" অত্যাচারিকে কোন ভাবেই সহায়তা জায়েজ নাই, এটা সম্পূর্ণ নিষেধ"
ইসলামের একটি গুরুত্ব পূর্ন নীতি হলো কোন অন্যায় দেখলে সরাসরি প্রতিবাদ করা, না পারলে মৌখিক প্রতিবাদ করা আর এটা সম্ভব না হলেও অন্তত মন হতে হলেও অন্যায়কে ঘৃনা করা। আর এটা না করতে পারলে আপনাকে বুঝতে হবে আপনার ইমানে ঝামেলা আছে।
ঈমানে ঝামেলা থাক আর নাই থাক, কিন্তু কোন অন্যায়কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগীতার ইসলামে কোন স্থান নাই।
আসুন অন্যায়ের সহযোগী হলে ইসলামের বিধান কি জেনে নেই। হাদীসে বর্নিত হয়েছে:
(١٢٦) وَعَنْ أَوْسِ بْنِ شُرَحْبِيلَ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ يَقُولُ مَنْ مَشَى مَعَ ظَالِمِ لِيُقَوِيَّهُ وَهُوَ يَعْلَمُ إِنَّهُ ظَالِمٌ فَقَدْ خَرَجَ مِنَ الْإِسْلَامِ - (بيهقى)
"হযরত আওস ইবনে সুরাহবীল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (সা:)-কে বলতে শুনেছেন, "যে ব্যক্তি যালিমকে যালিম বলে জানা সত্ত্বেও তাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হবে, সে ইসলাম হতে বের হয়ে যাবে।" (বায়হাকী-১২৬)
অর্থাদ যালিমকে বাধা দান এবং মজলুমকে সাহায্য করা হলো মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব। উক্ত দায়িত্ব পালন না করে বরং যে এর বিপরীত করে, অর্থাৎ মযলুমের কোন সাহায্য না করে যালেমেরই সাহায্য করে, সে ইসলামের নিয়ামত হতে বঞ্চিত হবে।
জালিমকে এ সহযোগীতা হতে পারে সরাসরি, তার পক্ষে যুদ্ধ করে, জালিমের সহায়ক হয়ে, টাকার লোভে জালিমের পক্ষাবলম্বন করে, তার পক্ষে কথা বলে, তাগুতের পক্ষে কলম ধরে, তাগুতী শক্তিকে ভোট দানের মাধ্যমে ক্ষতায় আরোহনের সহায়ক হিসাবে। যে ভাবেই হোক বাতিলের পক্ষ নেওয়া এমন কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাতিলের সহায়তা করা। সব ভাবেই বতিলের সহযোগি হওয়া জারাম।
এবার দেখা যাক এ বিষয়ে আল্লাহ কি বলেন:
اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ١ۚ وَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ الطَّاغُوْتِ فَقَاتِلُوْۤا اَوْلِیَآءَ الشَّیْطٰنِ١ۚ اِنَّ كَیْدَ الشَّیْطٰنِ كَانَ ضَعِیْفًا۠
যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল।(সূরা নিসা,আয়াত-৭৬)
এই আয়াতের প্রথম অংশে বুঝানু হয়েছে যে এটি আল্লাহর একটি দ্ব্যর্থহীন ফায়সালা। আল্লাহর পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করা হচ্ছে ঈমানদারদের কাজ। যথার্থ ও সত্যিকার মু’মিন এই কাজ থেকে কখনো বিরত থাকবে না। আর আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহ বিরোধী ও আল্লাহদ্রোহীদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাগুতের পথে লড়াই করা হচ্ছে কাফেরদের কাজ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে না।
দ্বিতীয় অর্ধে বুঝনো হয়েছে অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে শয়তান ও তার সাথীরা বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে এবং জবরদস্ত কৌশল অবলম্বন করে কিন্তু তাদের প্রস্তুতি ও কৌশল দেখে ঈমানদারদের ভীত হওয়া উচিত নয়, অবশ্যি তাদের সকল প্রস্তুতি ও কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
বিশদ ভাবে বলতে গেলে সব মোমেনরা আল্লাহর পথে আর কাফেররা তাগুতের পথে পরস্পর পরস্পরের সহযোগী হয়। এরপর উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি, চলার পথ আলোকিত করা ও প্রত্যেক পক্ষের অনুসৃত মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্য লক্ষ্য চিহ্নিত করার জন্যে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক পরশ বুলানো হয়েছে পরবর্তী ৭৬ নং আয়াতে । 'যারা মোমেন, তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর কাফেররা তাগুতের পথে যুদ্ধ ও কৌশল করে। অতএব তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও । নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল ।' এখানে দুটো দল, দুটো পথ, দুটো উদ্দেশ্য ও দুটো পতাকা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হছে, “যারা মোমেন তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে ।” যারা কাফের তারা তাগুতের পথে লড়াই করে ।' যারা মোমেন তারা আল্লাহর পথে লড়াই ও সহযোগীতা করে। তারা আল্লাহর বিধান ও তার আইনকে বাস্তবায়িত করার জন্যে এবং মানব জাতির মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করে, আর এটা শুধু আল্লাহর নামেই হতে হবে, অন্য কোনো নামে নয়। এ দ্বারা স্বীকৃতি দেয়া হবে যে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র ইলাহ এবং সার্বভৌম শাসক। আর যারা কাফের তারা তাগুতের পথে লড়াই করে। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান ছাড়া অনান্য বিধান বাস্তবায়নের জন্যে লড়াই করে, যে সব বিধান আল্লাহ কখনো অনুমোদন করেননি । মোমেনরা আল্লাহর তদারকী, তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বের ওপর নির্ভর করে । আর কাফেররা শয়তানের অভিভাবকত্বের ওপর নির্ভর করে তাদের রকমারি জীবন ব্যবস্থা, আইন বিধান ও নিয়মরীতির মাধ্যমে । তারা সবাই শয়তানের বন্ধু ও মিত্র। আর আল্লাহ তায়ালা মোমেনদেরকে নির্দেশ দেন যেন শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং শয়তানের চক্রান্তের যেন ভয় না করে; এরশাদ হচ্ছে, 'সুতরাং শয়তানের চেলাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। জেনে রেখো শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল ।' এভাবে মুসলমানরা এক দৃঢ় ভিত্তির ওপর অবস্থান করে। তাদের বিবেক এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে যে, তারা আল্লাহর পথেই লড়াই করছে। এ লড়াইতে তাদের নিজেদের বা তাদের জাতির বা তাদের আত্মীয়-স্বজনের কোনো স্বার্থ নেই। এ লড়াই শুধু আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর আইন ও বিধানের জন্যে ।
এ লড়াইতে তারা একটা বাতিলপন্থী মানব গোষ্ঠীর মোকাবেলা করছে, যারা সত্যের ওপর বাতিলকে বিজয়ী করতে চায়, যারা মানব রচিত জাহেলী মতবাদ ও মতাদর্শকে আল্লাহর মত ও মতাদর্শের ওপর বিজয়ী করতে চায়, মানব রচিত আইনকে আল্লাহর আইনের ওপর বিজয়ী কর্তৃত্বশীল করতে চায়। মানুষের যুলুম ও অবিচারকে আল্লাহর ন্যায় বিচারের ওপর বিজয়ী করতে চায় অথচ মুসলমানদেরকে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যেহেতু মানবরচিত সকল জীবন ব্যবস্থা ও সকল আইন বিধান সম্পূর্ণ জাহেলিয়াত, তাই এ জাহেলিয়াতকে পরাজিত ও উৎখাত করার জন্যে মুসলমানদেরকে লড়াই করতে বলা হয়েছে। তাই জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে এ লড়াই পরিচালনায় তারা তাদের বিবেকের কাছে পরিষ্কার ৷ মুসলমানরা এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়ে লড়াই করে যে, এ লড়াইতে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক আল্লাহ তায়ালা । আর তারা যে জাতির বিরুদ্ধে লড়বে, তাদের অভিভাবক শয়তান, তাই তারা দুর্বল । কেননা শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল । এখান থেকেই মোমেনের চেতনায় লড়াইয়ের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। লড়াই শুরু করার আগেই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, তা তাদের জানা হয়ে যায়। এরপর সে লড়াইতে শহীদ হোক বা বেঁচে থাক, তাতে কিছু এসে যায় না। শহীদ হলে তো ফলাফল সম্পর্কে সে নিশ্চিতই হয়ে গেলো। আর যদি বেঁচে থাকে এবং স্বচক্ষে বিজয় দেখতে পায়, তা হলেও সে মহান পুরস্কার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে । আল্লাহ্র পথে জেহাদের এই উভয় দিক সম্পর্কে এই নির্ভুল ধারণা লাভের কারণেই সেই সব অলৌকিক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিলো, যা প্রথম মুসলিম সংগঠনের জেহাদের ইতিহাসে সংরক্ষিত রয়েছে। সে সব ঘটনা সমগ্র ইতিহাসের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে রয়েছে। এখানে সেগুলোর উদাহরণ দেয়া সম্ভব নয়। সে সব ঘটনা সংখ্যায় প্রচুর । উল্লেখিত নির্ভুল ধারণার কারণেই অতো অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামের এমন বিপুল জোয়ার সৃষ্টি হতে পেরেছিলো ৷ আল্লাহর বিধান মুসলিম জাতির জীবনে কি অকল্পনীয় উন্নতি এনে দিয়েছিলো: এবং ইসলাম বিরোধী শিবিরগুলোর ওপর তাকে কতো শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলো, সে কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। কোরআন মোমেনদের সত্ত্বার অভ্যন্তরে যে সর্বাত্মক লড়াই পরিচালনা করেছিলো এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ধনে জনে ও সাজ সরঞ্জামে অধিকতর শক্তিধর তাদের দুশমনদের সাথে যে লড়াই চালিয়েছিলো, উল্লেখিত ধারণাটা সৃষ্টি করাও ছিলো সেই লড়াইয়ের একটা অংশ ৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে থাকে, তাই শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়। আল্লাহর বিধান উক্ত ধারণাকে গড়ে তোলার ও বদ্ধমূল করার ব্যাপারে কিরূপ চেষ্টা-সাধনা করেছে, সেটা যখন আমরা দেখি তখন মনে হয় যে, কাজটা সহজ ছিলো না এবং শুধু মুখের কথায় তা করা যায়নি । ক্রমাগত চেষ্টা সাধনা দ্বারা প্রবৃত্তির সংকীর্ণতা, যে কোনো মূল্যে তার দীর্ঘ জীবন কামনা এবং লাভ ও ক্ষতি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। বাদবাকী আয়াতগুলোতে এই চিকিৎসা ও এই চেষ্টা সাধনার উল্লেখ রয়েছে।
লেখক:চিকিৎসক, জার্নালিস্ট ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী।