expr:class='"loading" + data:blog.mobileClass'>

Wikipedia

সার্চ ফলাফল

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪

উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মের ভীতিকর ইতিহাস ও ভারতীয় সম্রাজ্যবাদের অজানা ইতিহাস (এই প্রতিবেদন প্রকাশের কারনে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে আমার)


উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মের ভীতিকর ইতিহাস ও ভারতীয় সম্রাজ্যবাদের অজানা ইতিহাস 



 

ভারতীয় অধিবাসীদের মধ্যে অতীতে উপনিষদ, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য দর্শন বিকশিত হচ্ছিল। তাদেরকে, পরবর্তীতে আর্যদের কর্তৃত্বকে গ্রহন করার জন্য নিজেদের প্রাচীন প্রথা সমূহ বিসর্জন দিয়ে বৈদিক সামাজিক শ্রেণী প্রথা গ্রহন করতে বাধ্য করা হয়।


প্রাচীন ভারতীয় সমাজ
জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শৈবধর্ম, নাথিজম (শৈব ধর্মের সাথে তন্ত্রের সংযোগ) এবং নাস্তিক্যবাদ (পুনর্জন্মে এবং নিয়তিতে বিশ্বাসী) ইত্যাদি ধর্ম বিশ্বাস সমূহ অ-বৈদিক, অনার্য অথবা ব্রত্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত। ব্রত্য ধর্ম সমূহ মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, পছন্দ বা আগ্রহের ভিত্তিতে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র সমূহের মত বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিল।

তবে, ব্রত্য সমাজে উত্তরাধিকার ভিত্তিতে অথবা ব্যাক্তি বিশেষের জন্মগত বা পারিবারিক অধিকার সুলভ “শ্রেণী বিন্যাস” স্বীকৃত ছিলনা। এই সমাজ শুধু কোন ব্যক্তির নিজস্ব যোগ্যতাতে বিশ্বাস করতো, কারও সন্তান বা উত্তরসূরি হিসাবে নয়। প্রকারান্তরে, ব্রত্য সমাজ ছিল শ্রেণীহীন সমাজেরই অন্যরূপ এবং ব্রাম্মন্যবাদী সমাজের তুলনায় প্রগতিশীল।



যেভাবে বৈদিক শ্রেণী প্রথা ভিত্তিক ধর্মের প্রবর্তন করা হয়
প্রাচীন ভারতে প্রাথমিক ভাবে, শ্রম বিভাগ গঠন করা হয় ব্রত্য সমাজের মাধ্যমে ব্যাক্তি বিশেষের যোগ্যতা এবং আগ্রহের উপর ভিত্তি করে। যদি কেউ কবিতা লিখে বা রচনা করে সমাজের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠতো অথবা সন্মান লাভ করতো, তাহলে সে “ব্রাম্মন” হিসাবে স্বীকৃতি পেত। অথবা, যদি কোন ব্যাক্তি অস্ত্র ব্যাবহারে বিশেষ যোগ্যতা প্রদর্শন করতো, তাহলে সে “ক্ষত্রীয়” হিসাবে স্বীকৃতি পেত, ইত্যাদি। “ব্রাম্মন” অথবা “ক্ষত্রীয়” শব্দদ্বয়ের শ্রেণী বিন্যাসের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না, তেমনি কারও জন্ম বা পারিবারিক সূত্রের সাথেও এদের কোন সম্পর্ক ছিলনা।

এই নিয়মানুসারে, কোন ব্যাক্তি নির্দিষ্ট কোন শ্রেণী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় যোগ্যতার কারনে অন্য শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেত। এভাবে, কোন শূদ্র পুরুষ ব্রাহ্মণের পদ মর্যাদা পেতে পারতো অথবা ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কোন বালককে তার কৃত কর্মের কারনে সূদ্র পর্যায়ে নেমে আসতে হতো। এভাবেই, গোত্র সমূহের মাঝে এমন এক সমাজ গঠনের সূত্রপাত হয়, যেখানে সকল কিছুই সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ব্রাম্মন্যবাদের জন্য লাভজনক পরিগণিত হওয়ার কারনে সমাজের এই শ্রম পদ্ধতিতে বিন্যাসের প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু শাসক অথবা কার্যনির্বাহী সদস্যদের সহযোগিতা ভিন্ন এই এককেন্দ্রিক নীতির প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে উঠে। সেই সুত্রে প্রবর্তিত হয় শ্রেণী প্রথা।

সে জন্যই প্রধান কার্যনির্বাহীকে সর্বোচ্চ পদ প্রদান করা হতো এবং এমন এক নিয়মের পালন করা হতো, যে নিয়মানুসারে কোন রাজপুত্র নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই রাজার উত্তরাধিকারী হিসেবে গন্য হতো, যার মাধ্যমে সে সকল প্রকার বিশেষ সুযোগ সুবিধার অধিকারী হতো, শুধু তাই নয়, এ নিয়ে সকল প্রকার বিতর্কেরও বিলুপ্ত সাধন করা হয়। এ ভাবেই প্রধান কার্যনির্বাহীর সন্তানও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে প্রধান কার্যনির্বাহীর পদ লাভ এবং কোন ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাম্মণের মর্যাদা লাভ করতো।
প্রধান কার্যনির্বাহী বা শাসনকর্তাকে রাজা হিসেবে অভিহিত করে দেবতার প্রতিনিধি বা সমাজের রক্ষাকর্তা হিসেবে তাকেই বিধাতার স্থলাভিষিক্ত করা হতো। এই নিয়মানুসারে রাজাকে সমাজের আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। অন্যান্য কার্যনির্বাহীদের, যাদের সহায়তা ব্যাতিরেকে নতুন আইন বা নিয়ম কানুন সমাজে প্রয়োগ করা সম্ভব হতো না, সেহেতু শুধু তাদেরকেই প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পদ্ধতি সমাজের সর্বত্র শ্রেণী প্রথার মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে প্রচলিত হতে থাকে। তবে, এমন ব্যক্তি বা ব্যাক্তি সমষ্টিও ছিল যারা এই শ্রেণী প্রথা এবং একাধিপত্যের বিপক্ষে ছিল। অ-বৈদিক অথবা ব্রত্য পদ্ধতির বিশেষত্ব ছিল প্রকারান্তরে শ্রেণীহীনতা।

এভাবেই, শ্রেণী প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষের জনগনের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
ঐতিহাসিক ভাবে, বৌদ্ধ, জৈন, ধর্মাবলম্বী এবং নাস্তিকতার অনুসারীগন এই শ্রেণী প্রথার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে। এদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীগন শুধু প্রতিপক্ষই হয়ে উঠে নাই বরং তারা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করে। এভাবে এঁরা ব্রাম্মন্যবাদের কট্টর অনুসারীগনের প্রধান শত্রু এবং অত্যাচারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠে। তথাপি, বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের বিলুপ্ত না করা পর্যন্ত এই শ্রেণী প্রথা প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব হয়ে উঠে। এই কারনে, অন্যান্য শ্রেণীর জনগনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পরে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সাক্ষ্য দেয় যে, ব্রাম্মণ এবং ক্ষত্রিয়গনের সম্মিলনের মাধ্যমেই শ্রেণী প্রথা বা বর্ণাশ্রম অদম্য শক্তি অর্জন করে।

ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে। মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বাজজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন…‘… এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে নাস্তিক, চার্বাকদের উক্তিতেই প্রমাণ রয়েছে। অতএব বৌদ্ধরা মূর্তিপূজা যজ্ঞবলি বা ধর্মাচার নিষিদ্ধ করে প্রচার করছিল পরকাল নেই,জীব হত্যা মহাপাপ প্রভৃতি। মোটকথা হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের বিপরীতে জাত ভেদ ছিল না।’গতিশীল বৌদ্ধবাদ যখন জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করল তখন থেকে শরু হল ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে বৌদ্ধবাদের বিরোধ।
 
সংঘাত ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠল। উভয় পক্ষই পরস্পরকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। হিন্দুরা তাদের রাজশক্তিরআনুকুল্য নিয়ে বৌদ্ধদের উৎখাতের প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত রাখে। কখনো কখনো বৌদ্ধরা রাজশক্তির অধিকারী হয়ে তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়। বৌদ্ধবাদ কেন্দ্রিক নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাঙন সৃষ্টির জন্য হিন্দুরা চানক্য কৌশল অবলম্বন করে। বৌদ্ধদের মধ্যকার অধৈর্যদের ছলেবলে কৌশলে উৎকোচ ও অর্থনৈতিক আনুকূল্য দিয়ে বৌদ্ধবাদের চলমান স্রোতের মধ্যে ভিন্ন স্রোতের সৃষ্টি করা হয় যা কালক্রমে বৌদ্ধদের বিভক্ত করে দেয়। বৌদ্ধবাদকে যারা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে থাকে তাদেরকে বলা হতো হীনযান। আর হিন্দু ষড়যন্ত্রের পাঁকে যারা পা রেখেছিল যারা তাদের বুদ্ধি পরামর্শ মত কাজ করছিল তাদেরকে ব্রাহ্মণ্য সমাজ আধুনিক বলে অভিহিত করে। এরা মহাযান নামে অভিহিত। এরাই প্রকৃত পক্ষে পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

মহাযান নতুন দল হিন্দুদের সমর্থন প্রশংসা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বৌদ্ধবাদের মূল আদর্শ পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তিমূলও নড়ে যায়। বৌদ্ধদের এই শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে প্রথমত নির্ভেজাল বৌদ্ধবাদীদের ভারত ভূমি থেকে উৎখাত করে এবং পরবর্তীতে মহাযানদেরও উৎখাত করে। কিন্তু যারা একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশ্রয় নিয়ে বৌদ্ধ আদর্শ পরিত্যাগ করে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে তাদের জাতি সত্তাকে বিসর্জন দেয় তারাই টিকেথাকে। সে কারণে আজ বৌদ্ধের সংখ্যা বৌদ্ধবাদের জন্মভূমিতে হাতে গোনা। কোন জাতি তার আদর্শ ও মূলনীতি পরিত্যাগ করে অপর কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করলে সেই জাতিকে স্বাতন্ত্রবিহীন হয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। ছয়শতকে যখন আরবে জাহেলিয়াতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে ইসলামের অভ্যুদয় হয়েছে সে সময় বাংলায় চলছিল বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞ।

৬০০ থেকে ৬৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শিবভক্ত রাজা শশাঙ্ক বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত গয়ার বোধিদ্রুম বৃক্ষ গুলিতিনি সমূলে উৎপাটন করেন। যে বৃক্ষের উপর সম্রাট অশোক ঢেলে দিয়েছিলেন অপরিমেয় শ্রদ্ধা সেই বৃক্ষের পত্র পল্লব মূলকাণ্ড সবকিছু জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। পাটলিপুত্রে বৌদ্ধের চরণ চিহ্ন শোভিত পবিত্র প্রস্তর ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। বুশিনগরের বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেন।

গয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে বৌদ্ধদেবের মূর্তিটি অসম্মানের সঙ্গে উৎপাটিত করে সেখানে শিব মূর্তি স্থাপন করেন। অক্সফোর্ডের Early History of India গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ মঠগুলি ধ্বংস করে দিয়ে মঠ সন্নাসীদের বিতাড়িত করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের পাদদেশ পর্যন্ত বৌদ্ধ নিধন কার্যক্রম চালিয়েছিলেন কট্টর হিন্দু রাজা শশাঙ্ক। ‘আর্য্যা মুখশ্রী মূলকল্প’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম নয় জৈন ধর্মেরওপরও উৎপীড়ন ও অত্যাচার সমানভাবে চালিয়েছিলেন তিনি। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক চেতনা একই রকম।

উভয় ধর্মে জীব হত্যা নিষেধ। ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করা হল এবং বৌদ্ধদের নিহত অথবা বিতাড়িত হতে হল অথচ মহাবীরের ধর্ম জৈন আজো ভারতে টিকে রয়েছে। এটা বিস্ময়কর মনে হলেও এর পেছনে কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সেটা হল বৌদ্ধরা শুরু থেকে হিন্দুদের দানবীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা প্রতিক্রিয়াশীল-চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। পক্ষান্তরে জৈনরা হিন্দুদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়নি। হিন্দুদের সাথে সহ অবস্থান করেছে তাদের ধর্মীয় রীতি নীতি সভ্যতা সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে। তারা মেনে নিয়েছে হিন্দুদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি, তারা ব্যবসায়ের হালখাতা, গনেশ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, দুর্গাকালি স্বরস্বতী পূজা পার্বন হিন্দুদের মত উদযাপন করতে শুরু করে। ভারত জনের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে- ‘হিন্দু মতে যদিও জৈন ও বুদ্ধ উভয়ে নাস্তিক তাহা হইলেও হিন্দু ধর্মের সহিত উভয়ের সংগ্রাম তীব্র ও ব্যাপক হয়নি।হিন্দুদের বর্ণাশ্রম হিন্দুদেব দেবী এবং হিন্দুর আচার নিয়ম তাহারা অনেকটা মানিয়া লইয়াছেন এবং রক্ষা করিয়াছেন।

সেন হিন্দু ব্রাহ্মণরা পাল রাজাদের হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে ও বিহার গুলো ধ্বংস করে ॥ ১২৬ বছর বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে॥ এবং বৌদ্ধের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে ॥ এবং সৃষ্টি করে বর্ণবাদী জাত প্রথা ॥ এর জন্য সেন রাজাদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশ ত্যাগ করে অসংখ্য বৌদ্ধ ॥

ঐতিহাসিকগণ মতামত প্রদান করেন যে, সমূদ্র গুপ্তের (রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৩৩৫ – ৩৮০ অব্দ) সময় কাল থেকে শঙ্কারাচার্যের (খ্রিস্টিয় ৮ম শতাব্দী) সময় কাল পর্যন্ত বৈদিক ব্রাহ্মণগণ বৌদ্ধ ধর্মকে বিলুপ্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। জানা যায় যে, শঙ্করাচার্যই বৌদ্ধ ধর্মের উপর সর্বশেষ আঘাত হানে। এতদসত্তেও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি, এমন কি শঙ্কারাচার্যের শাসনকালের পরও টিকে থাকে কিন্তু অগাধ আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধার লোভে অগনিত বৌদ্ধ পণ্ডিতদের বৈদিক ধর্মে ধর্ম্যান্তরিত হওয়ার কারনে ভারতের বেশীর ভাগ অঞ্চলেই তাদের শক্তি এমন ভাবে লোপ পায় যে বৌদ্ধ ধর্মের শক্তি কার্যত পঙ্গু হয়ে পরে। সর্বশেষে, ১৪ শতাব্দীতে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বারানসিতে বৌদ্ধ ধর্মের অবশিষ্টাংশ বিলুপ্ত করে।

ব্রাম্মণ্যবাদ ক্রমশঃ রাজা বা শাসকের এবং ধনিক শ্রেনীর সহযোগিতা নিয়ে বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ধর্ম বিধ্বংস করে এবং এসব ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারীদের ব্রাম্মন্যবাদে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্রাম্মণ্যবাদ উত্তরোত্তর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ থেকে ধারণা করা যায়, কি ভাবে বৈদিক ধর্মের নামে শ্রেণী প্রথা বিস্তার লাভ করে। রাণী এবং প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে সুবিখ্যাত শৈব আপ্পার এবং তিরুঙ্গনা সাম্বান্দর, মহারাজা মৌর্য বর্মণকে জৈন ধর্ম থেকে শৈব ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয় এবং ধর্মান্তরিত হওয়ার দিন ৮০০০ জৈন পুরোহিতের শীরচ্ছেদ করা হয়। এমন কি আজও মাদুরাই মন্দিরে এই দিবস পালন করা হয়। তারপর, এই সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিরুগনানা সাম্বান্দার এর মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যে সকল মন্দিরে স্থাপন করা হয়। খৃস্টীয় ১০ম শতাব্দীতে নম্বি অন্দর নম্বি এবং ১২শ শতাব্দীতে শেক্কিঝার মহারাজা মৌর্য বর্মণকে ধর্মান্তরিত করার এবং জৈন পুরোহিতদের হত্যা করার বিষয়টিকে শৈব ধর্মের মহা বিজয় বলে গন্য করে।
তিরুমাঙ্গাই আলোয়ার, নাগপত্তিনাম মন্দির থেকে স্বর্ণ দ্বারা তৈরি বৌদ্ধমূর্তি চুরি করে এবং এই চুরি করা ধন দিয়ে সুবিখ্যাত শ্রী রঙ্গনাথ মন্দির নির্মাণ করার জন্য সে বিখ্যাত হয়ে উঠে। বৌদ্ধ, জৈন মন্দিরকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার বহুল ঘটনাই ঘটে।

নিম্নে এসবের কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ
১। কুঝিথুরাই এর নিকটবর্তী বর্তমানের হিন্দু তিরুচানম মন্দির ছিল মূলত একটি জৈন মন্দির। এই মন্দিরে পার্সোনাথ, মহাবীর এবং পদ্মাবতী দেবীর মূর্তি সংরক্ষিত আছে।
২। নগরকইলে নাগরাজ মন্দিরও ছিল একটি জৈন মন্দির, যা হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা হয়।
৩। পেরুম্বাভুর নিকটবর্তী কলিল গুহা মন্দির ছিল প্রকৃতপক্ষে জৈন মন্দির।
৪। মাদিয়াম পল্লি মন্দির ছিল জৈন মন্দির। জৈন দেবী পদ্মাবতীকে দেবী ভগবতী হিসেবে রূপান্তর করা হয়।
৫। অন্ধ্র প্রদেশের চেয়ারলা এলাকার কপোতেশ্বরা মন্দিরকে আনুমানিক পঞ্চম/ ষষ্ঠ শতাব্দীতে রূপান্তর করা হয়।
৬। মহারাষ্ট্রের শোলাপুর এলাকার তাকাড়া মন্দির ছিল বৌদ্ধ মন্দির যা ৫ম শতাব্দীতে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা হয়।
৭। জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, সুবিখ্যাত দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর এর তিরুপতি মন্দির ছিল জৈন মন্দির। জৈন তিরথামকার “নেমিনাথ” কে এই মন্দির উৎসর্গ করা হয়েছিল। এমনও বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে বর্তমান দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর এর মূর্তি প্রকৃতপক্ষে ছিল “নেমিনাথ” এর মূর্তি। এই মন্দিরকে ব্রাম্ম মন্দিরে রূপান্তর করা হয়।

উত্তর ভারতেও এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে বৌদ্ধ মন্দির সমূহ হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা হয়েছে, গৌতম বুদ্ধ কে বিষ্ণু রূপে অথবা তাকে বিষ্ণুর পুনর্জন্ম হিসেবে দেখানো হয়েছে। এসবের মধ্যে একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে, গয়ার বৌদ্ধ মন্দিরকে এবং গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণু হিসেবে রুপান্তর করা। এই মন্দিরে প্রতিটি হিন্দুকে তার পূর্ব পুরুষের আত্নার মুক্তি এবং পরমাত্মার মাঝে বিলীন হওয়ার প্রার্থনায় বিষ্ণুর নামে বুদ্ধের পদ্মপাতা সদৃশ চরণে পিন্দাদনম বিসর্জন দিতে হয়। বোধগয়ার নিকটে বর্তমানের “কাল-ভৈরব” বা মহাকাল মন্দির প্রকৃত পক্ষে একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। কালো পাথরের তৈরি বৌদ্ধ ভিক্ষুর আকৃতিতে বুদ্ধের মূর্তিকেও মহাকাল রূপে পরিবর্তন করা হয়।


কাঠমুন্ডুর বিশ্ব বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দিরও বাস্তবে একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল যা পরবর্তীতে শীব মন্দিরে রূপান্তর করা হয়। ভগবান বিষ্ণুর “অনন্ত শয়ন” মূর্তিও ছিল গৌতম বুদ্ধের যা বর্তমান রূপে পরিবর্তিত হয়। সম্ভবত, এই রূপান্তরের ঘটনা ঘটে ৫০০ খ্রিঃ গুপ্ত যুগে। ৫০০ খ্রিঃ এর পূর্বে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কোথাও বিষ্ণুর মূর্তি বা কোন দলিল পাওয়া যায় নাই।
 

বিখ্যাত চিন্নামস্ত দেবী, বাংলা-উড়িষ্যার দেবী তারা বা তারিণী ছিল প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী যা রূপান্তর করা হয়। বর্তমান কালে তাকে শক্তিদেবী কালী রূপে ধারণা করা হয়।তারা
বৌদ্ধ ধর্মের পূর্বে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মগ্রন্থ সমূহে বিষ্ণুর অথবা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের কোন প্রমান পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ ধর্মই তাদের ধর্মে ধর্ম চক্রের প্রচলন করে। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এটাকে অশোক চক্র বলে গন্য করা হতে থাকে। পরবর্তীতে, ব্রাম্মন্যবাদ এই চক্র বৌদ্ধ ধর্ম থেকে গ্রহণ করে, বৌদ্ধ ধর্মকে ভারতে নিশ্চিহ্ন করে।

মন্দির ও মঠ সমূহের মাধ্যমে বিদ্যাচর্চা, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল ইত্যাদীর পরিচালনার অনুশীলন বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলন থেকে গ্রহণ করা হয়। ব্রাম্মন্যবাদ এসবও বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনুকরণ করে। বৌদ্ধ ধর্মই সর্বপ্রথম জনসাধারণের ধর্মশিক্ষার জন্য মঠ জাতীয় শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠা করে। শঙ্কারাচার্যের মঠ নির্মাণ এরূপ একটি জ্বলন্ত উদাহরন।

শিক্ষিত ব্যক্তি বা কবিগন যারা বর্ণ প্রথায় উৎসাহিত ছিল তাদেরকে ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য ব্যক্তিগনকে তাদের স্বীয় সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এভাবেই, ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থ সমূহে আদি কবি, বাল্মিকি, বৈশ্য দেব প্রমূখ ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃত হয়। ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ মত প্রদান করেন যে, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সমাজ যখন পুনর্গঠিত হচ্ছিল, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মানুসারী পরিবার সমুহের কোন কোন সদস্যকে ব্রাহ্মণ হিসেবে এবং অন্যান্যদের তাদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী অন্যান্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইতিহাসবিদ এবং গবেষকগণ এমনও উল্ল্যেখ করেন যে সামাজিক এই পুনর্গঠনের প্রাক্কালে দরিদ্র ব্রাহ্মণদেরকেও শূদ্র শ্রেণীভুক্ত করা হয় অথচ ধানাঢ্য এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সমূহকে সমাজে তাদের প্রভাব ও ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয় এবং বৈষ্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জনগনের যে অংশ এই বর্ণ প্রথার বিরোধিতা করেন তারা রাজার বা এই প্রথার অনুসারীদের শত্রু হিসেবে পরিগণীত হয় এবং তাদেরকে শূদ্র ও অস্পৃশ্য শ্রেণীভুক্ত করা হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, দক্ষিন ভারতে “পানা” নামক এক সম্প্রদায় আছে, যারা বর্তমানে হরিজন বা অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য হয় অথচ এই “পানা” সম্প্রদায় ৪০০ খ্রিঃ ব্রাহ্মণদের তুলনায় অধিক সন্মানের অধিকারী ছিলেন। তবে খ্রিঃ ৫০০ তারা পুনরায় ব্রাহ্মণদের সম মর্যাদা লাভ করেন। বর্ণপ্রথামুখি সামাজিক পুনর্গঠনের প্রাক্কালে অনেক শিক্ষিত “পানা” এবং কাব্যিক নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ হিসেবে ঘোষণা দেন। যে সকল “পানা” ঐ শ্রেণী প্রথার বিপক্ষে ছিলেন, তাদেরকে ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে বহিস্কার করা হয়, এবং তারা বর্তমানে হরিজন বলে পরিচিত। মজার বিষয় এই যে, মালয়ালম ব্রাহ্মণগণ সকলেই “নামবুদিরি পদ ব্রাহ্মণ” হিসেবে পরিচিত ছিল। এই “পদ” শব্দটি শুধুমাত্র বৌদ্ধ সমাজেই প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হয়, এই “নামবুদিরি” গন সকলেই অতীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

উত্তর ভারতে, “পানা” দের মতই বাল্মিকি, মৌর্য, বৈশ্য, মাল, কাপিল, নিসাদ বা তদ্রুপ সম্প্রদায় সমূহ শূদ্র বা অস্পৃশ্য শ্রেণীর হরিজন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হন।

লক্ষণীয় বিষয় এই যে, যে সকল শাসনামল ব্রাম্মন্যবাদ ভিত্তিক শ্রেণী প্রথাকে সহযোগিতা প্রদান করে এবং শ্রেণী প্রথা ভিত্তিক সমাজ গঠনে কাজ করে, ব্রাম্মন্যবাদী সমাজের লেখকগন ভারতীয় সাহিত্য সমূহে, ঐ সকল শাসনামলেরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও গৌরবান্বিত করে এবং ঐ সকল শাসনামলকেই ভারতের স্বর্ণ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এভাবেই, মগধের গুপ্ত বংশ, বাংলার সেন বংশ, দক্ষিন ভারতের চোলাস, পান্ডিয়া এবং কূলাসেকর বংশের রাজত্ব কালকে হিন্দু সাহিত্যে স্বর্ণ যুগ আখ্যায়িত করা হয়।

এই সমাজ পুনর্গঠনের প্রাক্কালে, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ব্রত্য ধর্ম গ্রন্থাদি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ফেলা হয়, তাদের স্থাপত্য এবং মঠ সমূহ বিধ্বংস করা হয়। কথিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সুবিখ্যাত “নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়”x কে এক সপ্তাহের অধিক সময় যাবত অগ্নিদগ্ধ করা হয়।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত “বড়গাঁও” গ্রামের পাশেই। তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০, তাদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরো ২,০০০ শিক্ষক। বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি বেধ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ দান চলত এখানে। শিক্ষকদের পাঠ দান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠ।

ধারণা করা হয় যে, গুপ্ত সম্রাটগণই নালন্দা মহাবিহারের নির্মাতা এবং সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তই সম্ভবত এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কনৌজের হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) নালন্দা বিহারের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

বাংলার পাল রাজগণ নালন্দার প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রেখেছিলেন। এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মপাল বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। লামা তারনাথ উল্লেখ করেন যে, ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা মহাবিহার তত্ত্বাবধানকারী প্রধান ব্যক্তি নালন্দা দেখাশোনা করার জন্যও রাজা কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হন। সুবর্ণদ্বীপের শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্রদেব জাভার ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য দেবপালএর অনুমতি নিয়ে নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। এদের প্রতিপালনের জন্য দেবপাল ৫টি গ্রামও দানকরেন। সে সময় নালন্দা বিহার ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতিজগতের বিশেষ কেন্দ্র এবং এর অভিভাবক হিসেবে পাল রাজগণ সমগ্র বৌদ্ধ জগতে উচ্চস্থান লাভ করেন। ঘোসরাওয়া শিলালিপি থেকে নালন্দা বিহারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ এবং বৌদ্ধ ধর্ম ওবিশ্বাসের প্রতি দেবপালের গভীর অনুরাগের কথা জানা যায়।nalandauniversity.wordpress.comabout-2

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে একটি মিথ্যা বানোয়াট ও অমার্জনীয় তথ্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে… বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ খৃস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ দিয়েছে ১১০০ খৃস্টাব্দ। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার উদন্ত পুরীআক্রমণ করেছেন ১১৯৩ খৃস্টাব্দে আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুভারত মুসলিম বিজেতাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য ইতিহাসের তথ্য বিকৃত করতেও কুণ্ঠিত নয়।

তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর বাংলা আক্রমণ ও বিজয়ের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৬৯ইং মৃণালিনী নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন। যেখানে বখতিয়ার খলজীকে এবং মুসলমানদের গালাগালি মূলক শব্দ যবন, বানর, অরন্যনর ও চোর হিসেবে উল্লেখ করে লিখেন। মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন বখতিয়ার খলজী অভিযানের প্রাক্কালে, সে সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুরক্ষিত দূর্গ মনে করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় এবং ভিক্ষু বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হত্যা করে ৷ অথচ ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, বখতিয়ার খলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করেননি বরং বঙ্কিম তাঁর সাহিত্যে ঐতিহাসিক সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে, নালন্দা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। যতদূর জানা যায় সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খৃষ্টাব্দে) মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানাদের দ্বারা। উল্লেখ্য মিহিরকুলার নেতৃত্বে হানারা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পূণর্গঠন করেন।

প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়’র রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে তার বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, তিনি সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ও এর একান্ত অনুরাগী। উল্লেখ্য রাজা শশাঙ্কের সাথে বুদ্ধের অনুরুক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড় একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থ স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় তীর্থস্থান বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে । হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন (চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৩ সালে গুপ্ত রাজাদের শাসনামলয়ে নালন্দা ভ্রমণ করেন): Sasanka-raja, being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet be did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka’s hatred towards Buddhism.

প্রকৃত ঘটনা হল একজন ব্রাহ্মণ কর্তৃক সম্রাট হর্ষবর্ধনকে হত্যা তারপর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ক্ষমতা দখল করেন। এই সময় ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে একদল উগ্রবাদী ধর্মোন্মাদ হিন্দু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও ভস্মীভূত করে। ৪০০ খৃষ্টাব্দে চীনা পর্যটক ফা হিয়েন যখন গান্ধারা সফর করেন তখন উত্তর ভারতে বিকাশমান বৌদ্ধ ধর্মের গৌরবোজ্জল অধ্যায় দেখতে পান। কিন্তু ৬২৯ খৃস্টাব্দে অপর একজন চীনা বৌদ্ধ সন্নাসী ১২০ বছর পর নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। ৬২৯ সালে আর একজন চীনা পর্যটক গান্ধারা সফর করে বৌদ্ধবাদের করুণ পরিণতি দেখে মানসিকভাবে বিপন্ন হন।

বখতিয়ার বৌদ্ধদের ওপর কোন ধরনের নির্যাতন করেছেন এমন কথা ইতিহাস বলে না বরং বৌদ্ধদের ডাকে বঙ্গ বিজয়ের জন্য বখতিয়ার সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। এমনকি বিজয়ান্তে তিনি বৌদ্ধদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় থেকে বিরত থাকেন। বাংলায় ১৪ শতকের অভিজ্ঞতা: ১২ শতকে বাংলার ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাব ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির উত্থান। ১৩ শতকের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার দুশ’ বছরের মধ্যে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিধ্বস্ত হিন্দু শক্তির উত্থান সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৫ শতকে রাজাগনেশের আকস্মিক উত্থান কিভাবে সম্ভব হল? এ জিজ্ঞাসার জবাব পেতে সমকালীন ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে।

উপমহাদেশের বৌদ্ধবাদের উৎখাতের পর বহিরাগত আর্য অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এখানকার মূল অধিবাসীদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলেও অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উপস্থিতি তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। মূলত হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খলজি বাংলার মানুষকে মুক্তি দান করেন।

অত্যাচারিত নির্যাতিত বৌদ্ধরা দুবাহু বাড়িয়ে বখতিয়ার খলজিদের স্বাগত জানালো। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়-‘বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরাব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্য ও নির্মূল অভিযানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলার মুসলিম বিজয়কে দু’বাহু বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ড. নিহার রঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস আধিপূর্বে উল্লেখ করেছেন-‘যে বঙ্গ ছিলো আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে কম গৌরবের ও কম আদরের সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান মুসলিম আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হলো।’ সবচাইতে মজার যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০মে, স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ খৃস্টাব্দে। যে লোকটি ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গে প্রবেশ করেন সে কিভাবে ১১৯৩ খৃস্টাব্দে নালন্দা ধ্বংস করেন এটা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭জন সঙ্গী নিয়ে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কৌশলে সেনরাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদে হামলা করেন। এসময় লক্ষণ সেন দুপুরের খাবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন- তিনি বখতিয়ারের আগমনের খবর পেয়ে ভয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান, প্রায় বিনা রক্তপাতে বঙ্গ বিজয় করেন বখতিয়ার খলজি।

সুতরাং বখতিয়ার কতৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ঘটনা একটা মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছু নয়। নালন্দার ধ্বংস হয় সর্বোমোট তিনবার, এর মধ্যে প্রথমবার মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী বাংলার শাসক শশাঙ্ক দ্বারা ও শেষবার অত্যাচারী সেনরাজাদের দ্বারা। নালন্দাকে প্রথম দুইবার ধ্বংসস্তুপ থেকে দাঁড়করানো গেলেও তৃতীয়বার সম্ভব হয়নি গুপ্ত ও পাল রাজাদের মতো পৃষ্ঠপোষক না থাকায়। দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধদের ব্যাপকহারে দেশত্যাগ ও বৌদ্ধদের জ্ঞানার্জনের চেয়ে তান্ত্রিকতার প্রসারও এর জন্য দায়ী।

বখতিয়ার খলজির অভিযান ছিলো সেনরাজা লক্ষণসেনের বিরুদ্ধে, বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নয়। বৌদ্ধরা বখতিয়ারের অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছিলো। সুতরাং বিনা রক্তপাতে বঙ্গবিজয়ের পরে বৌদ্ধদের বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার কাহিনী মুসলিম বিজয়ীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার বৈ অন্য কিছু নয়।

University library bulding 2 - Kanchipuram দক্ষিন ভারতে, সম্রাট অশোক যে কাঁচি পুরাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেন তা ছিল প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ শিক্ষালয়। দক্ষিন ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্বানগন সেখানে পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ করতেন।পরিণতিতে, গ্রাম ও শহরের মঠ সমূহকে ব্রাহ্মণদের মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়, সকল জনসাধারণকে ব্রাম্মন্যবাদের কর্তৃত্বের অধিনে আনার মাধ্যমে “আদি শঙ্কর” ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের হত্যাকারী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠে।Adi_shankara

অন্যদিকে, সকল জনসাধারনকে ব্রাম্মন্যবাদের কর্তৃত্বের অধীনে আনার লক্ষ্যে ব্রত্য সমাজের সমুদয় প্রথা ও রীতি এই নতুন সমাজ প্রথায় সন্নিবেশ করা হয়। এ সবের মধ্যে রয়েছে কোন কোন প্রাণীকে যেমন হনুমান, গরু, মৈয়ুর, নাগ (সর্প), হাতি এবং কিছু বৃক্ষ যেমন, ডুমুর (পিপাল), তুলসী, এবং নীম ইত্যাদি পূজা করা। সকল দেবতা ও দেবী কে ব্রাম্মনীয় দেব দেবী রূপে গ্রহণ করা হয়।

এভাবেই, উন্নততর ও প্রগতিশীল ব্রত্য সমাজের ধ্বংসাবশেষের উপর ভিত্তি করে অপ্রগতিশীল “হিন্দু ধর্ম” নামে ব্রাম্মন্যবাদের জন্ম হয়। এই বিষয় স্মরনে রেখে বাংলায় শ্রেণী প্রথার বিশ্লেষণ করা যায়।

রাঢ় বঙ্গের (পশ্চিম বঙ্গ) উচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের ঐতিহাসিক পরিচিতি:
বঙ্গদেশে, “উপাধ্যায়” সম্বোধনধারী যেমন মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং গঙ্গোপাধ্যায়গন ছিল তথাকথিত উচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ ছিল নিম্ন শ্রেণীর। খৃস্টীয় শাসনামলে, খ্রিষ্টান শাসকগন এই সকল নাম সমূহকে নিজেদের পছন্দানুসারে মুখার্জী, চ্যাটার্জী, ব্যানার্জী এবং গাঙ্গুলিতে পরিবর্তন করে। পরবর্তীতে, তাদের কর্ম ও আবাসস্থলের উপর ভিত্তি করে আরও নতুন নতুন শ্রেণী তৈরি করা হয়। এদের বেশির ভাগই পশ্চিম বঙ্গের গঙ্গা তীরবর্তী রাধ অথবা রাধা অঞ্চলে যেমন বর্ধমান, বীরভূম, হুগলী এবং তদসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করে। তারা কূলীন ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত।

ঐতিহাসিকভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চল বিশেষভাবে, প্রাচীন রাঢ বঙ্গ ছিল জৈন ধর্মের উৎস স্থান, মিথিলা ছিল উপনিষদ দর্শন সমূহের রচনার স্থান। প্রাচীন গৌড়ের বির বাহু জৈন মুনি ছিল চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের গুরু। এছাড়াও ছিল গৌড় পদ যে উপনিষদ সমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করতেন।
আধুনিক হিন্দু সাহিত্যে ৫১টি শক্তি পীঠের কথা উল্লেখ আছে। এই ৫১টি পিঠের অন্ততপক্ষে ২৫টি পীঠই অবস্থিত প্রাচীন বঙ্গে এবং ৭টি বঙ্গ সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলে। ৫১টির মধ্যে ৪টি পীঠকে বলা হয় আদি শক্তিপীঠ। এই পীঠ সমূহ হচ্ছে ১) উড়িষ্যার গঞ্জম জেলায় অবস্থিত দেবী তারার পীঠ। ২) জগন্নাথপুরির দেবী বিমলা ৩) কামরূপ এর দেবী কামাখ্যা এবং ৪) কলকাতা কালিঘাটের মা কালি মন্দির। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম তিনটি ছিল অতীতে বৌদ্ধ মন্দির। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, “মাতসেন্দ্রনাথ” কামাখ্যা পীঠে তন্ত্র সাধনা করতো। খুব সম্ভবত,মাতসেন্দ্রনাথই বৌদ্ধ তন্ত্রপীঠকে “শৈব শক্তি তন্ত্র পীঠ” এ রূপান্তরিত করে।

ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত যে কালীঘাটের মা কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিল গোরখ নাথ এবং তার অনুসারী চৌরঙ্গী নাথ ছিল এর তত্ত্বাবধায়ক। পূরীর দেবী বিমলা এবং গঞ্জমের তারা তারিণী উভয় পিঠকেই বৌদ্ধ পীঠ থেকে শিব শক্তি পীঠে রূপান্তর করা হয়। বঙ্গদেশের শুধুমাত্র রাধা অঞ্চলে (বর্ধমান, বীরভূম, হুগলী এবং তৎসংলগ্ন এলাকা) অবস্থিত এরূপ ৯টি শক্তি পীঠ।

বঙ্গে বর্ণ প্রথা ভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থার ক্রমবিকাশ
ঐতিহাসিক ভাবে এ বিষয় পরীক্ষিত যে বৌদ্ধ ধর্মই ছিল তন্ত্রবিদ্যার উৎস কেন্দ্র। ঐতিহাসিকদের মতে, পরবর্তী কোন সময়ে শৈব, জৈন, বৈষ্ণ ধর্ম এবং সর্বশেষে বৈদিক জনগণও তন্ত্রবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে। 

 ভ্রাম্যমান শিবরূপই ‘ভৈরব_ আমরা আজও দেখতে পাই অবশিষ্ট বৌদ্ধ, জৈন এবং সকল বৈদিক সাধকগন সকলেই “ভৈরব” এবং “কাল ভৈরব” সাধনা করে থাকে। কালক্রমে, মাতসেন্দ্রনাথ এবং শিব গোরখা নাথ সাধনার ধারণা এবং পদ্ধতি পরিবর্তন করে এবং তন্ত্র সাধনার প্রয়োজনে ভৈরব চরিত্রকে “মা” চরিত্রে পরিবর্তন করে। মাতসেন্দ্রনাথ এবং শিব গোরখা নাথ উভয়ই ছিল “নাথ শৈব” এবং “নাথ কৌল”। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, শিব দেবতাকে “মহা কৌল” হিসেবেও ডাকা হয়।

মাতসেন্দ্রনাথকে ভারতে কুল (শক্তি) বংশের অভিভাবক হিসেবেও দেখা হয়। সেই সূত্রে, মাতসেন্দ্রনাথ এর সামাজিক অনুসারীগন “কূলিন” (দেবী মাতা শক্তির পূজারী) নামে পরিচিত ছিলেন।

রাধা অঞ্চলে এই কূল সাধনার গভীর প্রভাব সম্মন্ধে ধারণা করা যায়, এই অঞ্চলে শক্তি পীঠের সংখ্যা থেকে, মোট ৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে ১০টি পিঠই এই রাধা অঞ্চলে অবস্থিত। এ সম্ভবপর হয়ে উঠত না, যদি এই অঞ্চলের প্রভাবশালী এবং বিদ্বান লোকজন এর পৃষ্ঠপোষকতা না করতো। বৈদিক সমাজ ব্যাবস্থা শক্তিধর এবং প্রভাবশালী গনের জন্য খুবই লাভজনক বলে প্রতিয়মান হয়। শ্রেণী প্রথার প্রতিষ্ঠার পেছনে এই শ্রেণীর লোকজনই ছিল মেরুদন্ড। এই শ্রেণী প্রথার বিশেষ সুবিধা ছিল এই যে, ইহা শুধু তাদের জন্যই লাভজনক ছিল না, বরং তাদের সন্তান এবং বংশধরদের জন্যও একটি স্থায়ী লাভজনক ব্যাবস্থা ছিল।

এভাবেই ভবিষ্যতের রাজা হিসেবে কোন রাজপুত্রের ভবিষ্যৎ এমন কি যোগ্যতা, সক্ষমতা নির্বিচারে ব্রাহ্মণের সন্তানের ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তিও পূর্বনির্ধারিত হয়ে যায়, যা ব্রত্য সমাজে স্বীকৃত ছিল না। ব্রত্য সমাজে শুধু ব্যাক্তিগত যোগ্যতাকেই স্বীকৃতি দেয়া হতো।

অংগ বা রাঢ় বঙ্গের বৈদিক প্রথার অনুসারীগন অ-বৈদিক অথবা ব্রত্য সমাজের অনুসারীগণের সাথে সামাজিক ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই কারনে ১২ শতাব্দীতে সেন বংশের শাসনামলের পূর্ব পর্যন্ত অংগ বা রাঢ় বঙ্গে শ্রেণী প্রথার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় নাই, যদিও তা মধ্য দেশে (বর্তমানে বিহার এবং উত্তর প্রদেশ) ৩য় শতাব্দীতে গুপ্ত বংশের শাসনামলের সময় থেকেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এও লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, বঙ্গের শ্রেণী প্রথা বৈদিক শ্রেণী প্রথার অনুরূপও নয়। বঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিল হয়তো “ব্রাহ্মণ- বৈদ্য- কেষ্ট- অথবা শূদ্র” কিন্তু তাদের মধ্যে ক্ষত্রীয় এবং বৈশ্য ছিল না।

এভাবেই ভারতীয় সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে এবং উপ শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। ফলে, “বিভক্তি এবং শাসন” পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা শ্রেণী প্রথার সমর্থকদের জন্য সুবিধাজনক হয়ে উঠে এবং তাদের পারিবারিক আধিপত্য সুদৃঢ় হয় এবং এভাবেই শ্রেণীহীন সমতা ভিত্তিক সমাজের বিলুপ্তি ঘটে। এই পদ্ধতি ভারতের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিন তথা সর্বত্রই গৃহীত হয়। রাজাকে বিধাতার স্থলে অথবা বিধাতার প্রতিনিধির স্থলাভিষিক্ত করা হয় এবং তার উত্তরসূরিদের প্রদান করা হয় সর্বোচ্চ স্থান, তার বিনিময়ে রাজা বা তার উত্তরসূরিগণ নিজেদের স্বার্থেই ব্রাম্মন্নবাদী অথবা বৈদিক শাসনকে সহযোগিতা করতে থাকে।

এখানে লক্ষ্য করা যেতে পারে, যে রাজা বা রাজবংশ ব্রাম্মন্যবাদী শাসনকে পৃষ্ঠপোষন এবং এই শ্রেণী- প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে, সে সকল রাজা বা রাজবংশের শাসনামলকে তাদের রচিত সাহিত্যে মহিমান্বিত এবং ভারতের স্বর্ণ যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এভাবেই, মগধের গুপ্ত বংশ, বাংলার সেন বংশ, দক্ষিন ভারতের চোলাস, পান্ডিয়া এবং কূলাসেকর বংশের রাজত্ব কালকে ব্রাহ্মন্য সাহিত্যে স্বর্ণ যুগ আখ্যায়িত করা হয়।

উল্লেখযোগ্য যে, সেন বংশীয় রাজাগন স্বয়ং ব্রাম্মন্যবাদী শাসনের অনুসারী ছিল। এভাবেই রাজা বল্লাল সেন এবং লক্ষন সেন বঙ্গে শ্রেণী প্রথা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রাহ্মন্য সাহিত্যে তাদের শাসন আমলকে বাংলার স্বর্ণ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

ব্রাম্মন্যবাদের এই“এক শ্রেণীর আধিপত্য” এবং “বিভক্তি এবং শাসন” পদ্ধতি আজও ভারতবর্ষ জুড়ে বিদ্যমান যার ফলে শোষিত, নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত হচ্ছে ভারতেরই আদি অধিবাসী তথাকথিত নিম্নবর্ণের এবং অন্যান্য ধর্মের জনসাধারন। শুধু তাই নয়, অত্যাচারের ব্রাম্মন্যবাদী খড়গ আজ প্রতিবেশী দেশ সমুহের দিকেও প্রসারিত।

তথ্যসূত্রঃ

Dr. K.K. Debnath, Development of Vedic social system of casteism in Bengal
storyofbangladesh.com/…/dui-po…/93-chapter-1.html
 
আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে পার হতে হয়েছে ইতিহাসের বন্ধুর পথ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার সর্ববৃহদাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের বর্তমান পরিস্থিতি ভালো রূপে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে তাদের ইতিহাস জানাও অতি জরুরী।

প্রাচীন বাংলা
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে টিকেও ছিল যুগে যুগে। উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। বাংলার ইতিহাস বলতে অধুনা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিগত চার সহস্রাব্দের ইতিহাসকে বোঝায়। প্রাচীন যে সকল সভ্যতার প্রভাব আজকের ভারতবর্ষের এবং তার আশে পাশের মানব সমাজে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছে সে সকল সভ্যতা হচ্ছে সান্তাল, মঙ্গোলীয়, আল্পিয়ান, দ্রাবিড় এবং আর্য সমাজ।

বাঙালি জনগোষ্ঠী
আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে যে সভ্যতা এই উপমহাদেশে বিকশিত হচ্ছিল, তা হচ্ছে আল্পিয় সভ্যতা (Alpine civilization)। মধ্য এশীয় অধিবাসী আলপাইনগন (Eastern Bracycephalic) পূর্ব ভারতে (বাংলা, উড়িষ্যা, এবং আসামের সমতল অঞ্চল সমুহে) স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকার মাধ্যমে বর্তমান বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি সৃষ্টির মৌলিক উপাদান প্রস্তুত করে।
 
আল্পিয়ান সভ্যতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
আলপাইন জাতী সুনির্দিষ্ট ভাবেই প্রাচ্য এবং এশিয়া মহাদেশীয় সভ্যতার অংশ। ১৯ শতাব্দীর এবং প্রারম্ভিক ২০ শতাব্দীর কতিপয় প্রত্নতাত্ত্বিকগন আলপাইন জাতীকে মঙ্গোলীয় জাতীর ককেশীয় শাখা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। ধারনা করা হয়, আলপাইন গন নবপ্রস্তরযুগে মধ্য এশিয়া থেকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল এশিয়া মাইনর, ইরান, পামির এবং হিন্দুকুশ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এমন কি সুদূর ইউরোপেও গমন করেন।

প্রকৃতপক্ষে, আল্পাইন গন বিশ্বজুড়ে মানব সভ্যতা বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে, এবং এশিয়া থেকে ইউরোপে উন্নত কৃষ্টির বাহকের ভূমিকা পালন করে। রিপ্লে এবং কুন এর গবেষণা অনুসারে, আলপাইন গন মধ্য- দক্ষিন- পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার প্রধান অধিবাসী ছিল। রিপ্লের মতে, আলপাইন গনই এশিয়া মহাদেশ থেকে কৃষিকার্য, আদিম মৃত্শিল্প এবং পশু পালন পদ্ধতি ইউরোপীয় সমাজে প্রচলন করেন।

আলপাইনগন কে তাদের গোলাকৃতি মুখমণ্ডল বিশেষ ভাবে মস্তিস্কের পরিমাপ যেমন কপালাঙ্ক ইত্যাদি দিয়ে স্বতন্ত্র ভাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সে কারনে, তাদের মাথার খুলি বিস্তৃত মস্তকধারী হিসাবে গন্য করা হয়।

কিন্তু আলপাইনগনকে তিব্বত এবং উত্তর এশিয়ার অন্যান্য সমতল অঞ্চলের অধিবাসী চেরা নেত্রবিশিষ্ট মঙ্গোল দের সাথে তুলনা করাও সঙ্গত নয়। বাস্তবে, এই উভয় জাতির মানুষ জনই গোলাকৃতি মুখমণ্ডল ও কপালাঙ্কের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা একই সভ্যতার বা প্রজাতীর নয় যদিও অনেক নৃবেজ্ঞানী এই দুই সমান্তরাল সভ্যতাকে এক হিসাবে গ্রহন করে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন।

মঙ্গোল, তাতার এবং তুর্কী যারা ইউরোপের আগমন করেছিলেন, তাদের সাথে গোলাকৃতির মস্তিস্ক বা মুখমণ্ডল ভিন্ন আলপাইনদের সাথে অন্য কোন সাদৃশ্য নাই।

পূর্ব ভারতে আলপাইনগন তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কার অনুসারে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল যেমন, বঙ্গ (দক্ষিন বঙ্গ), পুন্দ্র (উত্তর বঙ্গ), এবং রাঢ (পশ্চিম বঙ্গ) অঞ্চল সমূহ। বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য (৭০০ বিসিই প্রাচীন) ছিল পুন্দ্র রাজ্যের রাজধানি। আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে অর্থাৎ আল্পিয় সভ্যতার সময় থেকেই বঙ্গ (দক্ষিন বঙ্গ) অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ অন্যান্য বঙ্গীয় অঞ্চল সমূহ থেকে তৎকালীন ধর্মীয় সংস্কারের কারনে বিভক্ত ছিল। কালের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুন্দ্র ও বঙ্গের মধ্যকার সেই বিভক্তি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হলেও রাঢ (পশ্চিম বঙ্গ) ও বঙ্গের (পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশ) মধ্যকার সেই বিভক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। শুধু সাংস্কৃতিক বিভক্তি নয়, রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই বিভক্তি স্থায়ী রূপ লাভ করে, যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রয়াত মনসুর আহমেদ তার “বাংলাদেশের কৃষ্টিক পটভুমি” তে উল্লেখ করেন, বাংলায় দুইটি কৃষ্টি ছিলঃ একটা বাঙালী হিন্দু কালচার, অপরটা বাঙ্গালী মুসলিম কালচার।

ইতিহাসের পাতা উল্টাইলেই দেখা যাইবে, যে ভুখন্ড লইয়া আজ বাংলাদেশ গঠিত, মোটামোটি ও মূলত সে জনপদই ইতিহাসের বঙ্গ। খৃস্টীয় চার শতকের গোড়া হইতে এগার শতকের শেষ পর্যন্ত পুন্ডু, পাল ও সেন রাজাদের আমলেও এই ভুখন্ডের নাম ছিল বঙ্গ। গঙ্গা (ভগিরথী) নদীর পশ্চিম পারের যে ভখন্ডকে আজ পশ্চিম- বঙ্গ বলা হয়, তৎকালে তার নাম ছিল অংগ।

গোটা বাংলার (পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা) কৃষ্টি বলিয়া কোন নির্দিষ্ট কালচার বা কৃষ্টি নাই, কখনোই ছিলনা। ভাষার বিচারে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার জনগনের একটা নির্দিষ্ট কৃষ্টি থাকার কথা। কিন্তু, সত্যি কথা এই যে, এই দুই বাংলার কোনও জাতীয় কৃষ্টির সৃষ্টি হয় নাই। বাংলায় জাতীয় কৃষ্টি গড়িয়া না উঠার কারণ রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা নয়, বরং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। প্রকৃতপক্ষে, বাংলার মানুষের সমাজ একটি নয়, দুইটি। তাঁদের মধ্যে, খাওয়া-পরা, বিবাহ-শাদি ইত্যাদি অনেক বিষয়েই সামাজিক মিল নাই। তাই এগারশ বছর এক দেশে বাস করিয়া, একই খাদ্য-পানীয় গ্রহন করিয়াও দুইটি পৃথক সমাজে রহিয়া গিয়াছে। এই দুইটি সমাজে দুইটি সমান্তরাল কৃষ্টি গড়িয়া উঠিয়াছে। বাংলা ভাগের মধ্যে দুইটা কৃষ্টি নিজ-নিজ আশ্রয় স্থল খুজিয়া পাইয়াছে। রাঢ বাংলার কৃষ্টি ভারতের জাতীয়তার অংশ, দক্ষিন বঙ্গের কৃষ্টি বাংলাদেশের জাতীয়তার অংশ।

কোন কোন সুত্রে ধারনা করা হয় যে, বাংলার আদি অধিবাসিগন জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক ভাবে বৈদিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠাকারী আর্য সমাজ থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্টের অধিকারি।

যাই হোক, আলপাইন গন সহস্র বৎসর যাবত আক্রমনকারী বৈদিক আর্যদের প্রতিহত করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দিতে আর্যগন এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
 
দ্রাবিড় সভ্যতার প্রভাব
খৃষ্টের জন্মের প্রায় চার হাজার বৎসর পূর্বে উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে (বিশেষতঃ বর্তমান পাকিস্তান) অঞ্চলে দ্রাবিড় নামক এক প্রাচীন সভ্য জাতির অধিবাস ছিল। ভারত উপমহাদেশে আর্য জাতির আগমনের প্রায় দুই হাজার বছর আগে হইতেই এঁরা তথাকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। দ্রাবিড়রা সেমেটিক গোষ্ঠীর একটি সম্প্রদায়। ভারতে আগমনের পূর্বে এঁরা ব্যাবিলন অঞ্চলে বসবাস করতেন। প্রথমে তারা সিন্ধুদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বস্তি স্থাপন করেন। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা এদেরই দ্বারা স্থাপিত রাজধানী। এই দুই প্রাচীন নগরীর স্থপতি ও কারুকার্য হইতেই দ্রাবিড় জাতির সভ্যতার পরিমাপ করা যায়। এঁরা শুধু স্থপতি বিদ্যায়ই উন্নত ছিলেন না। উন্নত ভাষা ও বর্ণমালাও এদের ছিল। ভারতে বৌদ্ধ যুগে যে এই দ্রাবিড় বর্ণমালার প্রাধান্য ছিল, তার বড় প্রমান এই যে অশোক স্তম্ভগুলির স্মারক লিপিগুলি এই দ্রাবিড়ি সেমিটিক বর্ণমালাতেই লেখা। (সূত্রঃ অধ্যাপক নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান- “বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস”)

আর্যদের দ্বারা বিতাড়িত হইয়া দ্রাবিড়দের এক অংশ দক্ষিন ভারতের পথে ছড়াইয়া পরেন। সেখান হইতে এক দল বাংলাদেশের মাটির উর্বরতায় আকৃষ্ট হইয়া এখানে আসেন এবং স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন।

পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশ (বঙ্গ), পশ্চিম বঙ্গ (রাঢ), আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের অধিবাসীগণ আলপাইন ও দ্রাবিড়দের উত্তরসূরি, তবে রাঢ বা পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসীগণের মধ্যে তুলনামুলক ভাবে দ্রাবিড় ও আর্যদের প্রভাব বেশি বলে অনেক ঐতিহাসিকই ধারনা করেন।

আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল। এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এ এলাকার ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় একশ বছরের অরাজকতার (যাকে মাৎসন্যায় পর্ব বলে অভিহিত করা হয়) শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হয়, এবং পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করে। এর পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে।

যদিও বঙ্গ অঞ্চলে ভারতীয় অধিবাসীদের মাধ্যমে উপনিষদ, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ভারতীয় দর্শন বিকশিত হচ্ছিল, যারা পরবর্তীতে উচ্চ বর্ণের (আর্যদের) স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাচীন প্রথা সমূহের পাশাপাশি উচ্চ বর্ণের (আর্যদের) কর্তৃত্বকে গ্রহন করার মাধ্যমে বৈদিক সামাজিক শ্রেণী প্রথা গ্রহন করে, তবে খ্রিস্টাব্দ এগার শতাব্দীতে সেন বংশের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গে কোন বর্ণ প্রথা ছিল না।

ইন্দো-আর্যদের আসার পর মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে । এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল । খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই (বিশেষ ভাবে পশ্চিম বঙ্গ) শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল । মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য।

আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৫০০, গৌতম বুদ্ধের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম আর্যদের অত্যাচার এবং অবদমনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। পরিশেষে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অত্যাচার ও হত্যার মাধ্যমে বিলুপ্ত করে এবং প্রাচীন ভারতীয় ব্রত্য সমাজে প্রচলিত ‘ব্যাক্তিগত যোগ্যতা’র ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণী বিভাগ কে রূপান্তরিত করে এক শ্রেণীর মানুষের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রাম্মন্যবাদ ভিত্তিক শ্রেণী প্রথার প্রচলিত করা হয়, যা অদ্যাবধি বিদ্যমান।

প্রাচীন ভারতে ইসলামের প্রভাব
ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইসলামের আবির্ভাব হয় ৭ম শতাব্দীতে মালাবার সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে নব্য মুসলিম আরব বণিক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে আরব দেশ সমূহের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এমনকি, ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকেই আরবীয় বণিকগণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য বন্দরের সাথে সংযুক্ত মালাবার অঞ্চল ব্যবহার করত। নব্য মুসলিম আরব বণিক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ভারতে ইসলামের আগমন হয়।

ঐতিহাসিক ইলিয়ট ও ডউসন, তাদের রচিত “দ্য হিস্টরি অব ইন্ডিয়া এজ টোলড বাই ইটস অউন হিস্টরিয়ানস” গ্রন্থ অনুসারে, ভারতীয় বন্দরে মুসলিম পর্যটক বহনকারী প্রথম জাহাজ এমনকি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দেই দেখা যায় । এইচ, জি, রাওলিনসন তার রচিত গ্রন্থ, “এন্সিয়েন্ট এন্ড মেডিভাল হিস্টরি অব ইন্ডিয়া”তে দাবী করেন যে, ৭ম শতাব্দীর শেষের দিকেই মুসলিম আরবগন সর্বপ্রথম ভারতীয় সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেন।

এই বিষয়টি সম্মন্ধে জে, স্টার রক তার “সাউথ কানারা এবং মাদ্রাজ ডিসট্রিক্ট মেনুএলস” এ এবং হরিদাস ভট্টাচার্য “কালচারাল হেরিটেজ অব ইন্ডিয়া, ভলূম চার” এ বিশদ ভাবে বর্ণনা করেন। “ইসলামের ঊষালগ্নে আরবগন বিশ্বব্যাপী এক উন্নতমানের কৃষ্টিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হন। আরব ব্যাবসায়ী ও বণিকগণ এই নতুন ধর্মের বাহক রূপে যেখানেই তারা গমন করেন সেখানেই তা প্রচার করেন।“ কিন্তু ভারতে ইসলাম প্রচারকারীগণের অধিকাংশই অ- আরবীয় দেশ সমূহ থেকে আগমন করেন। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আরব মহাদেশের অন্যত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই আরব বনিকগন ভারতে আগমন করতেন।

ভারতে প্রথম ইসলাম প্রচারকারীগণ ছিলেন এমন সব ব্যক্তিত্ব যারা, ইসলাম প্রচার করাকে পূণের কাজ বলে মনে করতেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে সূফীবাদী ধর্ম প্রচারকগন বুখারা, তুরস্ক, ইরান, ইয়েমেন এমন কি আফগানিস্তান থেকে ভারত আগমন করেন। ভারতে ইসলাম প্রচারকারীগণের মধ্যে সবচাইতে স্বনামধন্য ছিলেন খাজা চিশতী, যিনি ইরান থেকে আগমন করেন এবং সূফীবাদ প্রচার করেন। ভারতে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠায় কোনভাবেই বলপূর্বক ধর্মান্তরকে দায়ী করা যায় না।

ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ৭১৩ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসিম আল থাকাফির সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের মাধ্যমে ১৮৫৮ সালে সর্বশেষ মোগল সম্রাটের পতন পর্যন্ত টিকে থাকে। যদিও ৮ম শতাব্দীতে মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে সিন্ধু বীজিত হয়, গযনির মাহমুদ এবং ঘোরের মুহাম্মদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশে ব্যাপক হারে মুসলমানদের অভিবাসন শুরু হয় নি। তবে সমসাময়িক ঐতিহাসিকগনের মতে ভারতের মুসলমানদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পেছনে বলপূর্বক ধর্মান্তর দায়ী নয়।

মুসলমান শাসকগণ বিশেষ করে মোগলগণ, দেশটি ঐক্যবদ্ধ করেন এবং একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অধিনে আনেন। তারাই সর্বপ্রথম দেশটিকে হিন্দ বা হিন্দুস্তান অর্থাৎ হিন্দুদের বা সকল অমুসলিমদের দেশ হিসাবে নামকরণ করেন। হিন্দু শব্দটি মূলত ফারসী, যা ভারতের মুসলমানগণ সর্ব প্রথম সকল অমুসলিম অধিবাসীদের বোঝাতে ব্যাবহার করতেন। অথচ হিন্দুগন, মুসলিম শাসকদের আগমনের পূর্বে ব্যবহৃত সংস্কৃতে কখনোই এই শব্দটি ব্যাবহার করেন নি।

স্বামী ধর্মতীর্থ বলেন, “মুসলমানগন, ভেদাভেদহীন ভাবে সকল অমুসলিম অধিবাসীদেরকে বোঝাতেই “হিন্দু” শব্দটি ব্যাবহার করতেন, যা প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র অমুসলিমই বোঝাত, এর বেশি কিছু নয়। এই সামান্য বিষয়টিই অন্যান্য অনেক ঘটনার তুলনায় ভারতের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সর্বাধিক অবদান রাখে, একই সাথে, কোটি কোটি মূক নিম্নবর্ণের সাধারন হিন্দুদের, তাদের শোষক শ্রেনীর যাজকদের নিকট চিরস্থায়ীভাবে পরাধীন হতেও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। পর্যায়ক্রমে ভারতের অধিকাংশ অধিবাসীর পরিচয় হয়ে উঠে ‘হিন্দু’, তাদের ধর্ম ‘হিন্দুত্ব’ এবং ব্রাহ্মণগণ তাদের প্রভু।

মুসলমান শাসকদের ভারত বিজয় সম্পন্ন করতে কয়েক শতাব্দী সময়ের প্রয়োজন হয়। মূর্তিপূজাকে নিন্দা করলেও মুসলমান সুলতানগণ হিন্দুদের এই সংস্কারকে উপেক্ষা করে যেতেন এবং তাদের উপর ইসলাম ধর্মকে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন নি। মুগল গনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের শাসনামল থেকে, ভারত বর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলই মুসলিম শাসনের অধিনে চলে আসে।

অনেক কণ্টকময় পথ পেরিয়ে ইসলাম ভারতের হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজে টিকে থাকে। যদিও ভারতে ইসলাম শতাব্দী সময়কাল ধরে প্রচারিত হয় কিন্তু কখনোই তা পূর্ণতা লাভ করেনি বরং ইতিহাসের সকল পর্যায়েই হিন্দুগনের কর্তৃত্বই ভারতে প্রাধান্য পায়।

মুসলিম মনীষীগণ এবং ধর্মীয় নেতাগন আদি অধিবাসীদের মাঝে ইসলাম প্রচার করতে সচেস্ট হলে, তাদের বিপুল সংখ্যক ইসলাম ধর্মকে গ্রহন করেন। বর্তমান কালের ভারতীয় মুসলমান গনের অধিকাংশ তাদেরই বংশধর।

এ কারনেই, এ কথা বলা যুক্তি সঙ্গত নয় যে, ভারতীয় মুসলমান গন ভারতীয় নন কিংবা তারা বহিরাগত। যেমনই, নিম্ন বর্ণের হিন্দুগন আর্য ধর্ম গ্রহণ করলেও তারা ভারতেরই আদি অধিবাসী, তেমনি, সূফি- দরবেশ, মুসলিম মনীষী বা ধর্মীয় নেতাগনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মুসলমান জনগণও ভারতের আদি অধিবাসী।

অন্যদিকে, আদি ভারতীয় পরিচয়ের বিচারে, আর্য অনুপ্রবেশকারীদের উত্তরসূরি যেমন, ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের সাথে পরবর্তীতে মোঘল, পাঠানদের উত্তরসূরিদের মাঝে কোন তফাৎ নেই। তারা উভয়েই ভারতে বহিরাগত। বস্তুত, ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়, যার বৃহদাংশ আদি ভারতীয়দেরই উত্তরসূরি, তারা খৃস্টপূর্ব ১৫০০ সালে উপমহাদেশ বিজয়কারী মধ্য ইয়োরোপ থেকে আগত আর্যদের বংশোদ্ভূত উত্তরসূরিদের তুলনায় অধিকতর ভারতীয়।

আর্যদের আগমনের পর থেকে ভারতীয় সমাজে শ্রেণী বিন্যাসের মাধ্যমে উচু নিচু ভেদাভেদ স্থায়িত্ব লাভ করলেও পরবর্তীতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দে) মুসলমান সূফি- দরবেশ ও আরবীয় বনিকদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম ধর্মের প্রসারের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ প্রকৃত পক্ষে সাম্য, সমতা এবং অন্যান্য মানবিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ উন্নত হয়।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ প্রয়াত আবুল মনসুর আহমেদ “বাংলাদেশের কালচার” গ্রন্থে যথার্থই লিখে গেছেন, “সময়ের সাথে সাথে, ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু এবং মুসলমান সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলন ঘটে এবং মুসলমানগণ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কৃষ্টিক উন্নতিতে বিশেষ অবদান রাখে।

বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের হাতে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২০৫-৬ সালের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খীলজী নামের একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত সেনাপতি রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজবংশের পতন ঘটান। ষোড়শ শতকে মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসার আগে পর্যন্ত বাংলা স্থানীয় সুলতান ও ভূস্বামীদের হাতে শাসিত হয়। মোঘল বিজয়ের পর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর।

অতি প্রাচীন বাংলাদেশের এই কালচারেরই নবরূপ আমাদের বর্তমান কালচার। ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশ ও তার জনগনের সামনে দিগ্বিজয়ীর বেশে আসে নাই। এখানে সে ধর্ম আসিয়াছে জনগনের ধর্ম হিসাবেই। বাংলাদেশে, ভারতে ও পাকিস্তানে ইসলামের আবির্ভাবের ইহাই মৌলিক পার্থক্য। ইতিহাসের অসাবধান লেখক ও পাঠকরা এইখানেই মস্তবড় ভুল করিয়া থাকেন। তারা দিগ্বিজয়ী বীর বখতিয়ার খিলজির বাংলাদেশে আগমনকেই এদেশে ইসলামের আগমন মনে করে থাকেন। এটা নিতান্তই ভুল ধারনা। বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশ জয় করেন ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। এই ঘটনার প্রায় তিন শ বছর আগে হইতেই বাংলাদেশে শুধু ইসলামের আবির্ভাবই হয় নাই, ততদিনে ইসলাম বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে জনগনের ধর্মে পরিনত হইয়াছে। বাংলাদেশে ইসলামের প্রথম আবির্ভাব হয় পশ্চিম ভারতের স্থলপথ দিয়া নয়, বরং দক্ষিন দিক দিয়া জলপথে।

প্রথমেই আসে সুফী সুলতান বায়জিদ বোস্তামির কথা। ইনি ৭৭৭ খৃস্টীয় সালে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৭৪ খ্রিঃ ইন্তেকাল করেন। তিনি ইরান, ইরাক ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার করিতে করিতে সম্ভবত আরব বণিকদের সাথে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে অবস্থিত তার নামীয় আস্তানা ও চিল্লার প্রতি স্মরণাতীত কাল হইতে সকল সম্প্রদায়ের জনগন, বিশেষত মুসলমানরা যে ভক্তি ও সম্ভ্রম দেখাইয়া এবং পবিত্র স্থানের মর্যাদা দিয়া আসিতেছে, তাতে বিনা-দ্বিধায় এটা ধরিয়া লওয়া যায় যে, সুফী সাহেব এই স্থানে ধর্ম সাধনা ও ইসলাম প্রচার করিয়া অগনিত ভক্ত ও শাগরেদ সৃষ্টি করিয়া গিয়াছিলেন।

সুলতান বায়যিদের পরেই মীর সৈয়দ সুলতান মাহমুদ শাহ মাহিসোওয়ার (মৃত্যু ১০৪৭ খৃঃ), শাহ মোহাম্মদ সুলতান রুমী (মৃত্যু ১০৫৩ খৃঃ), বাবা আদম শহীদ (মৃত্যু ১১১৯ খৃঃ), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুৎশিকান প্রমুখ ইতিহাস বিখ্যাত ওয়ালি- আল্লাগন বাংলার বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ইসলাম প্রচার করিয়া হাজার হাজার ভক্ত রাখিয়া গিয়াছেন।“  
 
ব্রিটিশ ভারতে দুই বাংলার পরিস্থিতি
ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাঙালি হিন্দু সমাজ ইংরেজি ভাষার সাহিত্য, দর্শনে পারদর্শিতা লাভ করে ইংরেজি সভ্যতা ও জীবন দর্শনকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করলেও মুসলমানগন বিধর্মী শত্রুর ভাষা, সাহিত্য, দর্শনকে পরিত্যাগ করেন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ইংরেজদের প্রিয়পাত্র হিন্দুরাই বেশির ভাগ জমিদারির মালিক হয়ে বসলেন এবং মুসলমানের বেশির ভাগ বিশেষত পূর্ব ভারতে চাষি ও প্রজা হয়ে জমিদারের অত্যাচারের বোঝা বইতে বাধ্য হলেন। হিন্দু ও মুসলমানের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত এই বিরাট পার্থক্যটি যতদূর সম্ভব দূর করার লক্ষ্যে ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল জর্জ ন্যথনিয়াল কার্জন বাংলা প্রদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি পশ্চিম বাংলা বিহার উড়িষ্যা এবং পূর্ব বাংলার আসামের অংশ বিশেষ নিয়ে দুটি প্রদেশ সৃষ্টি করলেন এবং এইভাবে মুসলমান প্রধান পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের শিল্প সংস্কৃতির পূর্ণবিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে দিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব সারা দেশের হিন্দু সমাজকে আলোড়িত করে তুললো। জমিদার শ্রেণী এই ভাবনায় চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থায় তারা এ পর্যন্ত যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিলেন বাংলা বিভাগের ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা।

বাংলার প্রভাবশালী তৎকালীন হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণীর কাছে এ পদক্ষেপ ছিল চরম আঘাত। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে বাঙালি রাজনীতিবিদরা বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তকে অকৃতকার্য করার জন্য শপথ করলেন, ঐ ঘোষণাকে তারা বানচাল করবেনই। এই রাজনীতিবিদদের সাথে যোগ দিলেন জমিদাররা। তাদের ভয় ছিল, নতুন প্রদেশ জমির ওপর তাদের অবাধ অধিকার বা মালিকানা স্বত্বের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

ভঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলমান বিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনের তাগিদে যে সকল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন, তারা সবাই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমান বিরোধী। প্রথম দিকে, সেই আন্দোলনে হিন্দু বাঙ্গালীদের সাথে মুসলমান বাঙ্গালিরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল কিন্তু এই আন্দোলনের প্রাক্কালে, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় অনৈক্য এবং বিরোধ। বিশেষ করে তখনকার বাঙ্গালি হিন্দু নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব এই ঐক্যবন্ধনকে আঘাত করেছিল। তাঁরা শুধু সাধারন মুসলমানদেরই বিভ্রান্ত করে নাই বরং সাধারন হিন্দু সমাজকেও বিপথগামী করেছিল।

পরবর্তীতে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও উপমহাদেশ বিভক্তি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস ও করমচাঁদ গান্ধি উক্ত প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। পশ্চিম বাংলার দাদা বাবুরা ও অবিভক্ত বাংলার প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভারতে যোগ দান করে।

১৯০৫ সালে ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল মুসলমানদের সম অধিকার দিতে হবে বলে। ১৯৪৭ সালে তারাই বঙ্গভঙ্গ করে ভারতে যোগ দেয় মুসলমান দের সাথে থাকবেনা বলে। তারা অতীতেও মুসলিম বিরোধী ছিল, বর্তমানেও আছে। ওরা যদি হিন্দু হিসাবে গর্ব করতে পারে আমরা মুসলমান হিসেবে পারবনা কেন?

পরিশেষে, ১৯৪৭ সালের পর ২৫ বৎসরের পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে শোষণ, অবদমনে থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হয়ে, আমরা দুটি পৃথক পর্যায় পার হয়ে ভারত (১৯৪৭) ও পাকিস্তান (১৯৭১) পৃথক জাতিসত্তা নিয়ে আত্নপ্রকাশ করেছি। বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্ব কোন চমকের বিষয় নয়। বিবর্তনের সুনির্দিষ্ট ধাপ পেড়িয়ে আজ আমরা বর্তমানে পৌঁছেছি। এই দেশের জনগনের জাতীয় পরিচিতি নিয়ে আজ আর কোন সন্দেহ বা দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকার সুযোগ নেই।

আমরা মুসলিম হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষার্থে ভারত থেকে এবং প্রাচীন বাংলা’র বাঙ্গালি হিসেবে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়েছি। আমরা একাধারে বাঙ্গালী এবং অধিকাংশ মুসলমান। এই উভয় সত্ত্বাই আমাদের বৃহদাংশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিচিতি বহন করে। ইস্রায়েলী- আমেরিকান- জার্মান- ব্রিটিশ- ফরাসী ইহুদি বা ক্যাথলিক- প্রটেস্টাণ্ট খ্রিস্টান, তেমনি বাঙ্গালী, মারাঠি সহ ভারতের বিভিন্ন জাতের হিন্দু জনসাধারণের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিচিতি পাশাপাশি চলতে পারলে, বাঙ্গালী মুসলমান পরিচয় যারা গ্রহণ করতে চায়না, তাদের উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক।

এই উভয় পরিচিতিই আমাদের অধিকাংশের হৃদয় এবং সমাজের গভীরে প্রোথিত। এই পরিচিতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের সামাজিক কৃষ্টি এবং আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গত ৬ জুন ২০২২ নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক বছরের মাথায় তিন দিক ঘিরে রাখা প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রথম বারের মত সফরে আসেন এবং ৭ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবেন। ইতিমধ্যেই, “বাংলাদেশ-ভারত” সম্পর্কের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে বাংলাদেশে সকল পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে আছে। অধির অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশী সহ ভারত এবং এশিয়ার, এমন কি বিশ্বের অগণিত মানুষ। কি হতে যাচ্ছে মোদীর বাংলাদেশে আগমনের পর? বাংলাদেশ সরকার, সরকার সমর্থিত জনতার অংশ এমন কি বিরোধী দল সমূহও তাকে সম্বর্ধনা দিতে সেজে গুজে অধির অপেক্ষায় আছে। যেন মহানায়কের দর্শনে সকলেই ব্যাকুল, অপেক্ষায় অধির।

প্রটোকল অনুসারে, ঢাকা সফরকালে মুসলিম বিদ্বেষী, বিজেপি নেতা চরম সাম্প্রদায়িক এবং গুজরাট দাঙ্গার নায়ক হিসাবে পরিচিত মোদি বাংলাদেশি নাগরিকদের সামনে ‘ ভাষণ দেবেন। এর আগেও চীনসহ যেসব দেশ সফর করেছেন সবখানেই জনসম্মুখে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে এ ‘ভাষণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ধরেই নেয়া যায় যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে প্রশ্নবিদ্ধ সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও প্রশ্নবোধক করতেই নরেন্দ্র মোদি তার ভাবনা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবেন।

আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ সমাজের সামনেও বক্তব্য নিয়ে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই বক্তব্যে তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসার বিরুদ্ধে বার্তা দেবেন !!

সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার একান্ত আলোচনাতেও অগ্রাধিকার পেতে চলেছে সাম্প্রদায়িক রাজনিতিকের এই অসাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গটি।

কথায় বলে, ‘ভুতের মুখে রাম নাম’। উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির নেতা হিসাবে পরিচিত এই লোকটির এই বার্তার পিছনে কি উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, তা পরিস্কার। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে অবদমিত রাখতে এটা তার উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনৈতিক বার্তা।

এদিকে, ভারতের পদলেহী আওয়ামী সরকার আর কতিপয় বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রী দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে, স্বাধীনতার স্বপ্ন ধুলিস্মাত করে, সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে শাড়ীর আচল বিছিয়ে রেখেছে।

অথচ, স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ভারত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমল) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে আসছে।

ভারত প্রেমিকদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়েছে, তাই ভারতের সাত খুন মাফ। প্রয়াত আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরন ও মনোভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে লিখেছিলেন, ‘একদা উপকার করিয়াছি বিধায় চিরদিনের জন্য গোলামীর পাশে আবদ্ধ রাখিব।’ ভারতেরই গোয়েন্দা সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকর্তা তাঁদের জীবনীতে কখনো সরাসরি কখনো ইঙ্গিতে ভারত সরকার অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু কন্যা প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে গিয়েছেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পিছনে তাঁদের আসল উদ্দেশ্য এবং লাভ কি।

বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অপ্রতিবেশী সূলভ আচরনের কিছু নমূনাঃ
১। ফারাক্কা বাঁধ।

২। তিপাইমুখ বাঁধ।

৩। তিস্তার পানি বন্টন।

৪। স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন (৬৮ বছর পূর্বের আন্তর্জাতিক সীমান্ত চুক্তি)।

৫। সীমান্তে কাটাতারের বেড়া এবং নির্মমভাবে সাধারন মানুষকে হত্যা।

৬। সমতার ভিত্তিতে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ না দেয়া।

৭। উভয় দেশেই প্রচার মাধ্যমের অনুমতি প্রদান না করা, ইত্যাদি।

৮। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা।

৯। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা সদস্যদের গুপ্ত তৎপরতার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, ইত্যাদি।

নরেন্দ্র মোদীর আগমনে সম্ভাব্য দশটি নতুন চুক্তি ও সমঝোতার অন্তরালে:
 

নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রাক্কালে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাদেও হয়পছিলো আরো মোট ডজন খানেক নতুন চুক্তি ।

দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরের জন্য উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন, অভ্যন্তরীণ নৌ প্রটোকল নবায়ন, সমুদ্র অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ভারতকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও নিবিড় করতে এবার প্রথমবারের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হবে। বিশেষ করে নেপাল ও ভুটানে ভারত যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের কুমুদিনী ট্রাস্টের একটি পানি প্রকল্পের মাধ্যমে এটি শুরু করার কথা রয়েছে। দুই দেশের চুক্তি ও এমওইউর সংখ্যা সর্বমোট দশে দাঁড়াতে পারে।

৬৮ বছর পর স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন
১৯৪৭ সনে ভারত- বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থল সীমান্ত নির্ধারণ করার কারিগর ছিলেন স্যার সিরিল রেডক্লিফের নেতৃত্বাধীন বাউন্ডারি কমিশনের পাঁচ সদস্য। পরে সুইডেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এলগট ব্যাগি, মাদ্রাজ ও ঢাকা হাইকোর্টের দুই বিচারকের সমন্বয়ে করা একটি ট্রাইব্যুনালও এই সীমান্ত নির্ধারণে কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা কেবল লাল কালিতে দাগ টেনে সীমান্তরেখা আঁকিয়ে রেডক্লিফের কথাই জানি, এলগট ব্যাগিও আমাদের সীমান্তরেখা টেনেছিলেন। তাই, এটা ব্যাগি লাইন হিসেবে পরিচিত। বাউন্ডারি কমিশন ও ট্রাইব্যুনালের আট সদস্য, যাঁদের বেশির ভাগই ভারত ও পাকিস্তানের বিচারপতি ছিলেন, তাঁদের কাছেও আমরা ঋণী । দুই রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে (১৩ আগস্ট, ১৯৪৭) করা স্যার রেডক্লিফের একটি উক্তি আজ স্মরণযোগ্য: ‘আসাম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ভূখণ্ডগত কিছু বিনিময় অবশ্যই ঘটাতে হবে, কিছু অমুসলিম ভূখণ্ড পূর্ববঙ্গে, কিছু মুসলিম ভূখণ্ড আসামে যাবে।’ ৬৮ বছর পরে তাই চূড়ান্তভাবে ফলল। তাদের কাছেও আজ আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।

১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ এবং ভারতের কট্টরপন্থীরা এই সীমান্ত চুক্তি সুনজরে দেখেনি। নূন-নেহরুর চুক্তিটা হয়েছিল ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘ভারতীয় জনসংঘ, যেটি আশির দশকে বিজেপিতে মিশে গেছে এবং নূন- নেহরুর মূল চুক্তির প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল তারই পথ ধরে নরেন্দ্র মোদি আজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছে, । সংগঠনটি ওই চুক্তি বাতিলে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে জোর আইনি লড়াই পর্যন্ত চালিয়েছিল। ১৯৭৪ এর চুক্তি ১৯৫৮ এর চুক্তির কার্বন কপি।

ভারতীয় বিলের প্রস্তাবনায় ১৯৭৪ এর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল ছাড়াও ১৯৮২ ও ১৯৯২ সালের সীমান্ত চুক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলেও স্থলসীমান্তে অগ্রগতি ঘটেছিল। এই ৪১ বছরে পর্যায়ক্রমে মোরার্জি দেশাই, রাজীব গান্ধী, এইচ. ডি. দেবে গৌড়া, অটল বিহারী বাজপেয়ী, ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেছেন।

ভারত- বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পাবে মোট ১৭,১৬০.৬৩ একর জমির ১১১টি ছিটমহল এবং ভারত পাবে ৭,১১০.০২ একর জমির ৫১টি ছিটমহল। বাংলাদেশ ১০ হাজার একর বেশি জমি পেয়েছে বলে অনেকে অবাক হন। তাঁদের জানা দরকার যে, নূন-নেহরুর সীমান্ত চুক্তি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যখন শুনানি চলছিল, তখন ভারতের সরকার আদালতকে বলেছে, সংবিধান সংশোধন না করে ১৯৫১ সালের চুক্তির আওতায় আমরা তো ভুটানকে ৩২ বর্গমাইল জায়গা ছেড়ে দিয়েছি, যা ছিল আসাম অংশের।

একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করার পরও, তা বাস্তবায়নে ৬৮ বছরের বিলম্ব বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতিকদের জন্য লজ্জাজনক।

তালপট্টি নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধ করেছে। ১৯৭৪ সালেই ইন্দিরা শ্রীলঙ্কার কাছে ‘কাছাতিভু’ দ্বীপের মালিকানার দাবি ত্যাগ করেন। ২০০৮ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জয়ললিতা সংবিধান সংশোধন না করে ওই দ্বীপ হস্তান্তর অবৈধ দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে রিট করেন। মনমোহনজির সরকার আদালতে সাফ বলেছেন, ওটা সব সময় বিরোধপূর্ণ ছিল। কখনো ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। একই যুক্তিতে ভারত আমাদের ছিটমহলগুলোকে অনেক আগেই দেয়া উচিত ছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, ১৯৪৭ সনে নির্ধারিত ভারত- বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থল সীমান্ত চুক্তি, বহু পূর্বেই বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ভারত-বাংলাদেশের বর্তমানের প্রশ্নবোধক সম্পর্কে যদি কারো সাফল্য এসে থকে, তা একান্ত ভাবেই চানক্যের দর্শনে অনুপ্রাণিত উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতা মোদীর। বিনা যুদ্ধে দেশ দখলে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের দক্ষতা বিশ্বের অনেক আধিপত্যবাদী নেতাদের কাছে দৃষ্টান্ত সরূপ হয়ে থাকবে। বর্তমান বিশ্বে কোন দেশ দখল করতে হলে সে দেশের ভূমি দখল করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু সে দেশে সার্বিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ সৃষ্টি করার।

উক্ত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সফলতা অর্জনে স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বক্তারা আরও বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকাকালে রাষ্ট্র প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের মুখ দেখেছে। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন। ইতোমধ্যেই অনেকের বিচারের রায় হয়েছে, দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রবৃদ্ধি প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতি কি প্রকৃতপক্ষেই এমন?

নিম্নে কয়েকটি উদাহরন তুলে ধরা হলঃ
ক) দেশের গনবিমুখ অর্থব্যবস্থার ও জনসংখ্যার তুলনায় কর্মস্থল সৃষ্টিতে ব্যর্থতার কারনে, অগণিত মানুষ বেচে থাকার লক্ষ্যে জীবনের ঝুকি নিয়ে সমূদ্র পথে বিদেশের পথে পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্রে প্রান হারাচ্ছে। বিদেশী অজানা স্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে অগণিত মানুষ। শত সহস্ত্র মানুষ হচ্ছেন মানব পাচারকারীদের অর্থ লোভের শিকার। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফে উপকূলীয় বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৫০ হাজারের অধিক লোকজন মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। এর মধ্যে অনেকেরই সমুদ্রে সলিল সমাধি হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। কিছু লোক থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার জেলে বন্দি অবস্থায়ও মানবেতর দিন যাপন করছে।

খ) প্রথম আলোতে দেয়া মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকারে’র এক সমিক্ষায় প্রকাশ, এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অন্ততপক্ষে ৯৫ জন বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। তারমধ্যে শুধু মে মাসেই হত্যা করা হয়েছে ১৮ জনকে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, বিগত পাঁচ মাসে অন্ততপক্ষে ত্রিশ জন নাগরিক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় এবং আরও প্রায় ত্রিশ জন তাঁদের মাধ্যমে গুম হয়। উপরন্তু, বিগত জানুয়ারি থেকে, রাজনৈতিক সংঘাতের সময় অন্তত ১৩৭ জনকে হত্যা করা হয় এবং ৩৭৮৩ জন আহত হয়। এই সময়ে, ৪৬ জন সাংবাদিক আহত এবং ১৫ জনকে হুমকি দেয়া হয়। পাচ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।

অন্ততপক্ষে ২০ বাংলাদেশী বছরের শুরু থেকেই ভারতের সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) কর্তৃক হত্যার শিকার হয়। এছাড়াও, একই সময়ের মধ্যে, ২৯ জনক আহত এবং ১৬ জন কিডন্যাপ হয়। ভারতের সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) কর্তৃক সাধারন মানুষজনকে হত্যার জন্য ‘অধিকার’ ভারত সরকারের নিকট ক্ষতিপূরণের দাবি করা সমিচিন মনে করে।

গ) আবহাওয়া অনুকূল ও নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা থাকায় বিগত বছরগুলোর মধ্যে এবারও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে।

খাদ্য বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, দেশের সরকারি খাদ্যগুদামে চাল ও গমের মজুদ সাড়ে ১২ লাখ মে. টনের বেশি আছে। আমদানি-রফতানি বুরোর ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, এ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি চাল ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ লাখ ৯১ হাজার ৪১০ মে. টন চাল আমদানি করা হয়েছে। ১৩-১৪ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৪ হাজার মে. টন চাল। ১২-১৩ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছিল ২৯ হাজার মে. টন চাল।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা আরো জানান, দেশের চালের ঘাতটি নেই। উদ্বৃত্ত চাল আছে তার পরও ভারত থেকে শুল্কমুক্ত ১৩ লাখ টন নিম্নমানের পুরনো চাল আমদানি করায় ধান-চালের বাজারে মহা ধস নেমেছে। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বর্গাচাষি পরিবার। এসব পরিবার দায়-দেনা করে ফসল ফলায়। বোরো চাষ করে প্রতি বিঘায় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লোকসান গুনবে এবার বর্গাচাষিরা। তারা কোনোভাবেই এসব দেনা আর শোধ করতে পারবে না। এজন্য তাদের শেষ সম্বল বিক্রি করা লাগতে পারে। অপরদিকে, বোরো চাষ করে লোকসানে পড়বে ২১ লাখ প্রান্তিক চাষি, ১১ লাখ ক্ষুদ্র চাষি, সাড়ে ৬ লাখ মাঝারি চাষি। বর্গাচাষিরা তো ক্ষতির মধ্যে আছেই। তাহলে দেখা যায়, এ অঞ্চলের ৪৭ লাখ কৃষক পরিবার বোরো চাষ করে লোকসানের মুখে পড়ছেন। গত বছর ভুট্টা, পাট শীতকালীন সবজি চাষ করেও এসব কৃষক দরপতনের কারণে দেনাগ্রস্ত হয়ে আছেন। এ অঞ্চলের ৪৭ লাখ কৃষি পরিবারের ২ কোটি মানুষ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ থেকে নিস্তারে তাদের কোনো পথ খোলা নেই। অনেকের আশঙ্কা কৃষিপণ্য উৎপাদন করে এভাবে ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকলে বাংলাদেশের কৃষকদেরও ভারতের কৃষকদের মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হতে পারে।

নদীপথে ট্রানজিট প্রটোকলের সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরের সমূহ সম্ভাবনা
 
২৮ মে ২০১৫ যুগান্তরে প্রকাশ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সই এবং বাণিজ্য চুক্তির আওতায় নৌ ট্রানজিট প্রটোকলও সই হবে বলে জানান। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য চুক্তির ভূমিকায় তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের কথা রয়েছে সেকারনে, বাণিজ্য চুক্তি থেকে নৌ ট্রানজিট প্রটোকলকে আলাদা করার সুযোগ নেই।’
কিন্তু নৌ ট্রানজিট প্রটোকল সংশোধনীর খসড়ায় ভারত আপত্তি তুলে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়। খসড়া প্রস্তাবটি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ভারত এই আপত্তি তোলে। নতুন প্রস্তাবে ভারত নদীপথে ট্রানজিটের আওতায় তৃতীয় দেশে পণ্য চলাচলের বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। এছাড়া অপারেশনাল মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ বাড়ানোর বিধানও বাদ দিয়ে ওরা নতুন খসড়া পাঠিয়েছে।

ভারতের প্রস্তাব সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, নৌ প্রটোকল ট্রানজিটে অন্তর্ভুক্ত ছিল তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেয়ার বিষয়টি। এতে নৌপথে নেপাল ও ভুটান থেকে পাথর, কাঠসহ বিভিন্ন পণ্য কম খরচে পরিবহনের সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ভারতের ওই প্রস্তাব মেনে নিলে আমরা এসব সুবিধা পাব না। ভারতের আপত্তির কারনে বাংলাদেশ সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বলে জানা যায়। ভারতের নতুন প্রস্তাব গ্রহণ করতে হলে খসড়াটি আবার যাচাই-বাছাই (ভেটিং) এবং নতুন করে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের প্রয়োজন হবে বলে এ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

১৮ মে মন্ত্রিসভায় খসড়া প্রটোকল অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সংস্কার ও সমন্বয়) মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বলেন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকে টার্গেট করে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি ট্রানজিট প্রটোকলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, এতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চুক্তি, কনভেনশন কিংবা চর্চা প্রয়োগ করা এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ট্রানজিট গ্যারন্টি দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ভারতের দেয়া নতুন খসড়ায় পুরো এ বিষয়টি মুছে দিয়ে তাতে যে দেশের পণ্য পরিবহন করা হবে, তা ওই দেশের আইনে পণ্য চলাচলের বিধান প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। খসড়ায় বাংলাদেশের নদীপথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভারত বাংলাদেশকে বছরে ১০ কোটি টাকা দেয়ার বিধান রয়েছে। এই চার্জ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে বাড়ানোর কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ভারতের নতুন পরিবর্তিত খসড়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধির কথাও মুছে ফেলা হয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথে ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকলের অধীনে ১৯৭২ সাল থেকেই ভারত ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করছে। তিন বছর পরপর বাণিজ্য চুক্তি নবায়নের পাশাপাশি নদীপথে ট্রানজিট প্রটোকলও নবায়ন করতে হয়। এবার ওই প্রটোকলে সংশোধনীতে প্রতি চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর কোনো পক্ষ আপত্তি না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই চুক্তি নবায়ন হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নেপাল, ভুটান সহ অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণকে পাশ কাটিয়ে চুক্তি সম্পন্ন হলে, তাতে হবে শুধুমাত্র ভারতের স্বার্থ চরিতার্থ।

তাছাড়া, ভারতের জন্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে সন্মান হারানোর প্রশ্নটি তো থেকেই যাচ্ছে।ট্রানজিট সুবিধা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। একজন সতী নারীর কাছে তার সতীত্ব যেমন তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু, তেমনি বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বহুমুখী করিডোর দেয়াও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।

উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সমরাস্ত্র পরিবহনেও সময় লাগবে যেমন কম, তেমনি নিরাপত্তা ঝুঁকিও প্রায় শূন্যের ঘরে। এছাড়া ভবিষ্যৎ ভারত-চীন সংঘর্ষে চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর হবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও নিরাপত্তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখানে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর পেলে ভারতের পক্ষে নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন কমে যায়, তেমনি অর্থনীতিতেও চাপ অনেক কমে যায়। সুতরাং ভারত বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এবং রাজনৈতিক দলের উপর করিডোর পাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। ভারতের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই তাদের দেশপ্রেমিকতার পরিচায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি সর্বনাশ স্বরূপ। কথায় বলে, ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।’ ভারতের জন্য করিডোর প্রাপ্তি তাদের সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থের সহায়ক, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি মৃত্যুফাঁদ। সে জন্যই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পর্যন্ত সকলেই ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে অতীতে বাংলাদেশের দু’একটি মহল ছাড়া সকলেই ট্রানজিট বা করিডোর প্রদানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। অনেক রাজনীতিবিদ অতীতে বহুবার বলেছেন যে, ট্রানজিট বা করিডোর কোনো বিনিময়যোগ্য বিষয় নয়। তাই তারা বজ্র নির্ঘোষে ঘোষণা করেছেন, জান দেব, তবুও ট্রানজিট বা করিডোর দেব না। আজ কোনো কিছু না পেয়েই বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সহ সবকিছু উজাড় করে দেয়ার জন্য বসে আছে।

তাই, ভারতকে একক ভাবে দোষ দেয়া যায়না। বাংলাদেশের জনগন ভারতীয় নর্তকীদের নগ্ন উরু দেখতে দেখতে গদা খাওয়া পছন্দ করলে, ভারতীয় সেনাদের বুটের লাথি খেতে পছন্দ করলে তাঁরা তো সানন্দে এসব করবেই। অবাক হওয়ার কি আছে?

আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার। সরকার এবং তাদের লবির লোকজন অনেকদিন থেকেই ভারতকে এই ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য অনেক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষকে তারা সেটা গেলাতে পারেনি।

প্রবল প্রতিকূল জনমত লক্ষ্য করে বিএনপি থেকে শুরু করে ২০ দলের সমস্ত উল্লেখযোগ্য দল ট্রানজিট তথা করিডোর প্রদানের বিরুদ্ধে সেদিনও উচ্চকণ্ঠ ছিল। কিন্তু আজ রহস্যময় কারণে এসব দল, মনে হয়, তাদের রাজনীতিতে ইউ-টার্ন ঘটিয়েছে। এখন নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি সরকারকে খুশি করার এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির আর্শীবাদ পাওয়ার জন্য সরকার যেমন সবকিছু বিসর্জন দিতে উদ্যত হয়েছে, তেমনি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোও তাকে তোষামোদ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।

বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

সূত্র মতে, অতীতের সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়া সাক্ষাত না করার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেন সিনিয়র নেতারা। এবিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে  বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

সূত্রটি জানায়, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়া সৌজন্য সাক্ষাৎ না হওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হবে। বৈঠকে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে আলোচনা হলে প্রয়োজনে জামায়াতের  ব্যাপারেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল অব. মাহবুবুর রহমান বলেন,বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বৈঠকে অতীতের ভুল ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিনগুলোতে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পরিকল্পনা  করা হবে। দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মোদী সরকারের সহযোগীতা চাওয়া হবে। এতে জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার শর্ত এলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সেই প্রস্তাব  বিবেচনা করবে বিএনপি।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে খালেদা জিয়া স্পষ্টভাষায় বলেছিলেন,বাংলাদেশের মাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কখনো প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। এবিষয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেস্টা এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, বৈঠকে মোদী সরকারের কাছে আমরা বিভিন্ন ইতিবাচক প্রস্তাব দেব। মোদী সরকারও আমাদের কাছে কিছু প্রস্তাব এবং কিছু শর্ত দেবেন। আমরা ভেবে সেগুলো মেনে নেওয়ার চেস্টা করবো। বিশেষ করে করিডোরের নামে ট্রানজিট। সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তির বিষয়েও আমাদের জোর দাবি থাকবে।

দলীয় সুত্রটি আরও জানায়, ভারতে মোদী সরকারকে খুশি করতে আপ্রাণ চেস্টা চালাচ্ছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিজেপি নেতাদের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। কারন আসন্ন ৭জুন মোদি-খালেদা বৈঠকে সকল টানাপড়েনের যবনিকাপাত এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয় নিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা তৎপর হয়ে উঠেছেন।

বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী জনগোষ্ঠী হাজার হাজার গুম খুনের শিকার হচ্ছে, বাংলাদেশের পুরো বাজার ভারতের দখলে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ভারত ধংস করে দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ, পররাষ্ট্র আজ ভারতের নিয়ন্ত্রণে, এমনকি বাংলাদেশের মানচিত্র ও ভূমির প্রতিটি ইঞ্চিও ভারতের কব্জায়। কিন্তু জেনারেল জিয়ার দল উচ্চ কন্ঠ হচ্ছে না।

আসলে এদেশের মানুষ ভাগ্যহত। জাতীয় স্বার্থে ভারত সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের জনগণই ঐক্যবদ্ধ এবং আপোষহীন হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা বিশ্ব সমাজের কাছ থেকে এই শিক্ষাটুকুও গ্রহণ করে নি।

পরিস্থিতি দেখে ধারণা করা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রস্তাবই মেনে নিবে। তাই, সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যে, বাংলাদেশ আজ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে এবং একটি অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের আজ্ঞাবাহী রাষ্ট্রে পরিণত করার সকল পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের পূর্ন অনুমতি পেতে যাচ্ছে ভারত ইতিমধ্যেই, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ তৈরিতে প্রকল্পও হাতে নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ কানেকটিভিটির বিষয়কে বিশেষভাবে জোর দিয়ে আসছে। ভারতকে এ অনুমতি দিলে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোও যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করবে। যা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে বলে শেখ হাসিনা সরকার মনে করে।

পররাষ্ট্র ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রোববার এব্যাপারে নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ নিয়ে আরো আলোচনা হবে। জানা গেছে, এই চুক্তির বাস্তবায়ন হলে সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের সাতটি রাজ্যই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সরাসরি আমদানি-রফতানির সুবিধা নিতে পারবে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরার সাবব্রুম পর্যন্ত সরাসরি যোগাযোগের জন্য প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। রেল সংযোগ হচ্ছে আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত। এই রেলপথে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় মালামাল পরিবহন করা সম্ভব হবে। এ সুবিধা শুধু ত্রিপুরাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া-সিলেট হয়ে করিমগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সরাসরি মেঘালয়ে যেতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটিকে পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের সিংহভাগ ঋণ হিসেবে ভারত দেবে বলে জানা গেছে। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার ফলে মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ থেকে মংলা সরাসরি আসার পথ তৈরি হবে।

উল্লেখ্য,  ২০১০ সালের দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন। কিন্তু, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের পূর্ন অনুমতি পেলেও বাংলাদেশ অনুরুপ ভাবে কোলকাতা বন্দর সহ অন্যান্য ভারতীয় বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পাবে কিনা তা এখনও জানা যায়নি।

তবে, ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তিস্তা চুক্তির সঙ্গে থেমে যায় এই বন্দর ব্যবহারে অনুমতি বিষয়ক সম্মতিপত্র। ওই সফরে এ দুটি বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশকে রাজি করাতে না পারলেও এবার সে অনুমতি পাচ্ছে প্রতিবেশি দেশটি!!

প্রকৃতপক্ষে, ভারত-বাংলাদেশ সর্ম্পকের মধ্যে যে দেয়া-নেয়া তাতে বাংলাদেশ ভারতকে যে সুবিধা দিচ্ছে তাতে পাচ্ছে খুবিই কম এবং নরেন্দ্র মোদির এই সফর থেকে, বাংলাদেশ যা পাবে তার চেয়ে বেশি পাবে ভারত।

মোদী ইতিমধ্যে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশ ভূটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। ফালে এই চারটা দেশের মধ্যে একটা বলয় তৈরি হবে। যে বলয়তে আমরা হয়ত ভবিষৎতে দেখবো ভারতের একক কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত হবে। যতটুকু বলা হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি এসে ১০০ কোটি ডলারের একটা ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এ ঋণ নিয়েও প্রশ্ন আছে । কারণ এ যুগে সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিট নিয়ে কেউ ঋণ নেয় না, এমন কি ভারত নিজেও সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিটে ঋণ নেয় না। এইযুগে সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিটে ঋণ নেওয়ার ফলে ৭০% পণ্য ভারত থেকে আনতে হবে। ফলে এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হবে। ভারত এখন চাইবে ত্রিপুরা হয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে এবং সেকারনে ফেনী নদীতে ব্রীজ তৈরি করতে বলছে।

কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা, গৌহাটি-ঢাকা-শিলং সরাসরি বাস যোগাযোগ
মোদির আগমনে যেসব চুক্তি এবং সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা, তার মধ্যে রয়েছে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা সরাসরি বাস যোগাযোগ, চট্টগ্রামের রামগড় থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত, গৌহাটি-শিলং-ঢাকা বাস পরিসেবা এবং বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল মোটর ভেহিকেলস চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ইতিমধ্যে, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি রুটে শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫ থেকে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরু হয়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ৬ জুন সল্টলেকের আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল থেকে বেসরকারি পরিবহন সংস্থার প্রথম বাস ছাড়বে ঢাকা হয়ে আগরতলার উদ্দেশে। আগরতলা থেকে আসাম ঘুরে কলকাতা পৌঁছতে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে এই রাস্তা মাত্রই ৫০০ কিলোমিটারের সামান্য বেশী।

কয়েকদিনের মধ্যেই খুব কম সময়ে, সামান্য খরচেই ত্রিপুরার মানুষ আগরতলা থেকে ঢাকা হয়ে কলকাতায় চলে আসতে পারবেন। নতুন রুটটি চালু হলে একটি বাসেই কলকাতা থেকে আগরতলা পৌঁছন যাবে।

সোমবার ০১.০৬.২০১৫ থেকে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা পথে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরু হয়েছে। পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, সেদিন কলকাতার সল্টলেক থেকে সকাল ৯টায় বাসটি ছেড়েছে। বাসটি সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছে। এরপর দিন সকালে ঢাকা থেকে সকাল ১০টা নাগাদ বাস পৌঁছে আখাউড়ায়। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বেলা ১১টার মধ্যে বাস ত্রিপুরায় পৌঁছে। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা রুটে বাস চলাচল কিভাবে হবে, কোন দেশের কতটি করে বাস চলবে, ভাড়া কত হবে, এ সুযোগের বিনিময়ে বাংলাদশে কী পাবে ইত্যাদি বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে দায়িত্বশীল র্কমর্কতারা এখনই এ নিয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না।

কলকাতা থেকে এই সার্ভিস চালাবে পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহন নিগমের লাইসেন্সে শ্যামলী যাত্রী পরিবহন। ঢাকা থেকে বিআরটিসির লাইসেন্সে শ্যামলী পরিবহন এই সেবা চালাবে। কলকাতা ও আগরতলা থেকে এই বাস সপ্তাহে তিন দিন করে চলবে। কলকাতা থেকে বাস ছাড়বে সোম, বুধ ও শুক্রবার। আর আগরতলা থেকে বাস ছাড়বে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার।

বি.দ্রঃ ইদানিং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবিশেষ আলোচিত বিষয় ছিল, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম হওয়ার বিষয়। অনেকেই ধারণা করেন, গুম হওয়া ব্যাক্তিগনের গন্তব্য হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে, যদিও তাঁদের অনেকেরই কোন হদিশ পাওয়া যায় নাই।

২০০৯ সালের শেষের দিকে গবেষণা মূলক পত্রিকা “The Week” নেপাল এবং বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আই.বি এবং ‘র’ এর সম্মিলিত ভাবে পরিচালিত গুপ্ত তৎপরতা সম্পর্কে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, উপরোক্ত গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ উপরোল্লিখিত প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে অন্ততপক্ষে চারশত ‘snatch operation’ ‘ছিনতাই অপারেশন’ বা গুম-অপারেশন পরিচালিত করে। দীর্ঘ হস্তান্তর প্রক্রিয়া এড়ানোর লক্ষ্যে, ‘র’ বিভিন্ন দেশ থেকে সন্দেহভাজন ব্যাক্তিকে গুপ্ত ভাবে এরূপ ছিনতাই কর্মকান্ডের মাধ্যমে গ্রেপ্তার বা আটক করে। আটককৃত ব্যক্তিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিভিন্ন কায়দায় জেরা এবং অনুসন্ধান কর্ম পরিচালনা করে। আটক কৃত এরূপ সন্দেহভাজন ব্যাক্তি সম্মন্ধে ঐ সংস্থা সমূহ কোন তথ্য প্রকাশ করে না।

নেপালকে সন্ত্রাসীদের অতিক্রমণ পথ হিসাবে ধারণা করে, ‘র’ এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আই, বি নেপালে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করে। উক্ত পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশকে ‘র’ এবং আই,বি’র মাধ্যমে নেপাল, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ সমূহে অন্ততপক্ষে চারশত এধরনের ‘গুপ্ত ছিনতাই কর্মকাণ্ড’ সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করে।

ভারত- বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি বাস চলাচল শুরু হলে তাঁদের এরূপ ‘snatch operation’ এর পথ আরও সহজ হবে। তাতে, বাংলাদেশ সরকারেরও প্রতিপক্ষকে মারাত্নক ভাবে ঘায়েল করা আরও সহজ হবে। তার সাথে বৃদ্ধি পাবে ভারতের গুপ্ত সংস্থা ও সেনা সদস্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবাধ বিচরন। এখনই বা বাধা কোথায়? তবে তাঁদের সংখ্যা যে বৃদ্ধি পাবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি এ যাত্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫ এ প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি হবে বলে সংবাদ পরিবেশন করে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম আইবিএন। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রভাবশালী বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং এ তথ্য প্রকাশ করেন। তার মতে, চুক্তির শর্তগুলো (?) বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সহযোগিতা করবে।
মোদির সঙ্গে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সহ অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমাও।

তার সফর তালিকায় আরও চার রাজ্যের প্রধানরা থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপ্যাধায়ের আগমন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অতীতে মনমোহন সিংয়ের সফরকালে মমতা নিজেই সরে গিয়ে ছিলেন সফর থেকে। তখনও সম্পন্ন হয়নি বিতর্কিত তিস্তা চুক্তি যদিও এই চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার, দিল্লি বা সংবিধানিক কোন বাঁধা ছিল না। সরকার চাইলেই এই চুক্তি সই করতে পারত কিন্তু হয়নি। কারণটা ছিল- পশ্চিমবঙ্গ।

মমতা ব্যানারজির ৫ জুন বাংলাদেশে আগমন এবং ৬ জুন প্রত্যাগমন কিসের ইঙ্গিত বহন করে?

স্থল সীমান্ত চুক্তি সই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে সম্মত হলেও নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একই ফ্লাইটে ঢাকা আসছেন না ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সফর সূচি অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা আসছেন ৬ জুন। মমতা আসছেন ঠিক তার একদিন আগে ৫ জুন। আবার মোদির যাওয়ার কথা রয়েছে ৭ জুন। আর মমতা চলে যাবেন ৬ জুন।

কেন এমন শিডিউল তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে কূটনৈতিক অঙ্গনে। কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকা এক প্রতিবেদনে নবান্নে সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনো বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে চান না মমতা। তাই এমন সফরসূচি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল পর্যন্ত সফর সূচির যে পরিকল্পনা তাতে মমতা শুধু স্থল সীমান্ত চুক্তি সই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।

২০১১-এর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতাকে দায়ি করে তাঁর এরকম একগুয়েমিকে অগ্রাহ্য করার হুমকি দিলেও এখন নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন সমীক্ষা শেষেই কেবল ভারত সিদ্ধান্ত নেবে তিস্তার প্রবাহে ‘বাড়তি জল’ আছে কি না এবং বাংলাদেশকে আদৌ কোন জল দেয়া যায় কি না। তিস্তার প্রবাহ নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গীর ছাপ পড়েছে জল কমিশনের চেয়ারম্যান অশ্বিন পান্ডের বক্তব্যে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কলকাতায় গত ১৮ ডিসেম্বর রাজ্যের সেচ ও পানিপথ মন্ত্রী রাজিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের কতটা জল দরকার, বাংলাদেশের কতটা জল দরকার- তা প্রথমে নির্ণয় করা দরকার। এর জন্য কারিগরী ও আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা প্রয়োজন। সেই কাজ শুরু হলো।’
ভারতের নতুন এই ছল কৌশলে বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বিস্মিত- কারণ সম্ভাব্য চুক্তির খসড়া বিনিময়ের পর এখন নতুন সমীক্ষার কথা বলা হচ্ছে- যা পুরানো অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার কৌশল হিসেবে দেখছে তারা। তাদের শংকা সমীক্ষার আগে যেমন তিস্তার পানি নিয়ে আর কোন চুক্তি হবে না- তেমনি সমীক্ষার পরও ভারত এমন এক প্রস্তাব দেবে যা বাংলাদেশের তরফ থেকে চুক্তি স্বাক্ষর দূরূহ করে তুলবে। এদিকে, যদিও দুটি দেশের সরকারই এ মুহূর্তে গভীর বন্ধুত্বের অভিনয় করছে কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অমিমাংসিত সমস্যার তালিকা মোটেই কমছে না।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যর্থতার পাল্লাই বেশি ভারী। কারণ তিস্তায় পানি পাওয়া যাবে এই আশায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধাসহ তার চাহিদামত অন্যান্য সকল সুবিধাই দিয়ে দিয়েছে। অথচ, মনমোহনের সফরকালে চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না করে পিছু হটে যায়।

যদিও, ১৯৭২ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি বিষয়ক আলাপ-আলোচনা চলছে, যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকও হয়েছে ৩৮ দফা। ফলাফল প্রায় শূন্য, প্রাপ্তিও সামান্য। দুই সরকারের মেয়াদও একদফা শেষ হলো।  কেবল পানি প্রাপ্তিতে ব্যর্থতাই নয়- পানি বন্টন আলোচনায় কূটনৈতিক বিবেচনায়ও বাংলাদেশ সম্প্রতি বেশ পিছু হটে গেছে। এতদিন সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলেও দু দেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় পানির সংকটই থাকতো এক নম্বর বিষয়। সেই অগ্রাধিকার এখন পাল্টে গেছে। আলোচনার টেবিলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয় হয়ে উঠেছে ট্রানজিট ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ- যাতে বাংলাদেশের সরাসরি কোন স্বার্থ জড়িত নেই। দু’দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে গত ৬ বছরের বৈঠকগুলো অনুসরণ করলে দেখা যায়, সিদ্ধান্ত যা হচ্ছে তার সবই ট্রানজিট ও নিরাপত্তা বিষয়ে, আর পরবর্তী এজেন্ডাগুলোর ক্ষেত্রে (যেমন, পানি, বাণিজ্য ইত্যাদি) কেবল ‘আশাবাদ’ ব্যক্ত করা হচ্ছে- কূটনীতির ভাষায় যা কেবল একটি শূন্যগর্ভ শব্দ মাত্র।

২০১০ সালে শেখ হাসিনার সফরকালে বাংলাদেশ-ভারত যে যৌথ ঘোষণা প্রচারিত হয় তাতে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি ২৭ তম অনুচ্ছেদে স্থান পায়! গত দুই দশক ধরে ভারত চেষ্টা করছিল ‘পানির বিনিময়ে করিডোর’ সুবিধা আদায় করে নিতে। অতীতে গণমাধ্যমে এরূপ ‘প্যাকেজ ডিল’-এর কথা শোনা যেত। এখন বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে ভারত ‘জল না দিয়েই করিডোর’ সুবিধা পেয়ে গেছে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ পর্যন্ত পানি বিষয়ে একমাত্র চুক্তি হয়ে কেবল গঙ্গার পানি নিয়ে। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এ বিষয়ে সর্বশেষ চুক্তি হয়। সেই ইতিহাসের আলোকেই কূটনীতিবিদরা ভেবেছিলেন, পানি আলোচনায় এবারের আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও বোধহয় এক ধাপ অগ্রগতি ঘটবে, বিশেষত তিস্তার পানি নিয়ে। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পরও এইরূপ কোন চুক্তি না হওয়ায় এবং এখন তিস্তার পানি নিয়ে নতুন ‘সমীক্ষা’ শুরু হওয়ায়- এটা স্পষ্ট, অভিন্ন নদীগুলোর পানিতে ভারত বাংলাদেশকে আর কোনভাবে অধিকারের স্বীকৃতি দিতে চায় না।

কূটনীতিক সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালেই বাংলাদেশ সরকার তিস্তার পানির বিষয়ে সম্ভাব্য একটি চুক্তির খসড়া ভারতীয়দের কাছে জমা দিয়েছিল। ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী পাওয়ান কুমারও একই বিষয়ে তাদের তরফ থেকে সম্ভাব্য চুক্তির একটি খসড়া উপস্থাপন করেছিলেন। দুদেশের কোন সরকারই অবশ্য পেশকৃত চুক্তিগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ বাংলাদেশকে তিস্তার প্রবাহের ৪৮ শতাংশ পানি দিতে চাইলেও অপর অংশ চূড়ান্ত পর্যায়ে তাতে আপত্তি তোলে এবং শেষপর্যন্ত দিল্লীতে আপত্তিকারীদেরই জয় হয়।
বাংলাদেশ-ভারত আন্ত:সীমান্ত নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা বেশ খরস্রোতা। নীলফামারী দিয়ে এদেশে ঢুকে কুড়িগ্রামে যমুনার সঙ্গে মিশে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিস্তা প্রায় ৮৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে। বাংলাদেশ অংশে তিস্তা বেশি শাখা প্রশাখায় বিভক্ত নয়। বর্ষায় তার দৈর্ঘ্য কমে যায়। কারণ সরাসরি প্রবাহিত হয়। গ্রীষ্মে প্রবাহিত হয় একেবেকে। ফলে দৈর্ঘ্য তখন বেশি মনে হয়। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবাহ কখনো কখনো কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪-৫ শত কিউসেকে (কিউসেক = প্রতি সেকেন্ডে এক ঘন ফুট)। অথচ পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে শুকনো মৌসুমে অন্তত ৩২০০ কিউসেক পানি বইতে দেয়া জরুরি।
সীমান্তের প্রায় ৫০ মাইল উজানে গজলডোবায় নির্মিত ২১১.৫৩ মিটারের একটি ব্যারাজের মাধ্যমে একপাক্ষিক পানি প্রত্যাহারের কারণেই এই দুঃসহ অবস্থা। ব্যারাজ নির্মাণের পূর্বে সর্বনিন্ম পানি-প্রবাহ ছিল ন্যূনতম চার হাজার কিউসেক। গজলডোবার ব্যারেজের দুটি সেচ খালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে প্রায় নয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ভারত তিস্তার পানি সরিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমে মহানন্দা, মেচি, পুনর্ভবা, আত্রাই ইত্যাদি অববাহিকায় এবং সেটা শুষ্ক মৌসুমেও। তিস্তার পানি দিয়ে এভাবে দূরান্তের অববাহিকায় কৃষি কাজ চলছে। যা পুরোপুরি আন্ত:নদী সংযোগের মতো। যদিও বহুল আলোচিত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের মতো তিস্তার আন্ত:নদী খালগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে কখনো কোন আলোচনা হয় না। ১৯৮৭ সাল থেকে এইভাবে পানি প্রত্যাহার চলছে। শুষ্ক মৌসুমে ভারত প্রায় ৮৫ ভাগ পানি প্রত্যাহার করে নেয় তিস্তার প্রবাহ থেকে। এতে ভাটিতে কুচবিহারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদ্বেগের আরেকটি দিক হলো, ভারতীয়দের তিস্তা সেচ প্রকল্পে জলঢাকা, তিস্তা, মহানন্দা ও ডাউক নদীকে খাল দিয়ে যুক্ত করার কথাও আছে। অথচ প্রত্যেক নদীর অববাহিকার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা সেই নদীর অববাহিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে এটাই পানি ব্যবস্থাপনায় বিশ্বজুড়ে স্বাভাবিক বিবেচনা। কিন্তু এই রীতি রক্ষায় আন্তর্জাতিক কোন আইন নেই।
উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার সেচ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া মাত্রই ভারত গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণের কাজে হাত দেয় এবং  মাত্র দু’বছরে তার কাজ সমাপ্ত করে ফেলে। আর বাংলাদেশ তার সেচ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতেই সাত বছর সময় নেয়। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু এখন কার্যত ৪০-৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের পানি দেয়া যাচ্ছে। ১৯৯৮ সালে ব্যারাজের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। সেই থেকে এখন পানির প্রবাহ কমে গেছে চার ভাগের এক ভাগ। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই, পানি পাওয়া যাচ্ছে অন্তত চার গুন কম- আর সেচের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের হার মাত্র এক দশমাংশ। প্রকল্পের কেবল প্রথম পর্যায়ের এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পাঁচ হাজার কিউসেক পানি দরকার। কিন্তু সর্বোচ্চ পাওয়া যায় দুই-আড়াই হাজার কিউসেক। এটাও আবার অনেক সময় কমে যায়। তখন কৃষক গভীর নলকূপ থেকে পানি তোলে। তার জন্য বিঘা প্রতি ধান আবাদের খরচ বেড়ে যায় ৩-৪ হাজার টাকা। অথচ তিস্তার পানির জন্য দিতে হয় বিঘা প্রতি ১৬০ টাকা। এই হিসাব থেকে দেখা যায়, কেবল তিস্তার পানি বঞ্চনার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের সাধারণ কৃষকের শত শত কোটি টাকা ক্ষতির কারণ হয়েছে।
যেহেতু আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভাটিতে সেকারণে কোন ধরনের চুক্তি না থাকলে শুষ্ক মৌসুমে সম্ভাব্য প্রবাহ সম্পর্কে কৃষকরা কোন অনুমান করতে পারে না এবং সে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ পারের নদী অববাহিকায় চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। অববাহিকা অঞ্চলে জনসংখ্যা ও কৃষি জমির চাহিদা বিবেচনায় পানি প্রাপ্তির যে অধিকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুরের মানুষের ভাগ্যে তা জোটেনি কখনো। ফলে পানি শূণ্য পদ্মা পাড়ের মানুষদের মতো তিস্তা পাড়ের মানুষরাও এখন প্রায় পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর সেখানেও ক্রমে নামছে পানির স্তর এবং তাতে মিলছে জীবনবিনাশী নানা জৈব উপাদান। ফলে আন্ত:সীমান্ত নদীগুলোর বিপন্নতা পরোক্ষে বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রামে সৃষ্টি করছে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত নয়া এক দুর্যোগ। গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে তিস্তা পাড়ের পানি সংকটের কথা শোনা গেলেও জনস্বাস্থ্যের বিপন্নতার কথা একেবারেই আসে না।

স্থল সীমান্ত চুক্তি ছাড়াও আরো কয়েকটি অনুষ্ঠানে মমতার থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেসব অনুষ্ঠানে তিনি থাকবেন না বলে জানা গেছে। নরেন্দ্র সফর সঙ্গী হিসেবে মমতা আমন্ত্রিত হলেও তিনি মোদির সঙ্গে আসছেন না। তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ৭ জুন আলোচনা হতে পারে। এ নিয়ে মমতাকে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। তাই তিনি আগেই চলে যেতে চান।

তবে মোদির সফরে তিস্তা চুক্তি আদৌ হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মমতার ঘোরতর আপত্তি রয়েছে।

অবশেষে সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ভারতের তরফ থেকে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরকালে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সম্পর্কে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না।

বাংলাদেশকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব ভারতের হাতে?
যে সকল চুক্তি সমূহ সম্পন্ন হতে যাচ্ছে, তার মধ্যে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশে একটি আই টি সেন্টার স্থাপন করার লক্ষ্যে তথাকথিত ‘মউ’ চুক্তি সম্পন্ন করবে, যে আই টি সেন্টারের উদ্দেশ্য হবে, সাইবার অপরাধ রোধে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করা। এই ‘মউ’ চুক্তির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ পুলিশকে আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যাবহারের প্রশিক্ষণ দিতে বিভিন্ন এলাকায়, আই টি কেন্দ্র স্থাপন করবে।

গত বছর, ভারত সরকারের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে অবস্থানের প্রাক্কালেই এরূপ আই টি সেন্টার স্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। শুধু তাই নয়, ২০১২ইং সনের মে মাসেই ভারত সরকার বাংলাদেশের ৬৪ টি মডেল স্কুল সহ, বাংলাদেশ ‘সেনাবাহিনী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইন্সটিটুট’, বাংলাদেশ ‘পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার’ এবং বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমীতেও এ ধরনের আই টি ল্যাব স্থাপিত হবে।

এই চুক্তির মাধ্যমে, ভারতীয় কতিপয় এজেন্সি(?) ঐ সকল আই টি ল্যাবের প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সংখ্যক বিল্ডিং নির্মাণে সহায়তা করবে। উপরন্তু, ঐ সকল ল্যাবের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও ভারত সরবরাহ করবে।

বাংলাদেশ-ভারত অসম বানিজ্যিক সম্পর্ক
২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি ব্যায় ৪,৪৫ বিলিয়ন ইউ এস ডলার, যেখানে রপ্তানি ব্যায় একই অর্থ বছরে ৩৯৬,৪৩ মিলিয়ন ডলার।

২০১৪ সনের জুলাই-মার্চের বানিজ্যিক ঘাটতি হয় যথাক্রমে, রপ্তানী খাতে ২৮৪,৪৯ মিলিয়ন এবং আমদানি খাতে ৪,৪৫ বিলিয়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংক এর জনৈক কর্মকর্তা ‘নিউ এজ’ কে জানান যে, ২০১৫ সনের প্রথম ৯ মাস ভারতের সাথে বানিজ্যিক ঘাটতি সামান্য হ্রাস পেলেও, এই সময়ে ভারতে রপ্তানির পরিমান মোটেও সন্তোষ জনক ছিল না। বাংলাদেশ “পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট” এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ, মনসুর ‘নিউ এজ’ কে বলেন যে, রপ্তানি বানিজ্যের মাধ্যমে তুলনামূলক ভাবে সল্প আয়ের বিপরীতে আমদানীতে অধিকতর ব্যায়ের কারনে দীর্ঘদিন যাবত এই বানিজ্য ঘাটতি হচ্ছে।

বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীগনের রপ্তানীর বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক ভাবে ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে উচিত। তিনি আরও বলেন, বানিজ্য মন্ত্রনালয়কে ভারত- বাংলাদেশের মধ্যকার শুল্ক সংক্রান্ত জটিলতা দুর করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ব্যাবসায়ীগন ভারতে রপ্তানীর পরিমান বৃদ্ধি করতে পারেন। তাছাড়া, সরকারকে বাংলাদেশ ‘স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউসন’কে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যাতে সংগঠনটি রপ্তানি দ্রব্যের যথাযোগ্য ‘মান নির্ধারণ’ করতে সক্ষম হয়।

ইতিপূর্বে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম, ‘নিউ এজ’ কে জানান, ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের বানিজ্য ঘাটতি ছিল বিশাল, যেহেতু বিভিন্ন অ-শুল্ক বাধা ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানীকে সঙ্কুচিত করে রাখছিল। ব্যাবসায়ীগন, এই মর্মে বহুদিন যাবত তাঁদের দাবী তুলছিল কিন্তু ভারত সরকার এ বিষয়কে গুরুত্ব দেয়নি।

মির্জা আজিজ আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে দিল্লির সাথে অ-শুল্ক সংক্রান্ত বাধা দূর করার লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

‘এটা একটি সাধারন ধারণা যে, ভারতের অর্থনৈতিক শক্তির বিপরীতে বাংলাদেশে বানিজ্য ঘাটতি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু বহু বছর যাবত যেমন ঘাটতি হয়ে আসছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশকে স্থায়ী ভাবে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করতে
অনেক দিন থেকে পূর্ব প্রস্তুতি চলছে
অনেক বিষয়ই আপাতত বিচ্ছিন্ন বিষয় বলে মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে এ সকল বিষয়ই একই সূত্রে গাঁথা, একই বৃহৎ চিত্রের খন্ডাংশ মাত্র। যেমনটি, আমেরিকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন তার যুগে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উল্যেখ করেছিলেন, “when we see a lot of framed Timbers, different portions of which we know have been gotten out at different times and places, and by different Workmen . . . And when we see those Timbers joint together, and see they exactly make the Frame of a House or a Mill . . . In such a case we find it impossible not to believe that . . . All understood one another from the beginning, and all worked upon a common Plan, drawn up before the first blow was struck.”

ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন তথা নব্য ঔপনিবেশিক ব্যাবস্থার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। বাকি শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু দস্তখত। নিম্নে সে সব পূর্ব প্রস্তুতির কিছু নমুনা তুলে ধরা হল।

ক। বাংলাদেশে ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের জোড়াসাঁকোর সাম্প্রদায়িক, সামন্তবাদী, প্রজা উৎপীড়ক জমিদার ঠাকুর পরিবারের রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ?… “রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়” স্থাপন।

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে, যেখানে ভারতের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর আদলে নির্মিত হবে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়’। ৮ই মে ২০১৫ শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।

শান্তি নিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও পাঠ পদ্ধতির আলোকেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোর্স ও কারিকুলাম সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য ইতিমধ্যে একটি কমিটি ভারত গিয়েছিলো । রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, যেখানে বাংলাদেশে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং শান্তি নিকেতনে ‘বাংলাদেশ ভবন’ নির্মাণ করা হবে বলে চুক্তি হয়েছে। এর আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে কাজ করবে। (http://goo.gl/8AgJhB)

বাংলাদেশে যারা সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তাদের অনেকেই ঐ শান্তিনিকেতন থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাই শান্তিনিকেতনের ‘বাংলাদেশ শাখা’ খোলার মানে, বাংলাদেশের সংষ্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতির আলোকে পরিবর্তন করা। সেই ট্রেনিং নিয়ে তারা বাংলাদেশের জারি করতো ‘ধর্ম যার যার, পূজা সবার’।

শান্তিনিকেতন হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র,যা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের পিতা ধর্মচর্চার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয় (bn.wikipedia.org/wiki/শান্তিনিকেতন)

শান্তি নিকেতন হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম, যেখানে নানান ধরণের (`ধর্ম যার যার, পূজা সবার’ টাইপ : http://goo.gl/Tyw293) অনুষ্ঠান সারাদিন হতে থাকে এবং ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে। ঐখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যরা চারুকলা আর ছায়ানটে এসব শিক্ষা দেওয়া শুরু করে। যার কারণে ইতিমধ্যে হোলি উৎসব, দুর্গা উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, চড়ক উৎসব, সরস্বতী উৎসবের মত বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশেও জাতীয় উৎসব হিসেবে মর্যাদা পেতে শুরু করেছে।

শান্তিনিকেতনে নানান ধরনের উৎসব প্রতিনিয়ত হয়ে থাকে যেমন,

  • ধর্মচক্র প্রবর্তন
  • গান্ধী পুণ্যাহ
  • রবীন্দ্র সপ্তাহ, হলকর্ষণ উৎসব
  • বর্ষামঙ্গল
  • শিল্পোৎসব
  • রাখীবন্ধন
  • শারদোৎসব
  • খ্রিষ্টোৎসব
  • মহর্ষি স্মরণ
  • পৌষ উৎসব
  • দিপাবলি উৎসব
  • হোলি উৎসব, ইত্যাদি

এবার বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তৈরী হবে রেজওয়ানা বন্যা, চলবে ঘরে ঘরে সুরের ধারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হবে ‘রবীন্দ্র দর্শন’, বাংলাদেশের মানুষও তখন রবীন্দ্রের মত মারাঠা শিবাজীর প্রেমে মত্ত হবে, চাইবে অখণ্ড ভারত। বেশি না, ২০ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ আর মাঝের সীমানা মানবে না। দেবের মত চিৎকার করে বলবে, “দাও! দুই বাংলা এক করে দাও”।

ইতিহাস সাক্ষী, রবীন্দ্রনাথের পারিবারিকভাবে ছিলো বেশ্যালয়ের ব্যবসা। (তার দাদা দ্বারকানাথের শুধু কলকাতাতেই ছিলো ৪৩টি পতিতালয়, আনন্দবাজার পত্রিকার ১৪০৬ এর ২৮শে কার্তিক সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পতিতা খুব এনজয় করতেন। বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গার পাশে গঙ্গাজলীতে এসে, এক পতিতালয় দেখে কবিগুরু কবিতা লিখেছিলেন: “বাংলার বধূ, বুকে তার মধু”।

সেকারনে, পোড়ামুখ নিন্দুকেরা বলেন, ‘বুকে মধু’ ওয়ালা রমণী তৈরী করাই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথদের স্বার্থকতা। তাই সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্রবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে সেখানেও তৈরী হবে ‘বুকে মধু’ ওয়ালা রমণীরদের অভয়ারণ্য। তখন দৌলতদিয়া-সোনাগাছির মত সিরাজগঞ্জকেও এক নামে চিনবে বিশ্ববাসী।

অনেকেই সন্দেহ করেন, রবীন্দ্রবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে সংস্কৃতির মুখোশের অন্তরালে ভারত কেন্দ্রিক সংগঠন সমূহের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যেমন, ৪৭ এর আগের হিন্দু যারা দেশ ত্যাগ করেছিল এবং বর্তমানে তাদের ভুমি ভিটা অর্পিত সম্পত্তি, তারা আবার ফিরে এসে এদেশে তাদের বাড়ী ভিটা দাবী করবে। দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে। সরকার আন্তর্জাতিক ভাবে চাপে পরে সেই সব হিন্দুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। আর এতে বাংলাদেশে কিছু নতুন করে জেনেভা ক্যাম্প হবে আর তাদের বাসিন্দা হবে এদেশেরই নতুন কিছু ভূমিহীন মুসলিম। জেনেভা ক্যাম্প এখনও এদেশে আছে, তবে বিহারীদের জন্য। এদেশের মানুষের চেতনায় ওরা মুসলিম না, বিহারী। সেই চেতনাই এক সময় নিজেদের কিছু অংশকে জেনেভা ক্যাম্পে ঢুকাবে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করার জন্য
১) ভারত সরকার বহুদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে,
২) এ বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে ভারত সরকার নিজেও টাকা দিচ্ছে।
(তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল ৫ জানুয়ারি ২০১৩, দৈনিক ডেসটিনি ১৭ জানুয়ারি ২০১৩, বাংলামেইল ৮ই এপ্রিল, ২০১৪)

প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য ভারত সরকার এত আগ্রহী কেন ?? রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় গোয়েন্দা সংস্থার বাংলাদেশ শাখা নয়তো??

ফেসবুক কমেন্টঃ
জনৈক ফেসবুক সদস্য, শ্রী নিলয় ভৌমিক এর একটি কমেন্টঃ “বাংলাদেশে রবিন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ও দেশটা দখল করতে আমাদের দখল করতে খুব একটা সময় লাগবে না ৷ তাই বাংলাদেশের হিন্দুরা এ ব্যাপারে আমাদের পথ সুগম করেছেন আপনাদের ধন্যবাদ ৷ হরে কৃষ্ণ”

সিরাজগঞ্জে (ভারত সরকারের নির্দেশ ও সিলেবাসে) রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে বাংলাদেশের যে উপকারগুলো হবে…..

১) এতদিনে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের ইন্টলিজেন্স টিমকে একটি স্বীকৃত ভূমি দেওয়া যাবে, সেখানে তারা নির্বিঘ্ন চালাতে পারবে তাদের ট্রেনিং কার্যক্রম, কেউ ডিস্ট্র্রাব করবে না।

২) বিশ্ববিদ্যালটি প্রতি বছর হাজার হাজার ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছাত্র জন্ম দিতে পারবে। এতে খুব শিঘ্রই বাংলাদেশে ভারত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

৩) এক নতুন সাংস্কৃতিক রাজধানীর জন্ম হবে, যেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভারতীয় উৎসব (যেমন: দুর্গা উৎসব, সরস্বতী উৎসব, রাখী বন্ধন, হোলি উৎসব, দেওয়ালী উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তী) হতেই থাকবে। ফলে বাংলাদেশের আত্মভোলা জনগণ সারা বছর নাচ-গানে মত্ত থাকার সুযোগ পাবে।

৪) এতদিন ভারতের বিভিন্ন নায়ক-গায়করা (যেমন: নচিকেতা, পাউলি দাম, পাবর্তী পাল, সুচিত্রা সেন) এখানে-সেখানে গিয়ে চোখের পানি ফেলতো, আর বলতো, বাংলাদেশের ‘অমুক জমি আমার বাবা’র, তমুক জমি আমার দাদার’ (http://goo.gl/RwGARf)। এটা বন্ধুরাষ্ট্রের জন্য খুবই কষ্টকর। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হলে আশা করা যায়, তাদের আর বেশি ঘোরাঘুরি করতে হবে না। তারা সেখান থেকেই মিডিয়ার সামনে ‘বেছে নাও সিস্টেমে’ বাংলাদেশে পছন্দের জমিকে বাপ-দাদার ভিটা হিসেবে দাবি করতে পারবে এবং প্রশাসন তা বাস্তবায়ন করবে।

৫) বাংলাদেশে এখন কিছু দুষ্টু ছেলেপেলে বেড়িয়েছে, যারা কথায় কথায় বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের বিরোধীতা করে, কিন্তু কোন ছাত্রগোষ্ঠী ভারতের পক্ষে দাড়ায় না। এতে মাঝে মাঝে বন্ধুরাষ্ট্রটির সাথে মুখ কালাকালি হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হলে, বন্ধুরাষ্ট্রের স্বার্থ বিরুদ্ধ (তেল, গ্যাস, সুন্দরবন) নিয়ে কোন কথা হলেই লাফ দিয়ে দাড়িয়ে যাবে এর ছাত্র-ছাত্রীরা। পক্ষ নিবে বন্ধুরাষ্ট্রটির।

৬) ভারতীয় ‘মাল’ আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। খোদ মিডলইস্টের শেখরা পর্যন্ত বছরে একবার সেই মালের খোজে ভারতের ছুটে যায়। শান্তিনিকেতন আদলে রবীন্দ্রবিশ্ববিদ্যালয়েও অবশ্যই সেই প্র্যাকটিসটা জারি থাকবে। সেখানে রিজার্ভ থাকবে প্রচুর ‘মাল’। ফলে বাংলাদেশের কর্তাগুরুরা সেখানে গিয়ে নিয়মিত দিল ঠাণ্ডা করতে পারবে। ফলে সবাই সর্বদা খুশি থাকতে পারবে।

৭) শান্তিনিকেতন মানেই বাউল, আর বাউল মানেই সিদ্ধি, আর সিদ্ধি মানেই গাঁজা। তাই শান্তিনিকেতনের আদলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে, সিরাজগঞ্জ পরিণত হবে গাজাখোরদের প্রধান আখড়া হিসেবে। এতে বাংলাদেশে ভারতীয় গাঁজা ব্যাবসার প্রসার লাভ করবে। (শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশী গায়ক অর্নব এখন মাদক নিরায়ম কেন্দ্রের প্রধান রোগী) ।

৮) যে যত বেশি সংস্কৃতিপন্থী, তার মিডিয়া কভারেজ তত বেশি। শান্তিনিকেতনের আদলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হলে তা নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিবুঝা পোলাপাইনের মিডিয়া কভারেজ খাটো করতে পারবে।

৯) রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হবে, তাদের উজ্জল ভবিষ্যত হবে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানটির মত—-
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি.
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,. দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে! তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে ॥”

—————-মানে সবাই বাংলাদেশের চেতনা দিয়ে ভর্তি হবে, এরপর দুর্গা দেবির (ডান হাতে খড়্গ, বাম হাত অভয়, কপালে চোখ) প্রশংসা শুরু করবে, শেষে সোজা চলে যাবে মন্দিরে।

. . . . মসজিদ সমূহ হতে থাকবে শূন্য।

খ। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নীতি-নির্ধারকদের প্রস্তুত করতে সরকার ট্রেনিং করাচ্ছে ২২ জন অতিরিক্ত সচিবকে। এদের মধ্যে ১৪ জনই হিন্দু ….

  • ১) তপন কুমার কর্মকার, অতিরিক্ত সচিব অর্থ মন্ত্রনালয়,
  • ২) ড. রাখাল চন্দ্র বর্মণ, অতিরিক্ত সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়,
  • ৩) মানবেন্দ্র ভৌমিক, অতিরিক্ত সচিব খাদ্য মন্ত্রনালয়,
  • ৪) পুনাব্রত চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব, ভূমি মন্ত্রনালয়ে সংযুক্ত,
  • ৫) নিখীল চন্দ্র দাস, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, (অতিরিক্ত সচিব) জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়
  • ৬) জ্যোর্তিময় দত্ত, অতিরিক্ত সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে সংযুক্ত,
  • ৭) ইতি রাণী পোদ্দার, অতিরিক্ত সচিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়,
  • ৮) অমিত কুমার বাউল, অতিরিক্ত সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়,
  • ৯) অশোক কুমার বিশ্বাস, অতিরিক্ত সচিব, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে সংযুক্ত,
  • ১০) সত্য ব্রত সাহা, অতিরিক্ত সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়,
  • ১১) সুশান্ত কুমার সাহা, অতিরিক্ত সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়,
  • ১২) তন্দ্রা শিকদার, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়,
  • ১৩) সুখকর দত্ত, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়,
  • ১৪) জ্ঞান রঞ্জন শীল, পরিচালক (অতি: সচিব) বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন ।

বাংলাদেশ কি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তবে ‘সিকিম’ হওয়ার দিকে?

একটি উক্তিঃ
হাসিনা সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জনগণের অংশগ্রহণহীন এক ধাপ্পাবাজির নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত ও দীর্ঘায়িত করে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করে দেশকে ভারতের অধীনস্থ করেছে।

চুক্তিসমূহের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগন কতটুকু লাভবান হবে তা দেশবাসী জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করবে। তবে, এসব চুক্তি বাস্তবায়নে, লগ্নিক্রিত অর্থ লাভে যে ক্ষমতাসীন সরকার দলীয়ভাবে লাভবান হবে তাতে সন্দেহ নাই।- বদরুদ্দীন উমর

১৯৯০ এর গণতন্ত্রায়নের পর দেশের মোট চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট দুইটিতে জয়লাভকারী বিএনপি, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের বিপক্ষে চাতুর্যের খেলায় হেরে গিয়ে বিরোধী মঞ্চে দাড়িয়ে যখন ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নে অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল, অবরোধ দিয়ে ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’ নীতির অনুশীলন রত। এমনই বিশেষ পরিস্থিতিতে বিগত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তিনদিনের সফরে ঢাকা আগমন করেন।

মমতা বন্দোপাধ্যায়, পশ্চিম বঙ্গের অভিনেতা ও কলাকুশলীদের নিয়ে এফডিসিতে ‘বৈঠকী বাংলায়’ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের বাজারে ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাজার সম্প্রসারনের ইচ্ছা জানান এবং প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভোজ সভায় এ দেশে থাকা সত্ত্বেও কোলকাতায় কেন ইলিশ যাচ্ছে না এ নিয়ে প্রশ্নও করেন অথচ বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও দাবির ব্যাপারে শুকনো মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দেননি এমন কি পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের অনুমতি দেয়ার ব্যাপারেও কার্যকর কোনো আলোচনা করেননি তারা।

উক্ত ‘বৈঠকী বাংলা’ অনুষ্ঠানে কোলকাতার চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘এখন থেকে এপার বাংলা, ওপার বাংলা না বললেই বোধ হয় ভালো।’ অনুষ্ঠানে ছায়াছবির নায়ক দেব আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, … আমাদের স্বপ্ন এক, আমাদের ইচ্ছেটাও। সবকিছুই যখন এক, তাহলে আমরা দুই সরকারকে বলি যে প্লিজ, এপার বাংলা, ওপার বাংলাকে এক বাংলা করে দাও।’ যদিও একটি প্রশ্ন বাংলাদেশীদের কাছে স্পষ্ট নয় যে দেব ‘আমাদের’ বলতে কাদের বুঝিয়েছেন?

শুধু দেব নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই কোলকাতার বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা বাংলাদেশে এসেই ‘আমি বাংলার গান গাই’ বলে গদগদ চিত্তে বলে থাকেন, এই কাঁটাতার, সীমান্ত তুলে দাও, দুই বাংলা এক করো, ইত্যাদি। কিন্তু দুই বাংলাকে কীভাবে এক করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা ব্যাখ্য কেউই দেন না। দুই বাংলা এক বলতে যদি বাংলাদেশ সীমান্ত মুছে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিশে যাওয়া বোঝায় তাতে দুই বাংলা কখনো এক হয় না বরং বাংলাদেশ ভারতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু যদি সত্যিকার অর্থেই অখন্ড সার্বভৌম বাংলা যা শরৎবসু, সোহরাওয়ার্দীসহ মুসলিম লীগের নেতারা চেয়েছিলেন তা বোঝায়, তাহলে আজ পশ্চিমবঙ্গকে প্রথমে ভারত থেকে আলাদা বা স্বাধীন হতে হবে। তারপর আসবে এক হওয়ার কথা। দেবরা কি সেই বাংলার কথা বলছেন? সেই বাংলা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষই চেয়ে এসেছে সেই চল্লিশের দশক থেকে। তবে সেই বাংলা বাস্তবায়নের আগে আজকের নায়ক দেবকে জানতে হবে বাংলা কেন ভাগ হয়েছিল।

ভারতে বাংলার মুসলমান সমাজ ভাষাগত ঐক্যের বন্ধনে হিন্দু সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠই ছিলেন এবং এই ঐক্য বাংলার হিন্দু- মুসলমানদের, দুই ফুল হিসাবে একই বৃন্তে বেঁধে রাখতেও পেরেছিল। কিন্তু এই ঐক্য বেশি দিন টিকে থাকেনি।

হিন্দুগন, বিশেষত বাঙ্গালি হিন্দুগন যদি প্রথম থেকেই মুসলমান ভাইদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত, তাহলে বোধ করি ভারত থেকে ইংরেজদের বিতারন করার কাজ আরও তরান্বিত হতো। কিন্তু তাঁরা স্বার্থের সঙ্কীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে তো পারেই নাই বরং মুসলমান ভাইদের পিছনে ফেলে ঔপনিবেশিক শাসকের সাথে গাঁট ছাড়া বাধেন। তাঁদের ভারতীয় জাতীয় পরিচয়ের তুলনায় সুযোগ সন্ধানি চরিত্রকেই ফুটিয়ে তোলেন।

শ্রী বিমলানন্দ শাসমল ‘ভারত কি করে ভাগ হলো’ বইতে লিখেন ‘ইংরেজ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য বাড়লো বই কমলো না। তার তিনটি কারণের প্রথমটি হলো হিন্দু বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু ইংরেজি ভাষার সাহিত্য, দর্শনে পারদর্শিতা লাভ করে ইংরেজি সভ্যতা ও জীবন দর্শনকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু মুসলমানরা বিধর্মী শত্রুর ভাষা, সাহিত্য, দর্শনকে পরিত্যাগ করলেন ও মাদ্রাসাগুলোতে ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধ করে নির্দেশ জারি করলেন অনেকে। দ্বিতীয় হলো, ১৮৪৪ সালে ভারতের ইংরেজ শাসকরা সরকারি দফতরে আদালতে এতো দিনের প্রচলিত ফার্সি ভাষা তুলে দিয়ে ইংরেজির প্রচলন করলেন এবং তাতে বহু মুসলমানের জীবিকা নির্বাহের পথ চিরদিনের জন্য রুদ্ধ হলো, কিন্তু ইংরেজি নবিশ হিন্দুদের বরাত খুলে গেলো। তৃতীয়টি হচ্ছে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ইংরেজদের প্রিয়পাত্র হিন্দুরাই বেশির ভাগ জমিদারির মালিক হয়ে বসলেন এবং মুসলমানের বেশির ভাগ বিশেষত পূর্ব ভারতে চাষি ও প্রজা হয়ে জমিদারের অত্যাচারের বোঝা বইতে বাধ্য হলেন।

হিন্দু ও মুসলমানের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত এই বিরাট পার্থক্যটি যতদূর সম্ভব দূর না করতে পারলে, এদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল এবং সেটাই ভারতবর্ষের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সম্মিলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ঘটনার তীব্রতা অনুভূত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল জর্জ ন্যথনিয়াল কার্জন সেটা বুঝতে পেরে বাংলা প্রদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করবার ব্যবস্থা করলেন।

তিনি ছিলেন দৃঢ়তাসম্পন্ন একজন আত্মগর্বী মানুষ। সেই সঙ্গে কলকাতায় বাঙালি জমিদার ও আইনজীবীদের যে ভিড় একত্রিত হয়েছিল কার্জন তাদের ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই প্রজাতির লোকেরা সম্পূর্ণভাবে এক অকর্মন্য গোষ্ঠী। ভূমির মালিক জমিদারদের তিনি রক্ত শোষকের দল বলে মনে করতেন, যারা সহজে অর্জিত উদ্বৃত অর্থে আয়েশী জীবনযাপন করে। এই জমিদার শ্রেণীকে চিরস্থায়ী প্রথা সুযোগ এনে দিয়েছিল অসহায় এবং মূলত বাঙালি মুসলিম কৃষককুলকে নিঙ্গরে নেয়ার। শোষিত এই কৃষকরা ছিলেন প্রধানত পূর্ববঙ্গের অধিবাসী। কলকাতাকেন্দ্রিক আইনজীবীরা ছিল আরো ভয়ানক। তারা নিজেদের অর্থহীন ছিদ্রান্বেষণের দ্বারা শাসন প্রক্রিয়ায় অনবরত হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করতো। ভাইসরয় কার্জন এই দুটি দলেই ‘শ্বাসরোধ’ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি বাংলা ভাগ করার পরিকল্পনা নিলেন। এর দ্বারা হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব ক্ষুণ্ন করা যাবে বলে তার ধারণা। কারণ যে ক্ষেত্রে অন্য প্রদেশে অবস্থিত জেলাগুলো থেকে জীবন ধারণ ও বিলাস ব্যসনের টাকাকড়ি আসা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা একটি প্রদেশ ছিল। তিনি পশ্চিম বাংলা বিহার উড়িষ্যা এবং পূর্ব বাংলার আসামের অংশ বিশেষ নিয়ে দুটি প্রদেশ সৃষ্টি করলেন এবং এইভাবে মুসলমান প্রধান পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের শিল্প সংস্কৃতির পূর্ণবিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে দিলেন।

কিন্তু বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব সারা দেশের হিন্দু সমাজকে আলোড়িত করে তুললো। এই আন্দোলন বাংলা থেকে শুরু হয়ে ক্রমে সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘(ভারত কী করে ভাগ হলো)’ পৃষ্ঠা ১৮-১৯। পূর্ববঙ্গ আসাম নামের নতুন প্রদেশের বিরুদ্ধবাদীদের ব্যাপারে ড. অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন, ‘বিচিত্র উপাদান এবং নানাবিধ বৈশিক স্বার্থ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে।… জমিদার শ্রেণী যাদের পুরাতন এবং নতুন উভয় প্রদেশেই জমিদারি ছিল এই ভাবনায় চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থায় তারা এ পর্যন্ত যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিলেন বাংলা বিভাগের ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা। কারণ, আসামে সাময়িক ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারিত হতো এবং ত্রিশ বছর মেয়াদে এর পুনর্বিন্যাস করার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সুতরাং আসামের সঙ্গে পূর্ব বাংলা সংযুক্ত হলে পূর্ব বাংলার জমিদারদের রাজস্ব খাতে আয় হ্রাস নিশ্চিত। তার ওপর বাংলা বিভক্ত হলে ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের চাকরির সম্ভাবনা ও পরিধি সংকুচিত হবে, এইরূপ বাস্তব আশঙ্কায়ও অনেকে বিচলিত ছিলেন। এ আশঙ্কা অমূলক ছিল না। কারণ আইন ব্যবসায়, সরকারি চাকরি, শিল্প ক্ষেত্র ইত্যাদি ইতোমধ্যেই জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। সুতরাং ‘বেকারির ভয় বাস্তব’ (রবীন্দ্রনাথ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃষ্ঠা ১২১-১২৩, উচ্চারণ, কলকাতা, ১৯৮২)।

অশোক মিত্র লিখেন, ‘বাংলার প্রভাবশালী তৎকালীন হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণীর কাছে এ পদক্ষেপ ছিল তাদের মর্যাদাবোধের ওপর চরম আঘাত এবং এক অশুভ সংঙ্কেত।
ইন্ডিয়ার তফসিলী সম্প্রদায়ের নেতা বিআর আস্বেদ কর লেখেন, সারা বাংলা, উড়িষ্যা, আসাম এবং এমন কি যুক্ত উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত ছিল বাংলার বর্ণ হিন্দুদের চারণভূমি। এদেশের সবগুলো সিভিল সার্ভিসই তারা দখল করে নিয়েছিল। বাংলা বিভাগের অর্থ ছিল এ চারণভূমির সীমানা সংকোচন। বাংলা বিভাগের প্রতি হিন্দুদের এই বিরোধিতার মুখ্য কারণ হচ্ছে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের তাদের ন্যয্য অংশগ্রহণে বাধা দেয়া। (পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ১১)।

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক অর্থমন্ত্রী কলামিস্ট অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র লেখেন, কার্জনের বাংলা ভাগের এই ঘোষণায় শোলগোল শুরু হলো। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে বাঙালি রাজনীতিবিদরা বাংলা ভাগের সেটেল্ডফ্যাক্ট’কে ‘আনসেটেল্ডড’ করার জন্য শপথ করলেন, ‘ঐ ঘোষণাকে তারা বানচাল করবেনই। এই রাজনীতিবিদদের সাথে যোগ দিলেন জমিদাররা। তাদের ভয় ছিল, নতুন প্রদেশ জমির ওপর তাদের অবাধ অধিকার বা মালিকানা স্বত্বের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ আন্দোলনকে ঔজ্জ্বল্য দিয়ে প্রভাব বিশিষ্ট করে তুলছিলেন এর আবেগ প্রবণ দিক। এমন প্রচারণা চলে যে, মাতৃহত্যার প্রতিবাদ জানাতে বাঙালিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। বিশাল এক সাহিত্য বন্যা শুরু হয়। এর মধ্যে ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ডজন খানেক দেশত্ববোধক কবিতা ও স্ত্রোত্র’। (বঙ্গভঙ্গ রদ : বাঙালি হিন্দুর গর্ব কথা, না সর্বনাশের পাঁচালি)।

আমরা বুঝতে পারছি এসব ছাত্র এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বিমলানন্দ শাসনামল তার, ‘ভারত কি করে ভাগ হলো’ বইতে লেখেন, ভঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলমান বিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনের তাগিদে যে সকল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন, তারা সবাই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমান বিরোধী।’

প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় লেখেন, স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দুধর্ম ও আদর্শের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসলমান জনগণের মনেও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যেমন ‘ইসলাম প্রচারক’। ‘মিহির ও সুধাকর’ ‘হাফিজ’-এ মুসলমান লেখকরা প্রচার করতে লাগলেন যে, তিলক, অরবিন্দু, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ হিন্দুধর্মকে কেন্দ্র করে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা করছেন তা উগ্রভাগে ইসলাম বিরোধী।

প্রথম দিকে, সেই আন্দোলনে হিন্দু বাঙ্গালীদের সাথে মুসলমান বাঙ্গালিরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল। এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবেই সেদিন ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। হিন্দু নেতাদের সঙ্গে একাত্ন হয়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল, মওলানা আকরম খাঁ, মঃ ইয়াসিন, আবুক কাশেম প্রমুখ মুসলিম নেতা ও মুসলিম জনগন।

কিন্তু এই আন্দোলনের প্রাক্কালে, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার এই অপরিহার্য ঐক্যের স্থলে সৃষ্টি হয় অনৈক্য এবং বিরোধ। বিশেষ করে তখনকার বাঙ্গালি হিন্দু নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব এই ঐক্যবন্ধনকে আঘাত করেছিল। তাঁরা শুধু সাধারন মুসলমানদেরই বিভ্রান্ত করে নাই বরং সাধারন হিন্দু সমাজকেও বিপথগামী করেছিল।

হিন্দু নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মধারা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল, সে বিভ্রান্তি থেকে দুই বাংলার মানুষজন আজও মুক্ত হতে পারেনি এবং আর কোনদিন যে মুক্ত হতে পারবে না তাও ধরে নেয়া যায়।

স্বদেশী আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন ক্রমান্বয়ে স্বদেশী আন্দোলনে সম্প্রসারিত হতে থাকে, তখন শুধু বঙ্গভঙ্গ রোধ করা নয়, এদেশ থেকে “ইংরেজ রাজত্বেরই অবসান ঘটাতে হবে”- এই সংগ্রামী চেতনায় দেশবাসী উজ্জিবিত হয়। সৃষ্টি হয় ‘অনুশীলন’ এবং ‘যুগান্তর’ দলের মতো বিপ্লবী সংগঠনের। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে, সেই বিপ্লবী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে বিপ্লবী চরিত্রের স্থলে ক্রমান্বয়ে জন্ম নেয় নানারূপ উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং ক্রমান্বয়ে এ সংগঠন গুলোর মধ্যে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।

এ সংগঠনের নেতৃত্বে সারাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় অসংখ্য ভবানী মন্দির। ভবানী মন্দিরে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা দেবী ভবানী বা কালীর সামনে উপবেশন করে মাথায় গীতা ও তরবারী রেখে বুকচিরে রক্ত দেবী কালীর পায়ে নৈবেদ্য দিয়ে মন্ত্র জপের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক ভাবে শপথ নিয়ে সদস্য হতেন। বঙ্কিম চন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’* জাতীয় শ্লোগান হিসেবে প্রচলিত হয়ে পড়ে। তখন যেসব মুসলমান তরুণ এগিয়ে এসেছিলেন, খুব স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা ধীরে ধীরে যে শুধু ঐ সকল সংস্থা থেকে সরে দাঁড়াতে লাগলেন, তাই নয়, একটা ধারণা ক্রমান্বয়ে তাঁদের মধ্যে বেশ বদ্ধমূল হতে থাকে যে, হিন্দুরা এ আন্দোলনকে শুধু হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে প্রয়াসী।

*বন্দে মাতরম্, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৮২ সালে রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান। সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লিখিত এই গানটি দেবী দুর্গার বন্দনাগীতি। শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম্ গানটিকে “বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত” (“National Anthem of Bengal”) বলে উল্লেখ করেন। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে ১৭৭০-এর দশকের বাংলার মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে। স্বভাবতই ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতটি মুসলিমবিরোধী। মিছিলে ও সভা-সমিতিতে এ সঙ্গীতের ব্যাপক ব্যবহার মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হানে এবং পরিণতিতে বাংলার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূচনা করে। (আইএইচ কোরেশী : দি কজ অভ দ্য ওয়ার অভ ইন্ডিপেনডেন্স, পৃ-১৭০; আরো দেখুন, ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন, মুহম্মদ ইনাম উল হক, পৃ-১৩৯)।

১৮৯৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গীত হয় বন্দে মাতরম্; উক্ত অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এ সময়েও বাঙ্গালি হিন্দুরা ভারতের স্বার্থ নিয়ে ততটা মাথা ঘামাননি যতটা ঘামিয়েছেন হিন্দুদের স্বার্থ নিয়ে। তাঁরা একদিকে “সর্বভারতীয়” অন্যদিকে “বাঙ্গালি” জাতীয়তাবাদকে সম্পূর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে সচেষ্ট হয়। সুতরাং স্বাধিকারের মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে অ-হিন্দুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের সেখানে প্রবেশের কোন সুযোগ রইলনা।

এভাবেই, কোলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন’, ‘অখন্ড স্বাধীন ভারতের’ সম্ভাবনাও নস্যাৎ করে ভারতবর্ষের বুকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টির বীজ বপন করে। তাঁদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে বাঙালি মুসলমানরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আলাদা রাজনৈতিক ফোরামের কথা চিন্তা করে। বিমলানন্দ শাসমলের মতে, ‘বাংলা ও ভারতের প্রবল হিন্দু জনমতের কাছে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ পরিত্যক্ত হওয়ায় মুসলমানদের মনে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলে মুসলিম লীগের জন্ম হয়’। (স্বাধীনতার ফাঁকি, বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা-৬৫)।

সাম্প্রদায়ীকতার বিষবাষ্প দ্রুত বাংলার আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলল। অথচ হিন্দু সমাজ সেদিন যদি মুসলমান সম্প্রদায়কে জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে টেনে নিতে পারতেন, তাহলে শুধু বাংলা কেন, সমগ্র ভারতের ইতিহাসই অন্যভাবে লিখিত হতো।

অবিভক্ত ভারতে হিন্দু সমাজ মুসলমান সমাজকে কোন দৃষ্টিতে দেখত এবং তাঁদের সাথে কেমন আচরন করতো তার কিছু উদাহরন নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
কলকাতা ভিত্তিক তৎকালীন হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের একটা কমন ডায়লগ ছিল ‘আপনি বাঙালী না, মুসলমান’।

পূর্ব বাংলার মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাঙালী কবি ভাবলেও, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাদের বাঙালী ভাবতেন না, ভাবতেন- ‘মুসলমান’ ও ‘প্রজা’। তাদের চোখে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই ছিলো প্রকৃত ‘বাঙালী’। রবীন্দ্র নাথ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন, কারন বাংলা ভাগ হয়ে গেলে পূর্ব বাংলার প্রজাদেরকে জমিদারীর মাধ্যমে শোষনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং পূর্ব বাংলার প্রজা গন আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল হয়ে উঠবে! এ ভয়ে দেশপ্রেমের ধোঁয়া তুলেছিল রবীন্দ্রনাথ সহ কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু সমাজ।

বাংলাদেশীদের অতি প্রিয় রবী ঠাকুর, কুষ্টিয়ায় দীর্ঘদিন জমিদারী করলেও সেখানে একটি প্রাথমিক স্কুলও সে কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করেনি, শান্তি নিকেতন করেছে কলকাতায়, এমনকি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করেছিলেন। ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে তিনি মুসলমান শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘যবন’ (অসভ্য) ও ‘ম্লেচ্ছ’ (অপবিত্র) প্রভৃতি শব্দ।

বাস্তবিক অর্থে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আগাগোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। এজন্যই ভারতবাসী তাকে জাতীয় কবি হিসেবে মেনে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় মারাঠা নেতা শিবাজীর প্রসংশা করেছেন, যেই শিবাজীর মতাদর্শে এখন ভারতের রাজনৈতিক দল হচ্ছে শিবসেনা (http://goo.gl/9TIHNw)। কবির বক্তব্যের সাথে তাই শিবসেনার বক্তব্য প্রায় মিলে যায়। কবির ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নামক নাটকে প্রতাপাদিত্যের উক্তির মাধ্যমে তার মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব স্পস্ট হয়ে উঠে যেমন,- ‘খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।’ অথচ বাংলাদেশের জনসাধারনের নিকট তাকে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সূচনা হয়েছিলো জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারের হাত ধরেই। তাদের অর্থায়নে সূচিত হয়েছিলো ‘হিন্দু মেলা’ (বাংলাপিডিয়া: http://goo.gl/rrLTCN)। পরবর্তীতে এ হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে `জাতীয় সভা’। এসভায়, কোন মুসলমান, খ্রিস্টান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার ছিল না। হিন্দুমেলার প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা, আর কবি রবিন্দ্রনাথ ছিলেন সেখানে সক্রিয় সদস্য।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ১৯০৫ সালের ২৪ ও ২৭শে সেপ্টেম্বর দুটি সমাবেশের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং ১৬ই অক্টোরব ‘রাখীবন্ধন’ নামক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হিন্দুদের কি স্বার্থ ছিলো? এর উত্তরে বিমলানন্দ শাসমল ‘ভারত কী করে ভাগ হলো’ নামক বইয়ে লিখেছে-
“ডঃ আম্বেদকর লিখেছেন: বাঙালী হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধীতা করার প্রধান কারণ ছিলো, পূর্ববঙ্গে বাঙালী মুসলমানরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে” (সূত্র: বই-‘ভারত কী করে ভাগ হলো’, পৃ:২৫; এ এক অন্য ইতিহাস-১৫৮)

রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ বিরোধীতার মূল কারণ ছিলো, এ অঞ্চলে ঠাকুর পরিবারের বেশিরভাগ জমিদারি। বঙ্গভঙ্গ হলে তাঁদের জমিদারীর ক্ষতি হয়ে যাবে। যেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সে। এ অঞ্চলের মানুষের রক্তচুষে খেয়ে বেচে থাকতো ঠাকুর পরিবারের মত জমিদাররা। তারা নানান অজুহাতে প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করতেন। যেমন:
  • —–গরুর গাড়ি করে মাল নিলে ধূলো উড়তো, তখন ‘ধূলট’ নামক কর দিতে হতো
  • —–প্রজারা নিজের যায়গায় গাছ লাগলেও এক প্রকার কর দিয়ে গাছ লাগাতে হতো। সেই করের নাম ‘চৌথ’।
  • —– গরীব প্রজারা আখের গুড় বানালে এক প্রকার কর দিতে হতো। তার নাম ‘ইক্ষুগাছ কর’।
  • —-প্রজাদের গরু-মহিষ মরে গেলে ভাগাড়ে ফেলতে হলে কর দিতে হতো। তার নাম ‘ভাগাড় কর’।
  • —– নৌকায় মাল উঠালে বা নামালে দিতে হতো ‘কয়ালী’ নামক কর।
  • —–ঘাটে নৌকা ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ‘খোটাগাড়ি কর’
  • —–জমিদার সাথে দেখা করলে দিতে হতো ‘নজরানা’।
  • —– জমিদার কখন জেলে গেলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে উল্টো প্রজাদের দিতে হতো ‘গারদ সেলামি’। (সূত্র: বই-গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, লেখক: স্বপন বসু)

রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সম্পর্কে অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন:
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। তার দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর জবরদস্তি করে আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্যার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিলো। (সূত্র: জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা, অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী)

এসব ছাড়াও,পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসী বিশেষ করে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মহল পূর্ব বাংলার মানুষকে অচ্ছ্যুত ও যবনের বংশ হিসেবে বিবেচিত করতো।

কোন ব্রাহ্মন এপার বাংলায় বেড়াতে এসে ফেতর গেলে তাকে বিশেষ পন্থায় শুদ্ধ হতে হতো, ইত্যাদি।

পূর্ব বাংলার মানুষ রবীন্দ্রনাথ সহ কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু সমাজের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে তাঁদের রায় দিয়ে “সোনার বাংলা” গান (বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত) প্রত্যাখ্যান করেছিল। বঙ্গভঙ্গ হলে আসাম ও বাংলার রাজধানী হবে ঢাকা এবং ঐ বঙ্গে মুসলমানরা হবে সংখ্যাগুরু। তাই নবাব সলিমুল্লাহ’র নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের এবং ভারতের বহু মুসলিম নেতাই বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেন।

যে সব মহা মানবদের নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত সংগ্রামের মাধ্যমে আজ বাংলাদেশের মানচিত্রের রূপ লাভ হয়েছে, সেই সব মহা মানবদের সকলেই ছিলো বঙ্গভঙ্গের পক্ষে এবং রবীন্দ্রনাথ গংদের হিন্দু স্বার্থবাদী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন দেখেই তারা বুঝতে পেরেছিলেন, এ অঞ্চলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসস্থলের কোন বিকল্প নাই।

ব্রিটিশ শাসনের ক্রান্তি লগ্নে
ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও উপমহাদেশ বিভক্তি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত না করে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। শরত্ বোস (নেতাজী সুভাস বোসের সহোদর) কিরণ শংকর রায় (তত্কালীন বাংলার আইনসভার কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা), সত্য রঞ্জন বকশি (শরত্ বোসের একান্ত সচিব), আবুল হাশিম (সাধারণ সম্পাদক, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ), ফজলুর রহমান (রেভিনিউ মন্ত্রী, প্রাদেশিক সরকার), মোহাম্মদ আলী চৌধুরীসহ (সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী) বহু হিন্দু-মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবী অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হন। অবিভক্ত বাংলা বলতে বোঝানো হয় পুরো বাংলা ও আসাম এবং বাংলা সন্নিহিত বিহার প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পুর্নিয়া জেলা। এমন কি মোহাম্মদ আলী জিন্নাও উক্ত প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস ও করমচাঁদ গান্ধি উক্ত প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। পশ্চিম বাংলার দাদা বাবুরা ও অবিভক্ত বাংলার প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভারতে যোগ দান করে।

“২৩ এপ্রিল জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের মধ্যে পাঞ্জাব ও বাংলাভাগের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলো। মাউন্টব্যাটেন স্বীকার করলেন যে, বাংলায় ভাগ বন্ধ হতে পারে… একটি শর্তে যে, বাংলা পাকিস্তান বা ভারতে যোগ দেবে না। সে কথার উত্তরে জিন্নাহ মাউন্ট ব্যাটেনকে বলেছিলেন যে, তিনি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলাকে স্বাগতম জানাবেন। কারণ কোলকাতা না পেলে বাংলাদেশের বাকি অংশ নিয়ে কী লাভ হবে?… ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সহযোগিতায় বাংলাভাগের যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তা প্রতিহত করার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ণ দায়িত্ব দেন।’ (পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি : কামরুুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা-৮৯)।

ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।’ (পৃষ্ঠা-৩৬)। অখন্ড বাংলার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ করেছেন এভাবে, “এই সময় শহীদ সাহেব, হাসিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎবসু ও কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যায় কিনা? শহীদ সাহেব দিল্লীতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তারা অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এ ফর্মুলা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎবসু দিল্লীতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎবসু নিজে লিখে গেছেন যে, জিন্নাহ তাকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎবাবু কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটল তাকে বলেছিলেন, ‘শরৎবাবু পাগলামী ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই। মাহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু কিছুই না বলে তাকে সরদার প্যাটলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটল তাকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎবসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথাও স্বীকার করেছিলেন’।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা-৭৪)। এরপর ‘শরৎবসুকে ১৯৪৭ সালের ৮ জুন লিখিত এক চিঠিতে গান্ধী জানিয়ে দেন যে, তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে নেহেরু ও প্যাটেলের সাথে আলোচনা করেছেন এবং এই উদ্যোগের প্রতি তাদের সম্মতি নেই। গান্ধী তার এই চিঠিতে শরৎবসুকে অখন্ড স্বাধীন বাংলার গঠনের পরিকল্পনা ত্যাগ করার জন্য বাংলা ভাগের বিরোধিতা হতে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দেন।’ (বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা-২৮২-২৮৩)।

কতো বিচিত্র তাঁদের চরিত্র, যারা ১৯০৫ সালে অখন্ড বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল, তারাই আবার ১৯৪৭ সালে যখন সত্যিকার অখন্ড বাংলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো, তখন এর প্রবল বিরোধিতা করে বসলো। বিমলানন্দ শাসমলের ভাষায়, ‘১৯৪৭ সালে মুসলমানরাই চাইল অবিভক্ত বাংলা আর হিন্দুরা চাইলো বাংলা বিভাগ। ১৯০৫ সালে কার্জন যা চেয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে হিন্দুরা স্বেচ্ছায় সে প্রস্তাবকে কার্যকরী করলো।’ (ভারত কী করে ভাগ হলো, বিমলানন্দ শাসমল, ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।

তাই, মুসলমান সমাজের প্রতি পশ্চিম বঙ্গের এবং কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়, প্রভাবশালী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের যে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরন, তাঁদের কাছ থেকে, মুসলমানদের সাথে মিল হয়ে ভারতের সীমানার বাহিরে এক বাংলার জন্য সংগ্রামের আশা অতিতেও করা যায়নি এবং ভবিষ্যতেও করা ঠিক হবে না।

উপরন্তু, ধর্মীয় কৃষ্টির প্রভাবে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের মানুষজনের ভাষা বাংলাও ভিন্ন বৈশিষ্ট ধারন করে, ধর্মীয় একাত্নতার অভাব তাঁদের মধ্যে তো আছেই।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ প্রয়াত আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়, “ঐতিহাসিক পূর্ব বাংলার কৃষ্টি পশ্চিম বাংলার কৃষ্টি থেকেও স্বতন্ত্র। …এক ভাষাভাষী হওয়া স্বত্বেও দুই দেশের সাহিত্য পরিষ্কার ভাবে বিভিন্ন। … রেস ভাষা ও কৃষ্টিতে বাংগালী হইয়াও পশ্চিম বঙ্গের বাংগালীরা ভারতীয়।

বহু ধর্ম, ভাষার রাষ্ট্র ভারত যদি প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাধিকারের ভিত্তিতে বহু কৃষ্টির দেশ হিসাবে উদাহরন সৃষ্টি করতে পারতো, তাহলে উপমহাদেশে একই মডেলে অনেক রাষ্ট্রই তাকে অনুসরন করে লাভবান হতো শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষই খন্ডিত হতোনা। কিন্তু ভারত সে ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এক মহল বিভিন্ন পরিচয়ে, বিভিন্ন কৌশলে নেহেরু ডকট্রিন বাস্তবায়নের ইজারা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং আমাদের বাংলার নতুন প্রজন্মকে অপাংক্তেয় বাংলার নতুন এক ঐতিহাসিক ফাঁদে ফেলতে ব্রেইন ওয়াস করে চলেছে।

এতএব, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা-রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগনের জন্য, পশ্চিমবঙ্গের নব্য বাংলা প্রেমিকদের একবাংলা প্রতিষ্ঠার দাবী ও যুক্তির ফাঁদে পা না দিয়ে যেমন আছে তেমন থাকাই ভালো। তা না হলে, যুক্তবাংলার পথ ধরে কষ্টার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে সিকিম, ভুটান, নেপালের পথ ধরে আধিপত্যবাদী ভারতের অঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের অবস্থা ১৯৪৭ সালের ভারতের অংশ বাংলায় পরিণত হবে, অর্থাৎ যেখানে পৃথিবীর অন্য সকল জাতি এগিয়ে যেতে থাকবে সম্মুখ দিকে আর আমরা ফিরে যাব অতীতের অন্ধকার গহ্বরে।

পরিশেষে, কোলকাতার বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের অনুরোধ করবো, তাঁদের এক বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবীর স্বপক্ষে নতুন প্রজন্মের মগজ ধোলাই করার আগে নিজেদের দাবীকে ইতিহাসের আলোকে যাচাই করে নিন, অন্যথায় কেউ যদি আধিপত্যবাদী ভারতের এজেন্ট হিসাবে আপনাদের উদ্দেশ্যে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাতে দোষের কিছু থাকবে না।

উপরন্তু, পূর্ব বাংলার জনগন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে রায় দিয়ে যে “সোনার বাংলা” গান প্রত্যাখ্যান করেছিল, সে একই গান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহন করাটা প্রশ্নবোধক নয় কি?

ভারত প্রজাতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে একটি বহুজাতিক দেশ। সাংবিধানিকভাবেও ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। বহুজাতি-ভাষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর একটি উপমহাদেশকে ভারত ঔপনিবেশিক ধারায় একটি রাষ্ট্রের কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাত তৈরি করে রেখেছে। রাজনৈতিক বিবেচনা এবং সামাজিক নৃ-তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় বিবেচনায় ভারতের জন্য এটি শিথিল ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো অনিবার্যতা রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, শিথিল ফেডারেশন না হলে কোন বহুজাতিক দেশকে একই জাতীয় পতাকার নীচে ধরে রাখা অসম্ভব।
ভারত প্রজাতন্ত্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ আজও পর্যন্ত একটি সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় করা হয়নি। রাষ্ট্র পরিচালিত, ‘মিডিয়া’ সমূহ যথাক্রমে আকাশবানী এবং দূরদর্শনে সপ্তাহে ৭ দিন গীতাপাঠ এবং একদিন করে পবিত্র কোরআন তেলোয়াত, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠকে কিছুতেই ধর্মনিরপেক্ষতা বলা উচিত নয়। বরং এটাকে বলতে হয় ‘ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা’। এরই চরম পর্যায়ে আমরা দূরদর্শনে দেখতে পাই বছরের পর বছর ধরে টিভি সিরিয়াল ‘রামায়ন’ ও ‘মহাভারত’। এই দুইটি ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনির মূল বক্তব্য হচ্ছে হিন্দু আর্য যুবকদের বীর গাঁথা এবং আর্যদের পর রাজ্য জয়। স্থানীয় কালো ও তাম্র বর্ণের আদি নরগোষ্ঠীকে অসুর ও অস্পৃশ্য হিসাবে বর্ণনা করে বহিরাগত আর্যদের যুদ্ধ জয়কে এসব কল্পকাহিনীতে সত্য ও ন্যায়ের বিজয় হিসাবে চিহ্নিত করে হয়েছে। এরই পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দিকে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দক্ষিনাঞ্চলের আদি বাসিন্দার হিন্দি ভাষাকে বর্জন করা ছাড়াও স্বাভাবিকভাবেই টিভি সিরিয়ালে প্রদর্শিত রামায়ন ও মহাভারতের প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করলেও উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে এসব পৌরাণিক কাহিনীর নবরুপ সাদরে গ্রহিত হয়। ১৯৮৯ সালের সাধারন নির্বাচন এবং ১৯৯১ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল এর জ্বলন্ত প্রমাণ। ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র একটি সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় না হওয়ায় এবং সরকারী মিডিয়া দূরদর্শনের টিভি সিরিয়ালে ‘রামায়ন’ ও ‘মহাভারত’ প্রদর্শিত হওয়ার জের হিসাবে স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪৪ বছ পর উত্তর ভারতে সংগঠিত হলো বর্ণ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থান। লোকসভা নির্বাচনে যেখানে ১৯৬২ সালে হিন্দু মহাসভার আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩টি, সেখানে ১৯৮৯ সালে একই মতাদর্শের বিজেপির আসন ৮৬টি এবং ১৯৯১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১১৭টিতে। ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশ সরকার এখন বিজেপি’র দখলে এবং কেন্দ্রীয় লোকসভায় বিজেপি হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল। এরূপ পরিবর্তন প্রমাণ করে যে ভারত সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অতীতের তুলনায় অধিকতর কট্টর সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হয়েছে।
সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে হিন্দু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলই রয়েছে কমপক্ষে ৩৭টি। এর মধ্যে ১০টি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে এবং বাকিগুলো আঞ্চলিক দল হিসেবে কর্মতৎপর বলে জানা গেছে। ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও এসব রাজনৈতিক দল বৈধভাবেই কাজ করছে। সর্বভারতীয় হিন্দু ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে, অল ইন্ডিয়া হিন্দু মহাসভা, অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জনজাগ্রুতি সমিতি, অখিল ভারতীয় হিন্দু শক্তি দল, অখিল ভারতীয় জন সংঘ, অখিল ভারতীয় রাম রাজ্য পরিষদ, অখিল ভারতীয় শিবসেনা রাষ্ট্রবাদী, অখ- হিন্দুস্তান মোর্চা, আপনা হিন্দু রামভক্ত পার্টি, আর্য সভা, ভারতীয় হিন্দু সেনা, ভারতীয় জনশক্তি, ভারতীয় স্বদেশী সংঘ, হিন্দু একতা আন্দোলন পার্টি, হিন্দু প্রজা পার্টি, হিন্দু সমাজ পার্টি, হিন্দু শিব সেনা, হিন্দু স্বরাজ সংগঠন, রাষ্ট্রীয় হিন্দু সংগঠন, রাষ্ট্রীয় হিন্দু মোর্চা, রাম রাজ্য মার্গ, রাম সেনা রাষ্ট্রবাদী, সমরাথ ভারত, শিব রাজ্য পার্টি, শিব সেনা প্রভৃতি। অন্যদিকে, আঞ্চলিক হিন্দুবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, অসম ভারতীয় জনতা পার্টি, নিখিল মনিপুরি হিন্দু মহাসভা, হিন্দু মুন্নানি (তামিলনাড়–), হিন্দু মাক্কাল কাচ্চি (তামিলনাড়–), জনথা পার্টি (দক্ষিণ ভারত ও মহারাষ্ট্র), তামিলনাড়– হিন্দু ভেল্লালার ইয়থ কাজাঘাম, শ্রীরাম সেনা (কর্ণাটক), ভারতীয় জন পাকসাম (কেরালা), সনাতন প্রভাত (মহারাষ্ট্র ও কেরালা), হিন্দু সংহতি (পশ্চিমবঙ্গ) প্রভৃতি। এসব দলের মধ্যে আরএসএস-এর মতো কোনো কোনো দলের আধাসামরিক বাহিনীর মতো বাহিনী রয়েছে। এসব দল প্রধানতঃ ভারতকে একটি হিন্দু দেশে পরিণত করতে কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে আন্দোলনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিন্দু ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে পরিচয় না দিলেও তারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং তাদের পেছনে শক্তি যোগায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), শিবসেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি)। বিজেপি অতীতেও ভারত শাসন করেছে। এ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চরম সাম্প্রদায়িক এবং গুজরাট দাঙ্গার নায়ক। এসব দল ভারতে এবং গোটা দুনিয়ায় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দল হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত।
মূলত, ভারত শুধু মৌলবাদী নয়, তীব্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক সামাজিক কাঠামো নিয়ে পরিচালিত হয়। সেখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো সংখ্যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। এসব দাঙ্গার প্রধান শিকার মুসলিম জনগোষ্ঠী। এর পরে রয়েছে শিখ ও খ্রিস্টানরা। এছাড়াও নিম্নবর্গের নানা গোষ্ঠী এই দাঙ্গার কবলে পড়ে জানমাল ও সহায়-সম্পদ হারায়।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও ভারতে সংখ্যালঘু ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা নিরসনে কমিশন গঠন করতে হয়। হিন্দুত্ববাদী আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দাপটে এসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভিপি সিং সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। মন্ডল কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে শিবসেনা-হিন্দু মহাসভার উগ্রবাদী কর্মীরা গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার উদাহরণও তৈরি করেছে। ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে শিবসেনা ও সংঘ পরিবারের সেøাগান হচ্ছে: “হয় কুরআন ছাড়ো, নয় ভারত ছাড়ো।” মুসলমানদের উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত ‘সাচার কমিটির’ সুপারিশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সরকারিভাবেই মুসলমানরা জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ হলেও চাকরি ও অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অংশীদারিত্ব মাত্র ২ শতাংশ। গোটা ভারতে মুসলমানদের জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় ৪০ শতাংশ কিন্তু তারপরও তারা অবদমিত ও চরমভাবে বঞ্চিত। সংঘ পরিবারের উগ্রবাদীরা বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর গুজরাটে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে- ভারতের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার সমাজ তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস ও বাম রাজনীতিকরাও।
ভারত দীর্ঘকাল থেকে বিশ্বময় প্রচার করে আসছে যে, ভারত হচ্ছে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। গনতন্ত্রের অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন, অথচ নির্বাচনের বিষয়টি সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সবার অলক্ষ্যে মাত্র ৪৪ বছরের ব্যবধানে ভারতের সাধারন নির্বাচনের ক্ষেত্রটি এখন শুধুমাত্র বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং বিত্তশালীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পরে।

আজ থেকে ৩০/৪০ বছর আগেও এমন একটা সময় ছিল যখন আদর্শবাদী একজন প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব ছিল। অথচ এখন একজন ‘কাস্তে-হাতুড়ী’ কিংবা ‘হাতের পাঞ্জা’ মার্কা প্রার্থীর জন্য দলীয় সমর্থন ছাড়াও প্রয়োজন কয়েকশ’ বেতন ভুক্ত “ক্যাডার”, কয়েক ডজন মটর সাইকেল, ভিডিও ক্যাসেট, মাইক্রফোন আর শিল্পপতি ও পুলিশের পরোক্ষ সমর্থন এবং প্রচুর অর্থকড়ি।
এই প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে, বহুজাতিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৩টি মৌলিক উপাদানের প্রথমটি অর্থাৎ “ধর্ম নিরপেক্ষতা” এক্ষনে “ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায়” দাঁড়িয়েছে এবং দ্বিতীয় মৌলিক উপাদান সর্বসাধারণের গনতন্ত্র সম্প্রতি বুর্জোয়া গনতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
অতএব বহুজাতিক ভারতীয় এককেন্দ্রিক ফেডারেশনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে ভারতের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও গবেষকদের মধ্যে এ মর্মে বিশ্বাস ছিল যে, স্বাধীনতার পর বহুজাতিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় কাঠামো হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণে শিথিল ফেডারেশন ভিত্তিক। কিন্তু পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থ এবং হিন্দু প্রধান সমাজের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানের কারনে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি বরং ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ক্রমান্বয়ে হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক একটি শক্তিশালী এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা পৌরসভার মতোই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। ফলে, বহুজাতিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রের প্রতি রাজ্য সরকারগুলোর আস্তা ও বিশ্বাসের দারুন অভাব এবং রাজ্যগুলোর কোনটাতে পরিস্থিতির অবনতি হলেই জারী হচ্ছে “রাষ্ট্রপতি শাসন”।
এরই ফলশ্রুতিতে কোন কোন রাজ্যের আঞ্চলিক দাবী-দাওয়াগুলো শেষ অবধি ভয়াবহ দমননীতির মোকাবেলার সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ধরনের এক বিরাজমান পরিস্থিতিতে ৩টি রাজ্য যথাক্রমে কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং আসামে ১৯৯১ সালের মধ্যবর্তীকালীন সাধারন নির্বাচন পর্যন্ত অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া শুধুমাত্র অস্ত্রের দাপটে ভবিষ্যতের এসব ভাঙ্গন প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
উপমহাদেশে ওহাবী আন্দোলনের (১৮১৮-১৮৭০ খ্রি) সময় থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক শতাধিক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ডামাডোলে যেখানে পাঞ্জাবী শিখদের খঞ্জরে অসংখ্য পাঞ্জাবী মুসলমান আত্নাহুতি দিয়েছে, কালের আবর্তে এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাতে দিল্লী সরকারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি শিখদের বিদ্রোহ ও ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে স্পস্ট হয়ে উঠে যে ধর্মকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন জাতির অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
ভারত শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে জাতি-গোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি না দিয়ে সামরিক ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছে। এরই প্রতিবাদে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য ছাড়াও জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিকতার বৃত্ত অতিক্রম করে সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। এরই পটভূমিতে যুদ্ধ ছাড়াই ভারত এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত। একমাত্র জম্মু-কাশ্মীরেই ভারত চার থেকে পাঁচ লাখ সৈন্য মোতায়েন রেখেছে।

এছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতসহ অন্যান্য সংঘাতময় রাজ্যে ভারত আরো কয়েক লাখ সেনা মোতায়েন করে তার কথিত রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষা করছে। ভারতের অনেক রাজ্য শাসিত হয় সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় গভর্নরের মাধ্যমে। যা কেন্দ্রীয় শাসনেরই নামান্তর। দুনিয়ায় ভারতই ইসরাইলের পর আর একটি নিরাপত্তা রাষ্ট্র। যে দেশের নীতিনির্ধারক ও শাসকরা দেশের অধিকাংশ নাগরিকের অ-হিন্দু হবার কারণে নাগরিক ও মানসিক অধিকার তথা রাষ্ট্র শাসনে সমঅধিকার অস্বীকার করে রাষ্ট্রকে বিভক্ত করে রেখেছে। পশ্চাদপদ হরিজন-সিডিউল কাস্ট এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভারত রাষ্ট্রের মূলধারায় স্বীকৃতি দিতে পারেনি। এর অর্থ দাঁড়ায় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের সংবিধানের শোভাবর্ধন করলেও এটি রাষ্ট্র, সরকারের ব্যবহারিক নীতি-আদর্শে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
তাই, “ভারতীয় জাতি” বলতে যা বুঝানো হয়, ভবিষ্যতে তা অটুট থাকবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আসামের জনগন শোষণ থেকে মুক্তিলাভ এবং নৃতাত্ত্বিক জাতীয় পরিচিতির ভিত্তিতে স্বাধিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় থেকেই সংগ্রামরত। অধিকাংশ মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত আসামীয় জনগন ছাড়াও মিজো, নাগা এবং খাসিরাও হিন্দু জাতাধিপত্য থেকে মুক্তিলাভের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। তাঁদের ন্যায্য দাবির বিষয় নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিবেচনা করতে কোনরূপ আগ্রহ তো দেখায়ই না, বরং, ঐ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী- সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে সর্বশক্তি দিয়ে দমন করে যাচ্ছে।
তার বিপরীতে, ১৯৪৭ সালে ভারতের হিন্দু এবং কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পৃথক আবাসভুমির দাবি করতে যে জনগন বাধ্য হয়, সেই পূর্ব পাকিস্তানীদের মূল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সংগ্রামে সাহায্য করতে একই ভারত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং তৎপর হয়ে উঠে। অথচ, পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধিকারের দাবীর সাথে আসামের জনগনের দাবীর কোন অমিল নাই, অমিল শুধু ভারতের স্বার্থ, নীতি এবং পরিকল্পনায়।
 

উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগনের স্বাধিকার আন্দোলনের নেপথ্যে(SevenSisterStates)

স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যসমূহ প্রকৃত পক্ষে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে চলমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সমূহ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোন বিষয় নয়, বরং এ সবের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ কালের আধিপত্যবাদী শোষণ, অবদমন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামের ইতিহাস ।
নাগা, মিজো, সহ আসামের বিদ্রোহী দল উলফা’র সশস্ত্র সংগ্রামের অন্তর্নিহিত কারন সম্মন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ননি গোপাল মেহতা উল্লেখ করেন,
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে পরিচালিত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অধিকাংশই মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত, যে বিদ্রোহ তাঁদের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করার একটি ভাষা।”

‘ঊলফা’, আসামের চেতনার গভীরে বদ্ধমূল একটি চাপা ক্ষোভের, একটি চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করে। “অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU)” এবং “আসম গণ পরিষদ” (AGP) এর পতনের পর, নয়া দিল্লির বিরুদ্ধে উলফা’ই শেষ ভরসা। উলফা যে সকল দাবী আদায়ে সংগ্রাম রত, সে সকল আসামের জনসাধারণেরই দাবী। আসামের জন্য একটি স্বতন্ত্র কন্ঠ এবং পরিচয়ের দাবী আদায়ের আন্দোলনে উলফাই কেন্দ্রবিন্দু। এ আন্দোলন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আসামের জনগনের জন্য স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অংশ।
তাঁদের দাবী, আসামে প্রাপ্ত অশোধিত তেল, উৎপাদিত কাঠ, চা, জমি এবং বন এর মতো বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি। এমন কি ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্মলগ্ন থেকেই এরূপ দাবীর স্বপক্ষে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। ঐ সময়ে, আসাম প্রদেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে, একটি স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র অথবা স্বায়ত্তশাসিত ও স্বনির্ভর রাজ্য এই দুই ধারনা নিয়ে মত বিভেদ দেখা দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের সংঘাতকে (১৯৪৭-৮৫) আসামের জনগনের ভাষা, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষন এবং জাতীয় পরিচয় রক্ষার চেষ্টা হিসাবে গন্য করা যায়। গান্ধী ভিন্ন ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের কতিপয় নেতা এবং অন্যান্য কোন কোন ব্যক্তিবর্গ ক্ষমতা হস্তগতের বিষয় নিয়েই এতো বেশি ব্যস্ত ছিলেন যে অত্র অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের দিকে ভ্রুক্ষেপই করেন নাই।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর সময় থেকেই, বিশেষ ভাবে আসামের খনিজ তেল উত্তোলনের বিষয়ে কেন্দ্রের ক্রমাগত বৈষম্যমূলক নীতির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তেল সম্পদে ন্যায্য অধিকার পাওয়ার লক্ষ্যে, সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থনে আসামে তেল পরিশোধানাগার আন্দোলন শুরু হয়। যদিও আসামে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে, সেখানে কোন তেল পরিশোধনাগার স্থাপনে ভারত সরকারের কোন আগ্রহ ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার বিষয় উপলব্ধি করতে পেরে, ১৯৫৭ সনে আসামের জনগন সম্প্রদায়, ভাষা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ ভেদাভেদে আসামে একটি বৃহৎ তেল শোধনাগার স্থাপনের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন।১
আসাম ভারতের সর্ব বৃহৎ চা, তেল, কাঠ এবং বনজ সামগ্রী উৎপাদক হওয়া স্বত্বেও রাষ্ট্রের সবচাইতে দরিদ্র এবং শিল্পে পশ্চাদগামী প্রদেশ রয়ে যায়। ‘আসাম আন্দোলনই’ পরবর্তীতে, উলফা কর্তৃক স্বাধীন আসামের আন্দোলন বিস্তারের ভিত্তি স্থাপন করে। অনেক লেখক এবং ইতিহাসবিদই স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এই আন্দোলনকে সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলন বলে গন্য করেন। আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার জন্য এ আন্দোলন ছিল তাঁদের কৃষ্টি এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি রক্ষার সংগ্রাম এবং আসামে সংগঠিত পূর্ববর্তী অন্য সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার সমস্টি।২
প্রকৃতপক্ষে, আসাম কখনই ভারতের অংশ ছিলনা- এমন কি মুঘল সম্রাটগনও আসামকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করতে সক্ষম হন নাই। বিচ্ছিন্নতাবাদের চেতনা আসামের অভিজাত সমাজের একাংশের মনে অপরিস্ফুট ভাবে হলেও বিরাজ করতো। অধিকাংশ সময়েই এ চেতনা সুপ্ত থেকে গেলেও, বিশেষ পরিবেশে প্রকাশ পেত। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, অসমীয়দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনা প্রকাশ পায় বিভিন্ন আঞ্চলিক আন্দোলনের মাধ্যমে যেমন, ১৯৬০ সনের “ভাষা আন্দোলনে”, ১৯৬৭ সনের “তেল পরিশোধনাগার” আন্দোলনে। এসকল আন্দোলনের পথ ধরেই উলফা সংগঠিত হতে থাকে। যে বিষয়টি প্রাথমিক ভাবে আসামে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় তা ছিল তাঁদের “ভাষা আন্দোলন”। ঐ সময়, বাংলার মতই অসমীয়দের জাতীয় চেতনার উন্মেষে ‘ভাষা আন্দোলন’ ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

কেস অব দ্য গ্রেট আসামিজ পিওপল এন্ড অব দেয়ার হোমল্যান্ড আসাম’ নামে এক স্বারকলিপিতেঃ ৯ জুন ১৯৪৬, নয়া দিল্লীর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এবং অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্যদের বরাবর, ‘আসম জাতীয় মহাসভার’ পক্ষ থেকে অসমিয়দের অস্তিত্ব রক্ষাকল্পে, ‘আত্নরক্ষী বাহিনী’ নামে এক শক্তিশালী অসমিয় সেচ্ছাসেবক সেনাদল গঠনের পরিকল্পনার বিষয় উত্থাপন করে।
মজার বিষয় হিসাবে মনে রাখা যায় যে, এরূপ পৃথক পরিচিতির দাবীতে ধিরে ধিরে স্বাধীন ও সার্বভৌম আসামের ধারনার জন্ম হতে থাকে। এমনকি ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরও এমন ধারণা প্রবল ভাবে অসমিয়দের আন্দোলিত করে।
জানুয়ারি ১৯৪৮ সনে ‘কামরূপ জাতীয় মহাসভা’র সভাপতি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, আসাম ভারত ইউনিয়ন থেকে বাহির হয়ে বার্মা বা অন্য দেশের মত স্বাধীন দেশ হতে পারে। এছাড়াও, উক্ত মহাসভার একদল সংগ্রামী সদস্য ‘শিলং টাইমস’ এর সম্পাদকের নিকট এক পত্রে এমন অভিমত প্রকাশ করে যে, ‘আসামের সার্বভৌমত্বের দাবী যেমন অতীতেও ন্যায্য ছিল, তেমনই ভবিষ্যতেও ন্যায্য থাকবে’।

অভিজাত আসামীয়গন দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন যে কেন্দ্র আসাম থেকে অত্যাধিক রাজস্ব আদায় করে নেয়, অথচ আসাম চা, তেল, পাট থেকে প্রাপ্ত শুল্কের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আসামের অভিজাত শ্রেনী কেন্দ্র এবং আসামের মধ্যকার বর্তমান আর্থিক সমন্বয় নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট এবং এই সমন্বয় কে অবৈজ্ঞানিক হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন, কেন্দ্র এই ব্যাবস্থার মাধ্যমে আসামকে অর্থনৈতিক ভাবে শোষণ করছে। তাই, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই আসামের এই অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা দূর কর করা সম্ভব বলে তাঁরা বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করেন । এছাড়াও তাঁরা মনে করেন, যতদিন আসাম ভারতের অংশ হিসাবে থাকবে ততদিন পর্যন্ত জাতীয় সরকারের ধোয়াটে পর্দার নিচে কেন্দ্রের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রনে থাকবে।
অপরিশোধিত তেলের রাজস্ব বৃদ্ধির আসামিয়দের পুনঃপুনঃ দাবির বিপক্ষে কেন্দ্র কখনোই আন্তরিক ভাবে অথবা যথাসময়ে সাড়া দেয় নাই। একই কথা খাটে, প্রাকৃতিক গ্যাস এর ব্যপারেও। আসামে গড়ে প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করা হয়। পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাস সিলিন্ডারের সংকটময় পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে প্রফেসর হুসেইন বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে, যদিও আসামে প্রচুর পরিমানে পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাস উত্তোলন করা হয়, তথাপি কেরসিন এবং গ্যাস এর জন্য লম্বা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, “অদ্যাবধি উপনিবেশিক কায়দার ভারতীয় শোষণ আসামিয়দের গভীর ভাবে মর্মাহত করে।”৩
পাকিস্তানের আই,এস,আই অথবা ডি,জি,এফ,আই এর সাথে উলফার সম্পৃক্ততা শুধুমাত্র তাঁদের কৌশলগত অস্তিত্ব রক্ষার উপায় বলে তাঁরা দাবি করে।
অভিজাত শ্রেনী ছাড়া, বিভিন্ন উপজাতি সংগঠনও আসামের স্বাধীনতার দাবি নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। এসকল সংগঠন যেমন, নাগা, মিজো এমন কি খাসিরাও হিন্দু জাতাধিপত্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল এবং স্বাধীন আসামের অংশ থেকেই হোক বা বাহির থেকেই হোক নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি করে। এমন কি ‘সংযুক্ত মিজো ফ্রিডম পার্টি’ সকল মিজো অধ্যুষিত এলাকাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বার্মার সাথে সংযুক্ত করার দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে।
তাই, সচেতন যে কোন ব্যক্তিমাত্রেরই প্রশ্ন, কি করে ভারত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে “অসমীয়”, “মিজো” এবং “নাগা” দের স্বাধিকার আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসাবে দমন করতে নেমে স্বীয় গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাবহারের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ইন্ধন যোগায়? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীদের (বাংলাদেশ) স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে আসাম, মিজল্যান্ড, নাগাল্যান্ড এর জনগনের স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি? পরস্পরবিরোধী আদর্শ কোন শান্তিপ্রিয় ও প্রগতিশীল দেশের আদর্শ হতে পারে কি?
চানক্যের দর্শন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর নেহেরুর কন্যা চৌকস রাজনীতিক ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একদিকে এক জনগোষ্ঠীকে তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরা করতে অতি আগ্রহে পূর্ব পাকিস্তানীদের সর্বশক্তি দিয়ে সহায়তা করে।
কত আদর্শহীন চানক্যের দর্শন, রাজনীতি এবং কৌশল!
চানক্যের দর্শন থেকে নেহেরু ডকট্রিন
“কোন রাষ্ট্রের বহিঃশত্রুর বিপক্ষে গোপন তৎপরতা পরিচালনার উপযুক্ত দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা থাকা যেমন অপরিহার্য, তেমনই অপরিহার্য, প্রত্যেক গোয়েন্দা সংস্থারই মুহূর্তের প্রয়োজনে ঝাপিয়ে পরায় সক্ষম এমন এক গুপ্ত বাহিনী।”
গোয়েন্দা সংগঠন একটি দেশের এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অবিচ্ছেদ্য অংশ।৪ এরূপ আদর্শের অর্থ বা উদ্দেশ্য, আত্ন্ররক্ষামূলক বোধ হলেও বাস্তবে এ বৈশিষ্ট যে শুধু আত্নরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমনাত্নক ও ভয়ঙ্কর, তা প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে ভারতের গুপ্ত বাহিনী ‘র’ এর কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে।

২৪০০ বছর পুর্বের মৌর্য সম্রাজ্যের বিখ্যাত কূটনীতিক বিষ্ণগুপ্ত চানক্যের দিক্ষা– “ক্ষমতা অর্জনের লোভ ও অন্য দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনও মন থেকে মুছে ফেল না। সব সীমান্তবর্তী রাজাকে শত্রু বলে মনে করবে”, এবং
১৯৪৭ সালে প্রকাশিত অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা জওহরলাল নেহেরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইতে, ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’, বা নেহেরু ডকট্রিন নামে খ্যাত এরূপ আদর্শ বা দর্শন উল্লেখিত আছে, যে “ভারত অবশ্যম্ভাবীভাবে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত হবে সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ছোট জাতিরাষ্ট্রগুলোর সর্বনাশ ঘটবে। তারা সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকবে না” ।
nehru-with-daughter-indira-gandhi


অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী
চানক্যের ‘অখন্ড ভারত’ এর দর্শন থেকে উৎসাহিত হয়ে, ভারত একে একে কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, সিকিম এবং নেপালের মাওবাদ, শ্রীলংকার তামিল টাইগার বিদ্রোহ…ইত্যাদির মাধ্যমে “ইন্ডিয়া ডকট্রিন” তার স্বরূপ উন্মোচন করছে সবার সামনে। হাজার বছর পর এসেও চানক্যের এই মূলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত।
সমস্ত পাক-ভারত উপমহাদেশ জুড়েই ভারত গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে কোন দেশের অভ্যন্তরে বিভেদ ও সংকট সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, পুতুল সরকার স্থাপন, অস্ত্র সরবরাহ, জঙ্গি সংগঠন তৈরি ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে দোষী সাব্যস্ত করতে সুচতুর ভাবে প্রয়োগ করে যাচ্ছে “ওয়েস্টার্ন-জিয়নিস্ট” “ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন” পদ্ধতি।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ সমূহের বিশেষ করে “র” এর গুপ্ত কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্য, তাঁদের প্রভাব, পরিণতি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল সমূহের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি বিশেষ সমর্থনের পিছনে কি কারন নিহিত আছে ইত্যাদি সম্মন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে দেখা যাক, সম্পূর্ণ পাক-ভারত উপমহাদেশে তাঁদের কর্মকাণ্ডের স্বরূপ কি!
নিম্নের কিছু উদাহরন থেকেই পাক-ভারত উপমহাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদী বৈদেশিক নীতির রূপ সম্মন্ধে ধারণা করা যায়। বলাই বাহুল্য, ১৯৬৮ সালে উপরোক্ত “র” গঠনের বহু পূর্ব থেকেই ভারতের আধিপত্যবাদী চরিত্র এবং ‘অখন্ড’ ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির প্রবনতা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, যে ভারত সরকার আক্রমনাত্নক নীতি এবং দুই পররাষ্ট্র লক্ষ্য অর্জনে গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা গ্রহন করেঃ (১) দক্ষিন এশিয়াতে আধিপত্যবাদী অবস্থান অর্জন করা; (২) চানক্যের নীতির উপর ভিত্তি করে বিশ্ব ব্যাবস্থায় ভূমিকা পালন করা। ভারত সরকার শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে পর্যবেক্ষণ করার লক্ষ্যেই নয়, বরং ঐ সকল অঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য অর্জনে আগাম গুপ্ত তৎপরতা পরিচালনায় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে। বিগত বৎসর সমূহে ‘র’ এশিয়াতে ভারতের আধিপত্যবাদী প্রভাব বিস্তারে বিশেষ হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে।

“দ্য রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উয়িং”(র’) ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতের অভ্যন্তরীণ এবং বিশেষ করে বিদেশ নীতি রূপায়নে বিশেষ অধিকার নিয়ে সজ্জিত হয়। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধিনে থাকার কারনে, সময়ের সাথে সাথে এই সংস্থা ভারতের জাতীয় ক্ষমতার একটি প্রধান কার্যকরী অস্ত্র হয়ে উঠে। র’ এর গোয়েন্দা তৎপরতা, কৌটিল্যের নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে ষড়যন্ত্র, পুনঃ পুনঃ গুপ্ত যুদ্ধ পরিচালনা নীতির উপর ভিত্তি লাভ করে।
প্রতিষ্ঠা লাভের লগ্ন থেকেই র’ ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী র’ কে নতুন আঙ্গিকে, নতুন কর্মসূচি এবং কৌশল দিয়ে সাজায়। বিখ্যাত “ইন্দিরা ডক্টরিন” এর আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইন্দিরা গান্ধী র’ এর অঙ্গ হিসাবে, প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সক্ষম একটি চৌকস গোয়েন্দা সেল গঠন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। এরূপ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে র’ বিশ্বের বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা যেমন, কেজিবি, সিআইএ, এমআই-সিক্স, বিএনডি এবং মোসাদ এর সমকক্ষ হয়ে উঠে।
র’ প্রধানের অধিনে একজন যুগ্ম সচিব বিশেষ অপারেশন দপ্তরের (OSO) দায়িত্বে থেকে, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা (নিরাপত্তা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেলের অধিনে), ইলেক্ট্রনিক ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভাগ এবং সাধারন প্রশাসনিক বিষয়ের তত্ত্বাবধান করেন। যুগ্ম সচিব এবং নিরাপত্তা বিভাগের মহা পরিচালক থাকে র’ এর পরিচালকের অধিনে। নিরাপত্তা বিভাগের মহা পরিচালকের অধিনে ন্যাস্ত হয়, ‘দ্য এভিএশন রিসার্চ সেন্টার (ARC) এবং দ্য স্পেসাল সার্ভিসেস ব্যুরো (SSB)।
যুগ্ম সচিবের অধিনে ন্যাস্ত হয় বিভিন্ন অঞ্চল/ বিভাগ/ এলাকা(দেশ) যেমনঃ প্রথম এলাকাঃ পাকিস্তান, দ্বিতীয় এলাকাঃ চিন এবং বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া, তৃতীয় এলাকাঃ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা, চতুর্থ এলাকাঃ অন্য সকল দেশ। এভিএশন রিসার্চ সেন্টারের (ARC) দায়িত্বে থাকে অন্যান্য দেশের যোগাযোগ ব্যাবস্থা পর্যবেক্ষণ/ নিয়ন্ত্রণ, আটক, এবং বিঘ্নিত করা। র’ কে সর্বাধুনিক ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম এবং সর্বাধুনিক আড়িপাতা সরঞ্জাম সমৃদ্ধ পর্যাপ্ত সংখ্যক গোয়েন্দা বিমান দিয়ে সজ্জিত করা হয়। তার সাথে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি দিকে এআরসি তে ‘দ্য গালফ স্ট্রিম-৩ নামে তিনটি নতুন বিমান সংযোজিত হয়।
এরূপ উড়োজাহাজ ৫২,০০০ ফুট উপর দিয়ে উড়তে সক্ষম এবং ৫০০০ কিঃমিঃ (5000 kms) এলাকা ব্যাপী কার্যসম্পাদন করতে সক্ষম। উক্ত এআরসি (ARC) বাংলাদেশ, চিন, নেপাল এবং পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্ত এলাকার বেশ কিছু সংখ্যক রাডার স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করে ।

ভারতের বিপরীতে অবস্থানকারী প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অবাধ স্বাধীনতা লাভ করে র’ স্বীয় সংস্থার আকার- কর্ম পদ্ধতি বিশেষ ভাবে পুনঃনির্মাণ করতে থাকে। ভারতের প্রতি বিদ্বেষমূলক বিবেচিত প্রধান টার্গেট হিসাবে র’ কে সাতটি প্রতিবেশী দেশের একটি তালিকা প্রদান করা হয়, যেমনঃ বাংলাদেশ, শ্রিলঙ্কা, নেপাল, সিকিম, ভুটান, পাকিস্তান এবং মালদ্বীপ।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভারত সরকারের আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নে, এই সংস্থা পর্যায়ক্রমে এবং সাফল্যের সাথে ঐ সকল দেশে গুপ্ত তৎপরতা পরিচালনা করার মাধ্যমে তাদেরকে দমন, অস্থিতিশীল এবং পরাভুত করতে সক্ষম হয়।
প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে র’ এর এধরনের কর্মকাণ্ড চৌকস, পেশাগতভাবে দক্ষ এবং অভিজ্ঞদের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। টারগেট দেশের অভ্যন্তরে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক স্থাপন করাই হলো এসব তৎপরতার প্রাথমিক লক্ষ্য। অতঃপর, ঐ সকল দেশের ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বা উপজাতীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা অথবা অপরাধীদের দুর্বলতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে র’ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র পরিচালনা করে।
এভাবে র’ ঐ সকল দেশে এমন পরিবেশ তৈরি করে যাতে সামরিক হস্তক্ষেপ কাম্য হয়ে উঠে। অথচ, নিজেদের উপস্থিতি থাকে সবার অলক্ষ্যে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহে এই সংস্থা ভারতের সম্প্রসারন বাদী “ইন্ডিয়া ডক্টরিন” নীতির বাস্তবায়নে দক্ষতার সাথে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
ভারত কর্তৃক হায়দ্রাবাদ দখল
দক্ষিন ভারতের এক রাজ্য হায়দ্রাবাদ। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মুঘল সুবাদার কামারুদ্দীন খান হায়দ্রাবাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজাম-উল-মূলক উপাধি নিয়ে হায়দ্রাবাদ রাজ্য শাসন করতে থাকেন।


হায়দ্রাবাদ
১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা পাবার পর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ভারত হায়দ্রাবাদে নানা রকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করলেও সর্বশেষ নিজাম তা শক্ত হাতে দমন করেন। এরপর ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করলেন, ‘যখন প্রয়োজন মনে করবো তখন হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করা হবে।’ এক পর্যায়ে ভারত বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার অংশ হিসেবে হায়দ্রাবাদের অভ্যন্তরে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের সক্রিয় করা হয়, হায়দ্রাবাদের রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়। শিক্ষাঙ্গন, সাংস্কৃতিক জগৎ, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনুগত লোক তৈরি করা হয়, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অনুগত দালাল সৃষ্টি করা হয় এবং হিন্দু মৌলবাদীদের দিয়ে নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উস্কে দেয়া হয়। কংগ্রেসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও আর্যসমাজ এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তেলেঙ্গনায় কম্যুনিস্ট বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ‘অপারেশন পোলো’ নামে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হায়দ্রাবাদে আক্রমণ চালায়। সর্বগ্রাসী এ আক্রমণ শুরুর আগেই স্বাধীন হায়দ্রাবাদের সেনাপ্রধান আল ইদরুসকে কিনে নিয়েছিল ভারত। আল ইদরুস দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তগুলো অরক্ষিত রেখেছিল, সেনাবাহিনীকে রেখেছিল অপ্রস্তুত অবস্থায়।
এরপর ভারত সেনাপ্রধানের সহায়তায় হায়দ্রাবাদে তার বিপুল সেনাশক্তি, পদাতিক বাহিনী ও বিমান বাহিনী সহকারে শুরু করলো সামরিক আক্রমণ। প্রথমে ট্যাংক এবং এরপর বিমান আক্রমণে বিপর্যস্ত মানুষের ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে একাত্ব হয়ে আর্যসমাজ ও অন্যান্য হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলো হায়দ্রাবাদে প্রায় দুই লাখ মুসলিমদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মুসলিম নিরীহ নারী-পুরুষ, শিশুদের হত্যা করেছে, বিমান হামলায় শহর বন্দর গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয় এবং মসজিদ, মাদ্রাসা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। তাদের এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর একটি মাত্র উদ্দেশ্যে তা হচ্ছে হায়দ্রাবাদের শেষ নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করা। অনেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বাহিনী রাজধানীর দিকে ধাবিত হয় এবং হায়দ্রাবাদ ভারতের দখলে পরিণত হয়। এরপর হায়দ্রাবাদ ভারতের পদানত রাজ্যে পরিণত হওয়ার পর একে অন্ধ্র, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র এই তিন রাজ্যে বিভক্ত করা হয়।
 

ভুটানে “র” এর তৎপরতা
ভূটান দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাজতন্ত্র। দেশটি ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। ভূটানের উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল, এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। পূর্ব দিক থেকে ভারত দ্বারা অধিকৃত সিকিম, পশ্চিম বঙ্গ, আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশ দ্বারা বেষ্টিত।
comtour-nepal-und-bhutan-1104618

নেপাল ও ভুটান
ভুটানের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক লামাবাদী বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। বাকীরা ভারত ও নেপালি ধারার হিন্দু ধর্ম পালন করে।
১৬১৬ সালে নগাওয়ানা নামগিয়াল নামের এক তিব্বতি লামা তিনবার ভূটানের উপর তিব্বতের আক্রমণ প্রতিহত করলে ভূটান এলাকাটি একটি সংঘবদ্ধ দেশে পরিণত হতে শুরু করে। নামগিয়াল বিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে পদানত করেন, একটি ব্যাপক ও সুক্ষ্ম বিবরণসমৃদ্ধ আইন ব্যবস্থা প্রচলন করেন এবং একটি ধর্মীয় ও সিভিল প্রশাসনের উপর নিজেকে একনায়ক বা শাবদ্রুং হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর অন্তর্কোন্দল ও গৃহযুদ্ধের কারণে পরবর্তী ২০০ বছর শাবদ্রুঙের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। ১৮৮৫ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগে সক্ষম হন এবং ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন।
১৯০৭ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক ভূটানের রাজা নির্বাচিত হন এবং ঐ বছর ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
ভুটানও নেপাল এবং সিকিমের মতো স্থলবেষ্টিত দেশ, সম্পূর্ণভাবেই ভারতের উপর নির্ভরশীল। “র” ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে, ভুটানের রাজ পরিবারের সদস্যদের এবং উচুপদের আমলাদের সাথে সংযোগ তৈরি করে। ভুটান সরকার এর জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করার লক্ষ্যে, ভুটানে আশ্রিত নেপালি অধিবাসীদের মধ্য ভারতের পক্ষে দালাল এবং গুপ্তচর তৈরি করে। বাস্তবে, ভুটানের রাজাকে নয়া দিল্লির অনুগত এক প্রতিনিধিতে পরিণত করা হয়, যে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভারতের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য।
১৯৪৯ সালে ভূটান ও ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে ভূটান ভারতের কাছ থেকে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পথনির্দেশনা নেবার ব্যাপারে সম্মত হয়। ঐ চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ মুক্ত বানিজ্য এবং শুল্ক মুক্ত আমদানি-রপ্তানি করে থাকে। ভুটানের ৯৮ শতাংশ রপ্তানি এবং ৯০ শতাংশ আমদানির উপর ভারত এমন কি ভুটানের বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা এবং বানিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ভূটানের রাষ্ট্রীয় মুদ্রা গুলট্রাম এবং এর বিনিময় হার ভারতীয় রুপীর সাথে সম্পর্কিত ।
এছাড়াও, এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশই শাস্তিপ্রাপ্ত পলাতক আশ্রয় প্রার্থীকে স্বীয় দেশের সরকারের নিকট হস্তান্তরে সম্মত হয়।
১৯৫২ সালে জিগমে ওয়াংচুকের ছেলে জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন।
১৯৬০ সালে সাহায্য প্রদান এবং ভুটানের কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়নের পথ ধরে ভারত ভুটানের উপর প্রভাব বিস্তারে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। ভারত ও চীন অথবা ভুটান ও চীনের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, ভারত ভুটানকে তাৎক্ষণিক ভাবে সামরিক সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
১৯৭২ সালে ১৬ বছর বয়সে জিগমে সিঙিয়ে ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন।
ভারত বর্তমানে ভুটানে তিনটি ১,৪১৬ মেগা ওয়াট সম্পন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচালনা করে এবং আরও তিনটি ২,১২৯ মেগা ওয়াট সম্পন্ন প্রকল্প নির্মাণাধীন।
২০০৩-০৪ সনে ভুটানের ‘সেনা বাহিনী’ আসামের ‘উলফা’ স্বাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সমূহ ধ্বংস করার কাজে ভারতকে সহায়তা করে।
 

ভারত কর্তৃক সিকিম দখল
সিকিম ছিল “র” এবং ভারতের সবচাইতে সহজ শিকার। তিব্বত, নেপাল এবং পশ্চিম বঙ্গের হিমালয় বেষ্টিত সিকিম ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে মহারাজার অধিনে স্বাধীন দেশ হিসাবে টিকে থাকে। ভারত সরকার সিকিমের মহারাজাকে ধর্ম রাজা (চগিয়াল) হিসাবে স্বীকৃতিও দেয়। ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী “র” এর হাতে সেখানে ভারতপন্থি সরকার স্থাপনের দায়িত্ব অর্পণ করে। অনধিক তিন বৎসরের মধ্যে, ১৯৭৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিকিম ভারতের ২২ তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
lendup-dorje

লেন্দুপ দর্জি – সিকিম এর মীরজাফর
ভারতে বৃটিশ শাসন শুরুর পুর্বে সিকিম তার পার্শ্ববর্তী নেপাল আর ভুটানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। বৃটিশরা আসার পর তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নেপালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সিকিম। এসময় রাজা ছিলেন নামগয়াল। কিন্তু বৃটিশরা তিব্বতে যাওয়ার জন্য এক সময় সিকিম দখল করে নেয় এবং ১৮৮৮ সালে রাজা নামগয়াল আলোচনার জন্য কলকাতা গেলে তাঁকে বন্দী করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৯২ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং সিকিমের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া হয়। এরপর তার পুত্র টুলকু নামগয়াল ক্ষমতায় বসে সিকিমের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। এসময় বৃটিশের কাছে সিকিম তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা লাভ করে। পরবর্তী চোগিয়াল থাসী নামগয়ালের সময়ে বৃটিশরা ভারত ছেড়ে গেলে গণভোটে সিকিমের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে রায় দেয় এবং ভারতের পন্ডিত নেহরু সিকিমকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৯৬২ সালের ভারত – চীন যুদ্ধের পর কৌশলগত কারণে সিকিমের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশক্তি নিয়োগ করেন সিকিমকে দখল করার জন্য। তিনি কাজে লাগান সিকিমের প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জিকে।
মূলত চীন সীমান্তে ৩টি স্বাধীন রাষ্ট্র (নেপাল, ভুটান ও সিকিম) নয়াদিল্লির জন্য অস্বস্তিকর ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক বোমার সফল বিস্ফোরণ ইন্দিরা গান্ধীর আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কংগ্রেস নেত্রী নয়াদিল্লিতে তার ক্ষমতাকে সুসংহত করেন এবং এরপর সিকিমের ওপর তার নজর পড়ে। নয়াদিল্লি উদ্বিগ্ন ছিল সিকিমের স্বাধীন সত্তার বিকাশ নিয়ে। ভুটানের পথ ধরে সিকিম যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে ফেলত, তাহলে তা হতো নয়াদিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বড় রকম বাধা। তাই দ্রুত কার্যোদ্ধারের জন্য তারা অগ্রসর হতে থাকে।

ভারতীয় কর্মকর্তার উপস্থিতিতে রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধন করছেন সর্বশেষ চোগিয়াল
১৯৭০ সাল থেকেই নেহেরু প্রভাবিত সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসকে লেন্দুপ দর্জি ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টি করেন। রাজপ্রাসাদের সামনে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে ইন্দিরা সরকার রাজার নিরাপত্তার কথা বলে ভারতীয় বাহিনী পাঠায়। কিন্তু তারা মূলত রাজাকে গৃহবন্দী করেন, বহির্বিশ্বের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং বি এস দাশকে ভারত সরকার সিকিমের প্রধান প্রশাসক নিয়োগ করে। এই সময় এক মার্কিন পর্বতারোহী গোপনে সিকিম প্রবেশ করেন এবং সিকিমের স্বাধীনতা হরণের খবর বিশ্বের নিকট তুলে ধরেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায়। সিকিম জাতিসংঘের সদস্যপদভুক্তিরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এর মধ্যে ভারতের তাঁবেদার লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বাধীন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (এসএনসি) ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পার্লামেন্টের ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জিতে ২৭ মার্চ ১৯৭৫ প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং এ প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি রাজতন্ত্র বিলোপ ও জনমত যাচাইয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেন। ততদিনে সিকিমে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। তারা বন্দুকের মুখে ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ভোট দিতে বাধ্য করে। পুরো ঘটনাই ছিল সাজানো। ৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সালের সকালে সিকিমের রাজা যখন নাস্তা করতে ব্যস্ত সে সময় ভারতীয় সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে এবং রাজাকে বন্দী করে প্রাসাদ দখল করে নেয়। তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ভারতের প্রদেশে পরিণত করে। সিকিম সেনাবাহিনীকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় সাংবাদিক সুধীর শর্মা ‘পেইন অব লুজিং এ নেশন’ (একটি জাতির হারিয়ে যাওয়ার বেদনা) নামে একটি প্রতিবেদনে জানান, ভারত তার স্বাধীনতার গোড়া থেকেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু অনেকের সাথে কথোপকথনে তার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়না তার বই ‘ইনসাইড স্টোরী অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’-এ সিকিম সম্পর্কে লিখেন, ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করে নেয়া হবে। সে লক্ষ্যে সিকিমে প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টির জন্য আন্দোলন, হত্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছিল। তারা ছোট ছোট ইস্যুকে বড় করার চেষ্টা করে এবং সফল হয়। তার মধ্যে হিন্দু – নেপালী ইস্যু অন্যতম। ‘র’ দুই বছর সময় নেয় সিকিমে একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য। এ ক্ষেত্রে নেপালী বংশোদ্ভূত হিন্দু ধর্মাবলম্বী সিকিমি নাগরিকদের ক্ষোভকে ব্যবহার করা হয়।
তাদের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ ছিল, সিকিমের বৌদ্ধ রাজা স্থানীয় নেপালী হিন্দু প্রজাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন। সাংবাদিক সুধীর শর্মা লিখেন, লেন্দুপ দর্জি নিজেই তাকে বলেছেন, ‘ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর লোকেরা বছরে দু’তিনবার তার সাথে দেখা করে পরামর্শ দিত কিভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা যাবে। তাদের একজন এজেন্ট তেজপাল সেন ব্যক্তিগতভাবে তাকে অর্থ দিয়ে যেতো এ আন্দোলন পরিচালনার জন্য। এ অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালিত হতো।’ শর্মা আরো লিখেছেন, এই ‘সিকিম মিশনের’প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, যা সর্বত্র ‘র’ নামে পরিচিত। সিকিমের চোগিয়ালের তৎকালীন এডিসি ক্যাপ্টেন সোনাম ইয়াংজু লিখেছেন, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক পোশাকে রাজার বিরুদ্ধে গ্যাংটকের রাস্তায় মিছিল, আন্দোলন ও সন্ত্রাস করত। নেহেরুর পরামর্শ, মদদ ও উৎসাহে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন করেছিলেন লেন্দুপ দর্জি। শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, চলবে’। লেন্দুপ দর্জির গণতন্ত্রের শ্লোগান শুনে সিকিমের সাধারণ জনগণ ভাবতেই পারেনি, এই শ্লোগানের পিছনে প্রতিবেশী দেশ একটি জাতির স্বাধীনতা হরণ করতে আসছে। সিকিমের জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত তার আগ্রাসন সফল করতে এবং এক পক্ষকে ক্ষমতায় এনে তাদের দ্বারা দেশ বিক্রির প্রস্তাব তুলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল।
ভারতীয় আধিপত্যবাদের সেবাদাস লেন্দুপ দর্জিকে ২০০২ সালে ভারত ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে। সিকিমের রাজ্য সরকার ২০০৪ সালে তাকে ‘সিকিমরত্ন’ উপাধি দেয়। তবে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য তিনি এক অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। সিকিমে তার ঠাঁই হয়নি। রাজনীতি থেকে তাকে বিদায় করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের নিজ শহর কালিম্পং এ একাকী, নিঃসঙ্গ, নিন্দিত ও ভীতসন্ত্রস্ত্র এক জীবনযাপন শেষে ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই লেন্দুপ দর্জি মারা যান। তার বয়স হয়েছিলো ১০৩ বছর।
 

নেপালে “র” এর তৎপরতা
অনেক বৎসর যাবতই, ভারত তার গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর সহায়তায় প্রকাশ্যে নেপালের অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে নেপালের বৈধ সরকারকে অস্থিতিশীল করে ভারত-পন্থি পুতুল সরকার বসাতে চেষ্টা করে আসছে। নেপালের প্রাক্তন রাজা ভারতের আধিপত্য গ্রহনে অস্বীকার করলে ২০০১ সালে, উক্ত “র” রাজ পরিবারের নয় সদস্যের হত্যাযজ্ঞের পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে।
King Birendra, Pr. Dipendra, Pr. Nirajan of Nepalese R.Fam.

নেপালের রাজা বিরেন্দ্র এবং রাজ পরিবার
অনেক সংগ্রামের পর, এপ্রিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাওপন্থিগনের জয়লাভ করার মধ্য দিয়ে নেপালে ভারতপন্থি রাজত্বের অবসান ঘটে। তারপর, নেপালের নতুন নির্বাচিত সরকার ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এশিয়া মহাদেশে ভারতের কৌশলগত প্রতিপক্ষ চীনের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভের পরও, নেপালের কংগ্রেস এবং পূর্বতন ভারতপন্থিদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারনে তাঁরা কোন ঐক্য মতে পৌছাইতে পারে নাই। এই সুযোগে, নেপালি কংগ্রেস এবং বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে পূর্ব থেকেই অপেক্ষায় থাকা “র” এর সদস্যগন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অবনতি ঘটানোর মাধ্যমে নেপালকে ভারতের প্রভাব বলয়ের মধ্যে ফিরিয়ে আনে।
প্রাথমিক ভাবে “র” এর মাধ্যমে সশস্ত্র বিদ্রোহের সুত্রপাত এবং পরবর্তীতে ভারতপন্থি নেতাদের অনুরোধে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রনের অজুহাতে ভারত নেপালে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। তাছাড়া, নেপালি কংগ্রেস সদস্যদের সাথে মিলে কাজ করার লক্ষ্যে ভারত নেপালি বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং উৎসাহও প্রদান করে। যখনই নেপালের রাজা বা নেপাল সরকার ঐ অঞ্চলকে ভারতের প্রভাব এবং আধিপত্য থেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করে, তখনই ভারত নেপালের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, তথাকথিত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে, নিয়মতান্ত্রিক সরকার সমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচলনার উদ্দেশ্যে মাওবাদিদের অস্ত্রাদী সংগ্রহে অনুপ্রাণিত করা হয়।
“র” এর পরিকল্পনায় এ ধরনের সাজানো বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ভারত নেপালে সামরিক ভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেয়। এরূপ ঘটনা, প্রকৃতপক্ষে কয়েক বৎসর পূর্বে শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে ঘটানো ভারতীয় নাটকের পুণরাবৃত্তি মাত্র। বাস্তবে, “র” শুধুমাত্র ভারতীয় বংশদ্ভুত নাগরিকদের সাহায্য এবং অস্ত্র-সস্ত্রাদী সরবরাহ করছিল।
ভুটান থেকে হস্তান্তরিত নেপালি আদিবাসী, যারা পূর্ব নেপালে আশ্রয় নিয়েছিল “র” তাদেরকেও অনুপ্রবেশ করায়। এছাড়াও, সম্পূর্ণ নেপালি অর্থনীতি ভারতীয় ঋণ দাতা, অর্থশালী, এবং বানিজ্য মাফিয়া নিয়ন্ত্রণ করতো।৬
( RAW’s Machination In South Asia by Shastra Dutta Pant, Kathmandu, 2003)
 

শ্রীলংকায় ‘র” এর কর্মতৎপরতা
শ্রীলংকায় দীর্ঘদিন যাবত চলমান সহিংসতা, ‘র” এর সদস্যগনের অনুপ্রবেশের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরন। এ প্রসঙ্গে, জৈন কমিশন প্রকাশ করে যে, ১৯৮১ সালের পর থেকে ‘র’ ভারতের অভ্যন্তরে “লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলাম”(LTTE) কে সহায়তা কল্পে ত্রিশটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিল এই সংস্থার বেতনভুক্ত কর্মকর্তা। অনতিকাল পূর্বে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন শিং, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপ্রধান মাহিন্দা রাজাপাক্ষাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “শ্রীলংকার তামিল সম্প্রদায়ের অধিকার এবং নিরাপত্তা যেন সুনিশ্চিত থাকে।”
ltte-blag_tiger_03
স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রীলঙ্কা, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একটি বহু ধার্মিক শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে পরিচালিত হচ্ছিল এবং স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির চর্চা করতো। ১৯৭১ সালে, পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রাক্কালে, ভারতের চাপ থাকা সত্ত্বেও, শ্রিলঙ্কা পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক বিমান এবং জাহাজ সমূহকে বিনা সমস্যায় জ্বালানী সরবরাহ করা সহ স্বীয় আকাশ সীমা এবং সমূদ্র বন্দর ব্যাবহারের অনুমতি দেয়।
এছাড়াও শ্রিলঙ্কা, ইসরায়েলকে গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ভয়েস অব আমেরিকাকে শ্রীলঙ্কার সীমানার অভ্যন্তরে শক্তিশালী প্রেরকযন্ত্র স্থাপনের অনুমতি দেয়, এবং ভারত তাতে প্রতিবাদ করে।
উপরোক্ত কারনে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী শ্রীলঙ্কাকেও তথাকথিত ইন্দিরা ডক্টরিন (India Doctrine) এর আওতাভুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করে। গান্ধী ‘কাও’কে শ্রীলঙ্কাতে বাংলাদেশে ‘র’ এর সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে নির্দেশ দেন। নির্দেশ প্রাপ্তির অনতিকাল পরই, ‘র’ শ্রীলঙ্কা সরকারকে দুর্বল এবং অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য জঙ্গিদের সন্ধানে নেমে পরে।
‘র’ একদিকে তামিলনাড়ুতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে, অন্যদিকে ‘র’ এর অবসরপ্রাপ্ত গেরিলা প্রশিক্ষকদের অবসর থেকে টেনে আনে। ‘র’ তামিল টাইগার দের অস্ত্র প্রদান এবং ‘গুন্ডা’, গোরাখপুর প্রভৃতি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সমূহে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ, ১৯৮৭ সনে “ভারত-শ্রীলঙ্কা ঐক্য চুক্তি” সাক্ষরের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা ভারতের প্রভাব বলয়ে পতিত হয় এবং ভারতীয় শান্তি রক্ষী বাহিনী শ্রীলঙ্কার মাটিতে পদার্পণ করে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শ্রীলঙ্কাতে ‘র’ এর তৎপরতার প্রাক্কালে উৎকণ্ঠিত হয়ে পরে, যেহেতু ‘র’ তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের পররাষ্ট্র নীতি পরিপন্থী, তামিল টাইগার প্রধান ‘প্রভাকরন’ এর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। আর, স্বামিনাথন (‘র’ এর প্রাক্তন বিশেষ সচিব) এর মতে, এই ব্যবস্থা রাজিব গান্ধী ও তামিল নেতা প্রভাকরনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

শ্রীলঙ্কাতে প্রাক্তন ভারতীয় হাই কমিশনার জে,এন,দীক্ষিত এল,টি,টি,ই কে পাঁচ কোটি রুপি প্রদান করার দায়ে ‘র’ কে অভিযুক্ত করেন।
পরবর্তীতে, ‘র’ উক্ত এল,টি,টি,ই র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ই,পি,আর,এল,এফ (Eelam People’s Revolutionary Liberation Front) এবং ই,এন,ডি,এল,এফ (Eelam National Democratic Liberation Front) গঠন করে, যাদের মাধ্যমে শ্রিলঙ্কার পরবর্তী পরিস্থিতি ভীষণ ভাবে অস্থিতিশীল, সংঘাতময় এবং অনিশ্চিত করে তোলে।


তিব্বত
তিব্বত বা শিচাং (চৈনিক: শিৎসাং) গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। তিব্বতের অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তিব্বতের রাজধানীর নাম লাসা।
১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিদের স্বাধীকারের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়। অনতিকাল পূর্বে, ‘র’ তিব্বতে চীনের শাসনের বিপক্ষে প্রতিবাদ মিছিলের সংগঠনের উদ্দেশ্যে নেপালে বসবাসরত তিব্বতীয়দের সহায়তা করে। ১০ মার্চ ২০০৮ যখন তিব্বতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সরকার বিরোধী আন্দোলন ও বিক্ষোভ পরিচালিত হয়, তা প্রতিবেশী প্রদেশ সমূহেও প্রভাব বিস্তার করে।
তিব্বতিদের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা তার ১২০,০০০ অনুসারী নিয়ে ভারতে নির্বাসনে থাকার প্রাক্কালে ‘র’ এর সদস্যগন কৌশলে তাকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং চীনের তিব্বত এলাকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে এবং সশস্ত্র বাহিনী সংগঠনে ও পরিচালনায় সহায়তা করে।
 

কাশ্মীর
কাশ্মীরে সহিংসতায় ভিন্ন মাত্রা যোগ হলে সেখানে ‘র’ এর তৎপরতাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বর্তমান সময়ে আগস্ট ১২ ২০০৮, হুরিয়াত সম্মেলনের আহ্বায়ক শেখ আব্দুল আজিজকে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা হত্যার মাধ্যমে শুরু হয়।
এই সময়ে, অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারফিউ বহাল, কাশ্মীরে বেসামরিক জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান এবং হত্যাযজ্ঞ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এযাবৎ কাল পর্যন্ত সহস্রাধিক নিরাপরাধ জনতাকে ভারতীয় সেনাগন হত্যা করে। এছাড়াও, ১৯৮৯ সনের পর থেকে, ভারতীয় সেনা সদস্যগন ‘র’ এর গুপ্ত তৎপরতা সহায়তায়, কাশ্মিরের জনসংখ্যার বৃহদাংশের মধ্যে সহিংসতা সৃষ্টি করার জন্য সকল প্রকারের অমানবিক ও অনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে।
বিগত কিছু বছরে ভারতের দখলকৃত কাশ্মীরে অন্ততপক্ষে শত শত গুপ্ত গনকবর আবিষ্কৃত হয়, যেখানে অন্ততপক্ষে ২০০০ কাশ্মিরীর মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়। এই সকল কাশ্মীরিগনকে ‘র’ এর সদস্যগন নিপীড়নের মাধ্যমে হত্যা করে।
 

র’ এর ‘ছিনতাই-গুম’ কর্মকাণ্ড
দেশ দখল করা ছাড়াও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে আরও যেসব গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তার কিছু নিম্নে তুলে ধরা হলো।
২০০৯ সালের শেষের দিকে গবেষণা মূলক পত্রিকা “The Week” নেপাল এবং বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আই.বি এবং ‘র’ এর সম্মিলিত ভাবে পরিচালিত গুপ্ত তৎপরতা সম্পর্কে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, উপরোক্ত গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ উপরোল্লিখিত প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে অন্ততপক্ষে চারশত ‘snatch operation’ ‘ছিনতাই অপারেশন’ বা গুম-অপারেশন পরিচালিত করে। দীর্ঘ হস্তান্তর প্রক্রিয়া এড়ানোর লক্ষ্যে, ‘র’ বিভিন্ন দেশ থেকে সন্দেহভাজন ব্যাক্তিকে গুপ্ত ভাবে এরূপ ছিনতাই কর্মকান্ডের মাধ্যমে গ্রেপ্তার বা আটক করে। আটককৃত ব্যক্তিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিভিন্ন কায়দায় জেরা এবং অনুসন্ধান কর্ম পরিচালনা করে। আটক কৃত এরূপ সন্দেহভাজন ব্যাক্তি সম্মন্ধে ঐ সংস্থা সমূহ কোন তথ্য প্রকাশ করে না।
নেপালকে সন্ত্রাসীদের অতিক্রমণ পথ হিসাবে ধারণা করে, ‘র’ এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আই, বি নেপালে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করে। উক্ত পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশকে ‘র’ এবং আই,বি’র মাধ্যমে নেপাল, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ সমূহে অন্ততপক্ষে চারশত এধরনের ‘গুপ্ত ছিনতাই কর্মকাণ্ড’ সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করে।

অপারেশন লিচ (বার্মা)
আরাকান এবং ঘন বনাঞ্চল বেষ্টিত, সামরিক শাসক দ্বারা পরিচালিত ‘মায়ানমার’ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার নিকট বিশেষ উদ্বেগ সৃষ্টিকারী অঞ্চল হিসাবে গন্য হয়ে আসছে। যেহেতু, প্রতিবেশী দেশ সমূহে বন্ধুসূলভ অথবা অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারত সর্বদাই তৎপর। এই উদ্দেশ্যে, ‘র’ বার্মার বিপ্লবী দল সমূহ এবং ‘কাচিন স্বাধীনতা সেনাদল’ (KIA) কে অনুশীলন প্রদান করতে থাকে। ভারত KIA কে সীমিত ভাবে ভারতীয় অঞ্চলে অলাঙ্কারাদিতে ব্যবহারকৃত পাথরের বানিজ্য পরিচালনা করার অনুমতি দেয়, এমন কি তাদেরকে অস্ত্রাদীও সরবরাহ করে। দিল্লীতে ‘র’ এর প্রধানের সাথে KIA র পরিচালক ‘মারান ব্রাং সেং’ দুইবার সাক্ষাৎ করে বলেও ধারণা করা হয়।
যেহেতু KIA উত্তরপূর্ব ভারতের সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী দল সমূহের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রাদীর উৎস হয়ে উঠে, ‘র’ তাঁদের মাধ্যমে ‘অপারেশন লিচ’ নামে একটি অপারেশন পরিচালনা করে, যাতে অন্যান্য সকল বিদ্রোহী দল সমূহের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার লক্ষ্যে ‘র’ এর দ্বারাই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বার্মার বিদ্রোহীদের হত্যা করা হয়।
এভাবে, ‘ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকানস'(NUPA) এর সামরিক প্রধান, খাইং রাজা সহ মোট ছয় জনকে গুলি করে হত্যা এবং অস্ত্র- ব্যবসার অজুহাতে ৩৪ জন আরাকানি গেরিলা যোদ্ধাকে বন্দী করা হয়।
অপারেশন বাংলাদেশ- তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পরিকল্পনা
“All revolutions launched with the help of crutches of other countries are self-destructive“— Shastra Dutta Pant.

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় “রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং” র’ এর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গুপ্ত তৎপরতার ভূমিকা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। উক্ত গুপ্ত তৎপরতা সম্পর্কিত নথিপত্র বা দলিলাদী সংস্থার গোপন কুঠরিতেই চাপা থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে উপরোক্ত সংস্থার দুইজন বিশেষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, আর এন কাও এবং কে শঙ্করন নায়ের গেরিলা ইউনিট গঠনে সবিশেষ তৎপর থাকে।
আর এন কাও ১৯৭১ সনের মার্চ মাসে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্য থেকে বহু সহস্র শরণার্থীদের পাক বাহিনী এবং সরকারী সংস্থা সমূহ বিধ্বংস করার উপযুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেয়, অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনী চূড়ান্ত আক্রমনের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষারত থাকে। র’ এবং ভারতীয় আধাসামরিক সংস্থাসমূহ প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত শরণার্থীদের “মুক্তি বাহিনী” নাম প্রদান করে। কাদের সিদ্দিকী পরিচালিত গেরিলা ইউনিটও র’ এর দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়। আর এন কাও এর তত্ত্বাবধানেই ১৯৭১ সনের ১৪ এপ্রিল (কলকাতায়) প্রবাসী সরকার গঠন করা হয় এবং মুজিব নগর নাম করা হয়।

১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর সশস্ত্র আক্রমন শুরু করলে, ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), আনসার এবং “ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট” বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইতিমধ্যে, ভারত এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপুল সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানী বাঙ্গালীদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদেরকে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি যুদ্ধাস্ত্র সমূহ প্রদান করে। তাঁদের সাথে অনেক ভারতীয় নিয়মিত সেনা এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যগনও একযোগে কাজ করেন।
১৯৭১, ১১ এপ্রিল কর্নেল ওসমানীকে (অব.) প্রধান করে, এ সকল বাহিনীকে “মুক্তি বাহিনী” নামে একটি আনুষ্ঠানিক নাম প্রদান করা হয়।১০ M.K.Dhar
 

পূর্ব পাকিস্তানকে, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে
ভারতীয় নেতৃত্বের অজুহাত
“১৯৬০ সালের দিকে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই লাল ডেঙ্গা পরিচালিত “মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট” এবং “নাগা” সংগঠন সমূহকে চীনের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে সহায়তা করে। এই সহায়তার বদৌলতে, চীনের গোয়েন্দা সংস্থা “নাগা” এবং মিজোদের চীনের ইউনান প্রদেশে স্থাপিত ঘাটি সমূহে প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয়।
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই’ পরিচালিত তৎপরতা রোধের অজুহাতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব-পাকিস্তানিদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচেষ্টায় সহায়তা করে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

অখন্ড ভারত
জুলাই ১৯৬৭ সনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাতে (IB) যোগদানকারী বি. রমন, তার লিখিত “দ্য কাও বয়েস অব র” গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “১৯৬০ সালের দিকে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই লাল ডেঙ্গা পরিচালিত “মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট” এবং “নাগা” সংগঠন সমূহকে চীনের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে সহায়তা করে। এই সহায়তার বদৌলতে, চীনের গোয়েন্দা সংস্থা “নাগা” এবং মিজোদের চীনের ইউনান প্রদেশে স্থাপিত ঘাটি সমূহে প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয়।
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই’ পরিচালিত তৎপরতা রোধের অজুহাতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব-পাকিস্তানিদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচেষ্টায় সহায়তা করে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ – Research & Analytical Wing
১৯৭১ সনে “র” এর বয়স মাত্র আড়াই বছর হলেও পরিপূর্ণভাবেই একটি বহি:স্থ গোয়েন্দা সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, এমন কি অন্যান্য দেশে, বিশেষতঃ প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে, গুপ্ত তৎপরতা চালাতে সক্ষম এমন প্রশিক্ষিত চৌকশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নিয়োগের মাধ্যমে এক সুসংবদ্ধ গোয়েন্দা সংস্থা “র” কে গড়ে তোলা হয়।
১৯৬৮ সনের ২১ সেপ্টেম্বর, ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আই.বি.”র(IB) বহি:স্থ গোয়েন্দা বিভাগীয় প্রধান প্রয়াত রমেশশর নাথা কাও কে ‘র’ এর প্রধান হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেন। ‘র’ গঠনের দু’এক মাসের মধ্যেই, এই সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রাথমিক ভাবে দুটি বিষয় অগ্রাধিকার পায়। একটি হলো, পাকিস্তান এবং চিন সম্মন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা এবং দ্বিতীয়টি, পূর্ব পাকিস্তানে গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
অন্য দেশের অভ্যন্তরে গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সাফল্য অর্জন করা দুই বছরের কিছু অধিক সময় যথেষ্ট নয়, তথাপি র’ এর পক্ষে তা সম্ভব হয়। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলেনে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তা দানে ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্তের মুহূর্ত থেকেই এ সংস্থা মাঠে নেমে পরে।
র’ এর দায়িত্ব ছিল পাচ ধরনের, 
১)রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গোয়েন্দা কর্ম চালু করা; 
২)গোপন স্থানে বাঙালি মুক্তি যোদ্ধাদের প্রশিক্ষন প্রদান করা; ৩)পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের এবং বিদেশে পূর্ব পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশন গুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা এবং তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করায় পরামর্শ দেয়া; 
8) পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগা এবং মিযো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবস্থান এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র সমূহ উচ্ছেদের উদ্দেশে বিশেষ অপারেশন চালানো; এবং 
৫) পাকিস্তানী রাষ্ট্র নেতাদের বিরুদ্ধে একটি প্রচারাভিযানের (PSYWAR) সংগঠন করা ইত্যাদি।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (IB) এবং “র” এর মাধ্যমে নিরচ্ছিন্ন এবং বিপূল তথ্যাদি প্রবাহিত হতে থাকে। এ কাজ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তার এবং পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর দুর্বল যোগাযোগ নিরাপত্তা ব্যাবস্থার কারনে খুব সহজেই সংগঠিত হয়। ১৯৭১ সনের পরিস্থিতি ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জন্য স্বপ্নিল, তাদেরকে তথ্যের পেছনে ছুটতে হয় নি, বরং তথ্যই তাদের পেছনে ছুটে আসে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন সাচ্ছন্দে বাঙালি নেতাদের এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। ১৯৬৮ সালের পূর্বে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (IB) এবং পরবর্তীতে “র” (R&AW), অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে যৌথ সম্প্রচার ব্যাবস্থার স্থাপন করে ছিল।

বি, রমনের লেখায় স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয় যে, পাকিস্তানকে দুর্বল করার, প্রয়োজনে ভাঙ্গার পরিকল্পনা ভারতের রাজনৈতিক নেতা এবং গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনেক পূর্ব থেকেই ছিল কিন্তু সামরিকভাবে ও রাজনৈতিক ভাবে অসম্ভব বিধায় কাপুরুষের মত গুপ্ত পন্থার আশ্রয় নেয়।
(যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন উভয় রাষ্ট্রই ভারতের পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রয়াসের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। উভয় রাষ্ট্রই আরও ধারণা করে যে, ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামক আর একটি রাষ্ট্র গঠনে সাফল্য লাভ করেই, তার দৃষ্টি ফেরাবে বেলুচিস্তানের দিকে, যেখানে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারন করছে।
প্রকৃতপক্ষেই, পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর, “র” পাকিস্তানে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেলুচিস্তানকে পৃথক করতে সচেষ্ট হয়। এই উদ্দেশ্যে “র” ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি দিকে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স টিম-এক্স (CIT-X) নামে গুপ্ত সংস্থা গঠন করে।)
রমন আরও উল্লেখ করেন, বিমান এবং নৌ বাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সেনা বাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকলেও, কাও এর অধিনস্ত “র” এর গুপ্ত সদস্যবৃন্দ এবং ডি.জি.এস (Directorate-General of Security) এর ইউনিট সমূহ, চট্টগ্রাম “নাগা” এবং “মিজ”দের পরিত্যক্ত আস্তানায় হানা দিয়ে ধংস করে। হানার প্রাক্কালে তাঁরা ধারণা করে, যে নাগা সদস্যগন ইতিমধ্যেই তাঁদের আস্তানা তৎকালীন বার্মার নাগা পাহাড় এলাকায় স্থানান্তরিত করে। অন্যদিকে, মিজো সদস্যগন স্থানান্তরিত না হলেও “র” এবং ডি.জি.এস এর হাতে ধরা পরা থেকে বেচে, চিন পাহাড়ে এবং বার্মার আরাকানের বিভিন্ন বিভাগে সরে যেতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সনের যুদ্ধ এবং “নাগা”, মিজো’ বিদ্রোহীদের বিপরীতে পাল্টা আক্রমনের প্রাক্কালে, নতুন ভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার বিষয়ে উত্তর বার্মার গুরুত্ব অনেক বেরে যায়। “নাগা”, মিজো’ বিদ্রোহীগন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে, গোপনে বার্মার কাচিন প্রদেশের পুতাও অঞ্চলে সরে যেতে সক্ষম হয়। কাচিন প্রদেশ এবং বার্মার নাগা পর্বতমালা ঐ সময় ছিল “নো ম্যান্স ল্যান্ড”, যেখানে মিতকিনিয়া এবং পুতাও শহর ব্যাতিরেকে বার্মা সরকারের কোন প্রতিনিধি বা সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল না। তা স্বত্বেও, একটি বিষয়ে সকলেই একমত ছিল যে, ১৯৭১ সন ছিল “র” এর জন্য খুবই সুবিধাজনক।১৩
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ব-পাকিস্তানিদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচেষ্টায় সহায়তা করে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ গঠনের সিদ্ধান্তের পিছনে, পাকিস্তানের আই,এস,আই এর ভারতের উত্তর পশ্চিমে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণকে সহায়তা প্রদানের দাবি ছাড়াও রয়েছে ভারতের আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারনবাদী নীতির বাস্তবায়নের লক্ষ্য। এ ব্যাপারে গভীরে যাওয়ার পূর্বে, উত্তর-পূর্ব ভারতে সংগঠিত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারন সমূহ সম্মন্ধে আলোকপাত করা প্রয়োজন।
পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধিকার অর্জনে সহযোগিতার দাবী সত্যের অপলাপ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বহুবিধ ভারত- বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানে অযথা কালক্ষেপন, পক্ষান্তরে সমস্যা সমূহ অমিমাংসিত রেখে ‘বিগ ব্রাদার’ সূলভ অবস্থান গ্রহন, কোনক্রমেই বন্ধু দেশের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ করেনা। উপরন্তু, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ভাবে অনধিকার চর্চা করে ভারত বাংলাদেশের জনসাধারনের প্রতি অবন্ধুসূলভ এবং আধিপত্যবাদী চরিত্রেরই পরিচয় অতীতে দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে।

সীমান্ত হত্যা-কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্তে বেসামরিক জনসাধারণকে হত্যা, ছিটমহল, ফারাক্কা-টিপাইমুখ বাধ, ট্রানজিট, গঙ্গা-তিস্তা সহ নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে ভারত বার বার প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এমন কি জনগনের অস্তিত্ব তদের নিকট একেবারেই গুরুত্বহীন।
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ভারত বহুবিধ সুবিধা অর্জন করে চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল যেভাবে প্যালেস্টাইনিদের কোণঠাসা করে রাখছে, ঠিক একই পদ্ধতিতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশকে ঘেরাও করে, ট্রানজিট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভারতের শাসকেরা পুরো দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথা নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় । বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে এখন ভারতের প্রভাব বাড়ছে, চার শতাধিক বায়িং হাউজ ভারতেরই। শিক্ষা, চিকিৎসা, মিডিয়া, বিনোদন জগতেও তাদের প্রভাব গভীর, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নানা আয়োজন চলছে। ভূমি ও বসতি বাণিজ্যেও অনেক প্রস্তাব আছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত অনেকাংশেই ভারতের নিয়ন্ত্রণে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও ভারতের পক্ষে, তৎকালীন পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে একটি নতুন অনুগত প্রতিবেশী রাষ্ট্র গঠন ভিন্ন আর কোন উদ্দেশ্য যে ছিলনা তা আজ একদিকে বাংলাদেশের জনগনের এবং বিশ্ববাসীর নিকট অত্যন্ত পরিস্কার।

সূত্র সমূহঃ
Nani Gopal Mahanta- Confronting The State
Professor Tilottoma Misra
Nani Gopal Mahanta- Confronting The State
4-5. Maloy Krishna Dhar, Formar Joint Director, Intelligence Bureau, India- ‘open secret’
RAW’s Machination In South Asia by Shastra Dutta Pant, Kathmandu, 2003
Open Secrets, Maloy Krishna Dhar, Formar Joint Director, Intelligence Bureau, India.
B.Raman, “The Kaoboys of R&AW”.
RAW :GLOBAL AND REGIONAL AMBITIONS” Edited by Rashid Ahmad Khan and Muhammad Saleem, Published by Islamabad Policy Research Institute, Asia Printers, Islamabad, 2005.
B.Raman, “The Kaoboys of R&AW”।ৃ

1 টি মন্তব্য:

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে!

  দলিল প্রমাণসহ রবীন্দ্রনাথের কুকর্ম তুলে ধরা হলো, কষ্ট করে পড়ুন—কত জঘন্য ব্যক্তি ছিল সে! এক.   শুনতে খারাপ শোনালেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের...