ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার নিয়মিত আয়োজন ‘মাসিক মুহাযারা’র অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম। তার আলোচনাটি পত্রস্থ করেছেন মাওলানা আনোয়ার হুসাইন। পরবর্তীতে এটি মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের পর আলকাউসারের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হল।-তত্ত্বাবধায়ক
আজকের আলোচ্য বিষয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ইনশাআল্লাহ আজ আমরা কথা বলব ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়, এর গোড়ার কথা, ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আমাদের দেশে এর প্রাসঙ্গিকতাসহ সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়ে। শুধু সচেতন আলেমে দ্বীন হিসেবেই নয়, স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও এ বিষয়টি আমাদের বোঝা উচিত। কারণ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছে তাতে রাষ্ট্রের মৌলিক চার নীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দেওয়া হয়েছে। এরপর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে এ নীতিটি বাদ দিয়ে তার স্থলে আনা হয়েছে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। কিন্তু তিন দশক পর আবারো বর্তমান সরকার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে এবং ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ‘‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’’-এর নীতিটি।
সংবিধান জনগণকে প্রজাতন্ত্র তথা দেশের মালিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সে হিসেবে রাষ্ট্রের মালিক তথা নাগরিকদের জন্য দেশের সংবিধান জানার ও বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের নামে জনপ্রতিনিধি তথা সংসদসদস্যগণ কী কী বিষয় সংবিধানে যোগ-বিয়োগ করছেন তার প্রতি নজর রাখা সচেতন নাগরিকদের কর্তব্যও বটে। আমরা মূল আলোচনায় চলে যাই।
ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা/পরিচয়
প্রথমেই বলা দরকার যে, কিছু জিনিস আছে যেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া লাগে না। এমনিই বুঝে আসে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিও এমন। কম পড়ুয়া লোকজনও এর অর্থ বুঝে নিতে পারবে। ইংরেজি Secularism শব্দের বাংলারূপ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, আরবীতে যাকে বলা হয় ‘আলআলমানিয়্যাহ’।
প্রথমেই দেখুন বাংলা একাডেমীর ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারী। ২০১২ সালের এ সংস্করণ ছেপেছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের সম্পাদনায়। Secular-(অর্থ) পার্থিব, ইহজাগতিকতা, জড়, জাগতিক।
Secular State ‘গীর্জার সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র’। এ অর্থ অনুযায়ী মুসলিম দেশে এর ব্যাখ্যা হবে মসজিদের সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র।
Secularism নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয়-এই মতবাদ। জাগতিকতা, ইহবাদ।
এ অর্থগুলো লিখেছে বাংলা একাডেমীর অভিধান। এটির সম্পাদনায় কোনো ডানপন্থী বা কোনো ‘হুজুর’ জড়িত ছিলেন না। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেব ছিলেন এর সম্পাদক।
এটা এমন নয় যে, কোনো মতবাদ ওয়ালারা নিজ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ ব্যাখ্যা লিখেছে; বরং দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত এবং বর্তমান সরকার নিয়ন্ত্রিত সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী, যারা সংবিধানে আবার সেকুলারিজমকে স্থান দিয়েছে তাদের কর্তৃক নিয়োজিত, নির্ভরযোগ্য, যোগ্য ব্যক্তিরাই সেকুলারিজমের এই অর্থ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
আমার দেখে ভালো লেগেছে যে, ওনারাও ভালো মানুষ। রাখঢাক না করে সাফ সাফ কথাটাই মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়’-এমন কথা লেখেননি। আমি বাইরের অভিধানেও খোঁজ করেছি। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা দেখেছি, উইকিপিডিয়া দেখেছি। একই ব্যাখ্যা পেয়েছি। অক্সফোর্ড ইংরেজী-উর্দু ডিকশনারী। সেখানে লেখা আছে, Secularism لا دينية لا مذهبية، (ধর্মহীনতা)।
এগুলো মুসলমানদের ব্যাখ্যা নয়। সেকুলারিজম যে বাস্তবেই لا دينية لا مذهبية، (ধর্মহীনতা) এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় না। বাংলা একাডেমীরটা তো দেখলেনই। উইকিপিডিয়াতে সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা করা হয়েছে Anti Islam দিয়ে।
তাই বলছিলাম অনেক কিছুই আছে যেগুলো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার হয় না। শব্দ দেখেই মতলব স্পষ্ট হয়ে উঠে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাঃ
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আনুষ্ঠানি কভাবে চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানের মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। জনগণ তখন জেনেছে এই রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য স্বাধীন হয়েছে। বিজয়ের এক বছর পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে সংবিধান প্রণয়ন সমাপ্ত হয়েছে। বস্ত্তত তখনই দেশের সাধারণ জনগণ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা জেনেছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক, অল্প ধার্মিক হোক বা বেশি ধার্মিক যুদ্ধের সময় তারা জানেনি যে, তারা সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করছেন। এটা জেনেছেন তারা ১৯৭২ এর শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আরো এক বছর পরে। কারণ সংবিধানে এই কথা লিখে দেওয়া হয়েছে যে, যে সব কারণে আমাদের দেশের আবাল, বৃদ্ধ, নওজোয়ানরা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা সংবিধানে লেখা আছে।
এর আগ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ধর্মনিরপেক্ ষতার জন্য হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক দলিলে সেটা নেই। আপনি আমাদের দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইগুলো, পৌরনীতির বইগুলো পড়লে এর যথার্থতা খুঁজে পাবেন। এছাড়া স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব
পাকিস্তানী জনগণ বহু আন্দোলন করেছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন হয়েছে। ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ হয়েছে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়েছে। এগুলোর কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার নাম-গন্ধও ছিল না। এমনকি আপনি বর্তমান সময়ের (যখন দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়) মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখুন। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পাবেন না। সুতরাং অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আস্থার সাথে বলা যায় যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিখিত নিম্নলিখিত বাক্যটি বাস্তবসম্মত নয়।
‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল ... ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’’
সম্ভবত এ কারণেই স্বাধীনতার ঘোষণাকারী মতান্তরে ঘোষণা পাঠকারী জেডফোর্সের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রথম সুযোগেই এটিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এবং পরবর্তীতে অনেক সেক্টর কমান্ডারকেই জনগণ ধার্মিকরূপে পেয়েছে।
সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিদায়ঃ
শেখ মুজিব সরকারের সময়েই সংবিধানে ৪টা সংশোধনী হয়ে গিয়েছিল। এরপর জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের আইন থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দেন এবং তার স্থলে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্য স্থাপন করেন। দুই যুগেরও বেশি সময় পর্যন্ত সংবিধানে এ বাক্যটি ছিল। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ সময়ের আওয়ামী লীগ আমলেও।
‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ গেল, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আবার এল। এরপর হঠাৎ একদিন দেশের ধর্মপ্রাণ নাগরিকগণ অবাক বিস্ময়ে শুনলেন যে, তাদের সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ দিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং এ কাজটি করেছেন দেশের উচ্চ আদালত। যদিও আদালতের রায় প্রকাশ করতে গিয়ে মিডিয়াগুলো বলেছে, ৫ম সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। বরং ৫ম সংশোধনীর অনেক কিছুই আদালত বহাল রেখেছেন। বাছাই করে করে কিছু জিনিস বাতিল করেছে আর কিছু জিনিস আগের মতোই রেখে দিয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, বিচারপতি খায়রুল হক সাহেবের আদালত এ কাজটি করেছে স্বউদ্যোগী হয়ে। তার কাছে কেউ এ ব্যাপারে আবেদন বা মামলা করেনি। বরং একটি সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত্র মামলার রায় দিতে গিয়ে তিনি কাজটি করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনেছেন।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরপরই বর্তমান সরকার সে অনুযায়ী সংবিধান মুদ্রণ করে এবং এরপর ১৫তম সংশোধনী এনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনরায় স্থান করে দেয়। এভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠে দেশের একশ্রেণীর ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণী, ধর্মবিরোধী গণমাধ্যমগুলো। আর উপেক্ষিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা। ... আমাদেরকে ইতিহাস জানতে হবে, মনে রাখতে হবে এবং অনুধাবন করতে হবে। কে কোন কাজটি কোন মতলবে করছে তা বুঝতে হবে। আজকে আমার মূল আলোচ্য বিষয় সেটি নয়। আমি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সেকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দুচারটা কথা বলব।
ধর্মনিরপেক্ষতাটা বেশি দিন আগের পরিভাষা নয়। অনেক আগ থেকে তা শুরু হয়েছে এমন নয়। ফরাসী বিপ্লবের পরের ঘটনা এগুলো। বিপ্লবটা ১৭৮০/১৭৯০এর দিকের অর্থাৎ ১৮০০ এর কাছাকাছি সময়ের। ইসলামী খেলাফতের পতনের পরের ঘটনা।
সেক্যুলারিজম, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কঃ
এডিটর’স নোট: রশিদ ঘানুশী তিউনিসিয়ার আননাহদা পার্টির প্রেসিডেন্ট। Center for the Study of Islam and Democracy (CSID)-র আয়োজনে ২০১২ সালের ২ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়ামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণের উপর প্রাণবন্ত ও খোলামেলা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শীর্ষস্থানীয় স্কলার, অ্যাক্টিভিস্ট, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনীতিবিদসহ মরক্কো, আলজেরিয়া, মিশর ও আমেরিকান দূতাবাসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বক্তব্যটি আরবি থেকে ট্রান্সক্রিপ্ট করে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সিএসআইডির কর্মকর্তা ব্রাহিম রওয়াবাহ। সিম্পোজিয়ামের শুরুতে সিএসআইডির প্রেসিডেন্ট ড. রেদওয়ান মাসমোদী সংক্ষেপে অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট বর্ণনাপূর্বক ঘানুশীর পরিচয় তুলে ধরেন। ড. রেদওয়ানের ভূমিকাসহ ঘানুশীর বক্তব্যটি সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মাসউদুল আলম।
আমরা আপনাদেরকে সিএসআইডির সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করায় আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আশা করছি সংলাপ ও জাতীয় ঐক্যের পথ ধরে সফলভাবে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে। এই মুহূর্তে তিউনিসিয়া এক ঐতিহাসিক পরীক্ষার মুখোমুখি। এই পরীক্ষার ফলাফল শুধু আমাদের দেশেরই ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, আরববিশ্বের ভাগ্যও নির্ধারণ করবে। এ জন্যে সবার দৃষ্টি এখন তিউনিসিয়ার দিকে। আমি সম্প্রতি জর্ডান, মিশর ও আলজেরিয়া সফর করেছি। বিশ্বাস করুন, বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে তারা সবাই তিউনিসিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আরব বসন্তের মাধ্যমে তিউনিসিয়া ইতোমধ্যে মুক্তি ও মর্যাদা ফিরে পেয়েছে। প্রতিবেশী ও অন্যান্য আরবদেশগুলো তিউনিসিয়াকে অনুসরণ করছে। তারা আমাদের কাছে অনেক কিছুই আশা করছে। আত্মমর্যাদা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও আরব-ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক তিউনিসিয়ায় উত্তরণে সবাই প্রতীক্ষা করছে।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সাথে সেক্যুলারিজমের সম্পর্ক খুবই জটিল। একই সাথে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুও বটে। আমরা একটি নতুন গঠনতন্ত্র ও সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাচ্ছি। এটি হবে এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে বলে আমরা আশা করছি। ঠিক এমনই একটা সময়ে আমরা বিষয়টির সম্মুখীন হয়েছি।
আন-নাহদার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক রশিদ ঘানুশীকে আমন্ত্রণ জানাতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তারপরও স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বলছি – তিনি ‘দ্য মুভমেন্ট অব ইসলামিক টেনডেন্সি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এটিই পরবর্তীতে আন-নাহদা মুভমেন্ট এবং বিপ্লবের আগে আন-নাহদা পার্টি হিসেবে পরিচিত হয়। এখন পর্যন্ত ঘানুশীই এর প্রধান নেতা। তিনি এই আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদও বটে। আরব বিশ্বসহ পুরো বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনগুলোর মধ্যে শীর্ষ চিন্তাবিদ হিসেবেও তিনি পরিচিত। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও এগুলোর সাথে ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে তিনি ব্যাপক লেখালেখি করেছেন।
গণতন্ত্র ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কারণে ঘানুশীকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। তাঁকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া, তিনি এখন এই দেশেই আমাদের মাঝে অবস্থান করছেন সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে। অথচ যিনি তাঁকে দণ্ড দিয়েছিলেন, তিনিই এখন নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।
ঘানুশীর কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হলো – 1) Our Way to Civilization, 2) Us and the West, 3) The Right to Differ and the Duty of Unity, 4) The Palestinian Issue at a Cross Road, 5) Women Between the Quran and the Reality of Muslims, 6) From the Islamic Thought in Tunisia, 7) Public Freedoms in the Islamic State, 8) Predestination in Ibn Taymiyya’s Thought, 9) Contemplations on secularism and Civil Society, 10) The Islamist Movements and Points of Change, 11) From the Experience of the Islamist Movement in Tunisia, and 12) A Rebellion of Silence.
আশা করি, তাঁর ব্যাপারে এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতিই যথেষ্ট। অধ্যাপক রশিদ ঘানুশী, আপনাকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
রশিদ ঘানুশীর বক্তব্যঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল (সা.), তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবী ও উম্মতের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, ভাই ও বোনেরা– আসসালামু আলাইকুম।
তিউনিসিয়ার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ও বিদেশী অতিথিদের সামনে এই সন্ধ্যায় আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়ার জন্য আমি সিএসআইডিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আপনাদেরকে জ্ঞান দিতে এখানে আসিনি। আজকের নির্ধারিত বিষয়ে নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। তবুও একটি সাধারণ ঐক্যমত্যে পৌঁছার লক্ষ্যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা আরেকটু যাচাই করে নিতে পারি। এটি হয়তো আমাদের নেতৃবৃন্দকে সার্বজনীন ঐক্যমত্য, কিংবা অন্ততপক্ষে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো ঐক্যমত্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো ইসলামের সাথে সেক্যুলারিজমের সম্পর্ক। এক দৃষ্টিতে বিষয়টি বেশ জটিল। এই সম্পর্ক কি দ্বন্দ্ব ও অনৈক্যের? নাকি সম্প্রীতি ও সাযুজ্যতার? প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে আরো কিছু প্রশ্ন এসে যায়। যেমন: সরকারব্যবস্থার সাথে ইসলামের সম্পর্ক কী? ইসলাম ও আইনের মধ্যকার সম্পর্ক কী? এই প্রশ্নগুলো তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার।
সেক্যুলারিজম ও ইসলাম নিয়ে কথা বলার সময় মনে হতে পারে– তুলনামূলকভাবে সহজ ও স্পষ্ট কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছি। অথচ এ বিষয়গুলো নিয়ে লোকজনের মাঝে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে, রয়েছে নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। তারমানে হলো, সেক্যুলারিজমের শুধু একটি ধরনই রয়েছে, তা নয়; বরং এর নানা ধরন রয়েছে। ইসলামের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কে, কোন উদ্দেশ্যে, কী প্রস্তাব করছে– এর ভিত্তিতে ইসলাম ও সেক্যুলারিজমের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি:
সাদামাটাভাবে মনে করা হয়– সেক্যুলারিজম একটি দর্শন এবং আদর্শবাদী ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি মোকাবেলার ক্ষেত্রে একটি দার্শনিক চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা তা নয়। ইউরোপে সৃষ্ট নানা ধরনের সমস্যার একটি নিয়মতান্ত্রিক সমাধান হিসেবে পাশ্চাত্যে সেক্যুলারিজম হাজির হয়। ক্রমান্বয়ে এর বিবর্তন ও রূপায়ন ঘটে। নিছক দর্শন বা অধিবিদ্যাগত ব্যাপার হিসেবে এর উদ্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোর অধিকাংশ সৃষ্ট হয়েছে প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে। এর ফলে ক্যাথলিক চার্চের একাধিপত্য খর্ব হয়ে যায়। ১৬-১৭ শতকে ইউরোপের সংঘটিত ধর্মযুদ্ধগুলোও এই সমস্যার অন্যতম কারণ। এরই প্রেক্ষাপটে সেক্যুলারিজমের উদ্ভব ঘটে।
এখানে প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন হলো– যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেক্যুলারিজমের সূচনা হয়েছে, আমাদের এখানে কি সেসব পর্যায় এসেছে? এই সমগ্র প্রক্রিয়ার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলো রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ। যেমন: ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা এবং মানুষের বিবেচনাবোধের ওপর হস্তক্ষেপ করা হতে বিরত থাকা। এর ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা সামাজিক ব্যাপারে সীমাবদ্ধ হয়েছে এবং ধর্মের পরিধি ব্যক্তিগত ব্যাপারে সীমিত থেকেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকাঃ
যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক জীবনে ধর্মীয় হস্তক্ষেপ সুস্পষ্ট। রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণ সত্ত্বেও সেখানে ধর্মের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তৃতায় উল্লেখযোগ্য হারে ধর্মকে ব্যবহার করেন। তাদের সকল নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্ম একটি আলোচিত বিষয়। স্কুলে প্রার্থনা করা এবং গর্ভপাতের অধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে প্রত্যেক দলেরই নিজস্ব বক্তব্য থাকে।
সেখানকার এই বাস্তবতার পেছনে একটা ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ইভানজ্যালিক খ্রিষ্টানদের দ্বারা। তারা ইউরোপের ক্যাথলিক চার্চের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্যে স্বীয় ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে এসেছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ তথা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ হিসেবে বিবেচনা করেছিলো। তাদের মতে, এই স্বপ্নভূমির কথা তাওরাত ও গসপেলে বর্ণিত রয়েছে।
ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান চিন্তক টকুইভেল একবার মন্তব্য করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দল হচ্ছে চার্চ। সেখানে চার্চ যে রকম ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে, ইউরোপে তা দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে চার্চে প্রার্থনাকারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও ইউরোপে তা ৫ শতাংশেরও কম।
ইউরোপে ধর্মের ভূমিকাঃ
ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটেও ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। এখানে ফ্রেঞ্চ ও অ্যাংলো-স্যাক্সন নামে দুইটি ধারা বিদ্যমান। অ্যাংলো-স্যাক্সন ধারায় ব্রিটিশ রাণী পার্থিব ও ধর্মীয় উভয় ধরনের শক্তির প্রতীক। অন্যদিকে, ফ্রান্সে ধর্ম ও রাষ্ট্র সম্পূর্ণ পৃথক। চার্চ ও রাষ্ট্রের বিপ্লবীদের মধ্যে সংঘাতের যে ইতিহাস ফ্রান্সের রয়েছে, তার পরিণতি হিসেবে এই পৃথকীকরণ ঘটেছে। তাহলে ইউরোপেও আমরা সেক্যুলারিজমের একক ধরন দেখছি না। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই, এমনকি ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরাও সেক্যুলারিজমের শুধু ফরাসী ভার্সন দ্বারা প্রভাবিত। ফ্রেঞ্চ ব্যাখ্যা অনুসারে, জনপরিমণ্ডল থেকে ধর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকবে। রাষ্ট্রই হবে জাতীয় পরিচয়ের একমাত্র শর্ত। জনপরিমণ্ডল থেকে ধর্ম ও এর প্রতীকগুলোকে বাদ দেয়ার এই মূলনীতির কারণে শুধু ফ্রান্সে হেডস্কার্ফ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে এ ধরনের মূলনীতি না থাকায় সেসব দেশে হেডস্কার্ফ নিয়ে এ ধরনের কঠোর অবস্থান দেখা যায় না। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ফলে শুধু ফ্রান্সেই রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে এই বিশেষ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, আমরা সাধারণত সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনটির দিকে দৃষ্টি দেই না। সেটি হলো রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা সম্পর্কিত সেক্যুলার বোঝাপড়া। এর মানে, রাষ্ট্র হচ্ছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সব ধরনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। রাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষ হয়ে কোনো বিষয়ে নাক গলাবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিভিন্ন ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার মতো ব্যাপার কি ইসলামে আছে?
ইসলাম একটি সমন্বিত ব্যবস্থা:
ইসলাম হচ্ছে রাজনীতি, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত ব্যবস্থা। মহানবী (সা.) ধর্মের সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মদীনা থেকে মক্কায় আগত যে দলটি প্রথমে আনুগত্যের শপথ (আকাবার প্রথম শপথ) করেছিলো, তা ছিলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) প্রতি ঈমানের ধর্মীয় শপথ। কিন্তু দ্বিতীয়বারের শপথ (আকাবার দ্বিতীয় শপথ) ছিলো মদীনা আক্রান্ত হলে প্রয়োজনে তরবারী দিয়ে হলেও মুসলমানদেরকে রক্ষা করা সংক্রান্ত। ইসলামপূর্ব সময়ে মদীনা পরিচিত ছিলো ইয়াসরিব হিসেবে। মোহাম্মদ (সা.) সেখানে হিজরত করার পর নাম পাল্টে রাখা হয় মদীনা। এই পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মদীনা অর্থ শহর বা নগর। এই নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে– ইসলাম নিছক কোনো ধর্ম নয়, বরং এটি একটা সভ্যতা সংক্রান্ত ব্যাপার। ইসলাম মানুষকে যাযাবর জীবন থেকে নাগরিক জীবনে নিয়ে এসেছে। তাই নগরব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর যাযাবর জীবনে ফিরে যাওয়াকে নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাই ইসলাম যেখানেই গেছে সেখানেই নগরের পত্তন হয়েছে। উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো নগরীটি আমাদের দেশে অবস্থিত, যেটি আরবরা গড়ে তুলেছে। ইসলাম যে একটি সভ্যতা নির্মাণকারী ধর্ম, মহানবী (সা.) কর্তৃক নগর প্রতিষ্ঠাই এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। এ ধর্ম যুদ্ধরত গোত্রগুলোকে যাযাবর জীবন থেকে সভ্য হিসেবে উন্নীত করেছে এবং একটা রাষ্ট্রের অধীনে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে।
ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতির প্রসঙ্গ:
যেহেতু মহানবী (সা.) মসজিদে নামাজ পড়াতেন, তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন ইমাম। আবার একই সাথে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক নেতা। তিনি লোকজনের বিরোধ মীমাংসা করতেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন এবং বিভিন্ন সন্ধি ও চুক্তিতে স্বাক্ষর করতেন। মহানবী (সা.) মদীনায় এসে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি একটি সংবিধান উপস্থাপন করেন, যা ‘সহীফাহ’ নামে পরিচিত। আপনাদের কাছে এর উদাহরণ হলেন মোস্তফা।[1] এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সংবিধান। অনেকগুলো চুক্তির সমন্বয়ে প্রণীত এই সংবিধানটি ছিলো মক্কার মুহাজির ও তাদের আশ্রয়দাতা মদীনার আনসারদের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তি। পরবর্তীতে ইহুদী গোত্রগুলো এই সংবিধানের আওতায় আসে।
আনসার ও মুহাজিরদেরকে একটি জাতি হিসেবে বিচেনা করা হয়েছিলো এবং ইহুদীদেরকে এ জাতিসত্তায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। এ সংবিধানে দুই ধর্মীয় জাতিকে একটি একক রাজনৈতিক জাতিসত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে পরিচয় লাভ করে। এই সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্ম ও রাজনৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য, যা বর্তমানকালের ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ। মোহাম্মদ সালিম আল আওয়া এবং মোহাম্মদ ওমরের মতো খ্যাতনামা স্কলারগণ এই অভিমত দিয়েছেন।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো পৃথকভাবে এ সংবিধানে উল্লেখিত ছিলো। সেখানে বলা ছিলো, মুসলিমরা একটি ধর্মীয় জাতি (উম্মাহ) এবং ইহুদীরা আরেকটি ধর্মীয় জাতি। এই দুই পক্ষ ও পৌত্তলিকরা মিলে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি জাতি হিসেবে গঠিত হয়েছিলো। ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা সর্বদা স্পষ্ট না থাকলেও মহানবী (সা.) কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা থেকে এই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এরই আলোকে বলা যায়, ধর্ম হলো ইবাদত ও আনুগত্য সংক্রান্ত ব্যাপার, আর রাজনীতি হলো যুক্তি ও বিবেচনাবোধের ব্যাপার। মহানবীর (সা.) কোনো বক্তব্য সাহাবীদের কাছে বোধগম্য না হলে তাঁরা জিজ্ঞেস করতেন, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত ওহী, নাকি নিছক তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। ওহী হলে তাঁরা মেনে নিতেন। আর মহানবীর (সা.) ব্যক্তিগত মতামত হলে প্রয়োজনবোধে ভিন্নমত পোষণ করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহানবী (সা.) কর্তৃক বিভিন্ন সময় গৃহীত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাহাবীরা একাধিকবার দ্বিমত পোষণ করেছেন।[2]
একদিন মদীনায় কিছু লোক খেজুর গাছের পরাগায়ণের কাজ করছিলো। মহানবী (সা.) তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, “আমি এ কাজের কোনো সুফল দেখছি না।” লোকেরা এ কথাকে ওহী মনে করে পরাগায়ণের কাজ বন্ধ করে দিলো। ফলে সে বছর অন্যবারের তুলনায় ফলন কম হলো। তারপর তারা মহানবীকে (সা.) জিজ্ঞেস করলো, কেন তিনি এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি জবাব দিলেন, তোমাদের জাগতিক ব্যাপারের লাভজনক ব্যাপারগুলো তোমরাই ভালো জানো।
ধর্মের প্রকৃত ভূমিকা:
সুতরাং, কৃষি, শিল্প, সরকার পরিচালনার পদ্ধতির মতো বিষয় সম্পর্কে ব্যবহারিক নির্দেশনা প্রদান ধর্মের কাজ নয়। কারণ, অভিজ্ঞতার আলোকে সত্যে উপনীত হতে যুক্তিবোধই যথেষ্ট। ধর্মের ভূমিকা হলো মানুষের অস্তিত্ব, উৎপত্তি, গন্তব্য এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কিত গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া। ধর্মের আরেকটা কাজ হলো কিছু মূল্যবোধ ও মূলনীতি প্রদান করা। এগুলো আমাদের চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নে নির্দেশনা প্রদান করবে।
জনজীবন থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়া অর্থে রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণের ধারণা কখনোই ইসলামে ছিলো না। এ পর্যন্ত মুসলমানদের জীবনে ইসলামের প্রভাব সুস্পষ্ট। মুসলিম জনজীবন ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ। যদিও ধর্ম ও রাজনীতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তারা সচেতন। ইসলামী স্কলারদের চিন্তাধারায়ও এই পার্থক্য সুস্পষ্ট। তারা মুয়ামালাত (ইবাদত ব্যতীত অন্যান্য কাজ) এবং ইবাদতকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ইবাদত হচ্ছে অপরিবর্তনীয় ও প্রথাগতভাবে পালনের বিষয়। অর্থাৎ এখানে সত্যে পৌঁছার জন্যে যুক্তি যথেষ্ট নয়। আর সাধারণ কল্যাণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হলো মুয়ামালাত। ইমাম শাতিবী ও ইবনে আশুরের মতো মহান স্কলারগণ জোর দিয়ে বলেছেন, ইসলাম এসেছে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য। স্কলারগণ একমত হয়েছেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই সকল ঐশীগ্রন্থের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। ধর্মীয় নির্দেশনা, উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ ও মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালিত যুক্তিবোধের আলোকে এই ব্যাপারগুলো বাস্তবায়নযোগ্য। মুয়ামালাতের ব্যাপারগুলো প্রতিনিয়ত বিকশিত ও পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু আকীদা, মূল্যবোধ ও সদগুণ সবসময়ই অপরিবর্তনীয়।
ইসলামে বহুত্ববাদ ও চিন্তার স্বাধীনতার ধারণা:
ইসলামের ইতিহাসে সবসময়ই রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম কোনো না কোনোভাবে ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। কোনো বিশেষ স্থান-কালের লোকেরা ইসলামী মূল্যবোধকে যেভাবে বুঝেছে, তার আলোকে রাষ্ট্রের আইন প্রণীত হয়েছে। এতদসত্তেও, নিছক ঐশী আইন-কানুন দ্বারা পরিচালিত হতো বলেই কোনো রাষ্ট্র ইসলামী হিসেবে গণ্য ছিলো না। বরং, সেখানে মানবীয় বিচার-বিবেচনাও কার্যকর ছিলো, যার সমালোচনা করা যেতো। রাষ্ট্র একটা পর্যায় পর্যন্ত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতো। রাষ্ট্র যখন এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতো এবং একটা একক ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিতো – যেমনটা ঘটেছিলো আব্বাসীয় আমলে – তখনই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তো। বলে রাখা দরকার, একই ধর্মের নানা ধরনের ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ নিয়ে আব্বাসীয় খলীফা আল মনসুর উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁর আশংকা ছিলো, রাষ্ট্রের উপরও এই বিভাজন প্রভাব ফেলতে পারে। তাই তিনি ইমাম মালেককে (রহ.) ডেকে আনলেন এবং সবকিছুর সমন্বয় করে একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রণয়ন করার অনুরোধ করলেন। এর ফলে ইমাম মালেক (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মুয়াত্তা’ রচনা করেন। এতে খলীফা আল মনসুর খুবই খুশি হলেন। তিনি এটাকে সকল মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক আইনে পরিণত করতে চাইলেন। এতে ইমাম মালেক (রহ.) আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি এ রকম কিছু না করার জন্যে খলিফাকে অনুরোধ করেন। তাঁর বক্তব্য ছিলো– মহানবীর (সা.) সাহাবীরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং তাঁরা ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা লোকজনকে পরিস্থিতির আলোকে উপযুক্ত পন্থা বেছে নেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কারণেই আমরা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় একটা মাজহাব, পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অন্য মাজহাব, আবার মিশরে আরেকটা মাজহাবের প্রাধান্য দেখি।
ধর্মীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে খ্রিষ্টধর্মে চার্চই একমাত্র কর্তৃপক্ষ। ইসলামে এ ধরনের কর্তৃপক্ষ না থাকায় ব্যাখ্যাদান ও চিন্তার অর্থবহ স্বাধীনতা রয়েছে। এই স্বাধীনতার ফলে স্বভাবতই বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাখ্যা তৈরি হয়েছে। আইন প্রণয়ন ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নির্বাচন ও গণতন্ত্রই হচ্ছে এখন পর্যন্ত অনুসরণীয় মানবজাতির জন্যে সর্বাধিক কার্যকর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতির নেতৃত্ব গড়ে ওঠে এবং ব্যক্তিচিন্তার পরিবর্তে সামষ্টিক মতামত প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে, খ্রিষ্টধর্মের মতো ইসলামে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ‘চার্চ’ ও কোরআনের মুখপাত্র হিসেবে ‘পোপ’ না নেই। ফলে কোনো বিশেষ স্কলার, দল বা রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমগ্র জাতি পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ঐশী ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
আব্বাসীয় খলীফা আল মামুন কোরআনের একটিমাত্র ব্যাখ্যা এবং আকীদা সংক্রান্ত মুতাজিলা দর্শনকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বিদ্রোহ করেন এবং ধর্মের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এতে তিনি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে জনমত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং আল মামুন শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হন।
আমাদের চ্যালেঞ্জ:
পাশ্চাত্যের সমস্যাগুলো আবর্তিত হচ্ছিলো ধর্ম থেকে রাষ্ট্রের মুক্তিকে কেন্দ্র করে। এটি করতে গিয়ে তারা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছিলো। অন্যদিকে, আমাদের প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য বিষয় হলো– রাষ্ট্রের কবল থেকে ধর্মের মুক্তি এবং ধর্মের ওপর আধিপত্য করা থেকে রাষ্ট্রকে বিরত রাখা। এর পাশাপাশি ধর্মকে সামাজিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বজায় রাখা, সকল মুসলমানের জন্য কোরআন পড়া এবং তাদের বুঝজ্ঞান অনুযায়ী কোরআন বুঝার সুযোগ রাখা আমাদের বিবেচনার বিষয়। বহুত্ববাদে কোনো সমস্যা নেই, এটা মানুষের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি করে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মুসলমানদের প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। ইসলামে যে ‘শুরা’র (পরামর্শ) ধারণা রয়েছে, তার সঠিক মূল্যায়ন করার এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, আমাদের ঐতিহ্যে চার্চের মতো কোনো একক ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান নেই। সম্ভবত আমাদের শিয়া ভাইয়েরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাসী। কিন্তু সুন্নীদের মাঝে দ্বিমত ও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করার মতো স্কলারদের কাউন্সিল বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তাই আমাদের প্রচুর স্কলার ও বুদ্ধিজীবী দরকার, যারা মুক্ত পরিবেশে আমাদের ইস্যুগুলো নিয়ে বিতর্ক ও গবেষণা করবেন এবং নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইনসভাকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক:
আমাদের দেশে সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। উভয় পক্ষই একে অপরকে চরমপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করছে। একটা পক্ষ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইসলাম সম্পর্কে তাদের বুঝজ্ঞানকে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতি। আরেকটা পক্ষ রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা ও জাতীয় সংস্কৃতি থেকে ইসলামের প্রভাব উপড়ে ফেলতে আগ্রহী।
মুসলিম বিশ্বসহ পুরো বিশ্বে এখন একটা ধর্মীয় পুনর্জাগরণ চলছে। পোপ দ্বিতীয় জন পল যে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, সেই সূত্রে পূর্ব ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চের অধিকতর ভূমিকা দৃশ্যমান হচ্ছে। পুতিনের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের সাফল্যও লক্ষ্যনীয়। এমন এক সন্ধিক্ষণে সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে ধর্মের প্রভাবের বিরোধিতা করাটা অযৌক্তিক। তবে ইসলামকে চাপিয়ে দেয়ারও প্রয়োজন নেই। এটা অভিজাতদের ধর্ম নয়, এটা গণমানুষের ধর্ম। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নয়, বরং ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই ইসলামের এত অনুসারী এবং দীর্ঘসময় ধরে এটি টিকে আছে। রাষ্ট্র বরং প্রায়শ ধর্মের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি আগেও বলেছি, ইসলামপন্থী বা অন্যান্য ধারার সাথে যারা যুক্ত তাদের অনেকের মধ্যে রাষ্ট্রের বন্ধন থেকে মুক্ত করে ধর্মকে একটা সামাজিক ব্যাপার হিসেবে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন হলো– রাষ্ট্র কেন ইমামদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়? কেন মসজিদকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়?
রাষ্ট্রের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসঙ্কুল ব্যাপার। ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ বলতে কী বুঝানো হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করছে এটা গ্রহণযোগ্য নাকি বর্জনীয়। ওহীর প্রত্যক্ষ বিষয় এবং প্রায়োগিক রাজনৈতিক বিষয়ের মধ্যকার পার্থক্য প্রাথমিক যুগের মুসলিমরা যেভাবে বুঝতেন সেভাবে যদি বিবেচনা করা হয় – অর্থাৎ রাষ্ট্র হচ্ছে একটা মানবীয় ব্যাপার, আর ওহী হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত – তাহলে তা ঠিক আছে। আর যদি একে ফরাসী ধারণা কিংবা মার্ক্সীয় অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে তা ভয়ানক বিপদজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এই ব্যাখ্যা রাষ্ট্র ও ধর্ম উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের ফলে রাষ্ট্র মাফিয়াচক্রে পরিণত হবে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে পড়বে লুণ্ঠনবাদী, রাজনীতি হয়ে পড়বে প্রতারণা ও ভণ্ডামিপূর্ণ। কিছু ইতিবাচক দিক ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যে ঠিক এই ব্যাপারগুলোই ঘটেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি অল্প কয়েকজন অর্থনৈতিক দালালের খপ্পড়ে বন্দি। এরা প্রচুর অর্থের মালিক, অসংখ্য মিডিয়া তাদের হাতে। এসবের মাধ্যমে তারা রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করে।
এই বিবেচনায় মানুষের জন্যে ধর্ম খুবই প্রয়োজনীয়। ধর্মের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নির্দেশনার ফলে মানুষ ন্যায় ও অন্যায়ের (হালাল ও হারাম) মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে।[3] হালাল-হারাম নির্ধারণে একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী চার্চের ধারণা যেহেতু ইসলামে নেই, তাই এসব সমস্যা অগ্রগণ্য চিন্তাবিদগণ, জনগণ ও মিডিয়া আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে।
রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এবং সামাজিক সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অতএব, মানুষের মুক্তি ও অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম একটা ভারসাম্যপূর্ণ উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ধর্মই এই কাজটি করতে পারে। এই ভারসাম্য অর্জন করতে আমাদেরকে ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে। ধর্মের কোনটা অপরিবর্তনীয়, আর কোনটা পরিবর্তনীয়– সেই মানদণ্ড ঠিক করতে হবে। আমাদের আইনপ্রণেতাদেরকে ধর্মের মূল্যবোধ সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত ও প্রশিক্ষিত হতে হবে। এমন ব্যক্তিদের দ্বারা আইন প্রণয়নের সময় ধর্মীয় স্কলারদের মুখাপেক্ষী থাকার দরকার পড়ে না। একই কথা রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধর্মীয় ইবাদত পালনে বলপ্রয়োগের মধ্যে কোনো ফায়দা নেই। রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্য বান্দাদের মুনাফিকে পরিণত করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। মানুষকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের বাহ্যিক কিছু দিককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও তাদের অন্তরের অবস্থা ও দৃঢ় বিশ্বাসকে পরিবর্তন করা অসম্ভব।
হেডস্কার্ফ বা নেকাব হলো এক্ষেত্রে আমাদের সামনে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। এর দুইটা মডেল রয়েছে। প্রথমটিতে নেকাব পরিধানের রাষ্ট্রীয় হুকুম তামিল করতে বাধ্য করা হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে রাষ্ট্র নেকাবকে নিষিদ্ধ করেছে। একবার আমি একটি মুসলিম দেশের এয়ারপোর্টে সব নারীকেই বোরকা পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। কিন্তু বিমানটি আকাশে উড়ার সাথে সাথে সব বোরকাও যেন উড়ে গেলো! এটা যে ওই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা, তা স্পষ্ট। জনগণের ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা সাধনে দেশটি দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বেন আলীর শাসনামলে তিউনিসিয়ায় নারীদের নেকাব পরা নিষিদ্ধ ছিলো। নারীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরে জনসমক্ষে আসতে পারতো না। এখানেও রাষ্ট্র দমনপীড়ন চালিয়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্বাসের স্বাধীনতা:
ধর্মের মূল ক্ষেত্র রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি নয়, বরং ব্যক্তিগত বিশ্বাস। আর রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের সেবা তথা কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করা। মানুষের হৃদয়-মন নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। এ কারণে আমি জনগণের উপর সব ধরনের বলপ্রয়োগের বিরোধী। “ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই”– কোরআনের এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে আমি মানুষের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী চলা কিংবা ধর্মত্যাগ করার স্বাধীনতার পক্ষে।
কাউকে জোর করে মুসলিম বানানোর কোনো মানে নেই। প্রকাশ্যে বিশ্বাসী, আর অন্তরে অবিশ্বাসী– মুসলিম জাতির এ ধরনের মুনাফিকের দরকার নেই। স্বাধীনতা এমন এক মৌলিক বিষয়, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ইসলামের ওপর অবিচল থাকতে পারে। অতএব, যিনি কালিমায়ে শাহাদাতের ঘোষণা দেন, স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতেই তিনি সেটি করেন। যার মূলে রয়েছে সচেতনতা এবং দৃঢ় বিশ্বাস।
মক্কার লোকেরা যখন মোহাম্মদকে (সা.) তাঁর ধর্মের ব্যাপারে আপত্তি জানালো, তখন তিনি তাঁর দাওয়াতী তৎপরতায় হস্তক্ষেপ না করতে তাদেরকে অনুরোধ করেন। তিনি লোকদের কাছে তাঁর বাণী প্রচারের স্বাধীনতা চাইলেন। মক্কার লোকেরা যদি তাঁকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতো, তাহলে তিনি মাতৃভূমি ছেড়ে হিজরত করতেন না। তাঁর বাণী এতই শক্তিশালী ছিলো যে, তারা একে দমিয়ে রাখার জন্য বিকল্প কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। একমাত্র সত্য হওয়ার কারণে ইসলাম এতই শক্তিশালী যে, এর প্রতি আকৃষ্ট করতে মানুষের ওপর পেশিশক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। যাবতীয় রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ইসলাম ঘোষণা করে– “যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে প্রমাণ হাজির করো”।
আমাদের দেশে চলমান বিতর্কের অধিকাংশই সেক্যুলারিজম ও ইসলাম নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির কারণে হচ্ছে। আমরা বাস্তবে দেখিয়েছি– সেক্যুলারিজম কোনো নাস্তিক্যবাদী দর্শন নয়। বরং বিশ্বাস ও চিন্তার স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখতে এটা একটা প্রক্রিয়াগত ব্যবস্থা। আব্দুল ওয়াহহাব আল মাসিরি তাঁর গবেষণায় কট্টর সেক্যুলারিজম ও উদার সেক্যুলারিজমের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। কট্টর সেক্যুলারিজমের উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের ইতিহাস থেকে জ্যাকবীয় মডেলের কথা বলা যায়। যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে যখন যুদ্ধ চলছিলো, তখন জ্যাকবীয়দের প্রধান শ্লোগান ছিলো– “শেষ রাজাকে ফাঁসি দাও শেষ পাদ্রিটার দড়িতে” (strangle the last king with the entrails of the last priest)। এটা হচ্ছে ফ্রান্সের বাস্তবতা, যেটি সেক্যুলারিজমের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা নয়। ইসলাম নিয়েও এ ধরনের কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এ কারণে অনেকে মনে করে– ইসলাম শুধু মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে বিজয়ী হতে চায় এবং জোরপূর্বক নামাজ, রোজা ও নেকাবের মতো বিষয় চাপিয়ে দিতে চায়। অথচ ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে এগুলো অনেক দূরের ব্যাপার। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা কপটতাকে সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। কপট লোকদের জন্যে চিরস্থায়ী দোজখের আগুন রয়েছে বলে সাবধান করা হয়েছে।
আমরা ইতোমধ্যে বিপ্লবের মাধ্যমে একটা স্বৈরাচারকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছি। এই বিপ্লব আমাদেরকে নাগরিক মূল্যবোধ মেনে চলার কথা বলে। এই দেশ নির্দিষ্ট কোনো দলের হবে না। বরং এই দেশ হবে ধর্ম, লিঙ্গ বা অন্য যে কোনো বিবেচনার ঊর্ধ্বে সকল নাগরিকের। নাগরিকদের সমঅধিকার, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে যে কোনো কিছু করার স্বাধীনতা এবং নাগরিক প্রতিনিধিদের দ্বারা সংসদে প্রণীত আইন মেনে চলার অধিকার ইসলাম আমাদেরকে দিয়েছে।
সেক্যুলারিজমের পক্ষে আমাদের মুসলিম অঞ্চলগুলোতে প্রায়শ যে দাবিটি উচ্চারিত হয় তা হচ্ছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়’। ধার্মিক মানুষের কাছে সেক্যুলারিজমের আসল চেহারাটা গোপন রাখার এটা একটা চেষ্টা মাত্র। সেক্যুলারিজম যদি ধর্মহীনতাই না হবে তাহলে ধর্মেই তার এলার্জি কেন এবং ধর্মের বিরুদ্ধে এত অসত্য ও একপেশে তথ্য ও বিশ্লেষণই বা উপস্থাপন করা কেন?
সেক্যুলার লেখকেরা যে সকল উপায়ে ধর্ম তথা ইসলামকে আক্রমণ করে থাকেন তার একটি হচ্ছে পরিচয়ের উৎস হিসেবে ধর্ম বা ইসলাম একটি সমস্যা। অথচ যে মানুষটি মুসলিম তার পরিচয়ের উৎস তো ইসলামই। ইসলামকে পরিচয়ের উৎস হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধা কেন? পরিচয়ের তো আরো কিছু সূত্র আছে যেমন, ভূখ-, গোত্র-বংশ, রাজনীতি ইত্যাদি, এসবের ভিত্তিতেও পরিচিত হবার ব্যাপক রেওয়াজ আছে। এ সকল পরিচয়ে যদি কোনো সামাজিক সমস্যা না থাকে ধর্মীয় পরিচয়ে থাকবে কেন?
বাংলাদেশে বসবাসকারী একজন মুসলিম বাংলাদেশীও বটে। এটাও তার পরিচয়ের অংশ। এই পরিচয়ের সাথে তার মুসলিম পরিচয়ের কোনো সংঘর্ষ নেই। তিনি বাংলাদেশ নামক ভূখ--র একজন সম্মানিত নাগরিক, একই সাথে মুসলিম উম্মাহরও একজন গর্বিত সদস্য। ‘বাংলাদেশী’ তার বিশেষ ভূখ-গত পরিচয় আর ‘মুসলিম’ তার আদর্শগত ও বিস্তৃত মুসলিম জাহানের সদস্যগত পরিচয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিও মুসলিম জাহানেরই অংশ। এই বাস্তবতা মেনে নিতে সেক্যুলার বন্ধুদের এত কষ্ট কেন? এতে কি প্রমাণ হয় না যে, মুখে যা কিছুই বলা হোক ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে চরম ধর্মহীনতা; বরং ইসলাম বিরোধিতা।
ধর্মীয় পরিচয় শুধু মৌখিক উচ্চারণের ব্যাপার নয়। এটি ব্যক্তি ও জাতির স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। এই স্বকীয়তা চেতনা ও বিশ্বাসগত এবং সংস্কৃতি ও জীবনাচারগত। কেউ যখন বলেন, আমি মুসলিম তখন তিনি তার চেতনা-বিশ্বাস, আয়-ব্যয়, সামাজিকতা, খাবার-দাবার এবং সংস্কৃতি ও জীবনাচার ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই একটি স্বতন্ত্র সত্তার উপস্থিতি ঘোষণা করেন, যে সত্তার সাথে জড়িত তার আবেগ-অনুভূতি, ঐতিহ্য ও আত্মমর্যাদা। তাই এই পরিচয় বিসর্জন দেওয়া যে আদর্শ, স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদা বিসর্জনেরই প্রথম ধাপ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই ধার্মিক মুসলমানের আত্মপরিচয় নিয়ে নাড়াচাড়া করার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্তত মুসলমানের সংশয় থাকা উচিত নয়।
সেক্যুলার বন্ধুরা যে ইসলামকে ‘অনুদার’, ‘বৈচিত্র গ্রহণে অবম’ প্রভৃতি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন সেই ধর্মও তো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় পরিচয় ও ধর্মীয় জাতিসত্তা বিলুপ্ত করবার চেষ্টা করেনি।
ইসলাম অন্যকে কল্যাণকামিতা থেকে ইসলাম কবুলের দাওয়াত দিয়েছে কিন্তু কখনো ইসলাম কবুলে বাধ্য করেনি। আর না ইসলামের অনুসারী কোনো মুসলিমের তা করার অবকাশ আছে। এর পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর উদ্ধৃতি, মদীনা-সনদের স্পষ্ট ধারা ও ভাষ্য, বাস্তব ইতিহাসের অসংখ্য নজির তুলে আনা যায়। পৃথিবীর যে সকল ভূখ-- শত শত বছর পর্যন্ত ইসলাম রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল ঐ সব ভূখ- ও সমাজও এই বাস্তবতার উজ্জ্বল প্রমাণ যে, অন্য ধর্মের অনুসারীরাও মুসলিমসমাজে যথাযোগ্য স্থানে অধিষ্ঠিত ছিল। আর এখনও পর্যন্ত ঐসব অঞ্চলে তাদের বিপুল উপস্থিতি একথাই প্রমাণ করছে যে, একমাত্র ইসলামেই আছে অন্যদের সাথে ন্যায়ভিত্তিক সহাবস্থানের যোগ্যতা ও প্রশস্ততা।
ভারতবর্ষে মুসলমানদের রাজ্য-শাসনের সময়কাল প্রায় হাজার বছর। এরপরও আজ ভারতের অধিবাসীদের ৮০ শতাংশেরও বেশি হিন্দু। আরব জাহানে ইসলামের শাসন-কাল ১৪০০ বছরেরও বেশি। এ সত্ত্বেও আরব খ্রিস্টানের সংখ্যা এখনো প্রায় ১৪ মিলিয়ন। অর্থাৎ এক কোটি চল্লিশ লাখ। এর বিপরীতে স্পেনের কথা চিন্তা করুন, প্রায় ৮০০ বছর মুসলিম শাসনের পর ক্রুসেডাররা যখন ঐ ভূখ-- প্রবেশ করেছে তখন এমনভাবে মুসলিম নিধন করেছে যে, সেখানে তাদের নাম নিশানাও অবশিষ্ট থাকেনি। প্রতিবেশী দেশে মুসলিম নিধনের ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটেছে; আসাম, গুজরাট... প্রভৃতি অঞ্চলের ভয়াবহ মুসলিম নিধন যে কোনো বিবেকবান মানুষকে শিহরিত করে। সম্প্রতি মিয়ানমারে মাসের পর মাস রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে। আর তা চলছে সেক্যুলার বিশ্বের নাকের ডগায়। এসবের বিরুদ্ধে সেক্যুলার-সমাজের কোনো মাথা ব্যথা তো নেইই, বরং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা সংঘটিত এই অমানবিক হত্যা ও রক্তপাতের দায় ইসলাম ও মুসলমানদের উপরও আরোপ করার চেষ্টা করা হয় আর তা করা হয় এক অদ্ভূত সরলীকরণের মাধ্যমে। অর্থাৎ এইসব হত্যা ও বর্বতার কারণ হচ্ছে ধর্ম বা ধর্মান্ধতা। আর ইসলামও একটি ধর্ম কাজেই ইসলামকেও এর দায় নিতে হবে, ইসলামের আদর্শ ও ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা হলেও এবং উপরোক্ত সহিংসতার ভিকটিমও মুসলিমেরা হলেও! এই সরলীকরণের প্রতারণাটুকু মুসলিমদের উপলব্ধি করা উচিত। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সেক্যুলার জগৎ একদিকে তাদের অতীত ও বর্তমানকে ঢাকার প্রয়াস পেয়ে থাকে অন্যদিকে ভিকটিমকেই অভিযুক্ত করার চেষ্টা করে থাকে।
মুসলিম জাহানে সেক্যুলারিজমের প্রচার ও বিস্তারের ক্ষেত্রেও এই ধরনের প্রতারণামূলক সরলীকরণের আশ্রয় নেয়া হয়, যার সারকথা হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়া সেক্যুলারিজমের মাধ্যমে ধর্মের নিগড় থেকে মুক্তি পেয়েছে কাজেই মুসলিম জাহানেরও ধর্ম থেকে মুক্তি অন্বেষণ করা উচিত। অথচ খ্রিস্টবাদ ও ইসলামের মাঝে নীতি-আদর্শ, ইতিহাস ও বাস্তবতার দিক থেকে রয়েছে বিরাট পার্থক্য, যে কারণে পশ্চিমা বিশ্বে সেক্যুলারিজমের কিছু ইতিবাচকতা থাকলেও এবং সেটা তাদের সমস্যার একপ্রকারের সমাধান হলেও মুসলিমসমাজে সেই সেক্যুলারিজমই হবে এক মূর্তিমান সমস্যা। তদ্রম্নপ আদর্শগত শূন্যতার কারণে সেক্যুলারিজম ঐ সমাজ-ব্যবস্থায় খাপ খেয়ে গেলেও মুসলিম সমাজে তা কখনোই খাপ খাবে না। আর তা খাপ খাবে না এই সমাজের আদর্শগত বাস্তবতার কারণেই। ফলে তা এখানে কখনোই টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের মুখ দেখবে না। এ শুধু বিভেদ-বিশৃঙ্খলা এবং রক্তপাত-হানাহানিরই বিস্তার ঘটাবে।
গীর্জা ও মসজিদের ইতিহাস কখনো এক ছিল না। এ কারণে ‘গীর্জা’র ক্ষেত্রে যা কিছু যথার্থ তা ‘মসজিদে’র ক্ষেত্রেও যথার্থ হবে এমনটা ভাবা ভুল। মধ্যযুগে গীর্জার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব শুধু ভিন্ন ধর্মীই নয়, স্বধর্মী ভিন্ন মত পোষণকারীদের উপর এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকারীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের যে স্টিম রোলার চালিয়েছে এর কারণে ‘রাষ্ট্র’কে গীর্জা থেকে আলাদা করার প্রয়োজন ছিল। এটা খ্রিস্টসমাজের নিজস্ব সমস্যা। ইসলামে মসজিদের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা। ভিন্নমতালম্বীই শুধু নয়, ভিন্নধর্মাবলম্বীর প্রতিও ইসলামের উদারনৈতিক অবস্থান এবং মুসলিম শাসক ও মনীষীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা এক প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। সত্যকে গোপন করা ছাড়া এ ইতিহাস অস্বীকার করার উপায় নেই।
দ্বিতীয়ত, খোদ খ্রিস্টধর্মের কাঠামোর মধ্যেই ঐ শূন্যতা আছে, যার কারণে রাষ্ট্র থেকে গীর্জাকে আলাদা করা অসুবিধাজনক নয়। প্রচলিত বাইবেলে ‘মাসীহ আ.-এর বাণী- ‘কাইজারের অংশ কাইজারকে দাও আর আল্লাহর অংশ আল্লাহকে’ জানাচ্ছে যে, খ্রিস্টধর্মে জীবনকে আল্লাহ ও কাইজারের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিতে কোনো অসুবিধা নেই।’১ তাছাড়া খ্রিস্টধর্মে নেই পূর্ণাঙ্গ কোনো জীবন-ব্যবস্থাও । যা আছে তা হচ্ছে সপ্তাহে একদিন গীর্জায় হাজিরি দেওয়া ও সামান্য কিছু ধর্মীয় আচার। কাজেই সেক্যুলারিজম ও খ্রিস্টধর্মের মাঝে বড় কোনো সংঘাত হয়নি। সেক্যুলারিজমও খ্রিস্টধর্মকে ঐটুকু ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছে, খ্রিস্টধর্মের অনুসারীরাও তাদের জীবনব্যবস্থার শূন্যতা সেক্যুলারিজম দ্বারা পূরণ করে নিয়েছে।
কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। একজন মুসলিম জীবনকে দুই রবের মাঝে ভাগ করতে পারে না। মুসলিম জীবনের সকল ক্ষেত্রেই মুসলিম ও আল্লাহর বান্দা। সপ্তাহের একদিন কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন নয়, ইবাদত বন্দেগী থেকে শুরু করে লেনদেন, বিয়ে-শাদী, সামাজিকতা, পর্ব-উৎসব, আইন-বিচার, রাজ্যচালনা সব ক্ষেত্রেই মুসলিমকে হালাল-হারামের বিধান মেনে চলতে হয়।
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কেও ইসলামী বিশ্বাস ও খ্রিস্ট বিশ্বাসে আছে বিরাট পার্থক্য; যা এখানে আলোচনা না করলেও চলে। এ কারণে খ্রিস্ট-সমাজে সেক্যুলারিজমের যে অর্থ মুসলিমসমাজে তা নয়। মুসলিম-সমাজে সেক্যুলারিজমের অর্থ ইসলামকে ত্যাগ করা অথচ পশ্চিমা সমাজে তা নয়। সেক্যুলার রাষ্ট্রে্যর সমান্তরালে পোপ ও ভ্যাটিকানের রয়েছে আলাদা শাসন ও সাম্রাজ্য। রয়েছে আলাদা ধর্ম-সেবক ও ধর্ম-প্রচারক। এটা কারো কাছে বৈচিত্র বলে ভ্রম হতে পারে, আসলে তা বৈচিত্র নয়, শূন্যতা। যাই হোক এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে কোনো মুসলিম সমাজে সেক্যুলারিজম কখনো টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেনি, পারবেও না। আধুনিক তুরস্ক এর এক দৃষ্টান্ত।
থাকল সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গ। সেক্যুলার গোষ্ঠী এই প্রসঙ্গটা যত কম তুলবেন ততই তাদের জন্য মঙ্গল। কারণ আজ পর্যন্ত সেক্যুলার সন্ত্রাসীরা পৃথিবীতে যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং মানবতাকে পদদলিত করতে যে মূঢ়তা, শঠতা ও হিংস্রতার পরিচয় দিয়েছে তা ইতিহাসের এক কৃষ্ণ অধ্যায় হয়েই থাকবে। এই বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহ সব যুদ্ধ ও হত্যাকা--র অন্যসব ক্ষয়-ক্ষতি বাদ দিয়ে শুধু নিহতের সংখ্যা গণনা করলেও শিহরিত হয়ে যেতে হয়! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ছয় কোটি। আর আমেরিকার গণতান্ত্রিক বিল্পবের ৫০ বছরে হত্যা করা হয়েছে কয়েক লক্ষ রেড ইন্ডিয়ানকে। অর্থাৎ ‘মহান’ আমেরিকা আজ দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের উপর। ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন বিপস্নবে, যার সবগুলোই ছিল সেক্যুলার বিপস্নব, নিহত হয়েছে ৮ কোটিরও বেশি মানুষ ।
আসলে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোতে সেক্যুলারিজমের একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাপারেই উদ্বেগের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। এটা অনেকটা সেই মস্তিষ্ক-রোগে আক্রান্ত মানুষটির মতো ব্যাপার, যে তার চারপাশের সবাইকে ‘অসুস্থ’ আখ্যা দিতে থাকে। তো যে অসুস্থ তাকে না হয় অসুস্থই ধরে নেয়া হল, কিন্তু যে সুস্থ-সচেতন লোকটা ঐ অসুস্থের কথায় বিশ্বাস করে নিজেকে ও অন্য সবাইকে অসুস্থ ঠাওরাতে থাকে তার দাওয়াই কী?
(এটি একটি সংকলন)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ