বাংলাদপশের উপর ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন
বাংলাদেশে ভারতের “সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন” এবং “রাজনৈতিক কর্তৃত্ব” প্রতিষ্ঠার স্বরূপ অনুধাবন করার পূর্বে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক “সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ” এবং “রাজনৈতিক কর্তৃত্ব” বলতে কি বোঝায়।
“সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ” বলতে এমন পরিস্থিতিকে বোঝায়, যখন রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী কোন রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোন রাষ্ট্রের উপর স্বীয় সংস্কৃতিকে প্রচার এবং প্রসারিত করতে সচেষ্ট হয়। অথবা, কোন জনগোষ্ঠীর মাঝে বাধ্যতামূলকভাবে বিদেশী সংস্কৃতিকে অভিযোজন করাকে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ (Cultural imperialism) বলা যেতে পারে।
“ভাষাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ” (language imperialism) এবং “শিক্ষাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ” (Academic imperialism) হচ্ছে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের অপর দুই মাধ্যম। তেমনই, তথ্য- প্রযুক্তি নির্ভর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে বলা হয় “সফট পাওয়ার” (soft power)।
“রাজনৈতিক কর্তৃত্ব” (hegemony) হচ্ছে, পরোক্ষ আধিপত্যের ভূ- রাজনৈতিক পদ্ধতি, যে মাধ্যমে আধিপত্যবাদি কোন রাষ্ট্র অনুগত কোন রাষ্ট্রকে সরাসরি সামরিক আক্রমণ, দখল বা স্বরাজ্যভুক্তি না করে, হস্তক্ষেপের হুমকি প্রদানের মাধ্যমে কর্তৃত্ব করে।
“সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ” (cultural hegemony) হচ্ছে, কোন আধিপত্যবাদি রাষ্ট্র যখন একই পদ্ধতিতে অনুগত কোন রাষ্ট্রের সামাজিক কৃষ্টির উপাদান সমূহকে (যেমন, ধর্ম বিশ্বাস, ধর্মীয় ব্যাখ্যা, অনুভূতি, ধ্যান- ধারণা, মূল্যবোধ ইত্যাদি) স্বীয় কর্তৃত্ব স্থায়ী করার উপযোগী করে তুলতে সচেষ্ট হয়।
বাংলাদেশের উপর ভারতের যত প্রকার আগ্রাসন চলছে, এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী বা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী এবং “সফট পাওয়ার” মূলক আগ্রাসন।
বিশ্বের অন্যান্য প্রগতিশীল উদারমনা বিবেকবান মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও মনে করে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সাথে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময় মানবজাতির স্বার্থের অনুকূল এক প্রক্রিয়া। সাংস্কৃতিক বিনিময়ে উভয় দেশের অংশগ্রহন অপরিহার্য অথচ বাংলাদেশে ভারতের এত টিভি চ্যানেল দেখানোর অনুমতি থাকলেও ভারতে বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেল দেখানোর অনুমতি নেই, আবেদন বা গ্রহণযোগ্যতা থাকে স্বত্বেও। একতরফা সাংস্কৃতিক প্রভাব কোন অর্থেই পারস্পরিক হতে পারে না।
তাছাড়া, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে তা যদি হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, প্রশ্রয় দেয়া হয় অপসংস্কৃতিকে, আর এর বিরূপ প্রভাবে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় দেশের তরুণ প্রজন্ম তবে তা কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না। ভালো কিছু গ্রহণ করতে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু অবাধে অপসংস্কৃতি প্রবেশে সকল দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষেও কেউই সায় দিবে না।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার শুরুর পর থেকে কার্যত ভারত আমাদের ওপর অব্যাহতভাবে এক ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই চালিয়ে যাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়টি এ দেশের মানুষের কাছে উদ্বেগের কারন হয়ে উঠেছে। অনেকেই আজ খোলাখুলি বলতে বাধ্য হচ্ছেন, আমরা আজ ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভির সূচনা ১৯৯২ সালে। এর আগে ১৯৬৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে চালু ছিল শুধু বিটিভি। ১৯৯২ সাল থেকে প্রধানত টেলিস্টার-১০ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি অন্যান্য স্যাটেলাইটও ব্যবহার করছে। বাংলাদেশী এসব টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান, বিশেষ করে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গানের ভিডিও পশ্চিম বাংলার মানুষের কাজে জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ভারত সরকার তাদের দেশে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলার ওপর এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। অথচ বাংলাদেশে অবাধে চালু আছে প্রচুর সংখ্যক বিদেশী টিভি চ্যানেল, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই ভারতীয়। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের ডাউনলিঙ্ক করা হচ্ছে অবৈধভাবে। বাংলাদেশী ক্যাবল অপারেটরেরাও তথ্য মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন না নিয়েই বিদেশী টিভি চ্যানেলের সিগন্যাল ডাউনলিঙ্ক করছে। এই প্রক্রিয়াকে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের “সফট পাওয়ার” (soft power) এর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
বর্ণ বিদ্বেষী, শ্রেনী বিন্যাসী এবং জাত্যাভিমানী সহ অনেক সমাজের মানুষজনের নিকট অন্য কোন কৃষ্টির উপাদান তত আকর্ষণীয় নয় যতটা বাংলাদেশের জনগণের এক ব্যাপক সংখ্যার নিকট আকর্ষণীয়। হতে পারে, অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশীরা অতি মুক্তমনা বা অন্য কিছুর প্রতি অতি আগ্রহি কিংবা অপসংস্কৃতির সাথে পরিচিত নয় বলেই তার প্রতি আগ্রহ অতি তীব্র। তবে অন্য সংস্কৃতির প্রতি অতি উদারতা এবং অতি আগ্রহ যে ক্ষতির কারন এবং আত্ন বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যহীন ও ক্ষতিকারক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ছায়াছবি এবং টিভি প্রোগ্রাম সমূহের প্রতি তাঁদের অতি আগ্রহ যদিও, আমাদের দেশে ভালো মানের ছবি, নাটক ও টিভি অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যায় না।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ভারতীয় ছায়াছবি এবং টিভি সিরিয়াল সমুহে যে সকল উপাদান তাঁদের সবচেয়ে বেশী আগ্রহি করে তোলে তার মধ্যে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে যৌন উত্তেজনা। অনেক ভারত প্রেমিক চট করে বলে ফেলেন, ভারতের টিভি সিরিয়াল গুলি বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান সমূহের তুলনায় অনেক উন্নত মানের, তাই তারা বাংলাদেশের টিভি প্রোগ্রাম দেখেন না।
হতে পারে ভারতীয় অনুষ্ঠানগুলির প্রিন্ট বাংলাদেশী অনুষ্ঠানগুলির তুলনায় ভালো, ওদের সাজ-পোশাকে থাকে একটি বাড়তি চমক যা দর্শকদের আকৃষ্ট করে থাকে, এদের বিজ্ঞাপনের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম ইত্যাদি। কিন্তু কথায় বলে, যার যেমন আয়, তেমনই ব্যয় করা উচিত। সবাই কি মার্সিডিজ কিনতে পারে? দেশ বড় হওয়ার কারণে ভারতের ছবি এবং সিরিয়াল নির্মাতাদের আয় বাংলাদেশী নির্মাতাদের তুলনায় অনেক বেশি, সেকারনে তারা এসব নির্মাণে ব্যয়ও করতে পারে বেশি। ব্যয় বেশি তাই, চাকচিক্য বেশি। তাই, অন্যের চাকচিক্য দেখে কি আমার আত্মবিস্মৃত হওয়া যুক্তিযুক্ত?
যারা অন্যের এই চাকচিক্যের কারণে আত্মবিস্মৃত হচ্ছেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, প্রতিবেশী বাড়িতে পোলাও-গোস্ত রান্না করা হয় বলে কি নিজ গৃহের মাছ-ভাত অখাদ্য হয়ে যায়? প্রতিবেশীর ঘি দিয়ে পাক করা খাবারের প্রাপ্তি যদি হঠাৎ কোনদিন, কোন কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তখন কি খাবেন? তখন কি ওদের ডাস্টবিনে খাবার খুজবেন নাকি নিজের মাছ-ভাত বা যাই আছে তাই খাবেন?
“সফট পাওয়ার” এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
“সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ”
একটি কথা প্রচলিত আছে যে, মিথ্যা কথা বার বার বললে তা মানুষের কাছে সত্য বলে মনে হয়।
পশ্চিমা বিশ্বের খৃষ্টান অধ্যুষিত আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র সমুহ যেমন মুসলমান সমাজকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য কয়েক শতাব্দী যাবত কোমর বেধে ইসলামের বিরুদ্ধে জোর প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবি এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে এক্সপ্লয়েট করে যাচ্ছে। বলিউড নির্মিত “প্রচারণা ছায়াছবি” (propaganda film) ভীর জারা, ফানা, সারফারোজ, গার্ব , এল ও সি, আব তুমহ্যারে হাওলা ওয়াতান সাথিও, বর্ডার, দেব, জামীর, গ্যাং, ওয়েন্ডস ডে, কাছে দাগে, ইয়ে দিল আশিকানা, হিন্দুস্তান কি কসম, ওয়ান্টেড ইত্যাদি সহ ৭৫.০৬ ভাগ বলিউড সিনেমায় মুসলমান চরিত্র উল্লেখযোগ্য। এই সকল চরিত্রের মাধ্যমে, মুসলমানদেরকে কৌশলে উপহাস এবং মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের সহানুভূতিমুলক মনোভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমান চরিত্রকে লোভী, শত্রুতাপূর্ণ, দুর্বল ইচ্ছা শক্তি এবং দুর্বল প্রত্যয়ের অধিকারী হিসেবে, সন্ত্রাসী বা মাফিয়া চক্রের নেতা, অস্ত্র- মাদক চোরাকারবারী, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টিকারী, খুনী, প্রতারক বা নির্মম অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এক দিকে ভারতের ছায়াছবি নির্মাতাগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছায়াছবির মাধ্যমে অপপ্রচার চালায়। অন্যদিকে, ভারতীয় টিভি চ্যানেল সমূহে আমাদের সংস্কৃতির উপাদানের সাথে বেমানান সংস্কৃতির চর্চা করে, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান দিয়ে আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সঙ্গীতের নামে এসব টিভি চ্যানেলে পরিবেশিত হয় এক ধরনের উলঙ্গ নৃত্য যা ভারতের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের ৯০% মানুষের সংস্কৃতির সাথে নয়।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি বাংলাদেশের মানুষের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জীবনাচার। এ দেশের মাটি, নদনদী, জনগোষ্ঠীর শিকড় থেকে উঠে আসা শিল্প। আমাদের সাহিত্য মূলত এ দেশে গড়ে তুলেছে সমৃদ্ধ এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আমাদের সংস্কৃতি নিশ্চিতভাবেই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে স্বতন্ত্র। এ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁর সময় লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক, চিন্তক-গবেষক, সুফি-দরবেশ, সঙ্গীতসাধক, চিত্রকর, চলচ্চিত্রকার, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ আর এ দেশের মাটি-মানুষের সম্মিলিত অবদানের ফসল আমাদের অনন্য এ সংস্কৃতি। হাজার বছরের ঐতিহ্য লালন করেই চলে এসেছে আমাদের জীবনযাপন আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড: শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক-সিনেমা, লোকশিল্প, কুটির শিল্প, লোককাহিনী, দর্শনচর্চা, উৎসব-আয়োজনসহ যাবতীয় লোকাচার। আমাদের সংস্কৃতির ওপর নানা ধর্মের নির্দোষ প্রভাবও ছিল বরাবর। কিন্তু এর পরও স্বীকার করতেই হবে, সব কিছুকে ছাপিয়ে আমাদের সংস্কৃতি আগ্রাসনের শিকারও হয়েছে নানাভাবে। সে আগ্রাসন মোকাবেলা করেই আমরা আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক- বাহক।
এক সময় যখন বাংলাদেশে কোনো বিদেশী টিভি চ্যানেল ছিল না, তখন বিটিভি যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনগুলোর ভালো ভালো টিভি সিরিয়াল আমাদের দেখাত। ম্যাকগাইভার, স্টারট্র্যাক, ইনক্রেডিবল হালক, ওশিন ও কার্ল সাগানের বৈজ্ঞানিক সিরিয়াল এমন সব সিরিয়াল যেন ছেলে-বুড়ো সবার নির্মল আনন্দের আধার ছিল। আমাদের বিটিভির রাবেয়া খাতুনের সকাল-সন্ধ্যা, হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’, জহির রায়হানের সংশপ্তক-এর মতো অসংখ্য টিভি সিরিয়াল ছিল অনন্য অসাধারণ। সুস্থ বিনোদনের আধার। কিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো আসার পর আমরা পাচ্ছি শুধু ভারতীয় সংস্কৃতির উপাদান সমূহ যে সব আমাদের সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা দেশীয় সুস্থ সংস্কৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছি অপসংস্কৃতির ওপর।
সময়ের সাথে এই অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ক্রমেই আমাদের গ্রাস করছে। এই আগ্রাসনের সহজ শিকার আমাদের তরুণ প্রজন্ম। কোনো ধরনের ভাল-মন্দ বিবেচনা না করেই অন্ধভাবে অনুকরণ করছে এমন বিদেশী সংস্কৃতি, যার পরিণাম ভয়াবহ। এর অনিবার্য পরিণাম নিজস্ব সংস্কৃতিকে অস্থিত্বহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া। সম্প্রসারণবাদীদের লক্ষ্যটাও তাই। কারণ, এরা ভালো করে জানে একটি জাতিকে পদানত করতে সবার আগে প্রয়োজন এর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করা। আজকের যুব সমাজের একটি অংশ আসক্ত হয়ে পড়েছে হিন্দি ভাষায়। অনেক ঘরের শিশুর মুখেও আজকাল ‘বাচ্চা মাত বলোনা, শিভা মেরা নাম হ্যায়’ অথবা হারামজাদে, ‘ম্যায় তেরা খুন পিই যাউংগা’ এমন হিন্দি ডায়ালগ শোনা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট ডিশ মানে ভারতীয় চ্যানেল। আর ভারতীয় চ্যানেল মানে অলংকার আর নানা চমকের ঝলকানির পোশাক পরে সংসারের কূটনামি, ষড়যন্ত্র মার্কা ধারাবাহিক। উচ্চবিত্তের পরকীয়া, বহুবিবাহ, বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ, পারিবারিক বিরোধ প্রভৃতি এইসব সিরিয়ালের মুল বিষয়বস্তু, যা কঠিন ব্যাধির মতোই মানসিক আঘাত হানছে নারী ও শিশু দর্শকের মনের উপর।
এই সব টিভি সিরিয়ালগুলোর মূল বিষয়বস্তু তিনটি। প্রথমত: সিরিয়ালগুলোতে ভরপুর থাকে পারিবারিক ও সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা এবং ঝগড়া। এটাকে কেন্দ্র করে গোটা সিরিয়াল জুড়েই থাকে কূটবুদ্ধির চর্চা। প্রতিহিংসা রূপ নেয় একে অপরকে ধ্বংস বা হত্যা ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে। গৃহবধূ, নারী এবং কিশোরীরা এই ঝগড়া-ঝাটি দেখতে বেশ পছন্দ করে। এটা তাদের মনের মধ্যে দাগ কাটে, নিজেদের প্রবৃত্তিটাও আস্তে আস্তে সেভাবেই বিকশিত হয়। পরিণত বয়সীদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসে এই সিরিয়াল দেখে। তাদের ভিতরের স্বভাবটাও আস্তে আস্তে ঝগড়াটে স্বভাবে রূপ নেয়। এটা যখন বাস্তবে রূপ লাভ করে তখন পরিবার গুলোতেও দেখা দেয় প্রতিহিংসা, দ্বন্দ্ব, ও সংঘাত। আমাদের ধর্ম, আমাদের পরিবার প্রথা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুসারে আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা থাকার কথা । কিন্তু ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের প্রতি আসক্তির কারণে এমন শ্রদ্ধা, ভালবাসা পরিবার ও সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে এবং এসবের স্থলে স্থান করে নিচ্ছে প্রতিহিংসা, দ্বন্দ্ব, ও সংঘাত।
ভারতের বাংলা চ্যানেল জি বাংলা, স্টার জলসা, ইটিভি, হিন্দি চ্যানেল জিটিভি এবং স্টার প্লাস সর্বাধিক সিরিয়াল প্রচার করে থাকে। এসব সিরিয়ালের দ্বিতীয় বিষয়বস্তু হলো ‘পরকীয়া’ অর্থাৎ এক নারীর সাথে একাধিক পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত মেলামেশা, আবার এক পুরুষের সাথে একাধিক নারীর দৈহিক সম্পর্ক ও মেলামেশা। এগুলোকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবর্তে সৃষ্টি হয় সন্দেহের। স্বামী স্ত্রী উভয়েই উভয়কে সন্দেহ করে। নেশাগ্রস্তের মতো আগ্রহ নিয়ে এইসব সিরিয়ালের কাহিনী পর্যবেক্ষণের কারণে আমাদের সমাজেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলে ভারতের একেকটি সিরিয়াল। বিশ্বাস না থাকলে বাস্তবে পৃথিবীতে কোন সভ্যতাই গড়ে উঠতো না। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যৌন উত্তেজনা পরিবেশনের মাধ্যমে সেই বিশ্বাসই ভেঙ্গে দিতে সঙ্কল্পবদ্ধ সিরিয়াল নির্মাতাগন। এইসব সিরিয়ালের কুপ্রভাবে সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা, বেলেল্লাপনা, পরকীয়া, বহুবিবাহ, মনোমালিন্য, সন্দেহ, ডিভোর্সসহ বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনা।
সিরিয়ালগুলোর তৃতীয় মৌলিক বিষয়বস্তু হলো ধর্ম। সস্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, বা যা কিছু নিয়েই দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা বা প্রতিহিংসা যখন চরম পরিণতির দিকে যায় তখন ধর্মের কাছে গেলে তার সমাধান হয়ে যায়। ধর্মই সত্যের ওপর অবিচল থাকা নায়ক বা নায়িকার শেষ আশ্রয়স্থল। চরম সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতে যখন কেউই তার পক্ষে নেই বলে মনে হয় তখন দেখা যায় যে, সংক্ষুব্ধ নায়ক, নায়িকা বা সংশ্লিষ্ট চরিত্রের ব্যক্তি দেব-দেবীর মন্দিরে মূর্তির কাছে পূজা দিয়ে তার কাছেই সব সমস্যার সমাধান খুঁজছে। শেষ পর্যন্ত সমাধানও তাদের ধর্মের কাছে গিয়েই হচ্ছে। একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলা মেগা সিরিয়ালের কাহিনী, কথোপকথন এবং ঘটনা পরম্পরায় যখন যে পূজা তখন সেখানে গিয়ে আবর্তিত হয়। বাস্তবে কৌশলে সিরিয়ালগুলোতে তারা তাদের ধর্মটাকেই প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করছে। অথচ আমাদের দেশের সমস্ত নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল সব কিছুতেই ধর্ম প্রায় অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে ধর্মটাকে এখানে প্রগতির পথে অন্তরায় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
কিছু কাল পূর্বেও আমাদের মা, চাচী, খালা, বোন, আর ভাবীরা দুপুরে খাওয়া সেরে হয় ঘুমাতেন; না হয় কয়েকজন মিলে সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। কিন্তু আজকাল ওনারা অবসর সময়ে নেশগ্রস্তের মতো টিভির সামনে বসে থাকেন। তারা কী বিটিভি, বিবিসি, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, এনিমেল প্ল্যানেট, কিডস চ্যানেল, নিও স্পোর্টস বা স্টার স্পোর্টস দেখেন? অবশ্যই নয়। ওরা দেখেন স্টার প্লাস, জি বাংলা, সাহারা ওয়ান, সনি, এনডিটিভি, ইমেজিন ইত্যাদি চ্যানেল।
মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির এ যুগেও পার্শ্ববর্তী দেশের বিনোদন ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোকে তাদের গৃহে প্রবেশ করতে দেন না, কিন্তু আমাদের দেশের মেরুদন্ডহীন বিনোদন ব্যবসায়ীরা প্রতিবেশি দেশের চ্যানেলগুলোকে সাদরে আমাদের অন্দরমহলে প্রবেশ করিয়েছেন। প্রবেশের সুযোগ পেয়েই আমাদের নারীদের মনের গভীরে প্রবেশ করছে সিরিয়ালের অতি নাটকী অর্ধ নগ্ন নায়ক- নায়িকারা।’
সংসার কর্তার বেতন থেকে ডিশ সংযোগের বিল দিয়ে আমাদের নারীরা এক দিকে শিখছেন বউ শাশুড়িকে, শাশুড়ি বউকে, ননদ ভাবীকে, ভাবী ননদকে কিভাবে সাইজ করে; স্বামীকে কী করে দৌড়ের ওপর রাখা যায়; কিভাবে স্বামী তালাক দেয়ার পর দেবরকে বিয়ে করে সংসারে আগুন জ্বালাতে হয়। এসব ছাড়াও আমাদের নারীরা গিলছেন; কী করে সিরিয়ালের নায়িকা স্বামী ও প্রেমিককে, বা নায়ক স্ত্রী ও প্রেমিকাকে ম্যানেজ করছেন সেই সাথে বোনাস হিসেবে পরকীয়ার রগরগে দৃশ্য। আগে নারীদের আড্ডায় নিজেদের সাংসারিক আলাপ হতো আর এখন হয় সিরিয়ালের নায়িকাদের ভার্চুয়াল পরিবারের সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনা।
শুধু তাই নয়, এসব সিরিয়াল দেখে দেখে আমাদের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী আজ বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ককে স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এসব সিরিয়ালে যেভাবে অপরাধকর্মের ছড়াছড়ি, তা দেখে দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই অপরাধের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। এতে করে সামাজিক ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলাও সময়ের সাথে বাড়ছে। ঘটছে মূল্যবোধের অবক্ষয়।
ভারতীয় সংস্কৃতির আধিপত্যের ফলে আজ আমাদের বিয়ের উৎসব-আয়োজনও হারাতে বসেছে অতীত ঐতিহ্য। আমাদের পোশাক-আশাকে আসছে ভারতীয় ঢং। মুসলমানদের বিয়ের উৎসবেও চলে বলিউড স্টাইলে নাচের আয়োজন। বিয়ের উৎসবের সময়-পরিধিও বেড়ে গেছে। বাড়তি দিনগুলোতে ভারতীয় সিরিয়ালের আদলে চলে হিন্দি নাচগান, যা কয় বছর আগেও এ দেশে ছিল অকল্পনীয়। আজ দর্জি বাড়িতে হিন্দি সিরিয়াল আর সিনেমার নায়কের পোশাকের আদলে পোশাক তৈরি করে দেয়ার অর্ডার যাচ্ছে। ড্রেস ডিজাইনারেরাও শিকার একই প্রবণতার। মরণঘাতী এ ছোবল আমাদেরকে ক্রমেই করে তুলছে পরনির্ভর সংস্কৃতির ধারক-বাহক।
শুধু তাই নয়, আগে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা ছিল স্ট্যটাসের চিহ্ন, আর এখন হিন্দি সে স্থান দখল করে নিচ্ছে। “ভাষাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ” আমাদের মুখের ভাষাও বদলে দিচ্ছে। সালাম বরকতকে আমরা ভুলতে বসেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি শুধুই বাৎসরিক এক সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিনত হচ্ছে।
যে কাহিনী এক পর্বের নাটকের জন্যও যথেষ্ট নয়, সে কাহিনীকে রাবারের মতো লম্বা করে কয়েক শ’ পর্ব বানিয়েও আরো লম্বা করতে পুনর্জন্মকে মাধ্যম হিসেবে নেয়া হয়। এভাবে মানুষের চিন্তা-ভাবনা করার সময়ও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ‘প্লেইন লিভিং এন্ড হাই থিঙ্কিং’ বৈশিষ্ট হাড়িয়ে আমরা গ্রহন করছি ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তির’ সংস্কৃতিকে। জাতিগত ভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে, সব রকম আগ্রাসনকে সুযোগ দিয়ে আমরা সম্রাট নিরোর মত বাশি বাজাচ্ছি, আর ভাবছি দেশের চিন্তা করার দায়িত্ব তো অন্যদের।
এমনি পরিস্থিতিতে সমাজের একটি বড় অংশ যখন ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে, ঠিক তখনি কেউ কেউ ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ না করার পক্ষে নানা যুক্তি খাড়া করছেন। মুক্ত এই আকাশ সংস্কৃতির যুগে নাকি উত্তরের জানালা যদি খুলে দেয়া হয়, সেই জানালা দিয়ে বাতাসের সাথে খানিকটা ধুলো-বালিও নাকি আসবে। এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
খানিকটা ধুলো-বালি যদি আসতো, তা নাহয় সহ্য করা হতো। কিন্তু এ যে ধুলো-বালি নয়। রীতিমত কাদামাটি ও নোংরা জল যা আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্ম ও সাংস্কৃতিকে একসাথে কর্দমাক্ত করে দিচ্ছে। তাঁদের কারনেই, আমরা কাদামাটি ও নোংরা জল প্রমাণ করতে পারছিনা, প্রমান করতে পারছিনা ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার’কে। তাই আমাদের শিশুরা মোটু-পাতলু, শিভা মেরা নাম হ্যায় ইত্যাদি দেখে সারাদিন হিন্দি প্র্যাকটিস করতে থাকে।
ভারতীয় চ্যানেল আমাদের ‘দেশীয় পণ্য কিনে হও ধন্য’ স্লোগানটাকেও নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। ভারতীয় চ্যানেলে সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপনের বদৌলতে আমাদের নারীসমাজ ভারতীয় পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। ভারতীয় পণ্যের নাম তাদের মুখস্ত। ভারতীয় সিরিয়ালের নামে বাজারে ঈদ-পূজায় পোশাক আসে। সেই সাথে, ভারতের ব্যথা, বেদনার মলম থেকে শুরু করে পান পরাগ, গুটকা, শাড়ি-চুড়ি, কাপড় জুতায় আমাদের বাজার ভর্তি। শুধু কী তাই, দোকানিরাও এক পা এগিয়ে আছে আগে ভারতীয় পণ্যগুলিই কাস্টমারদের দেখানোর জন্য।
এতে বোঝা যাচ্ছে, আমরা শুধু ভারতীয় চ্যানেল দেখছি না, সাথে চ্যানেলে বিজ্ঞাপিত পণ্যও ক্রয় করছি। মহিলা ক্রেতারা বাজারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে টাইগার বাম, জান্ডু বাম, লেহেংগা, কিরণ মালা ইত্যাদি। সেই পোশাক কিনতে না পেরে ডিভোর্স ও আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। অথচ এর বিপরীতে, দেশের ভালো ভালো পণ্য আজ ভারতীয় পণ্যের কাছে হেরে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে দেখানো হয় না। ভারত যে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখায়না এটা তাদের দেশপ্রেম। তারা যে দেশকে ভালোবাসে এটা তার প্রমাণ। একসময় কোলকাতায় বাংলাদেশি টেলিভিশন খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখন স্যাটেলাইটের যুগ ছিল না। ওই সময় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলির সাবান কোলকাতার বাজারে বিক্রি হতো। এখন আমরা ভারতীয় চ্যানেল টাকা দিয়ে দেখি এবং সেই সাথে তাঁদের পণ্যও ক্রয় করি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভারতের একটি বড় বাজারে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের কেউ একবারও ভেবে দেখেছে বলে মনে হয়না যে, এত বড় দেশ ভারত, সেখানে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে পারলে সেখান থেকে আমরা ভারতের তুলনায় অধিক লাভবান হতে পারি। কিন্তু আমাদের ব্যাবসায়ীদের মধ্যে তেমন দেশ প্রেম কোথায়। তাঁদের নিকট চোরাকারবারি করে হলেও ভারতীয় পণ্য বিক্রয় করে ব্যাক্তিগত মুনাফাই শ্রেয়তর।
বাংলাদেশের অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী বিশ্বাস করেন, বাংলা চলচ্চিত্রের ধ্বংসের পর এখন টিভি নাটকেরও সমাপ্তি টানার আয়োজন চলছে। তারা বলেন, সংস্কৃতি শুধু বাণিজ্য নয়; একটা জাতিকে এগিয়ে নেয়ার হাতিয়ার। আমরা সে হাতিয়ারই তুলে দিয়েছি ভারতীয় চ্যানেলের হাতে।
বাংলাদেশ ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সামগ্রিক প্রক্রিয়া চলছে গ্লোবালাইজেশনের নামে। বলা হচ্ছে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, মুক্ত অর্থনীতি, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট আজ গোটা পৃথিবীকে করে তুলেছে এক গ্লোবাল ভিলেজ। পাশাপাশি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, এসব একই সাথে আমাদের পৃথিবীকে করে তুলেছে এক গ্লোবাল পিলেজ তথা লুণ্ঠনের স্থানে, পাশাপাশি বিশ্বকে করে তুলেছে সম্প্রসারণবাদীদের আগ্রাসনের অবাধ ক্ষেত্র। নইলে কেন গ্লোবালাইজেশনের দোহাই দিয়ে আমাদের দেশে অবাধে চলবে অসংখ্য ভারতীয় টিভি চ্যানেল, আর ভারতে চলতে পারবে না আমাদের একটি টিভি চ্যানেলও? কেন এসব টিভি চ্যানেল আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, আমরা বরাবরই থাকব সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত?
সাপ্তাহিক ব্লিটজ পত্রিকার সাম্প্রতিক এক জরিপে উল্লেখ রয়েছে, ভারতীয় কোন চ্যানেল বাংলাদেশ থেকে কত আয় করছে। বিদেশী টিভি চ্যানেল, যার বেশির ভাগই ভারতীয় বাংলাদেশের ক্যাবল নেটওয়ার্কে অনুমোদিত। পত্রিকাটি জানিয়েছে, প্রতি মাসে ভারতীয় চ্যানেলগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশ থেকে আয় করছে গ্রাহকচাঁদা ও বিজ্ঞাপন বিক্রি থেকে। কিন্তু ভারত সরকার আমাদের চ্যানেলগুলোকে সে দেশে প্রবেশের কোনো সুযোগ দিচ্ছে না, অলিখিতভাবে সে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। অথচ অনেক আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল ভারতে চালু রাখার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারতে বাংলা ভাষাভাষীদের মাঝে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বাংলাদেশী নাটক ও সিরিয়ালগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তা ভারতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কোনটি বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে কত আয় করছে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ব্লিতস জরিপ দল। এই তালিকা মতে,
এসব চ্যানেলের মাসিক আয় নিম্নরূপ : স্টার প্লাস ১৯৫ হাজার ইউএস ডলার, স্টার মুভিজ ১১৮ হাজার ডলার, জি স্টুডিও ৯৪ হাজার ডলার, জিটিভি ৬৭ হাজার ডলার, সনি ১২৩ হাজার ডলার, সেটম্যাক্স ৭২ হাজার ডলার, স্টার গোল্ড ৬১ হাজার ডলার, জি সিনেমা ৯৫ হাজার ডলার, স্টার স্পোর্টস ৭০ হাজর ডলার, বিএইউ পাঁচ হাজার ডলার, স্টার জলসা ১৭ হাজার ডলার, জি প্রিমিয়ার ৩৯ হাজার ডলার, জি প্রিমিয়ার ৩৯ হাজার ডলার, জি অ্যাকশন ২৯ হাজার ডলার, জি কাফে ১৯ হাজার ডলার, জি বাংলা ১৭ হাজার ডলার, সাব টিভি ছয় হাজার ডলার, তারা টিভি ছয় হাজার ডলার, তারা মিউজিক ছয় হাজার ডলার, স্টারওয়ান ২৩ হাজার ডলার এবং স্টারওয়ার্ল্ড ২৩ হাজার ডলার।
এ তালিকা সম্পূর্ণ নয়, তবে এ থেকে আন্দাজ-অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, আমরা কেন ভারতের কাছ থেকে সমান সুযোগ পাবো না?
এ ছাড়া এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকা আমরা ভারতকে দিয়ে থাকি শুধু জি, সনি, স্টার এর মতো পে চ্যানেল দেখার জন্য।
এ দিকে বাংলাদেশের ‘অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনারস’-এর নেতারা গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের সাথে দেখা করেন। এ সময় এরা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে বিদেশী চ্যানেলগুলোর ওপর ইউজার ট্যাক্স বসানোর সুপারিশ করেন। তাদের অভিযোগ, প্রতিবেশী ভারত আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোকে সে দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না। অথচ ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের বাজার দখল করে তাদের পণ্য ও বিজ্ঞাপন প্রমোট করছে। ভারতীয় চ্যানেলগুলোকে বাংলাদেশ সরকারকে কোনো কর দিতে হয় না। অপর দিকে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল মালিকদেরকে ভ্যাট দিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এরই মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পাস হয়েছে, সেখানে বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপর কোনো কর আরোপ করতে দেখা যায়নি। ফলে আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির দাবিটি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সে দেশের বাংলা ছবি প্রদর্শনের ওপর যে পরিমাণ কর আদায় করে, হিন্দি ছবি প্রদর্শনের ওপর আরোপ করে এর কয়েক গুণ বেশি কর। কারণ, সরকার চায় পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পকে সংরক্ষণ সুবিধা দিতে। আমরা আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর স্বার্থ রক্ষায় পালন করছি সম্পূর্ণ উল্টো ভূমিকা।
উল্লেখ্য, ভারতে বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমতি নেই। কোন কেবল অপারেটরই একটি কানেকশনে দুনিয়ার সব চ্যানেল আমাদের দেশের মত দেখিয়ে দিতে পারেনা। তাদের জাতীয় টেলিভিশন ছাড়া যে কোন বেসরকারি বা বিদেশী চ্যানেল দেখতে হলে আগে পারমিশন নিতে হয়। আমাদের সরকার কিসের বিনিময়ে আমাদের সংস্কৃতির ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের অনুমতি দিয়ে দিলেন?
ভারতের রাজনীতিক, সংস্কৃতি কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাদেশীদের মুক্তমন এবং অন্য কিছুর প্রতি অতি আগ্রহের কথা জানেন। তারা এও জানেন যে, দেশ দখলের জন্য এখন আর তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করা লাগে না । তাঁদের কৌশল হলো বাংলাদেশের মানুষের মুক্তমন আর অতি আগ্রহ এই দুই বৈশিষ্টকে কাজে লাগিয়ে, মনের জগতটাকে দখল করে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আগ্রাসনে সাফল্য অর্জন করা। ভারতীয় সিরিয়ালগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মানুষের মগজ ধোলাই কাজে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে, ফিলিস্তিনিদের মতো ইসারেলীদের দ্বারা তৈরি কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে আটকা পরে গুলি খেয়ে মরার মত, একই ভাবে বাংলাদেশীদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে আটকিয়ে যখন-তখন গুলি করে মারলেও, ফারাক্কা, তিপাইমুখ দিয়ে চির সবুজ বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিনত করলেও, আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি বণ্টন না করলেও, ভিতর এবং বাহির সর্ব দিক দিয়ে বাংলাদেশকে দখল- নিয়ন্ত্রন করলেও আমরা ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোমর সোজা করে দাড়াতে পারিনা। এছাড়াও রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করার এক স্থায়ী “ব্ল্যাক মেইলিং” অস্ত্র। যদিও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব সহ অনেকেই স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হতে ভারতের সেনা বাহিনীর তুলনায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবদানই বেশী। তারাই জয়ের জন্য আসল কাজটি করেছেন এবং তাদের বীরত্বের জন্যই জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে। তবুও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশে তাঁদের আঞ্চলিক এজেন্টগন শুধু ভারতকেই আমাদের মুক্তকারী, ভাগ্য বিধাতা বলে মনে করে এবং প্রচারও করে। তাঁদের প্রচারের কারণে আমাদের অধিকাংশই আজ মগজ ধোলাইয়ের শিকার।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে আমাদের অনেক মেধাবীদেরকেও। এরা নিজস্ব আইডিয়ার স্ফুরণ ঘটানোর পরিবর্তে আজ ভারতীয় সংস্কৃতি অনুকরণেই বেশি আগ্রহী।
সত্যি আমরা আত্ন বিধ্বংসী এক অদ্ভুত জাতি। সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল, ইয়াবা সহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের আগ্রাসনে যুব সমাজ শেষ হবার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবার পর এবার ঐ দেশের টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে রীতিমতো মগজ ধোলাই হতে চলেছে এই জাতির।
সূত্রঃ ওয়ার্ল্ডপ্রেস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ