জিহাদের গুরুত্ব
![]() |
জীহাদের গুরুত্ব |
জিহাদ মানে কি?
জিহাদ শব্দের অর্থ হলো "সংগ্রাম" বা "চেষ্টা"। এটি একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ "সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা"। ইসলামের দৃষ্টিতে, জিহাদ একটি ব্যাপক ধারণা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ আত্ম-সংগ্রাম (নিজের কুপ্রবৃত্তি ও দুর্বলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম) এবং বাহ্যিক সংগ্রাম (ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম) উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।
১বৃহত্তর জিহাদ (الجهاد الأكبر):
এটি বাহ্যিক সংগ্রাম, যা সাধারণত অন্যায়, অবিচার, এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণভাবে লড়াই করাকে বোঝায়। অনেক সময় জিহাদকে "পবিত্র যুদ্ধ" হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, তবে এটি একটি ভুল ধারণা। জিহাদের মূল ধারণা হলো সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রাম করা এবং সমাজের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য প্রচেষ্টা করা।
২. ছোট জিহাদ (الجهاد الأصغر):
এটি হলো নিজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তি, দুর্বলতা, এবং খারাপ কাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করে এবং আরও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালায়।
জিহাদের কিছু আয়াতঃ
সরাসরি ‘জিহাদ’ শব্দটি কুরআনে এসেছে প্রায় ২৭ বার। এখানে জিহাদ সম্পর্কে বেশ কিছু আয়াত একত্রিত করা হলো ফজিলত হিসেবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে জিহাদের ফজিলত বুঝে নিজেদেরকে প্রস্তুত করার তাওফিক দান করুন।
সূরা বাকারার ১৫৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَ لَا تَقُوۡلُوۡا لِمَنۡ یُّقۡتَلُ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اَمۡوَاتٌ ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ وَّ لٰکِنۡ لَّا تَشۡعُرُوۡنَ
যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা বুঝতে পার না।
সূরা আলে ইমরানের ১৫৬ থেকে ১৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ قَالُوۡا لِاِخۡوَانِهِمۡ اِذَا ضَرَبُوۡا فِی الۡاَرۡضِ اَوۡ کَانُوۡا غُزًّی لَّوۡ کَانُوۡا عِنۡدَنَا مَا مَاتُوۡا وَ مَا قُتِلُوۡا ۚ لِیَجۡعَلَ اللّٰهُ ذٰلِکَ حَسۡرَۃً فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
হে মুমিনগণ, তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা কুফরী করেছে এবং তাদের ভাইদেরকে বলেছে- যখন তারা যমীনে সফরে বের হয়েছিল অথবা তারা ছিল যোদ্ধা (অতঃপর নিহত হয়েছিল)-‘যদি তারা আমাদের কাছে থাকত, তবে তারা মারা যেত না এবং তাদেরকে হত্যা করা হত না’। যাতে আল্লাহ তা তাদের অন্তরে আক্ষেপে পরিণত করেন এবং আল্লাহ জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক দ্রষ্টা।
وَ لَئِنۡ قُتِلۡتُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اَوۡ مُتُّمۡ لَمَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَحۡمَۃٌ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ
যদি তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মৃত্যুবরণ কর, তবে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা অতি উত্তম তারা যা সঞ্চয় করে তার চেয়ে।
وَ لَئِنۡ مُّتُّمۡ اَوۡ قُتِلۡتُمۡ لَاِالَی اللّٰهِ تُحۡشَرُوۡنَ
আর তোমাদের মৃত্যু হলে অথবা তোমরা নিহত হলে, আল্লাহর কাছে তোমাদেরকে অবশ্যই একত্রিত করা হবে।
সূরা বাকারার ২১৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِتَالُ وَ هُوَ کُرۡهٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَهُوۡا شَیۡئًا وَّ هُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تُحِبُّوۡا شَیۡئًا وَّ هُوَ شَرٌّ لَّکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
তোমাদের জন্য জিহাদের বিধান ফরজ করা হলো। যদিও এটা তোমাদের কাছে অপছন্দ। কিন্তু তোমরা যা পছন্দ কর না, হতে পারে, তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, হতে পারে তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ যা জানেন, তোমরা তা জান না।
সূরা নিসার ৭১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا خُذُوۡا حِذۡرَکُمۡ فَانۡفِرُوۡا ثُبَاتٍ اَوِ انۡفِرُوۡا جَمِیۡعًا
হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন কর; তারপর হয় দলে দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হও অথবা একসঙ্গে অগ্রসর হও।
* আয়াতের প্রথমাংশে জিহাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং আয়াতের দ্বিতীয় অংশে জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। *
সূরা নিসার ৭২-৭৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَ اِنَّ مِنۡکُمۡ لَمَنۡ لَّیُبَطِّئَنَّ ۚ فَاِنۡ اَصَابَتۡکُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ قَالَ قَدۡ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیَّ اِذۡ لَمۡ اَکُنۡ مَّعَهُمۡ شَهِیۡدًا
আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যে অবশ্যই বিলম্ব করবে। সুতরাং তোমাদের কোন বিপদ আপতিত হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না’।
وَ لَئِنۡ اَصَابَکُمۡ فَضۡلٌ مِّنَ اللّٰهِ لَیَقُوۡلَنَّ کَاَنۡ لَّمۡ تَکُنۡۢ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَهٗ مَوَدَّۃٌ یّٰلَیۡتَنِیۡ کُنۡتُ مَعَهُمۡ فَاَفُوۡزَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا
আর যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হয়, তবে যেন তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোন প্রকারের সম্পর্ক ছিল না,
এমনিভাবে অবশ্যই বলে উঠবে, ‘হায় আফসোস! আমিও যদি তাদের সঙ্গে থাকতাম তাহলে মহা সাফল্য লাভ করতাম।
সূরা নিসার ৭৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
فَلۡیُقَاتِلۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ الَّذِیۡنَ یَشۡرُوۡنَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا بِالۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ مَنۡ یُّقَاتِلۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَیُقۡتَلۡ اَوۡ یَغۡلِبۡ فَسَوۡفَ نُؤۡتِیۡهِ اَجۡرًا عَظِیۡمًا
অবশ্যই যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে তারা যেন আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে।
আর যে আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করবে অতঃপর সে নিহত হোক কিংবা বিজয়ী, অচিরেই আমি তাকে দেব মহা পুরস্কার।
সূরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَ مَا لَکُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ هٰذِهِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَهۡلُهَا ۚ وَ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ وَلِیًّا ۚۙ وَّ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ نَصِیۡرًا
আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।’
সূরা আনফালের ১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا زَحۡفًا فَلَا تُوَلُّوۡهُمُ الۡاَدۡبَارَ
হে মুমিনগণ, তোমরা যখন কাফিরদের মুখোমুখি হবে বিশাল বাহিনী নিয়ে, তখন তাদের থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না।
সূরা আনফালের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
হে মুমিনগণ, যখন তোমরা কোন দলের মুখোমুখি হও, তখন অবিচল থাক, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হও।
সূরা তাওবার ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ اشۡتَرٰی مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ وَ اَمۡوَالَهُمۡ بِاَنَّ لَهُمُ الۡجَنَّۃَ ؕ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَیَقۡتُلُوۡنَ وَ یُقۡتَلُوۡنَ ۟ وَعۡدًا عَلَیۡهِ حَقًّا فِی التَّوۡرٰىۃِ وَ الۡاِنۡجِیۡلِ وَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ وَ مَنۡ اَوۡفٰی بِعَهۡدِهٖ مِنَ اللّٰهِ فَاسۡتَبۡشِرُوۡا بِبَیۡعِکُمُ الَّذِیۡ بَایَعۡتُمۡ بِهٖ ؕ وَ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে,
তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। অতএব তারা শত্রুকে মারে ও নিজেরা মরে।
তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ ওয়াদা পূরণে আল্লাহর চেয়ে অধিক কে হতে পারে? সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে যেই বিনিময় করেছ, সেই বিনিময়ের জন্য আনন্দিত হও এবং সেটাই মহাসাফল্য।
জিহাদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত রয়েছে আরো। বিশেষ করে সূরা আনফাল, সূরা তওবা এবং সূরা মুহাম্মাদে আরো আলোচনা আছে। আগ্রহীরা জিহাদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত জানতে পড়ুন সেই সূরাগুলো।
ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এর দুটি দিক রয়েছে: আত্মরক্ষা ও সমাজের উন্নতি। এটি কেবল একটি সামরিক শব্দ নয়, বরং একটি ব্যাপক প্রচেষ্টা যা আত্মিক, নৈতিক, এবং সামাজিক উন্নতির জন্য পরিচালিত হয়। আত্মরক্ষার জন্য জিহাদ বৈধ, তবে এটি অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত হতে হবে এবং আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত নয়।
জিহাদের গুরুত্ব:
আত্মরক্ষা:
জিহাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আত্মরক্ষা। যখন মুসলিম সম্প্রদায় বা তাদের ধর্ম হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন আত্মরক্ষার জন্য জিহাদ করা আবশ্যক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:
জিহাদের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা মুসলিমদের কর্তব্য।
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি:
জিহাদ মুসলিমদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ খুলে দেয়। এটি তাদের আত্মসংযম, অধ্যবসায় এবং আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়।
সামাজিক সংস্কার:
জিহাদ সমাজের অন্যায় ও কুসংস্কার দূর করতে সাহায্য করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
জিহাদের ধারণা কেবল যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি জীবনদর্শন যা মুসলিমদের সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ