বরংমহান আল্লাহ এ কথা বলে দিয়েছেন যে, যারা স্বেচ্ছায় তা তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করবে বা এ জন্য চেষ্টা করবে, তারা আল্লাহর আইনের কাছে আত্মসমর্পণকারী ও তাঁর দাস হিসেবে গণ্য হবে অর্থাদ মুমিন। তারা আল্লাহকেই তাদের জীবনের পরিচালনাকারী ও রব হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী হবে। আর যারা তা করবে না, তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তাঁর দাসত্বকে অস্বীকারকারী হয়ে নিজেদেরকে নিজেদের ইলাহ ও রব হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী হবে। কুরআন ও হাদীসের দ্বারা এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও দেখা যায়- বর্তমান বিশ্বে নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করেন, তাদের অধিকাংশই তাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে ওহীর বিধান বাস্তবায়ন করতে রাজি নন।
তারা এটাকে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম ইসলামী রাজনীতির পরিবর্তে পাশ্চাত্য রাজনীতির অনুসরণ ও অনুকরণ করার ফলে দেশে যেমন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হচ্ছে না, তেমনি শুধুমাত্র বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইন ব্যতীত মানব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অহীর যে সব বিধান রয়েছে, তা রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ যেখানে যাবতীয় আইনের মূল উৎস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা, সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেই আইনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি যে, এ সংবিধানে বর্ণিত বিধানের সাথে অপর কোনো বিধানের বিরোধিতা করার কোনো আইনগত অধিকার নেই এবং করলে তা আপনিতেই বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ম ধারার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি যে,
This Constitution is, as the solemn expresson of the will of the people, the supreme law of the Republic, and if any other law is inconsistent with this Constitution that other law shall, to the extent of the inconsistency, be void.”
এ সিদ্ধান্তের দ্বারা আমরা নিজেদের রচিত সংবিধানের আইন ও বিধানকে কুরআন ও সুন্নাহের আইন ও বিধানের উপর মর্যাদা দান করেছি। বিচার কার্য অহীর বিধানানুযায়ী পরিচালিত না করে তা পাশ্চাত্য বা নিজেদের রচিত বিধানানুযায়ী করছি। এভাবে আমরা সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে স্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিয়েছি এবং এ জাতীয় কর্ম করে নিজেদের অজান্তেই নিজেদেরকে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শরীক করে নিয়েছি।
এ হেন অভিযোগ থেকে কেবল তারাই মুক্তি পেতে পারেন যারা আল্লাহর আইন ও বিধানকে কোনো প্রকার অবজ্ঞা না করে সর্বকালে তা বাস্তবায়নের যোগ্য বলে মনে করেন, ক্ষমতায় যেতে না পারলে ইসলাম বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়াই শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতায় যেয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ও তদবীর করেন।
কিন্তু যারা শুধু সেমিনার, সেম্মোজিয়াম ও বক্তৃতায় দাঁড়িয়ে ইসলামী বিধানের মৌখিকভাবে প্রশংসা করেন এবং শুধুমাত্র সমস্যাদির কথা ভেবে তা বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো প্রকার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন, তারা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্ক করা থেকে বাঁচতে পারলেও কোনো অবস্থাতেই তারা কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পারবেন না কেননা, একজন মুসলিম বা একটি মুসলিম রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও অনুসারীদের ঈমানী দায়িত্ব হচ্ছে- ক্ষমতায় গিয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেশ ও বিচার কার্য পরিচালনার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা, যারা তা চায় তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা। নিজে চাইবো না বা যারা তা চায় তাদের সহযোগিতাও করবো না, এমন মুনাফিকী চরিত্র নিজের আখেরাত সম্পর্কে সচেতন কোনো মুসলিমের কশ্মিনকালেও হতে পারে না।
আল্লাহ سبحانه و تعالى পবিত্র কোরআনে বলেন,
“অতঃপর (হে নবী), আমি তোমাকে দ্বীনের এক (বিশেষ) পদ্ধতির উপর এনে স্থাপন করেছি,অতঃএব তুমি শুধু তারই অনুসরণ কর, (শরীয়তের ব্যপারে) সেসব লোকদের অনুসরণ করো না,যারা (আখেরাত সম্পর্কে) কিছুই জানেনা” (৪৫.জাসিয়া : ১৮)
আয়াতে ব্যবহৃত ‘এক (বিশেষ) পদ্ধতি’ বলতে শরিয়াহ বোঝানো হয়েছে, যে আইন ব্যবস্থার প্রত্যকটি হুকুম আল্লাহর سبحانه و تعالى পক্ষ থেকে মোহাম্মাদ (সাঃ) মাধ্যমে সরাসরি এসেছে অথবা উৎসরিত হয়েছে। শরীয়ার ব্যপারে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হল (যা West promoted,সাধারণ জনতার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে), এটি শুধু মাত্র ধর্মীয় কিছু ব্যপারে আদেশ-নিষেধ সম্বলিত রীতি-নীতি বিশেষ। উপরোল্লেখিত আয়াত থেকে আমরা দেখি, আল্লাহ سبحانه و تعالى আমাদের জাহেল (যারা মানব রচিত আইনে বিশ্বাসী) ও নাস্তিকদের অনুসরণ না করার জন্য আদেশ করেছেন। কেউ যদি আল্লাহর বিরোদ্ধচারী আইন (মানব রচিত/মানব উৎসরিত আইন) অনুসরণ করে অথবা নিজের খেয়াল খুশির মত চলে, তখন সে তাদের (জাহেল/নাস্তিক) অনুসরণ করলো,যা আল্লাহ سبحانه و تعالى পরিষ্কার ভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। এ ব্যপারে একটি হাদিস আছে, যা আলি (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
মোহাম্মাদ (সাঃ) বলেন “সেখানে কোন আনুগত্যের নেই,যেখানে আল্লাহর আনুগত্য নেই, বস্তুতঃ আনুগত্য সেখানেই, যেটা সঠিক” (বুখারি এবং মুসলিম)।
আইন প্রণয়ন (যার উৎস মানুষ) অথবা ভিন্ন কোন আইন প্রতিষ্ঠা অথবা যেসব আইন ইসলাম থেকে উৎসরিত নয়, সেসব হচ্ছে শিরক এবং নিজেকে আল্লাহর سبحانه و تعالى ক্ষমতার বিরুদ্ধে নিজেকে উপস্থাপন করা। যেটা এই আয়াতে বলে হয়েছে,
“এদের কি এমন কোন শরীক আছে, যারা এদের জন্য এমন কোন বিধান প্রণয়ন করে নিয়েছে,যার অনুমতি আল্লাহ তায়ালা দান করেননি, যদি (আযাবের মাধ্যমে) সিদ্ধান্ত নেওয়া হত তাহলে কবেই তাদের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়ে যেত; অবশ্যই যালেমদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে” (৪২.আশ শুরা : ২১)
আল্লাহ سبحانه و تعالى এ আয়াতে পরিষ্কার ভাবে ঘোষনা করেছেন যে, আল্লাহর আইনের পাশাপাশি কোন আইন উদ্ভাবন বা প্রতিষ্ঠা করা হলো তাঁর سبحانه و تعالى বিরুদ্ধে শরীক করা (শিরক হলো আল্লাহর ক্ষমতার সাথে ভিন্ন কোন ক্ষমতার ঘোষনা দেয়া/প্রতিষ্ঠা করা, যা আল্লাহ سبحانه و تعالى নিজের উপর ‘জুলুম’ হিসেবে ঘোষনা করেছেন,যার গোনাহ কখনো ক্ষমা হবার নয়)। প্রত্যেক মুসলিমই জানে (যাদের ইসলাম সম্পর্কে কিঞ্চিত জ্ঞান আছে) যে, ইসলাম শুধু মাত্র কিছু আধ্যাতিক অনুষ্ঠান পালন সর্বস্ব কোন ধর্ম নয়- বরং তার চেয়ে বেশি কিছু,এটি পুর্ণাঙ্গ ঐশ্বরিক জীবন ব্যবস্থা। তাই, কোন আইন, যা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করে, তা কেবল আল্লাহরই سبحانه و تعالى অধিকার, যিনি আসমান ও যমিন সমূহের অধিকর্তা।
আমাদের বিচার-ফয়সলা (আদালত) সবসময় অবশ্যই শরিয়াহ মোতাবেক হতে হবে,যা আল্লাহ سبحانه و تعالى প্রদত্ত। আল্লাহ سبحانه و تعالى বলেন,
“ হে ঈমানদার মানুষেরা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর,আনুগত্য কর (তাঁর) রাসূলের এবং সে সব লোকদের,যারা তোমাদের মাঝে দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত,অতঃপরও কোন ব্যপারে যদি তোমরা মতবিরোধ করো, তাহলে সে বিষয়টি (ফয়সলার জন্য) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও,যদি তোমরা (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহর উপর ও শেষ বিচার দিবসের উপর ঈমান এনে থাকো! (তাহলে) এ পদ্ধতিই হবে (তোমাদের বিরোধ মীমাংসার) সর্বোৎকৃষ্ট উপায় এবং বিরোধপুর্ণ বিষয় সমূহের ব্যাখ্যার দিক থেকেও (এটি) হচ্ছে উত্তম পন্থা ” (৪.নিসা : ৫৯)
আল্লাহ سبحانه و تعالى মানবজাতিকে তাঁর সাথে শিরক করা থেকে সাবধান করে দিয়েছেন। আল্লাহ سبحانه و تعالى বলেন,
“ (যারা অহঙ্কারী) তাদের মধ্যে যদি কেউ এ কথা বলে আল্লাহ তায়ালার বদলে আমিই হচ্ছি মাবুদ,তাহলে তাকে আমি জাহান্নামের (কঠিন) শাস্তি দেবো, (মূলত) আমি জালেমদের এভাবেই শাস্তি দেই” (২১. আল-আম্বিয়া : ২৯)
আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে বলছি যে, আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালানো বা বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তাতে আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, পরিপূর্ণ রাজত্ব এবং পরিচালনা ক্ষমতার দাবী অনুযায়ী তাঁর হুকুম কার্যকর করার নামান্তর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ سُبۡحَٰنَهُۥ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٣١﴾ [التوبة: ٣١]
“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলিম ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও অথচ তাদের প্রতি শুধু এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক মা‘বূদের ইবাদাত করবে, যিনি ব্যতীত মা‘বূদ হওয়ার যোগ্য কেউ নয়। তিনি তাদের অংশী স্থাপন করা হতে পবিত্র।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩১]
এখানে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদী-নাসারাদের ধর্ম-যাজকদেরকে রব হিসেবে নাম করণ করেছেন। কারণ, তারাও আল্লাহর বিধানের মত বিধান রচনা করত। তাদের রচিত বিধানের অনুসারীদেরকে গোলাম বা বান্দা হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে। কারণ, তারা আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে ঐ সব পাদ্রি ও আলিমদের কাছে নতি স্বীকার করত এবং তাদের অনুসরণ করত। আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, তারা তো তাদের ইবাদাত করে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে। আর সাধারণ লোকেরা তাদের অনুসরণ করে থাকে। এটার নামই ইবাদাত।
আপনি জেনে নিন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না; বরং অন্যের বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করতে চায়, তাদের ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের আয়াতে তাদেরকে ঈমানহীন (মুনাফিক) দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতে কাফির, যালেম ও ফাসিক বলা হয়েছে। ,
﴿أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ يَزۡعُمُونَ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓاْ إِلَى ٱلطَّٰغُوتِ وَقَدۡ أُمِرُوٓاْ أَن يَكۡفُرُواْ بِهِۦۖ وَيُرِيدُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَن يُضِلَّهُمۡ ضَلَٰلَۢا بَعِيدٗا ٦٠ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ رَأَيۡتَ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودٗا ٦١ فَكَيۡفَ إِذَآ أَصَٰبَتۡهُم مُّصِيبَةُۢ بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ جَآءُوكَ يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ إِنۡ أَرَدۡنَآ إِلَّآ إِحۡسَٰنٗا وَتَوۡفِيقًا ٦٢ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُ ٱللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ فَأَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَعِظۡهُمۡ وَقُل لَّهُمۡ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَوۡلَۢا بَلِيغٗا ٦٣ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ وَلَوۡ أَنَّهُمۡ إِذ ظَّلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ جَآءُوكَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ ٱللَّهَ وَٱسۡتَغۡفَرَ لَهُمُ ٱلرَّسُولُ لَوَجَدُواْ ٱللَّهَ تَوَّابٗا رَّحِيمٗا ٦٤ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٠، ٦٥]
“আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য শয়তানের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, তোমরা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং তাঁর রাসূলের দিকে এসো তখন আপনি মুনাফিকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তখন কেমন হবে? অতঃপর তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ফিরে আসবে যে, কল্যাণ ও সমঝোতা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত।
অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোনো কথা বলুন, যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাদের (রাসূলগণের) আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবান রূপে পেত। অতএব, তোমার রবর কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবূল করে নিবে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬০-৬৫]
এখানে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবীদার মুনাফিকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন:
(১) মুনাফিকদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা তাগুতের নিকট বিচার-ফায়সালার জন্য গমণ করে থাকে। প্রত্যেক ঐ বিষয় বা ব্যক্তির নামই তাগুত, যে আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে। সমস্ত বিচার-ফায়সালা এবং হুকুমের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। বলেন,
﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ﴾ [الاعراف: ٥٤]
“জেনে রাখ! তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ করা। আল্লাহ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের রব।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]
(২) তাদেরকে আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে আহ্বান করা হলে তারা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
(৩) তারা কোনো বিপদে পড়লে অথবা তাদের কৃতকর্ম মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলে শপথ করে বলে থাকে যে, সৎ উদ্দেশ্য এবং পরিস্থিতি শান্ত রাখা ব্যতীত আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। বর্তমানে যারা ইসলামের বিধান বাদ দিয়ে মানব রচিত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালায়, তাদের কথাও একই রকম। তারা বলে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো যুগোপযোগী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের উপকার সাধন করা।
আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত চরিত্রের অধিকারী মুনাফেকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরের খবর জানেন এবং তাদেরকে নসীহত করার জন্য এবং কঠোর ভাষায় কথা বলার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ দিয়েছেন। রাসূল পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো, যাতে শুধুমাত্র তাঁদেরই অনুসরণ করা হয়। অন্য মানুষের অনুসরণ নয়। তাদের চিন্তাধারা ও মতবাদ যতই শক্তিশালী হোক না কেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজের রুবূবীয়্যাতের শপথ করে তাঁর রাসূলকে বলছেন যে, তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ব্যতীত কারও ঈমান সংশোধন হবে না।
- সকল প্রকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে রাসূলের দিকে ফিরে আসা।
- রাসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য অন্তরকে প্রশস্ত করা।
- পরিপূর্ণভাবে রাসূলের ফায়সালাকে মেনে নেওয়া এবং কোনো প্রকার শীথিলতা ব্যতীত তা বাস্তবে রূপদান করা।
দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতসমূহে আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ﴾ [المائدة: ٤٤]
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফির।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৪]
﴿وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ﴾ [المائدة: ٤٥]
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৫]
﴿وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ﴾ [المائدة: ٤٧]
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসিক।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৭]
যারা আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না তাদেরকে আল্লাহ উপরের তিনিটি আয়াতে পরপর কাফির, যালেম এবং ফাসিক বলেছেন। তিনটি গুণই কি এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে? অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করল না, সে কাফির, ফাসিক এবং যালেমও বটে। কেননা আল্লাহ কাফিরদেরকে যালেম এবং ফাসিক হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلۡكَٰفِرُونَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ﴾ [البقرة: ٢٥٤]
“বস্তুতঃ কাফিররাই প্রকৃত যালেম।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৪]
আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَٰسِقُونَ﴾ [التوبة: ٨٤]
“তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফুরী করেছে এবং ফাসিক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮৪]
প্রত্যেক কাফির-ই কি যালেম এবং ফাসিক? নাকি আল্লাহর আইন দিয়ে ফায়সালা না করার কারণে বিভিন্ন প্রকার মানুষের ওপর অবস্থাভেদে এ সমস্ত বিধান প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয় মতটি আমার নিকট গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার না করলে মানুষ কখনো কাফির হয়, কখনো যালেম হয় আবার অবস্থাভেদে কখনো ফাসিক হয়।
সুতরাং আমি বলব যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে এবং অন্য বিধানকে অধিক উপযোগী ও উপকারী মনে করে তার মাধ্যমে মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফির হয়ে যাবে। এদের অন্তর্ভুক্ত ঐ সমস্ত লোক, যারা মানুষের জন্য পথ হিসাবে ইসলাম বিরোধী বিধান রচনা করে। তারা তাদের রচিত বিধানকে মানুষের জন্য অধিক উত্তম ও উপযোগী মনে করেই তৈরি করে থাকে। এ কথা স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মানুষ এক পথ ছেড়ে দিয়ে যখন অন্য পথে চলে, তখন এটা মনে করেই চলে যে, প্রথম পথের চেয়ে দ্বিতীয় পথটি উত্তম।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং বিচার-ফায়সালা করে, কিন্তু সে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করে না এবং অন্য বিধানকে অধিক উপকারী এবং উপযোগীও মনে করে না; বরং সে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য এরূপ করে থাকে, তাহলে কাফির হবে না বরং যালেম হিসাবে গণ্য হবে।
এধরনের মানব সৃষ্ট আইনের আনুগত্য করা বা মানব সৃষ্ট আইন রাষ্ট্রে বলবত রাখা মুসলমানের জন্য জায়েজ নাই বরং এটা করা কুফুরী।
প্রশ্ন:মানব সৃষ্টা আইনে গঠিত দেশে মুসলমানদের করনীয় কি?
উত্তর: আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার চপষ্টা করা।