আসিফ আদনানদের জঙ্গী মনে না করার বিজ্ঞান
লেখকঃ ডা: মো: নাজমুল হূদা মোজাদ্দেদী
আসিফ আদনান নামে একজন জনপ্রিয় ধর্মীয় লেখক আছে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়েছে। এখন মালয়েশিয়ায় পড়ছে। এই লেখক গণতন্ত্রকে সরাসরি হারাম মনে করে। এর বদলে সে শরীয়া রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। অনেক কিশোর ও তরুণ আছে যারা আসিফের অনুসারী। আসিফকে যদি জঙ্গী বলা হয় তাহলে এর অনুসারীরা দল বেঁধে ফেসবুকে এসে বলবে আমি মুরতাদ, কথায় কথায় জঙ্গী ট্যাগ দেই। এরা আহ্লাদ করে বলবে গণতন্ত্রের বিরোধিতা কেন জঙ্গীবাদ হবে, জঙ্গীবাদের সংজ্ঞা কি? এরা বলবে আসিফ যে জঙ্গী তার প্রমাণ কি?
তাহলে শুরুতে জেনে রাখুন, আসিফ হলো সিরিয়ার জঙ্গী সংগঠন আইসিসের একজন রিক্রুটার যার দায়িত্ব ছিলো বাংলাদেশ থেকে লোকজনকে রিক্রুট করে সিরিয়ায় পাঠানো। একই সঙ্গে বাংলাদেশেও জঙ্গীবাদ পরিচালনা করতে লোকজনকে জঙ্গী হিসাবে গড়ে তোলা তার কাজ।
এখন আসিফকে যে জঙ্গী বলছি, এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ থাকলে কি কিছু আসে যায়? আসিফ প্রমাণিত জঙ্গী হলেও তাকে প্রমোট করছে রকমারি ডটকম, সিয়ান পাবলিকেশন্স ও কওমী মাদরসার লোকেরা। এরা সবাই মিলে উল্টা এই প্রবন্ধের লেখকের উপর ঝাপিয়ে পড়বে আর বলবে যে লেখক টাকা নিয়ে আসিফকে জঙ্গী ট্যাগ দিচ্ছে। আর এটিই সত্য যে, আসিফ যে জঙ্গী এটি জানার পরেও তাকে জঙ্গী নয় দাবি করার একটা বড় পক্ষ আছে।
মূলতঃ বাংলাদেশে চিহ্নিত জঙ্গীদেরকে জঙ্গী নয় দাবি করে উল্টা ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসাবে সেলিব্রেশন দেওয়ায় জঙ্গীবাদের ব্যাপারটা নরমালাইজ হয়ে গেছে। এ কারণে সত্যিকারের জঙ্গীরা কিশোর-কিশোরীদের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের কাছে রীতিমতো সেলব্রেটি বনে গেছে।
ব্যাপারটা বুঝাতে শুরুতে জিজ্ঞেস করি আল কায়েদা ও আইসিস তথা দায়েশকে কি আপনারা জঙ্গী সংগঠন মনে করেন কি না? যদি জঙ্গী সংগঠন হয় তাহলে আল কায়েদা ও আইসিসের সদস্যকে কি জঙ্গী বলা যাবে না?
অবাক হওয়ার কিছু নাই যে, অনেক কিশোর কিশোরীকে পাবেন যারা আল কায়েদা ও আইসিসকে জঙ্গী সংগঠনও মনে করে না। উল্টো এদের মতাদর্শকে সমর্থন করে। যারা জঙ্গীদের মতাদর্শের বিরোধিতা করে তাদেরকে মুরতাদ, কাফের মনে করে।
এখন কথা হলো জঙ্গীদেরকে জঙ্গী মনে না করার বিজ্ঞানটা কিভাবে ঘটল?
তাহলে আসুন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি আবদুস সালাম মামুনের কথা জানি।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার বুলারতালুক গ্রামের বাসিন্দা মামুন। ১৯৫৭ সালে তার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল. এল. বি (অনার্স) ও এল. এল.এম করেছেন।চট্টগ্রামের আইনজীবী ও পিপি ছিলেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হন।
২০০২ সালে বিএনপি সরকার তাকে সুপ্রিম কোর্টে অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগ দেয়। তবে বিএনপি সরকার তাকে স্থায়ী বিচারপতি করেনি। এ নিয়ে সে তৎকালীন প্রধাম বিচারপতির বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনার জন্ম দিছিলেন। তবে মামুনকে পরে আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে হয়।
২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর বিচারপতি মামুন আইনজীবী আপিল বিভাগে হাজির হন।তাকে দেখে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক(কালো মানিক খ্যাত) তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের হয়েছে বলে জানান। মানিক বলেন, “আমাদের ব্রাদারকে ছেলের বিষয়ে এখানে আসতে হয়েছে। আমাদের সত্যি খারাপ লাগছে। আমাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”
বিচারপতি মামুনের ছেলে আসিফ আদনান সিরিয়ার জঙ্গী সংগঠ আইসিসে যোগ দিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতির সময় তার সঙ্গী ফজলে এলাহী তানজিলসহ ধরা পড়ে। তখন আসিফকে ছাড়াতেই মূলতঃ তার বাপ মামুন আদালতে হাজির হয়।
আসিফকে ছাড়াতে তার বাপের তৎপরতাও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তারা শুরুতেই আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের মতো নামকরা আইনজীবীকে। এরপর দেখা গেল অল্প কয়দিনে হাইকোর্ট আসিফকে জামিন দিয়ে দিল। মিডিয়ায় এটি আলোচিত হলে আপিল বিভাগে তার জামিন স্থগিত হয়। তবে অল্প কয়দিনেই প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যদের বেঞ্চে শুনানি হয় এবং এক পর্যায়ে আসিফকে সম্পূর্ণ খালাস দেওয়া হয়।
এখন যারা মনে করে যে আসিফ আদনান চুনোপুঁটি জঙ্গী তাদের কিছু তথ্য জানা দরকার।
মূলতঃ ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদান সিরিয়ায় জঙ্গী সরবরাহ করতো। সে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ছেলেমেয়েদেরও সিরিয়া পাঠিয়েছিল।
এই সামিউন বাংলাদেশ থেকে লোক যোগার করতে ২০১৪ সালের মার্চের দিকে ঢাকায় আসে।
এরপর বিচারপতি মামুনের ছেলে আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী তানজিলের সঙ্গে মিলে ছয় মাস ধরে আইসিসের জন্য জঙ্গী রিক্রুট করে।২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আসিফ ও তানজিলকে পুলিশ আটক করে। এক পর্যায়ে আসিফ পুলিশের কাছে সামিউনের কথা জানিয়ে দেয় এবং আসিফের দেওয়া তথ্য অনুসারে সামিউনকে গ্রেপ্তার করে।
এবার আসুন পরের ঘটনা প্রবাহে। আসিফ আদনানরা জেল থেকে বের হওয়ার পর এক পর্যায়ে দেখতে পেল বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ লোকজনকে আকর্ষণ করতে পারছে না। কারণ ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গীরা পরাজিত হয়েছে। তারা মুসলমানদের এক মিথ্যা লড়াইয়ে নামিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে রক্ত ঝরিয়েছে। মাঝখানে মুসলমানদের শত্রুরা শক্তিশালী হয়েছে। ফিলিস্তিনের মুক্তির লড়াই অধিকতর আক্রমণের মুখে পড়েছে। ফলে সরাসরি জঙ্গীবাদ করলে মুসলমানদের জনরোষের মুখে পড়তে হবে।
এ অবস্থায় আইসিস জঙ্গী আসিফ আদনান রীতিমতো ইসলামী লেখক হয়ে গেল। তার পক্ষের লোকজন সোশাল মিডিয়ায় এমনভাবে আসিফের লেখা শেয়ার করতে শুরু করলো যেন দেশে এক বিশাল নতুন লেখকের জন্ম হয়েছে। মূলতঃ জঙ্গীদের দায়িত্বই দেওয়া হয়েছিল আসিফকে জনপ্রিয় লেখক হিসাবে প্রচার করা। আর এটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে রকমারি ও সিয়ান পাবলিকেশন্সের মতো বড় প্লাটফর্ম থেকেও আসিফকে প্রমোট করা হয়। এরমধ্যে একটা দুঃখজনক ঘটনা হলো, বাংলাদেশে কওমী মাদরসার লোকেদের বাস্তবতা সম্পর্কে খুবই দুর্বল বোঝাপড়া আছে। এদেরকে একটু পামপট্টি দিলেই এরা যে কাউকে নিয়ে মাথায় নাচে। জঙ্গী আসিফ আদনানরা এই কাজটা ভালোমতই করেছিল। দেখবেন আইসিসের সঙ্গে কওমী মাদরাসার কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু আসিফ আদনানদের পক্ষে কওমীদের লোকেরা ঠিকই সরব।
তবে জঙ্গীদের নরমালাইজেশনের সায়েন্সটা হলো এদের মাত্র কয়েক বছর আগের অতীতটাও লোকজনকে জানতে দেওয়া হয় না। কিশোর কিশোরীদের বলা হয় না তাদের শায়েখ আইসিস দায়েশ নেতা। মূলতঃ এ পরিচয় গোপন রেখে এ কাজ চালিয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ