মাদখালি সালাফি তথা আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা
“সালাফ” শব্দের অর্থ হলো পূর্বসূরী। ইসলামী পরিভাষায় সালাফ বলতে ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের মানুষদেরকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ সাহাবী, তার পরবর্তী প্রজন্ম তাবিঈ ও তার পরবর্তী প্রজন্ম তাবা তাবিঈ। এই তিন প্রজন্মের হিদায়াতপ্রাপ্ত মানুষরাই হলেন আমাদের সালাফ। আর সালাফদের যারা অনুসরণ করবে তারা হল সালাফি। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, সালাফদের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার মাধ্যমেই আমরা সঠিক ইসলামি পথের সন্ধান পেতে পারি। আমরা কখনোই প্রকৃত সালাফিদের ঘৃণা করি না, বরং যারা সালাফি নামটি ব্যবহার করে সাধারণ মুসলিমদের ধোকা দিচ্ছে আমরা শুধুমাত্র তাদের বিরোধিতা করছি।
বর্তমান যুগে একটি দল নিজেদের সালাফি দাবি করলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা সালাফদের প্রদর্শিত পন্থা পরিহার করে নির্দিষ্ট কিছু শাইখদের অন্ধ অনুসরণ করছে। এমনই একটি দল হচ্ছে মাদখালি সালাফি। ইথিওপিয়ার আলেম মুহাম্মাদ আমান আল জামি এবং ইয়েমেনের আলেম রাবি আল মাদখালি এর বিভ্রান্তিকর মানসিকতার অন্ধ অনুসারী হচ্ছে মাদখালি সালাফি নামক এই দল। আমাদের দেশে এ দলটি মূলত নিজেদের “আহলে হাদিস” বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। শিরক বিদ’আত সম্পর্কিত কিছু ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য হলেও ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয়ে তাদের বিভ্রান্তি ও গোঁড়ামি ধীরে ধীরে স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হচ্ছে।
১) তারা বিশ্বাস করে যে, ঈমান হচ্ছে শুধুমাত্র অন্তরের বিশ্বাসের নাম এবং আমলগত কুফরির কারণে কেউ কাফির হয় না। কোন ব্যক্তি অন্তর থেকে অস্বীকার না করলে সে যত বড় কুফরি কাজ করুক না কেন তার ঈমান নষ্ট হবে না। আমরা যদি তাদের এরূপ অদ্ভুত ব্যাখ্যা মেনে নেই তাহলে কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দিলেও আমরা তাকে কাফির বলতে পারব না। কারণ গালি দেওয়া তো আমলগত কুফরি, অন্তরে সে কি বিশ্বাস করে তা তো আমরা জানি না। সত্যিই অদ্ভুত তাদের ব্যাখ্যা।
২) ইসলামের বিধান বাতিল করে মুসলিম ভূখন্ডগুলোকে সেক্যুলার মানব রচিত বিধানের মাধ্যমে শাসন করা তাদের নিকট মারাত্মক কোন বিষয় নয়। মতভেদ সম্পর্কিত মাস’আলা সম্পর্কে তাদের কঠোর অবস্থান থাকলেও কুফরি শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের তেমন কোন কঠোর অবস্থান লক্ষ্য করা যায় না। কারণ তাদের মতে, কুফরি বিধানের মাধ্যমে শাসন করা ছোট কুফরি যার কারণে কেউ কাফির হয় না। অথচ ইমাম ইবনে হাযাম রহিমাহুল্লাহ “ইহকাম আল আহকাম ফি উসুল আল আহকাম” গ্রন্থে এই মর্মে ফাক্বীহগণের ইজমা বর্ণনা করেছেন যে, যদি কেউ তাওরাত কিংবা ইঞ্জিল দ্বারাও বিচার করে, তাহলে সে একজন কাফের মুশরিক।
৩) যে সকল শাসক প্রতিনিয়ত ইসলাম বিরোধী আইন তৈরি করার মত বড় কুফরি করছে সে সকল শাসককে তারা কাফির তো মনে করেই না, বরং সে সকল তাগুত শাসকের আনুগত্য করা ফরজ বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে তারা শাসকের আনুগত্য সম্পর্কিত কিছু হাদিস প্রদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ মুসলিমদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ সহীহ হাদিস থেকে এটি স্পষ্টরূপে প্রমাণিত যে, আনুগত্যের শর্ত শুধুমাত্র সে সকল মুসলিম শাসকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা জনগণকে আল্লাহ তায়ালার কিতাব অনুসারে পরিচালনা করে এবং যারা কোন প্রকাশ্য কুফরি কাজে লিপ্ত হয় নি। কুফরি বিধান তৈরি করার চেয়ে প্রকাশ্য কুফরি আর কি হতে পারে?
৪) তাদের ভ্রান্ত নীতির অনুসরণ না করে কোন মুসলিম যদি আইন প্রণয়নকারী শাসককে কাফির ঘোষণা করে এবং উক্ত শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মানসিকতা রাখে তাহলে তারা সেই মুসলিমকে খারেজি, তাকফিরি বলে অপবাদ প্রদান করে। অথচ আমরা জানি যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ ও ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ তৎকালীন যুগের মঙ্গোলদের কাফির ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন, কারণ তারা মুসলিম ভূখন্ডের শাসক হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিচার না করে চেঙ্গিস খানের তৈরি করা “আল ইয়াসিক” নামক সংবিধান দ্বারা বিচার করতো।
৫) তাদের বিকৃত ধর্মে জিহাদের কোন স্থান নেই। তারা প্রতিনিয়ত জিহাদের ক্ষেত্রে নানা সংশয় ও অদ্ভুত শর্ত তৈরি করতে থাকে এবং জিহাদের প্রতি সাধারণ মুসলিমদের নিরুৎসাহিত করতে থাকে। তারা তাগুত শাসকের অধীনে জিহাদ করার আহ্বান জানায়। যারা জিহাদের আলোচনা করে, জিহাদের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তাদেরকে তারা খারেজি ও চরমপন্থী উপাধি প্রদান করে। এমনকি তারা জিহাদ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত ও হাদিসের প্রচারকেও ফিতনা বলে অভিহিত করে।
৬) যারা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং মুসলিমদেরকে আল্লাহ তায়ালার পথে জিহাদের প্রতি আহ্বান করেন তাদেরকে তাগুত প্রশাসনের নিকট অর্পণ করাকে তারা তাদের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে। তাদের বিকৃত মনোভাব দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, তারা ইসলামি শাসন ব্যবস্থাকে অপছন্দ করে এবং শয়তানের তৈরি কুফরি শাসন ব্যবস্থাকেই তারা ভালবাসে। এভাবেই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
সালাফি নামটি ব্যবহার করে যে সকল দল তাদের ভ্রান্ত আকিদা ও মানহাজ প্রচার করে সাধারণ মুসলিমদের ধোঁকা দিচ্ছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই পেজে এতদ সংক্রান্ত অনেক পোস্ট আছে এবং আসবে, লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
লেখক:চিকিৎসক, জার্নালিস্ট ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ