকে বিতাড়িত করলে তারা বান্দরবানের পার্বত্য অঞ্চলে চলে আসে এবং মাতামুহুরী নদীর তীর বরাবর সাঙ্গু উপত্যকার পশ্চিমে বসতি স্থাপন করে। তৎকালীন বার্মা রাজা কর্তৃক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত এক চিঠিতে এর সমর্থন পাওয়া যায়। 

১৭০৮ সালে লিখিত আরাকানী শাসক এর একটি চিঠিতে প্রমাণিত হয় যে, মার্মা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরুং ইত্যাদি জনগোষ্ঠী স্বদেশভূমি আরাকান ত্যাগ করে এদেশের সীমান্তভূক্ত পাহাড়ী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রথম ব্রিটিশ জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি.এইচ লুইনকে (Capt. T.H. LEWIN) এতদাঞ্চলের প্রথম নির্ভরযোগ্য জ্ঞান করা হয়। তিনি স্বীয় পুস্তক ‘THE HILL TRACTS OF CHITTAGONG AND THE DWELLERS THEREIN’--এর ২৮ পাতায় উল্লেখ করেছেন- A greater portion of the hill tribes at present living in the Chittagong Hills undoubtedly came about two generations ago from Arracan this is asserted both by their own traditions and by records in the Chittagong Collectorate.

অর্থাৎ- উপজাতীয় যারা বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস করছে তাদের অধিকাংশ প্রায় দু’যুগ আগে আরাকান থেকে এসেছে। এসব তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আর ঐসব তালিকাপত্র দ্বারা প্রামাণিত যা চট্টগ্রাম রাজস্ব দপ্তরে সংরক্ষিত আছে।
মোরং বা ম্রো



মোরংদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ঃ
মুরুং বা ম্রো জনগোষ্ঠীর দৈহিক গড়নের মধ্যে মঙ্গোলয়েড (Mongoloid) বৃহৎ নরগোষ্ঠী (Race) এর মালয়ী ইন্দোনেশীয় বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। এদের গায়ের রং হলুদ পীতাভ, নাক মোটা ও থ্যাবড়া, তবে নাকের গোড়া অক্ষিকোটর থেকে যথেষ্ট উন্নত নয়। কপোলতলের হাড় প্রশস্ত ও উন্নত বলে মুখম-ল দেখে মনে হয় সমতল ধরণের। মধ্যমাকৃতির লম্বাটে মুখম-ল, স্বল্প দাড়ি-গোঁফ, ভাঁজযুক্ত পাতলা চোখের পাতা (epicanthic fold), চোখের মণি ধূসর বা গাঢ় ধূসর রঙের। চোখের ওপরের পল্লব ঝুলে থাকে সামনের দিকে।


গাঁট্টাগোট্টা পেশল সুঠাম দেহের অধিকারী এই উপজাতীয়দের পাহাড়ি পথে উপর-নীচ, ওঠা-নামা করতে পায়ের পাতা ও কোমরের ওপর মূল চাপ (ভার) পড়লেও শক্তির উৎস কিন্তু পায়ের থোড় এবং উরুর মাংসপেশী। পাহাড়ি চড়াই পথে ওপরে উঠতে সামনের দিকে ঝুঁকে নিচের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, আবার নিচের দিকে নামতে দেহ টান টান হয়ে থাকলেও চোখের দৃষ্টি কিন্তু সেই নিচের দিকেই রাখতে হয়। সাধারণত: এঁরা পিঠেই বোঝ বহন করে, মাঝে-মধ্যে গাড়েও। এই দু’অবস্থায়ও চোখ নিচের দিকে থাকে। চোখ নিচের দিকে রাখতে বা নিম্নমুখী তাকাতে গেলে স্বাভাবিকভাবে মাথাটি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাথায় খাড়া মোটা চুল (leiotrichi) এদের অন্যতম প্রধান দৈহিক বৈশিষ্ট্য। দৈহিক গড়ন ও চেহারায় এঁরা মঙ্গোলয়েড বৈশিষ্ট্য বহন করলেও এদের স্বভাব নিরীহ।

জনসংখ্যাঃ
বাংলাদেশে ১৯৭৪, ১৯৮১, ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুরুং জনসংখ্যা- ২২,১৬৭ জন। যদিও এ সংখ্যা বর্তমানে ৩ গুণ হবে। বাংলাদেশের বাইরে মায়ানমারের আকিয়াব জেলায়ও (সিত্তুই) এরা বসবাস করে। এথনোলগ রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে তাদের সংখ্যা ২০,০০০ মতো।

পরিসংখ্যান অনুসারে মুরুং সম্প্রদায় বান্দরবান জেলায় দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি উপজাতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পঞ্চম (চতুর্থ?) সংখ্যাগরিষ্ট উপজাতি মুরুং। বান্দরবানের সদর উপজেলা, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদম উপজেলা মুরুংদের বসবাস রয়েছে। কিছুকাল পূর্বে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলার ভাজ্যাতলী মৌজা এলাকায় মুরুংরা বাসবাস করলেও বর্তমানে সেখানে তাদের বসতি নেই বলে জানা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে প্রায় ৭০হাজার মুরুং জনগোষ্ঠী বসবাস করছে বলে জানা যায়।

এমএসসি জরিপে জানা গেছে, প্রতি পাড়ায় গড়ে ২৫-২৮টি মুরুং পরিবার বাস করে। বান্দরবানে রয়েছে ৩৪০টি মুরুং পাড়া। এমএসসি জরিপ অনুযায়ী বান্দরবানে মুরুং জনসংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার। ২০০১ সালের আদমশুমারীতে মুরুংদের সংখ্যা ২৯ হাজার ৩৮৩জন হলেও ২০০৬ সালের মুরুং স্যোশাল কাউন্সিল এর শুমারী অনুযায়ী ৫৯ হাজার ৫১৯জন মুরুং রয়েছে বান্দরবানে।

বর্তমান অবস্থানঃ
মুরং নৃগোষ্ঠীদের নিবাস বান্দরবান জেলাতে সর্বাধিক। তাছাড়া রাঙ্গামাটি জেলাতেও মুরং জনগোষ্ঠীদের নিবাস রয়েছে। তবে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় মুরংদের নিবাস সর্বাধিক। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে দেড় কি.মিটার দুরে চিওনী পাড়া ও আমতলী এলাকায় এ সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পাড়া রয়েছে। তাছাড়া প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকা তৈন মৌজা, মাংগু মৌজা, চ্যৈং মৌজা, চাইম্প্রা মৌজা, তৈনফা মৌজা এবং তৈন খাল এলাকা ও মাতামুহুরী সন্নিহিত পাহাড়ী এলাকায় তাদের বসতি রয়েছে। তবে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী ও পাহাড়ে তাদের বসবাস উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে। মুরং সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। মুরংদের একটি অংশ আলীকদমের প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় তাদের ‘‘কিম’’ ঘর তৈরী করে বসতি স্থাপন করেন। মুরংরা তাদের ঘরে জীব জন্তুর মাথা ঝুলিয়ে রেখে থাকে। মুরংদের মধ্যে কয়েকটি গোত্র রয়েছে; এর মধ্যে-
  • ঙারুয়া
  • প্রেন্জু
  • সাংকান
  • জালা
  • কানবক
  • নাইজাহ
  • তাং
  • দেং
  • রুমওয়া
  • উইয়াচা
  • দেং
  • রেংতিং

প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক পাড়ায় তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় একজনকে ‘কারবারি’ নিযুক্ত করা হয়। মুরং নারী-পুরুষ কঠোর পরিশ্রমী বলে এদের স্বাস্থ্য সুঠাম। মেয়েরাও পুরুষের পাশাপাশি পাহাড়ী জুমচাষে সমান পারদর্শী।


মোরংদের ভাষাঃ

সব মানুষই অন্তত একটি ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। বিভিন্ন ধ্বনি পরপর সাজিয়ে তৈরি হয় শব্দ, আর অনেক শব্দ নানা বিন্যাসে সাজিয়ে গড়া অসংখ্য বাক্য নিয়ে তৈরি হয় একটি ভাষা। কিন্তু কোন্ ভাষায় কতগুলি বাক্য হতে পারে, তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। ভাষার বক্তারা কতগুলি সীমিত সংখ্যক সূত্র কাজে লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য বলতে ও বুঝতে পারেন। আধুনিক চম্স্কীয় ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই সূত্রগুলিকে বলা হয় বক্তার মানসিক ব্যাকরণ। বক্তা যখন ছোটবেলায় ভাষা অর্জন করে, তখন তার মধ্যে এই মানসিক ব্যাকরণের বোধ গড়ে ওঠে। এই ব্যাকরণের অংশ হিসেবে আছে ভাষাটির ধ্বনিব্যবস্থা (ধ্বনিতত্ত্ব), শব্দের গঠন (রূপমূলতত্ত্ব), কীভাবে একাধিক শব্দ সংযুক্ত হয়ে পদগুচ্ছ বা বাক্য গঠন করে (বাক্যতত্ত্ব), ধ্বনি ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক (অর্থবিজ্ঞান), এবং ভাষার শব্দভান্ডার। ভাষা হল সেই ব্যবস্থা যা ধ্বনির সাথে অর্থের সম্পর্ক স্থাপন করে। ভাষা সম্পর্কে কোন মানুষের এই মানসিক বোধ, বাস্তব জীবনে তার ভাষার প্রয়োগ অপেক্ষা স্বতন্ত্র। মানুষ বাক বৈকল্যের শিকার হয়ে বা অন্য যেকোন কারণে ভাষাপ্রয়োগে ভুল করতে পারে, কিন্তু এতে তার ভাষাবোধের কিছু হয়।

ভাষাবিজ্ঞানীরা বিশ্বের হাজার হাজার ভাষা নিয়ে গবেষণা করে বের করেছেন যে এদের মধ্যে বহু পার্থক্য থাকলেও এই পার্থক্যের পরিমাণ সীমিত। সব ভাষার ব্যাকরণেই কিছু বিশ্বজনীন অংশ আছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষাসমূহের এই বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্যগুলিকে কতগুলি নিয়মনীতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। এই নিয়মনীতিগুলির সমষ্টিগত নাম দেয়া হয়েছ বিশ্বজনীন ব্যাকরণ। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বজনীন ব্যাকরণ সব ভাষার ব্যাকরণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং এর মানুষের সহজাত ভাষা অর্জন ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক আছে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করে অনেকগুলি সত্য বের করেছেন, যেগুলি সব ভাষার জন্য প্রযোজ্য। যেখানেই মানুষ আছে, সেখানেই ভাষা আছে। আদিম ভাষা বলে কিছু নেই। সব মনুষ্য ভাষাই সমান জটিল এবং মহাবিশ্বের যেকোন ধারণা প্রকাশে সমভাবে সক্ষম। যেকোন ভাষার শব্দভান্ডারকে নতুন ধারণা প্রকাশের সুবিধার্থে নতুন শব্দ গ্রহণ করিয়ে সমৃদ্ধ করা যায়। সব ভাষাই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়।

বিশিষ্ট ভাষা তাত্ত্বিক ‘ডঃ গ্রীয়ার্সন তার ল্যাঙ্গুয়েজট্রিক্স সার্ভে অব ইন্ডিয়া (১৯০৯) গ্রন্থে মুরুং ভাষার বিস্তারিত নমুনা তুলে ধরেছেন এবং এই ভাষাকে বর্মীদলভূক্ত ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। মুরুংদের লোক-সংস্কৃতি অত্যন্ত উন্নত। মুরুংদের নন্দন সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়ার মূলধারার সংস্কৃতি থেকে পৃথক কিছু নয়। তাদের গো-হত্যা উৎসব প্রমাণ করে আদিম অরণ্যচারী শিকারজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া এক প্রাচীন সংস্কৃতি ধারাকে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে’।


জর্জ গ্রীয়ারসনের “লিঙ্গুইজটিক্স সার্ভে অব ইন্ডিয়া” প্রকাশিত হবার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন কাজ হয়নি। ভাষাগুলোর তুলনামূলক শ্রেণীকরণ ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা গবেষক সুগত চাকমা তাঁর এমফিল অভিসন্দর্ভে প্রাথমিক শ্রেণীকরণের চেষ্টা করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন,‘ম্রোদের ভাষা আমি ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। তাদের ক্রিয়াপদ ও বহুবচন গঠনে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ভাষার সাথে বর্মী ভাষার চেয়ে কুকি-চিন ভাষাগুলির অধিক মিল রয়েছে।

বিগত এক শতাব্দিতে এ ভাষায় পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। মেনলে ম্রো (ক্রামাদি) ক্রামা ধর্ম এবং ম্রো বর্ণমালার প্রবর্তক। জনসংখ্যা এবং ভাষা বিচারে মুরুংরা সংখ্যালঘু। মাতৃভাষা ছাড়াও তারা বাংলা এবং মারমা ভাষায় কথা বলে। জর্জ গ্রিয়ারসন তাঁর গবেষণায় মুরুং ভাষাকে বর্মী দলের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং এ ভাষাকে একটি ‘জটিল ভাষা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এথ্নোলগ এর ১৫শ’ সংস্করণ (২০০৫) এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ৩৯টি ভাষা রয়েছে। এরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২০০টি গ্রামের প্রায় ৮০ হাজার মুরুং ‘ম্রু ভাষায়’ কথা বলে। এই ম্রু ভাষা চীনা-তীব্বতি ও তিব্বতি-বর্মী ভাষাভুক্ত।


পোশাক পরিচ্ছদঃ

মুরংরা অত্যন্ত স্বল্পবসন পরিধান করে (তবে বর্তমানে ব্যবহার নেই)। মেয়েরা ‘ওয়ানক্লাই’ নামে একধরনের ছোট পরিধেয় ব্যবহার করে। যা নাভীর নীচ থেকে হাঁটুর উপরিভাগ পর্যন্ত পড়ে থাকে। এটি ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়ামাত্র। মেয়েরা পায়ে “খক খ্যান” (নুপুর) কোমরে ‘‘রোওয়া কম” (বিছা) পড়ে থাকে। পুরুষগণ ‘ডং’ (লেংটি-বিদ্রি) নামে একধরনের কিঞ্চিতকর বস্ত্র পরিধান করে। মুরুং মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও মাথায় লম্বা চুল রাখে। নারী-পুরুষরা মাথায় অধিকন্তু “ছুরুত” (চিরুনী) গেঁথে রাখতে দেখা যায়। মুরুং মেয়েরা মাথায় কানে ও খোঁপায় বিভিন্ন ধরনের “পাও” (পাহাড়ী ফুল) গুজে রাখে। ছেলেরাও মাথার চুলকে খোপা আকারে বেঁধে রাখে। মুরংরা দাঁতের মধ্যে এক ধরনের রংয়ের প্রলেপ দিয়ে থাকে। লোহাকে উত্তপ্ত করে কাঁচা বাঁশের সাথে লাগিয়ে নির্গত রসকে দাঁতে লাগিয়ে দেয়। মুরুং সম্প্রদায়ের ছেলে একই গোত্রের কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেনা। মুরুং সমাজে তিন পদ্ধতিতে বিবাহ হয়ে থাকে। রীতি অনুযায়ী মুরুং ছেলে কন্যার দেহের মূল্য বাবদ রৌপ্য মুদ্রায় ১০১/= টাকা, মায়ের দুধের দাম বাবদ ১০/= টাকা প্রদান করতে হয়। এসব রৌপ্য টাকা অবশ্য পরিশোধনীয় বলে গণ্য করা হয়। একই গোত্রের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে বিবাহ নিষিদ্ধ। মুরুং দম্পতির মধ্যেও মনের মিল না থাকলে তালাক প্রথা বিদ্যমান রয়েছে।


মোরং সাংস্কৃতিঃ
মুরুং নৃত্যের মধ্যে ছেলে মেয়েরা গালে, ঠোঁটে ও কপালে রংয়ের প্রলেপ লাগায়। নৃত্যের আগে ১৫ থেকে ২০ জন মুরুং যুবক-যুবতী মুখোমুখী দাড়িয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি রচনা করে। এরপর তাদের তৈরী বাঁশির সুর ও বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশ করে থাকে। নাচে ও গানে বিবাহিত মেয়েদের অংশ নিতে দেয়া হয়না। মুরুং সম্প্রদায় নিজেরাই ‘‘প্লুং” নামের একটি বাঁশি তৈরী করে। পাহাড়ে উৎপন্ন ‘‘বুদুম’’ (এক ধরনের পাহাড়ী লাউ) এর শুকনো খোলের সাথে ৫/৬ বা ততোধিক “কাও” (বাঁশের কঞ্চি) এর টুকরা দিয়ে এ বাঁশীটি তৈরী করা হয়।

রীতিনীতিঃ
মুরুং সম্প্রদায় মূলতঃ প্রকৃতি পুজারী। তারা ইহকালকেই স্বর্বস্ব জ্ঞান করেন। তাঁরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। মুরুংদের ধর্মীয় বিধি নিষেধ সংবলিত কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। মুরংদের ধর্মবিশ্বাসে আকীর্ণ প্রধান উৎসবের নাম হলো “চিয়া-ছট-প্লাই” অর্থাৎ গো-হত্যা উৎসব। গো-হত্যাকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসাবেই পালন করা হয়। প্রতিবছর জুমের ফসল ঘরে তোলার আগে মুরুং সম্প্রদায় মহাধুমধামের সাথে এ উৎসব করে। এছাড়া এ সম্প্রদায়ের পরিবারে কারো অসুখ বিসুখ হলে তারা রোগ বালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ‘চিয়া-চট-প্লাই’ পালনের মানত করে থাকন। তারা “চাম্পুয়া” নামের অপর একটি উৎসব পালন করে থাকে। সৃষ্টিকর্তা তাদের ধর্মীয় বিধান কলাপাতায় লিপিবদ্ধ করেছিল বিশ্বাসে তারা কলাপাতা কেটে এ উৎসব করে থাকে। এ সম্প্রদায়ের অনেকে আবার ‘‘ক্রামা’’ নামের অপর একটি ধর্ম মতেও বিশ্বাস করে থাকে। মৃত ব্যক্তির পাশে শুকরছাগল ও মোরগ জবাই করে পরিবেশন করা হয়। মৃতকে নদী তীরবর্তী চিতায় দাহ করার আগ পর্যন্ত গান বাজনা ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে উল্লাস করা হয়।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে!

  দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে! এক.   শুনতে খারাপ শোনালেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের...