যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
৪০ বছর পর এক দুরূহ দায়িত্ব সম্পন্ন হলো বাংলাদেশে। ১৯৬০ সালে বাইরের যুদ্ধাপরাধীদের আইনের অধীনে প্রথম বিচার সম্পন্ন হলো ২০১৩ সালে। এই আইন এবং বিচার দুটোই বিচার রাশিয়া, গোল্যান্ড ও ইসরায়েলে জাতীয়ভাবে হলেও, স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সংঘটিত ধরণের পেরাধের বিচার নেই এ জন্য প্রথম বলা হয়।
সংশোধনীগুলোর অধীনে বাংলাদেশ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করেছে স্বাবলম্বীভাবে। ৪০ বছর পরে সম্পূর্ণ নিজের সামর্থে। কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য না নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করার ঘটনাও অত্যন্ত বিরল। এ বিচার প্রয়োজনীয়, প্রত্যাশিত এবং বহুল প্রতীক্ষিত। এই বিচার বানচাল করা এবং ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করার যে দাবি জামায়াত ও শিবির বর্তমানে করছে, তা চরম নিন্দনীয় ও পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। এসব দাবিতে আক্রমণ, ভাঙচুর, নাশকতা ও হরতাল খুবই উদ্বেগজনক জাতির জন্য। হরতাল চলাকালে পুলিশের ওপর নির্বিচারে হামলা এবং ছাত্রশিবিরের কর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনাও নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত প্রদান করছে।
জামায়াতের ডাকা সর্বশেষ হরতালের প্রধান দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক করা তাদের নেতাদের মুক্তি ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল করা। এই দাবিতে আয়ুত হরতালকে আবল সমর্থন জানিয়ে বিএনপি চরম দায়িত্বহীন কাজ করেছে। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা বিশ্বসমাজে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটি আমরা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করেছি, তার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে হলেও এই অপরাধের বিচার আমাদের করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া, এর ধরন, একে রাজনৈতিক সুবিধালাকের জন্য ব্যবহারের চেষ্টার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু তাই বলে এই বিচারের যৌক্তিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। আবার এই বিচারকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করণে এসব সমালোচনা করা যাবে না বা সুশাসন, গণতন্ত্রও • মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, এটিও ঠিক নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে অন্যান্য ইস্যুকে গুলিয়ে না ফেললে বরং এই বিচারের প্রশ্নে আরও ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা যাবে, জামায়াত-শিবিরের নাশকতাকে রাজনৈতিকভাবে দমনও করা যাবে। এ মুহূর্তে তা-ই প্রয়োজন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে বিচারের রায় এর বিশ্লেষণ পাঠ করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে রায়ের ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ কমই হয়ে থাকে, যা হয় তা পড়ার মানসিকতাও খুব একটা দেখা যায় না। ২১ জানুয়ারি যদি সরাধের দায়ে দোয়ী সাব্যস্ত আবুল কামাল আজাদের মামলার রায় প্রকাশিত হওয়ার পর উচ্ছ্বাসমূলক বেশ কিছু লেখালেখি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর অধিকাংশগুলোতে রায়ের কোয়ালিটি ও অ্যাশনালিটি নিয়ে আলোকপাত করা হয়নি অক্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে প্রথম রায়
এই রায় প্রদানের জন্য ট্রাইব্যুনালকে খুব কষ্ট করতে হয়নি। মাওলানা আযাদ পালিয়ে যাওয়ার কারণে এবং তাঁর পক্ষে কোনো সাক্ষী না থাকার কারণে তাঁর দোষ প্রতিষ্ঠায় সরকারের আইনজীবীদের তেমন বেগ হয়নি। তবে রায়ে কোনো একটি আন্তর্জাতিক আইন (জেনেভা কনভেনশন) কেন প্রাসঙ্গিক, নয় বা কোনো একটি আন্তর্জাতিক আইনের (নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আরেকটি অংশ কেন নয়, এসবের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আমাদের দেশের রায়গুলোতে আন্তর্জাতিক আইন বা অন্য দেশের আদালতের রায় উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কোনো 'ডায়ালজিক'
আসা। এই বিচার আওয়ামী লীগ কতটা আমার অবস্থলি থেকে করছে, কতটা করছে রাজনৈতিক সুবিধালাভের জন্য, তা নিয়ে সমাজে প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন তোলার কারণও রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পুনরুত্থান, এর আওয়ামী লীগের সখ্যের নজিরও কম নয়। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন বয়কটের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে এসে নির্বাচনে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুগপৎ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিল, ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সমর্থন কামনা
পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না বলে রায়ের এই সীমাবদ্ধতা অবশ্য উল্লেখজনক কিছু নয়। ডেভিড বার্গম্যান তাঁর একটি বিশ্লেষণে আযাদের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর নিরপেক্ষতা ও প্রস্তুতি নিয়েও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু আযাদ দিজে পালিয়ে গিয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন বলে এই রায় নিয়ে এখনই গুরুতর প্রশ্ন ভোলার অবকাশ নেই।
যুদ্ধাপরাধ-সম্পর্কিত অন্যান্য মামলায় অভিযুক্ত বাক্তিরা বিচারকাজে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের আইনজীবীরা একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এবং তাঁদের পক্ষে সুসংগঠিত প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এসব মামলার রায়ের যৌক্তিকতা রায়ের ভেতরেই যঘোটভাবে থাকার প্রয়োজনীয়তা বাবদ রায়ের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করার যৌক্তিকতা রায়ের ভেতরেই যথেষ্টভাবে থাকলে এ দিয়ে অপপ্রচারণা চালানোর সুযোগ আর থাকবে না। রায়ের পক্ষে আরও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও তাতে সৃষ্টি হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আরেকটি গড় পূর্ব রান্ড, একে রাজনৈতিক সুবিধালাতের ডিভা থেকে সরে
করেছিলেন। বিশেষ করে ১৯৯৬ দিযুদ্ধাপরাধবিরোধী আবেদন থেকে সরে সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎভাবে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ জামায়াতের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছিল।
হতে পারে শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এ ধরনের পদক্ষেপ আওয়ামী লীগ নিয়েছিল। কিন্তু একই কৌশল হিসেবে বিএনপি কেন জামায়াতের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করতে পারবে না, তা জনগণকে ব্যাখ্যা করার দায় আওয়ামী লীগ কখনো অনুভব করেনি। কেন তারা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পদক্ষেপ নেয়নি, এই ব্যাখ্যাও আজ পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করা হলে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অতিপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করার পর তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন কৌশার কোনো সুযোতালেরত নান্য
অতীত ভূমিকার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার বরং তাদের দুর্নীতি আর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপগুলোর সমালোচনাংক ঢালাওভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে মনে। নতজানু নীতি, পৌ ভারতে কি পাটের পে ছাত্রলীগের পাশবিক সন্ত্রাস, চমৎ খাঠোরভাবে দমনসহ যা ইচ্ছা এই মার তারা পেয়ে গেছে। সরকারের। যুদ্ধাপরাধ বিচারের মাহাত্মা মুর্তি মানুষের মনে যেকোনো ি প্রতিবদর। ব্যর্থতাকে আড়াল করার ঢাল হিসেবে যা জন্য এই বিচার করা হচ্ছে কি না, এমন। উদ্রেক করছে।
জামায়াত প্রসঙ্গে সরকারের ভূমিকাংে ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর। যুদ্ধাপরাধের জামায়াতের যেসব নেতাকে গ্রেপ্তার একটি হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য অদি রয়েছে। কিন্তু এরপর দলটির দ্বিতীয় সময়ে প্রায় সব নেতাকে সরকার অন্য নানা অতি গ্রেপ্তার করে, জামায়াতের নেতা-কর্মীর নামামাত্র তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ চড়াও হা তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাবা বেশ হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায় বৈধতা অব্যাহত রেখে দলটিকে রাজাপ্রাজনৈ কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়ার যৌক্তিকরাইন তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে। বিচাে কর্মসূচি এখন সহিংস হয়ে উঠছে, কর্মসূচি কঠোরভাবেই দমন করতে হবে মান নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস প্রতিবাদের কার অধিকার থেকে জামায়াতকে বঞ্চিত করয়েজনর্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার অকপট সরকারকে নিতে হবে
8. যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিএনপির ভূমিকাও অভ্যলে বিভ্রান্তিকর। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমোলায়ে বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে রাখতে পারে। এই দাবির আবরণে বিচারকে বানচাল করণী কিংবা বিচার চলা অবস্থায় আটক করা নৌ মুক্তি ও ট্রাইব্যুনাল বাতিল করার জামায়াতের হরতালকে সমর্থন করার কী। প্রদান করবে দলটি? বিএনপির এই নিন্দনীয় ভূমিকা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে গ করছে, দায়হীনতার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত নদীগকে এবং পরবর্তী নির্বাচনের পর এই কি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর সংশয়ের সৃষ্টি করা
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বার্থে অব লীগ ও বিএনপিকে এটি নিয়ে রাজনীতিতে করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজা ইস্যু নয়, এটি প্রধানত সাংবিধানিক ও সাজানোর বাধ্যবাধকতা এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। আওয়ার লীগকে এই বিচার বিতর্কমুক্ত রাখতে হবে মো এটিকে রাজনৈতিক হিসাবের উর্ধ্বের হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বিএনপিকে নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের আ যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার রকম যড়যন্ত্র বা ফাঁদ থেকে সুস্পষ্টভাবে বিকা রব থাকতে হবে, সরকারের দমননীতির পাশ জামায়াত-শিবিরের উগ্র তাণ্ডবকের জানাতে হবে। তা না হলে যুদ্ধাপর বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক অপপ্রচ ক্ষমতার যুদ্ধের বলিতে পরিণত হতে প ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জাতি হিসে আমাদের চিরদিন এক গ্লানির করিয়ে দেবে।
(আসিফ নজরুল। অধ্যাপক, আইন বিভাগ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ