"মুসলমানরা যেভাবে দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করে"
আমরা মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ১৭ রাকাত ফরজ নামাজ পড়তে হয়। আর প্রতি নামাজেই সূরা ফাতিহা পাঠ করি আমরা। এই নামাজে ১৭ বার সূরা ফাতিহা পড়ে আমরা আল্লাহর সাথে বিনয়ের সাথে ওয়াদা করি। আসুন আগে জেনে নেই আমরা নামাজে আল্লাহর সাথে কি ওয়াদা করি?
চলুন দেখে নিই:
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ -
যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহ তা’আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
যিনি পরম করুনাময়, মেহেরবান ও দয়ালু।
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
বিচার দিনের একমাত্র অধিপতি।
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
আমাদের সরল পথ দেখাও।
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
আসলে এ সূরাটিকে ইসলামি চিন্তাবিদরা একটি দোয়া বলে বর্ননা করে । কেননা কোন ব্যক্তি এ আল কোরআন পড়তে শুরু করলে আল্লাহ প্রথমে তাকে এ দোয়াটি শিখিয়ে দেন। কোরআনের শুরুতে এর স্থান দেয়ার অর্থই হচ্ছে এই যে, যদি যথার্থই এ গ্রন্থ থেকে তুমি লাভবান হতে চাও, তাহলে নিখিল বিশ্বের মালিক আল্লাহর কাছে দোয়া এবং সাহায্য প্রার্থনা করো।
মানুষের মনে যে বস্তুটির আকাংখা ও চাহিদা থাকে স্বভাবত মানুষ সেটিই চায় এবং সে জন্য দোয়া করে। আবার এমন অবস্থায় সে এই দোয়া করে যখন অনুভব করে যে, যে সত্তার কাছে সে দোয়া করছে তার আকাংখিত বস্তুটি তারই কাছে আছে। কাজেই কোরআনের শুরুতে এই দোয়ার শিক্ষা দিয়ে যেন মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সত্য পথের সন্ধান লাভের জন্য এ গ্রন্থটি পড়, সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে এর পাতা ওল্টাও এবং নিখিল বিশ্বের মালিক ও প্রভু মহান আল্লাহ হচ্ছেন জ্ঞানের একমাত্র উৎস। একথা জেনে নিয়ে একমাত্র তাঁর কাছেই পথনির্দেশনার আরজি পেশ করেই এ গ্রন্থটি পাঠের সূচনা কর।
এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন ও সূরা ফাতিহার মধ্যকার আসল সম্পর্ক কোন বই ও তার ভূমিকার সম্পর্কের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং এ সম্পর্কটি দোয়া ও দোয়ার জবাবের পর্যায়ভুক্ত। সূরা ফাতিহা বান্দার পক্ষ থেকে একটি দোয়া। আর সম্পূর্ণ কুরআনে তার জবাব আল্লাহর পক্ষ থেকে। বান্দা দোয়া করে, হে মহান প্রভু! আমাকে পথ দেখাও। জবাবে মহান প্রভু এই বলে সমগ্র কুরআন তার সামনে রেখে দেন এই নাও সেই হিদায়াত ও পথের দিশা যে জন্য তুমি আমার কাছে আবেদন জানিয়েছ।
কিন্তু আমি মনে করি এই সূরাটি নামাজে পাঠের মাধ্যমে আমরা সৃষ্টি কর্তার সাথে প্রতি দিনই ওয়াদা করি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে। আমরা এই সূরার একটি অংশে পাঠ করি:
اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُؕ
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
এই ইবাদাত শব্দটিও আরবী ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
(১) পূজা ও উপাসনা করা আরাধনা।
(২) আনুগত্য ও হুকুম মেনে চলা এবং
(৩) বন্দেগী ও দাসত্ব করা।
এখানে একই সাথে এই তিনটি অর্থই প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ আমরা আল্লাহর উপাসনা করি, আল্লাহর আনুগত্য করি এবং আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বও করি। আর আমরা তোমার সাথে এ সম্পর্কগুলো রাখি কেবল এখানেই কথা শেষ নয় বরং এ সম্পর্কগুলো আমরা একমাত্র তোমারই সাথে রাখি। এই তিনটি অর্থের মধ্যে কোনো একটি অর্থেও অন্য কেউ আমাদের মাবুদ নয়।
আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল ইবাদাতের নয় বরং আমাদের সাহায্য প্রার্থনার সম্পর্কও একমাত্র তাঁরই সাথে রয়েছে। আমরা জানি আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব-জাহানের রব। সমস্ত শক্তি আল্লাহর হাতে কেন্দ্রীভূত এবং তিনি একাই যাবতীয় নিয়ামত ও অনুগ্রহের অধিকারী। তাই আমাদের অভাব ও প্রয়োজন পূরণের জন্য আমরা একমাত্র আল্লাহর দুয়ারে ধর্ণা দেই। আল্লাহর সামনে নিজেদের সপোর্দ করে দেই এবং তাঁর সাহায্যের ওপরই নির্ভর করি। এ জন্য আমাদের এই আবেদন নিয়ে আমরা তোমার দুয়ারে হাজির হয়েছি। আর এটিই আমাদের ওয়াদা প্রতিনদিন পাঁচ বেলা করে কমপক্ষে ১৭ বার। এ যেন বার বার ওয়াদা করছি আল্লাহর সাথে।
এই ওয়াদায় আমরা শপথ করি যে আমরা আল্লাহর সকল বিধি বিধান মেনে চলি এবং চলব। এই চলা কাদের মত করে চলব? যারা আল্লাহর হুকুম মেনে সীরাতুল মুসতাকীমের পথ অবলম্বন করে আল্লাহকে রাজী ও খুশি করেছেন এবং যাদেরকে আল্লাহ তাঁর অনুগত বান্দা হিসাবে কবুল করেছেন। ঐ অনুগত বান্দার মত করে আল্লাহর হুকুম মত আমরা আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করেই আমারা সীরাতুল মুসতাকীমের পথে যেতে চাই।
ঠিক এই কথা বলার পর আমরা আল্লাহকে আরো অনুরোধ করি আমাদের (সরল ও) অবিচল পথটি দেখিয়ে দাও,' হে আল্লাহ তায়ালা, আমাদের সোজা রাস্তা চিনিয়ে দাও ৷ হে আল্লাহ, এ পথ চিনিয়ে দেয়ার পর তাতে অটল থাকারও শক্তি দাও। কেননা পথ চেনা এবং সে পথে টিকে থাকা এ দু'টোই আল্লাহ তায়ালার হেদায়াত ও রহমতের ফলশ্রুতি মাত্র । এ ব্যাপারে আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট হওয়া এই বিশ্বাসেরই অপরিহার্য পরিণাম যে, আল্লাহ তায়ালাই সাহায্যকারী এবং তিনিই মদদগার। 'সেরাতুল মোস্তাকিম' সঠিক পথের দিশাই সেই মহান নেয়ামত যা পাওয়ার জন্যে মোমেন আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে। সেরাতুল মোস্তাকিমের দিকে পথনির্দেশই দুনিয়া আখেরাতের সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধানকারী জিনিস । কেননা সঠিক পথের হেদায়াত হচ্ছে সঠিক অর্থে মানবীয় প্রকৃতির সেই আল্লাহর অভীষ্টের দিকে ধাবিত হওয়া, যা মানুষ ও এই সৃষ্টি জগতের প্রতিটি চলন বলনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে এককভাবে নিবিষ্ট রাখা।
আমরা কি নামাজ শেষে বের হয়ে ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর দেওয়া বিধান মত চলি না শয়তানের কুমন্ত্রণা মত চলি? পারিবারিক জীবন কি আল্লাহর দেওয়া বিধান মত চালাই না বাতিল শক্তির চাকচিক্যময় নিয়মে চালিয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করি? আমাদের অর্থনৈতিক লেনদেন কি ইসলামি নিয়মানুযায়ী করি না সুদের মত জঘন্য পাপের মাধ্যমে করি?
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন কি আল্লাহর দেওয়া খিলাফতের নিয়মে করি না বাতিল, নাস্তিক ও সেক্যুলারদের সমাজ তন্ত্র, পুঁজিবাদ, গনতন্ত্রের মত খোদা দ্রোহী উপায়ে পরিচালানা করি? আমরা তো নামাজে দাঁড়িয়ে ওয়াদা করছি এসকল নিয়ম আল্লাহর দেওয়া বিধান মতে করব কিন্তু নামাজ শেষে কি তার নিয়ম মত চলি? যদি না হয় আমাদের ওযাদার কতটুকু বাস্তবায়ন করলাম? নাকি ওয়াদা ভঙ্গ করলাম?
আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে এই ওয়াদা করার পর নামাজ শেষ করে আমরা কি আমাদের শপথের উপর অবিচল থাকি? নাকি ওয়াদার কথা মুহূর্তে ভুলে আবার শয়তানের দেখনো পথে নিজেকে পরিচালনা করি? যদিমতা না হয় তবে মনে রাখবেন এই নামাজ পড়ার পর আমরা নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করে শয়তানের দেখনো পথে যে নিজেকে পরিচালিত করি তা নিত্যান্তই স্ববিরোধীতা ও অবাধ্যতা আর এ অবাধ্যতার জন্য নিশ্চয়ই একদিন আল্লাহ আমাদের পাকড়াও করবেন। আল্লাহ সবাইকে নামাজে আল্লাহর সাথে করা ওয়াদা মেনে চলার তাওফিক দিক,(আমীন)।
লেখক:
ডা.বশির আহাম্মদ, চিকিৎসক, জার্নালিস্ট ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ