"মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের ইতিহাস"
ডক্টর কামাল সিদ্দিকী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তার পুস্তকে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতীয় বাহিনী ফিরে যাওয়ার সময় লুটপাট করে বিপুল সম্পদও সাথে করে নিয়ে যায়। কিছু ভারতীয় অফিসার ও তাদের অধীনস্ত সেনারা যশোর, কুমিল্লা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এবং খুলনার শিল্পাঞ্চলে লুটপাট শুরু করে।
সেই সময়ে ভারতীয় বাহিনী সদ্য স্বাধীন দেশে যে সর্বব্যাপী এবং নজিরবিহীন লুটপাট চালায় তা বিদেশীদেরকেও হতবিহ্বল করে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়, মিল ফ্যাক্টরির মেশিনাদি যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুটপাট করে ভারতীয় সেনারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও খাদ্যশস্য, পাট, সুতা, যানবাহন, এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ, কারখানার মেশিনপত্র, যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুট করে। এই লুটের সম্পদের পরিমাণ ছিলো সবমিলিয়ে সেইসময়ের হিসাবে ২.২ বিলিয়ন ডলার।
এখন তার মূল্য দাঁড়ায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৪৭৯৩৫১ কোটি টাকা!!!
১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের আইডি এস বুলেটিনের (ভলিউম ৯, ১ নং) এর ১২ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত রেফারেন্স থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অন্তত চারটি ডিভিশনের অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, গোলাবারুদ, যানবাহন ও অন্যান্য সরঞ্জাম ভারতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিবাদ করলে টোকেন হিসেবে অল্প কিছু পুরোনো অস্ত্র ফেরত দেয়া হয়।
এই ভারতীয় বাহিনী এতই নির্লজ্জ ছিলো যে, এতো কিছু নিয়ে যাবার পরেও মিশ্র নামের ব্রিগেডিয়ার Rank এর অফিসার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ট্রাকে ভর্তি করে ভারতে পাচার করে।
প্রখ্যাত উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পুর্ব পশ্চিম উপন্যাসে লিখলেন,
“ঢাকায় এতসব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়, এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা । রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার-এইসব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে।"
পাকিস্তানি বাহিনীর পরিত্যাক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক যান, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ অনেক মুল্যবান জিনিস এমনকি প্রাইভেটকার পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই লুন্ঠন এমন বেপরোয়া আর নির্লজ্জ ছিলো যে বাথরুমের আয়না এবং ফিটিংসও সেই লুন্ঠন থেকে রেহাই পায়নি।
নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল তখন খুলনায়, তিনি প্রাইভেটকার যা পেলেন তা রিকুইসিজন করে সার্কিট হাউজে মুক্তিযোদ্ধাদের তত্বাবধানে রেখে কিছু সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করেন।
ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধে এই বীর সেক্টর কম্যান্ডার জনগনকে সাথে নিয়ে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। ফলও পেলেন দ্রুত। ৩১শে ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হন। যশোর সেনা ছাউনির অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে তাকে আটক রাখা হয়। বাড়িটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি নির্যাতন সেল। বাড়িটি অন্ধকার, রুমে মানুষের রক্তের দাগ, এলমেলো ছেড়া চুল, কিছু নরকংকাল সাথে শকুন আর শেয়ালের উপস্থিতির মধ্যে একটা খাটে ডিসেম্বরের শীতের রাতে আধা ছেড়া কম্বল গায়ে দিয়ে দেশের প্রথম রাজবন্দী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল শুনতে পেলেন পাশেই ভারতীয় সেনাদের বর্ষবরনের উল্লাস, নাচের ঘুঙ্ঘুরের শব্দ আর সেইসাথে নারী পুরুষের হল্লা।
জলিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন কনিষ্ঠতম মেজর; সাঁজোয়া বাহিনীর সদস্য এবং অকুতোভয় এক সৈনিক। জলিলের সঙ্গে সেদিন ভারতীয় বাহিনী আরো গ্রেপ্তার করে একই সেক্টরের আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত নৌবাহিনীর প্রাক্তন লিডিং সী ম্যান সুলতানউদ্দিন আহমেদ ও মোঃ খুরশিদ। বাকী দুইজন খালাস পেলেও জলিলের কোর্ট মার্শাল হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই সামরিক আদালতের বিচারক ছিলেন আরেক সেক্টর কম্যান্ডার কর্নেল তাহের। বিচারে জলিল নির্দোষ প্রমাণিত হন। কিন্তু মেজর জলিল নিজে থেকেই এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
এই লুটপাটের বাহিরেও ছিল চোরাচালান ও কালোবাজারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্পদের পাচার। কামাল সিদ্দিকী তার থিসিসে দেখিয়েছেন কিভাবে বৈদেশিক সাহায্য, আমদানী-রপ্তানিতে, টাকার অবমূল্যায়ন করে ভারত বাংলাদেশকে লুট করে।লুটপাট ভারতীয় সেনাবাহিনী করলেও চোরাচালান ও কালোবাজারিতে যুক্ত ছিল ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণী এবং তাঁরা বাংলাদেশেরও কিছু দালাল জুটিয়ে নিয়েছিল।
ভারত ও ভারতীয়দের এসমস্ত কর্মকান্ডের কারনে পুরো দেশে অল্প সময়ের মধ্যেই এন্টি-ইণ্ডিয়ান মানসিকতা তৈরি হতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখতে হয় একটি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ যেখানে ৫-১০ লক্ষ মানুষ খুন হয়। এর জন্য দায়ী কে? এরপরও বাংলাদেশীরা আজ ভারতীয় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায্য অধিকারের দাবী জানাতেও সরমিন্দা অনুভব করে। অথচ ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ স্বীকার করে বলেন,‘……আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিৎ ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন’ (ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’, স্টেটম্যান, ২৯ এপ্রিল, ১৯৮৮)।
সূত্র:মিলিটারী ডিফেন্স ফোরাম।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের দলিল |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ