expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Wikipedia

সার্চ ফলাফল

সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২৫

বিহারী-বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা

 পূর্ব পাকিস্তানের বিহারী-বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত বিহারী- বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ও পর্যালোচনা




Abstract

The aim of this paper is to explore the interrelationship between the East Pakistan riot of 1964 and the growth of Bengali nationalism. The 1964 East Pakistan riot refers to the massacre of Bengali Hindus and some of the cases Bengali Muslims by the Pakistani Bihari in the wake of and alleged theft of what was believed to be the profhet's hair from the Hazratbal shrine in Jammu and Kashmir. But the main effect of this riot is the growth of Bengali nationalism which led the East Pakistan to the liberation war of 1971. The language movement of 1952 of the then East Bengal can be depicted as the rising period of language based on Bengali nationalism against the Muslim religion based Pakistani nationalism. This Bengali nationalism had been flourished by the mass uprising of Bengali people against the Pakistani Bihari massacre and ethnic cleansing of Bengali Hindus in 1964. Progressive minded Bengali Political leaders, Journalists, Cultural Activists such as Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Ataur Rahman Khan, Tofazzal Hossain, Abdus Samad, Sufia Kamal and so on stood against the Bihari rioters. Students and general people of East Pakistan did the same. This all created a sense of Bengali nationalism, on the basis of this nationalism Bangladesh becomes independent in 1971.

বাংলাদেশ পৃথিবীতে সম্ভবতঃ একমাত্র দেশ যা দু'বার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। ১৯৪৭ সালে প্রথম ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীনতার পর যে অবিভক্ত পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তাকে পুনরায় বিভক্ত করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ভাগ্য বিপর্যয়ের পর বাংলা প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়। এই দুইশত বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে বাংলা কেবল অর্থনৈতিকভাবে শোষিত বা নিপীড়িত হয়েছে তাই নয় ব্রিটিশরা তাদের ভাগ কর ও শাসন কর নামক কূটনীতির দ্বারা বাংলার আবহমান কাল ধরে বিরাজমান সাম্প্রাদায়িক সৌহার্দ্যকে বিনষ্ট করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন এলিট শ্রেণি পূর্বতন ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করে শাসন পরিচালনা করে। আর এখানে যাতে বাঙালিদের মধ্যে কখনো জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটতে না পারে এবং দীর্ঘদিন এ অঞ্চলকে যাতে শাসন ও শোষণ করা যায় সেজন্য বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট করার লক্ষ্যে নানাভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ঘটায়। মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি তথা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘটিত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের উস্কানিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হয়। আরও মনে করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আইয়ুব খান অত্যন্ত কৌশলী পন্থায় প্রদেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে গভর্ণর মোনায়েম খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় তা দাঙ্গার ব্যাপকতা ও প্রসারতার কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দাঙ্গা প্রথমে হিন্দু-মুসলমান, পরে বাঙালি-বিহারিতে রূপান্তরিত হয়। এ দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৪ সালের পর হিন্দুদের দেশত্যাগ অব্যাহত থাকে।

১৯৬৪ সালে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয় তার উৎস পূর্ব পাকিস্তান নয় বরং ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর। তৎকালীন করাচি হতে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক 'Dawn' পত্রিকাতে ১৯৬৪ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে দাঙ্গার উৎস সম্পর্কে কিছুটা তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম দাঙ্গার সূত্রপাত হয় ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তর্গত হজরতবাল মসজিদে সংরক্ষিত হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র কেশ অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার কলকাতার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানেও সরকারি মদদে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। 'Dawn' পত্রিকাতে প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায় যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতানুযায়ী ১৯৬৩ সালের ২৬-২৭ ডিসেম্বর রাতে হজরতবাল মসজিদ হতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র কেশ চুরি হয়। কিন্তু 'Dawn' পত্রিকার ভাষ্য মতে, এ চুল চুরি হয় পূর্ববর্তী রাত্রি ৩-৫ টার মধ্যে। ২৬-২৭ ডিসেম্বর রাতে চুরি হওয়া অসম্ভব কেননা সেদিন বৃহস্পতিবার রাত হওয়ায় অসংখ্য ভক্তরা মসজিদ প্রাঙ্গনে সমবেত ছিল। কিন্তু এটি পূর্ববর্তী রাতে চুরি করা খুবই সহজ। প্রত্যক্ষদর্শী এক গোয়ালার সাক্ষ্য অনুযায়ী ঐ রাতে ৭ জন দুর্বৃত্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে মসজিদে আসে এবং মহানবীর চুল অপসারনের পর তারা গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। দুর্বৃত্তদের মধ্যে কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সাধারন সম্পাদক বখশী আব্দুর রশীদ উপস্থিত ছিল। যখন এই পবিত্র স্মৃতি চুরি হবার সংবাদ বাইরে ছড়িয়ে পড়ে তখন হাজার হাজার মুসলমান এ ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। ২৮ ডিসেম্বর কাশ্মীরে প্রায় ২ লক্ষ জনতা হাতে কালো ও সবুজ রংয়ের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা যখন লাল চক্রের (Lal Chowk) দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বাধা ধেয় এবং গুলিবর্ষণ করে। ফলে মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ পর্যায়ে কাশ্মীরের স্টেট কংগ্রেস এর সভাপতি শফি কোরেশী, পলিটিক্যাল কনফারেন্স এর সভাপতি গোলাম মহিউদ্দিন কারা এবং গণভোট ফ্রন্টের মোজাহিদ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিক্ষোভকারীদের শান্ত হতে ও জামিয়া মসজিদে চলে যেতে রাজি করাতে সক্ষম হয়। এসময় হঠাৎ করেই ন্যাশনাল কনফারেন্স এর সেক্রেটারী বখশী আব্দুর রশীদ ও শ্রীনগর ন্যাশনাল কনফারেন্স এর সভাপতি আম্মা সূফী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এসময় বখশী আব্দুর রশীদ চিৎকার করে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন যে, “তোমরা চিৎকার চেঁচামেচি কেন করছো? তোমাদের বাড়িতে কি খাবারের অভাব পড়েছে। চলে যাও। এটা তোমাদের চিন্তার বিষয় না। খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব। যেভাবে এটা অদৃশ্য হয়ে গেছে সেভাবেই এটার পুনরাবির্ভাব ঘটবে।” বখশী রশীদের এই উদ্ধত আচরণ জনতাকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলে ও তারা রশীদকে ধাওয়া করার পাশাপাশি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। এসময় আরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, আব্দুর রশীদ পালিয়ে কোথি বাগ (Kothi Bagh) পুলিশ স্টেশনে লুকিয়ে আছে। এসময় জনতা পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং এতে ৩ জন নিহত ও প্রায় ৩০০ জন আহত হয়। এ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলীয় নেতাদের গ্রেফতার করে। ফলে শ্রীনগর ও অন্যান্য শহরে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা হয়। এদিকে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি কাশ্মীরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শামসুদ্দীন ঘোষণা করেন যে, হজরতবাল হতে অপহৃত রসুলুল্লাহর পবিত্র কেশ উদ্ধার করা গিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনরোষ সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি এবং অনেকে এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।"

ভারতের শ্রীনগরে অবস্থিত হজরতবাল মসজিদ থেকে মুহম্মদের পবিত্র স্মৃতি অপহরণের বিষয় নিয়ে যখন জম্মু ও কাশ্মীরে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলমান তখন পূর্ব পাকিস্তানেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামিক বোর্ডের উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুল হাই পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু ও অ-মুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। এমনকি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা থেকে ইসলামাবাদ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন যে, হজরতবালের ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানে কোনও প্রতিক্রিয়া হলে তিনি এর কোনও দায়ভার গ্রহণ করতে পারবেন না।

হজরতবাল ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা যায়। প্রদেশের বিভিন্ন স্থান হতে কয়েকজন পরিষদ সদস্য ১ জানুয়ারি গভীর ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এছাড়া এদিন করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন ও শহরের বিভিন্ন কলেজের ছাত্র সংসদের ৩০ জন এক বিবৃতিতে হজরতবালের ঘটনার গভীর উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগ ১৯৬৪ সালের ৩ জানুয়ারি 'কাশ্মীর দিবস ঘোষণা করে। ১৯ এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা ও দৌলতপুরে দুর্বৃত্তরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ঘটায়। তারা বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের গৃহ ও দোকানপাটে লুটতরাজ ও ক্ষেত্রবিশেষে অগ্নিসংযোগ করে। তবে দাঙ্গা সৃষ্টি করে শহরের শান্তি বিনষ্ট করতে গেলে কিছু সংখ্যক সমাজের সুস্থ চেতনাসম্পন্ন নাগরিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় 'ও বিপন্ন নাগরিকদের আশ্রয় দেয়। অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা ৬টা হতে ভোর পর্যন্ত খুলনা শহরে ও দৌলতপুরে সান্ধ্য আইন ও অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। সন্ধ্যা হতে ই.পি.আর (E.P.R) বাহিনীকে মোতায়েন করা হলে রাত্রি সাড়ে ৮টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।” ৩ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয় খুলনার দৌলতপুর এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মিল শ্রমিক এদিন মিছিল বের করে ও এক পর্যায়ে তারা উগ্র হয়ে বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের গৃহের ক্ষতিসাধন ও দোকানপাট লুটতরাজ করে। পুলিশ ও ই.পি.আর তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেবার কিছুক্ষণ পর আর একদল মিল শ্রমিক দৌলতপুরের নিকটবর্তী আরেকটি গ্রাম আক্রমণ করে তারা বাড়ি-ঘর লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। ১২ পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় এবং প্রায় ৭৩ জন দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার করে। এদিকে ৫ জানুয়ারি খুলনার কোনও কোনও অঞ্চলে প্রায় ৪০% দোকানপাট বন্ধ থাকে। গত দু'দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৩৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খুলনা শহরের অবস্থা ক্রমশ এসময় স্বাভাবিক হয়ে আসলেও দাঙ্গাকারীরা দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ৫ জানুয়ারি রাতে খুলনার ৩৬ মাইল দূরবর্তী মংলা বন্দর এলাকায় গ্রামাঞ্চলে যথাক্রমে শ্যাওলাধুনিয়া, কানাইনগর এবং মোকাদ্দমপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে কিছু কিছু লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়। এসময় ১০ জন দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার ছাড়াও ১৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে বাগেরহাটের রূপসা হতে মুলঘর স্টেশনের পার্শ্ববর্তী নীলাপুর, সামন্তসেনা, খাজুরা, চুলকাঠি ও আলাইপুর গ্রামেও দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৩

পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে ৭ জানুয়ারি ঢাকা, আদমজী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পেশাদার গুণ্ডা দিয়ে হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার সূচনা করে। ১০ জানুয়ারি তা তীব্র আকার ধারণ করে ও শত শত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” অবশ্য এসময় খুলনার দাঙ্গা পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়।১৫ ৯ জানুয়ারি বিকেলে কলকাতা এবং এর শহরতলী এলাকায় হঠাৎ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে ১২ জন ছুরিকাহত হয়। চব্বিশ পরগণা জেলার সীমান্তবর্তী বনগাঁও শহর, বারাসাত ও হাওড়া এলাকায় দাঙ্গার তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তী দু'দিন কলকাতায় ব্যাপকভাবে দাঙ্গা চলতে থাকে। ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত দাঙ্গায় পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৬০ জন ব্যক্তি নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয় বলে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মি. পি.সি সেন ঘোষণা করেন। এছাড়া ১১ জানুয়ারি অপরাহ পর্যন্ত একমাত্র যশোর জেলাতেই পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকা হতে প্রায় ৩০ হাজার মুসলমান আগমন করে। পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁও মহকুমা হতেই অধিকাংশ মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে।* ১৩ জানুয়ারি বি.বি.সি (B.B.C) নিউজের বরাতে জানা যায় যে, কলকাতা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় ১০০ জন নিহত ও ৪৩৮ জন আহত হয়েছে। এছাড়া ৭০০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয় যাতে ২৯ জন নিহত হয়। মূলত কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১০ জানুয়ারি পাবনায় হঠাৎ করেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। খুলনায় ১০ জানুয়ারি সান্ধ্য আইনের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করা হয়। এদিকে ১১ জানুয়ারি ঢাকার ৮ জন সাংবাদিক ও পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের দুইজন কর্মকর্তা এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করে যাতে খুলনার সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয় এবং মানবতার দুশমনদের রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া একই দিনে মওলানা ভাসানী মীর্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে এক বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রতি দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।

কলকাতায় ১২ জানুয়ারি দাঙ্গা পরিস্থিতির অবনতি হলে ৩টি এলাকায় ২৪ ঘন্টাব্যাপী

সান্ধ্য আইন জারি করার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৫৯ দফা গুলিবর্ষণ করা হয়। তবে ১৩ জানুয়ারি হতে কলকাতার দাঙ্গা পরিস্থিতির অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। কলকাতার দাঙ্গার সূত্র ধরে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা চালানো হয়। এসময় ঢাকার ডেপুটি কমিশনার আবুল খায়ের ও সিটি এম.পি ইয়াহিয়া চৌধুরী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করেন। ২০ এদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে দেশের সকল শ্রেণির জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে সাম্প্রদায়িক শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে মানবতার দুশমনদের রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। শেখ মুজিবুর রহমান তার বিবৃতিতে দেশবাসীকে সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের ঘৃণ্য চক্রের ঊর্ধ্বে থেকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার আহ্বান জানান এবং একইসাথে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীতে উত্তেজিত না হবার আবেদন জানান। *

শুধু বিবৃতি প্রদানই নয় শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ জানুয়ারি দাঙ্গা প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এছাড়া ১৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি লেখক সংঘের এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পূর্ব পাকিস্তান কমিটি পাকিস্তানের জনসাধারণের কাছে সীমান্তের অপর পারের উত্তেজনা ও উস্কানি সত্ত্বেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। ২৫ একই দিনে ঢাকার নেতৃস্থানীয় মহিলাগণ এক যুক্ত বিবৃতিতে সম্প্রীতির দুশমনদের রুখে দিতে মা- বোনদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। **

এদিকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অবস্থা বরাবর শান্ত থাকার পর ১৩ জানুয়ারি সোমবার শেষ রাতের দিকে নারায়ণগঞ্জের মিল এলাকায় ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সংবাদ পাওয়া যায় এবং এসময় নারায়ণগঞ্জের জেলেপাড়া ও গোদনাইলে বেশকিছু গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে ১৪ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতির মারাত্মক রূপ ধারণ করে। এজন্য এদিন ৪টার পর হতে নারায়ণগঞ্জে ২০ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ১৪ জানুয়ারি সারাদিন কিছুটা শান্ত থাকার পর সন্ধ্যার দিকে ঢাকার নওয়াবপুর রোডের কিছু দোকানে দাঙ্গাকারীরা অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অগ্নিসংযোগ করা হয় বিধায় এদিন রাত ১০টা হতে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ২৬

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিস্তার লাভ করলে ১৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল শিক্ষক-ছাত্র শ্রমিক-বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি সকল মহল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশবাসীর নিকট দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখার আহ্বান জানান। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংস্থা এবং ঢাকার বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের ১৮ জন ছাত্রনেতা এক যুক্ত বিবৃতিতে দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান। ২৭ এছাড়াও এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, কবি এবং সাহিত্যিক এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানিদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। *

তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামের প্রেসিডেন্ট মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন এবং প্রাদেশিক আঞ্জুমান মোহাজেরিনের সাধারণ সম্পাদক এস.কে ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার উদাত্ত আহ্বান জানান। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ছাত্রলীগের সকল শাখাকে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য জনমত গঠনের জন্য তৎপর হতে নির্দেশ দেয়। ২৯ ১৪ জানুয়ারি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক প্রেস রিলিজে পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন কমিটি, ছায়ানট ও আঞ্জুমানে আদাব সকল লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রতি সকল মহল্লা ও ওয়ার্ডে সমাজবিরোধী ব্যক্তিকে রুখিবার উদ্দেশ্য শান্তি স্কোয়াড ও অতন্দ্র দৃষ্টি রাখার জন্য কমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এদিন বিকেলে আতাউর রহমান খানের বাসভবনে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৩১ এছাড়া সর্বদলীয় নেতৃসভা নিয়মিতভাবে শহরের দাঙ্গাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। জাতীয় ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ এবং শ্রমিক ও ছাত্র প্রতিনিধিগণ ১৪ জানুয়ারি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা সফর করেন এবং এসকল অঞ্চলের জনগণকে নিজ নিজ এলাকায় শান্তি ও শৃংখলা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে বলেন। পরিদর্শকদের মধ্যে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী, অলি আহাদ এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অন্যতম। ৩২

এদিকে ১৫ জানুয়ারি তারিখেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ১৫ জানুয়ারি দাঙ্গাবিধ্বস্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে বাঁচাতে গিয়ে নবাবপুর রেলক্রসিং এর সামনে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন কবি ও বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আমির হোসেন চৌধুরী, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরামের চেয়ারম্যান। তাছাড়া ১৫ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে অবস্থানরত ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে বিহারিরা হামলা চালিয়ে মেয়েদের শ্লীনতাহানি করে। ৩৪ সমগ্র পরিস্থিতি এভাবে ভয়াবহ ও নিয়ন্ত্রণহীণ হয়ে পড়ে। ঢাকায় এদিন বিশেষ শ্রেণীর দুষ্কৃতিকারী তথা বিহারীরা দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে হামলা চালায়। এছাড়া এদিন ঠাটারীবাজার, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ি, নয়াপল্টন, গেন্ডারিয়া প্রভৃতি এলাকায় দুর্বৃত্তরা সংখ্যালঘু ও স্থানীয় মুসলমানদের দোকানপাট ও গৃহে অগ্নিসংযোগ করে। ১৫ জানুয়ারি সকাল ১১ টায় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এক শান্তি অভিযান বের করে। এতে আতাউর রহমান খান, সৈয়দ আজিজুল হক, আব্দুস সামাদ, শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, নুরুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এ শান্তি অভিযান পুরান ঢাকার বিশেষ করে ইসলামপুর, আরমানীটোলা, ওয়ারী এলাকার হেয়ার স্ট্রীট, লারমিনি স্ট্রীট, ফোলডার স্ট্রীট প্রভৃতি রাস্তা পরিক্রমণ করেন। পরিক্রমণকালে তিনটি স্থানে শান্তিদূতদের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা করে। শেখ মুজিবুর রহমান এদিন ওয়ারী এলাকায় সংখ্যালঘু অধিবাসীদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকাকালে দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি প্রায় ৫০০ জন সংখ্যালঘু অধিবাসীকে স্থানান্তরে সক্ষম হন। এদিকে চট্টগ্রামেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে ১৫ জানুয়ারি ১৫ দিনের জন্য চট্টগ্রামের ৩টি থানায় যথাক্রমে কোতোয়ালী, ডাবলবুরিং এবং পাঁচলাইশ থানায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ৩৭ খুলনায় বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাট শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মী কিসমত-কে ছুরিকাঘাত করে হত্যা এবং হাবিবুর রহমান নামক এক ইউ.সি সদস্যকে গুরুতর ছুরিকাহত করা হয়। তাছাড়া হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে স্থানীয় অনেক নেতৃবৃন্দকে হুমকি দেওয়া হয় ।”

দাঙ্গার তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি তারিখেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভীষিকা অব্যাহত থাকে। তথাকথিত বিহারি মুসলিমদরদীদের আক্রমণে হিন্দু সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বহু মুসলমান হতাহত হয়। ১৬ জানুয়ারি বিহারিদের আক্রমণে নিহত হন আমেরিকার জাতীয় অধ্যাপক এবং নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার নোভাক। তিনি নারায়ণগঞ্জে এক বিপন্ন হিন্দু পরিবারকে উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যান। ৪ দিন পর তার মৃতদেহ নদীতীরে খুঁজে পাওয়া যায় এবং তার হাতঘড়ি ও মোটরসাইকেল তাঁকে হত্যাকারী দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ১৬ জানুয়ারি দাঙ্গাকারীদের হামলায় ৪ জন মুসলমানসহ ১১ জন নিহত হয়। পাশাপাশি ময়মনসিংহ লাইন দিয়ে ঢাকা গমনাগমনকারী বিভিন্ন ট্রেনের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এদিকে অশুভ শক্তির মোকাবিলার জন্য ১৬ জানুয়ারি বেসরকারী দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের সভাপতিত্বে ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের এক সভায় ব্যাপকভিত্তিক এই বেসরকারী দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়। ১১ সদস্য সমন্বিত এ কমিটির বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, খাজা খয়েরউদ্দিন, ডক্টর আলিনুর রাজি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, বেগম রোকেয়া আনোয়ার, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকার ৩৩ নং তোপখানা রোডে কমিটির অফিস ও সাহায্য দান ত্বরান্বিত করার জন্য এক কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। গভর্ণর মোনায়েম খান ও কনভেনশন মুসলিম লীগ দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির কাজকে সুনজরে দেখেননি। এমনকি দাঙ্গা কবলিত পুনর্বাসন প্রশ্নেও প্রশাসন শিথিলতা প্রদর্শন করে। ৪২ দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে ১৭ জানুয়ারি ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ পত্রিকায় 'পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও' শিরোনাম একটি আবেদনপত্র প্রকাশ করা হয়। ৪৩ এ আবেদনপত্রে সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তদের হামলায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে যে ব্যাপক বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখপূর্বক এর প্রতিরোধকল্পে পূর্ব পাকিস্তানের দেশবাসীকে মানবতার জন্য ও পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াবার আবেদন জানানো হয়। একইসাথে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীদের শায়েস্তা করার জন্য দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার আহ্বান জানানো হয়। এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবন ও মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

১৮ জানুয়ারি ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্ট হতে জানা যায় যে, পুরান ঢাকার ক্ষতিগ্রস্থ গৃহের প্রায় ৯৫% সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং প্রায় ১ লক্ষ হিন্দু জনগোষ্ঠী ঢাকা শহরে গৃহহীন অবস্থায় বসবাস করছে। মূলত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি বহু বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও নেতৃবৃন্দ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখেন। ১৬ জানুয়ারি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া); ডি. আই. জি এন. এ হক এবং স্থানীয় লোকজন যাত্রাবাড়ি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৭ হাজার সংখ্যালঘু মহিলা পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করেন। তন্মধ্যে ৪ হাজার সংখ্যালঘুকে কামরুন্নেসা স্কুলে, ১২ শতকে হরদেত্ত গ্লাস ফ্যাক্টরীতে এবং বাদবাকী লোকজনকে হাটখোলা রোডের একটি বাড়ীতে স্থান দেওয়া হয়। ৪৫ ১৯ জানুয়ারি থেকে ঢাকা নগরী এবং এর আশেপাশের এলাকার সামগ্রিক অবস্থার লক্ষ্যণীয় উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এদিন সান্ধ্য আইনের মেয়াদ ৬ ঘন্টার জন্য শিথিল করা হয়। এদিন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন আশ্রয় শিবির প্রাদেশিক গভর্ণর আব্দুল মোনায়েম খান পরিদর্শন করেন। তাছাড়া দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা ও শহরতলীর আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেন। ৪৬ শহরের ২১ টি শিবিরে অর্ধলক্ষাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা যেসব আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় প্রার্থীদের স্থান দেওয়া হয়েছিল তা হল: জগন্নাথ কলেজ, জগন্নাথ হল, উইমেন্স হল, পগোজ স্কুল, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম স্কুল, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, শশী মোহন বসাক লেন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল, সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল, কাজী পাড়া ইত্যাদি। দাঙ্গার ৭ম দিনে অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ঢাকার নাগরিক জীবনে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া দেখা যায়। তাছাড়া এদিন টঙ্গী, সাভার, নরসিংদী, রূপগঞ্জ, কালিয়াকৈর এসকল দাঙ্গা কবলিত এলাকায় শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, তাজুদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সফর করেন। পাশাপাশি বেগম রোকেয়া আনোয়ার এম.এন এর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাহায্য করার জন্য ২১ জানুয়ারি ওয়ারী এলাকার টিকাটুলি, হাটখোলা ও কমলাপুর এলাকায় সাহায্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে। তাছাড়া এস. হাসান আহমদ এবং শামসুজ্জোহার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জে শক্তিশালী শান্তি কমিটি গঠিত হয়। প্রদেশের অন্যান্য স্থানের মধ্যে ভৈরব (ময়মনসিংহ) মাইজদি, ফতুল্লা, ফরিদপুরে শান্তি কমিটি গঠণপূর্বক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্য্য অক্ষুণ্ণ রাখার শপথ গ্রহণ করা হয়।

এদিকে ২১ জানুয়ারি রয়টার সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে ভারতীয় বেতার পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১০০০ লোক নিহত হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার করে। তাছাড়া নিখিল ভারত আকাশ বাণী হতে প্রচারিত রয়টারের উক্ত খবরে বলা হয় যে, রায়ের বাজারে ৫০০ লোককে হত্যা করা হয়েছে। আমেরিকার শান্তি বাহিনীর জনৈক নার্সের বরাত দিয়ে উক্ত বেতারে বলা হয়েছে যে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬০০ মৃতদেহ দেখা গিয়েছে এবং ঢাকার নিকটে তেজগাঁয় ট্রেন থামিয়ে ৪০০ লোককে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ১ যদিও পূর্ব পাকিস্তান সরকার ২২ জানুয়ারি এক প্রেসনোট এ সংবাদকে সম্পূর্ণ আজগুবী ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দেন। পাশাপাশি এ প্রেসনোটে বলা হয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে ও প্রদেশের বাদবাকী অংশে শান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ২ পরবর্তীতে ২৪ জানুয়ারি পি.পি.এ পরিবেশিত আরেকটি সরকারি প্রেসনোটে জানানো হয় যে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও বিভিন্ন জেলার পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় অধিকাংশ কারখানায় কাজ শুরু হয়েছে এবং ক্রমে ক্রমে শ্রমিকরা কাজে যোগদান করছে। মূলত ১৯ জানুয়ারি নাগাদ কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায় বিধায় এর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানেও দাঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। ২৪ জানুয়ারি নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা শান্ত হয়ে যায়। এ সময়ের পর থেকে দাঙ্গা সংক্রান্ত সংবাদ পাওয়া যায়নি যদিও কিছু কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় তা প্রথম পর্যায়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থাকলেও পরবর্তীতে তা বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় পরিণত হয়। এ দাঙ্গায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিহারিদের হাতে বাঙালি মুসলমানরাও হতাহত হয়। আর এ দাঙ্গার পর হতে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। তথাপি এ দাঙ্গার উল্লেখযোগ্য দিক হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। এ দাঙ্গা চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী দাঙ্গা প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, শেখ মুজিবুর রহমান, আজিজুর রহমান, আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন, সৈয়দ আজিজুল হক, বেগম রোকেয়া আনোয়ার, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ। এ দাঙ্গাবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই একদিকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক শ্রেণি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপ্লবাত্মক পতাকাকে হাতে নিয়েছিল, তেমনি মেহনতী জনগণের ঐক্যের শিক্ষাকেও গ্রহণ করেছিল। ৪ তাই ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা ও দাঙ্গাবিরোধী গণঅভ্যুত্থান বা গণজাগরণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আর ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়বাদের পরিবর্তে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।



তথ্যনির্দেশঃ
১. নূহ-উল-আলম লেনিন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল), সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৪৮।

২. শেখ হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট, জোনাকী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১১৭ । ড. মোহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-১৯৭১), আগামী প্রকাশনী,

ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ২৭৭ ।

৩. The Dawn, দৈনিক পত্রিকা, করাচি, ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪. দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫.The Dawn, দৈনিক পত্রিকা করাচি, ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৬. S. K. Bhattacharya, Genocide in East Pakistan / Bangladesh, Houston: A Ghosh

( Publisher), 1987, p. 78 

৭. কালিদাস বৈদ্য, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব, কলকাতা, শংকর কর্মকার পাবলিশার্স, ২০০৫, পৃ. ৮৪।

৮. দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জানুয়ারি ১৯৬৪ ।

৯. Rabindranath Trivedi ( 23 July 2007). "The Legacy of the Plight of Hindus in Bangladesh - Part- VII: Bengali Muslims Fight Commuralism in 1964", Asian Tribune (World Institute for Asian Studies) 12 (492). Retrieved 27 August 2013.

১০. দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১১. ঐ, ৪ জানুয়ারি ১৯৬৪ ।

১২. ঐ ৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৩. ড. মাহফুজুর রহমান, বাঙালি জাতীয়বাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা, ট্রাস্ট, পৃ. ৩০৪।

১৪. দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৫. ঐ ১১ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৬. ঐ ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৭. ঐ, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।


১৯. দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জানুয়ারি ১৯৬৪

২০. ঐ, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২১. ঐ ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৪ ।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে!

  দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে! এক.   শুনতে খারাপ শোনালেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের...