"ভার্সিটিতে পড়া মানেই কি চরিত্রহীন? মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও চাকুরী করা কি ইসলামের অন্তরায়"
আমি শুরুতেই নারী জাতির প্রতি যথাযাথ সন্মান ও তাদের ব্যক্তিত্ব ও পর্দার প্রতি সন্মান জানাচ্ছি। গত বছর নারীর পর্দা নিয়ে আমার একটি পোস্ট করেছিলাম। ওখানে আমি পর্দার বিষয়ে আমার দৃষ্টি ভঙ্গি প্রকাশ করেছি। আবারও বলছি আমি মেয়েদের পর্দার বিষয়ে কঠোর পর্দার কথা বলি ও বিশ্বাস করি। গত সপ্তাহেও আমার সবচেয়ে প্রিয় একটি পরিবারের আমার সন্ত্বানের সমতুল্য এক মেয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার পর তাকে চরম বকাঝকা করায় সম্পর্ক অবনতি হয়েছে।
যাই হোক ইদানীং কিছু সেলিব্রিটি ও আলেম সমাজের একটা অংশ এবং মাদরাসায় পড়ুয়া আলেমা গনও একটি বিষয়ে বিশোধাগার করছে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে আর তা হলো ভার্সিটিতে ফ্রি মিক্সিং ও মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও চাকুরী নিয়ে। সমালোচকদের এমন মনোভাব যেন স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে মানেই পাপিষ্ঠ আর চাকুরীজিনী মহিলা মানেই নষ্টা-ভ্রষ্টা।
বাংলাদেশের মাদরাসা গুলোর মধ্যে দ্বীনি শিক্ষা ও পর্দার বিষয়টা কড়াকড়ি থাকার কারনে এখানে ছেলে মেয়ের ফ্রি মিক্সিং ও বেপর্দা হওয়ার সুযোগ কম। আর কলেজ-ভার্সিটির ছেলে মেয়েদের মধ্যে বাধ্যবাধকতা না থাকায় বেশীর ভাগ ছেলে মেয়ে শিক্ষার অভাবে হোক, জানার অভাবে হোক আর ইচ্ছাকৃত ভাবেই হোক পর্দার বিষয়টা ৫০% ভাগ ছেলে মেয়ে অবহেলা করে কিন্তু ইদানীং পর্দা করা মেয়ের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে(আলহামদুলিল্লাহ)।
এবার আসুন কলেজ-ভার্সিটিতে যারা পড়াশোনা করে তাদের বিষয়ে মাদরাসায় পড়ুয়া ভাই বোনেরা যে অভিযোগ করেছে তা কতটুকু সত্য বলি, মন দিয়ে শুনুন। আপনারা মাদরাসায় নামাজ পড়েন আর পর্দা করেন এটা আপনাদের ক্যাম্পাস গুলোতে স্রোতের পক্ষে করেন। আর স্কুল-কলেজে যারা পর্দা করে এবং নামাজ পড়ে তারা স্রোতের বিপরীতে করতে হয়। পরতে পরতে বাঁধা আসে ইসলাম মানার ক্ষেত্রে। ক্লাশ, পরীক্ষা ও চাকুরী সব জায়গায়ই হাজারো প্রতিকূলতা পেরিয়ে পর্দা ও ইবাদত করতে হয়।আর আপনারা স্রোতের অনুকূলে থেকে নিজেরা পরহেজগার হচ্ছেন।
আমি নিজেও কলেজ-ভার্সিটির ছাত্র। আমি নিজেই দেখেছি কত ছেলে হলের মধ্যে রাতে আঁধারে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলায় রাতের পর রাত। কিভাবে নিজের ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করে ইসলামী আন্দোলন করে। আমি নিজেই স্বাক্ষী কত ভাইয়েরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন জেল জুলুম সহ্য করছে। আমার মেডিকেলের ১ দিনেই ছাত্র-চিকিৎসক সহ ৮৮জন জেলে নিয়েছে পুলিশ শুধু মাত্র ঈদ পরবর্তী পূর্মিলনীর অনুষ্ঠান হতে। যে মামলা এখনো চলমান। কই কেউ তো ইসলামী আন্দোলন ছেড়ে যায় নি। তবে হ্যাঁ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কযাম্পাস গুলোতে বাতিল শক্তির দাপটের কারনে এখানে যে কেউ চাইলেই নফসের গোলামী করতে পারে এবং করছেও। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাতো এই বিপরীত মূখী স্রোত হতে দোজখের পথ যাত্রী গুলোকে দ্বীনের পথে আনছে। আর মাদরাসায় বসে আপনারা স্রোতের অনুকূলে বসে নিজেদের একমাত্র বুজুর্গ মনে করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গনহারে চরিত্রহীন বলছেন। আচ্ছা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো মাদরাসার ক্যাম্পাস হতে কত গুলো ছার-ছাত্রী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছেড়ে দিলে নিজের দ্বীন আর বুজুর্গ গিরি কতক্ষন ধরে রাখতে পারবেন? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গুলোতে ইসলামি সংগঠন গুলো দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে কি আপনাদের ধারনা করা চরিত্রহীন লোকদের দিয়ে? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতনখারাপ হলে ইসলামি সংগঠন গুলোমদিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কিভাবে?
আমি যদি প্রশ্ন করি মাদরাসায় পড়ুয়া ছাত্ররা বা আলেমরা চলমান বিশ্বের বাতিলের মোকাবেলায় ইসালমকে কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছেন তার উত্তর কি দিবেন? উইলিয়ম ক্যাম্পবেলের কোরআন নিয়ে অভিযোগের উত্তর দাতা ডা. জাকির নায়েক এবং নাস্তিক আসাদ নূরের কোরআন নিয়ে ১১টি মিথ্যা অভিযোগের জবাব দাতা ডা:বশির আহাম্মদের পড়াশোনাও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়েছে। আমি তাই বলে মাদরাসার আলেম-আলেমাদের অবদান অস্বীকার করছি না। আপনারা আপনাদের জায়গা হতে আপনাদের কাজ করছেন, আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের কাজ৷ নিজ নিজ অবস্থান করছে। কোন কাজই অবহেলার নয়। তবে মাদরাসায় পড়াশোনাটাই ইসলামকে কেন্দ্র করে আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের কাজটা ঐচ্ছিক।
আপনারা গনহারে যে বলছেন কলেজে পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে করলে সন্ত্বান ভাল মা পাবে না এটা সর্ববৈ মিথ্যা এবং আপনাদের অহঙ্কারের প্রকাশ। বহু বাংলা পড়া মায়ের সন্ত্বানরা আজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ইসলামি সংগঠন গুলোর ঝান্ডা বাহী।
আপনারা যে ক্যাম্পাসকে ফ্রি মিক্সিংয়ের কারখানা বলেন সে ক্যাম্পাসের একটা ঘটনা বলি। মেডিকেলে ২য় বর্ষের ছাত্র আমি তখন। এক বেপর্দা বান্ধবী(যেহেতু চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়টাই কো-ডুকেশন, সেখানে ছেলে-মেয়ে আলাদা করে রাখা সম্বব নয়) পাশাপাশি হাটছিলাম, দূর থেকে মনে হয়েছিলো আমরা গায়ে গা লাগিয়ে হাটছিলাম,কিন্তু আদতে তা ছিলো না। হঠাৎ এক বোরকা ও নেকাব পড়া বড় আপু যাকে কখনোনদেখিনি তিনি আমাকে ক্যান্টিনে ডেকে নিয়ে আমাকে বিনা কারনে বকা ঝকা দিয়ে তার পড় আমার কাছে থাকা ফিমারের হাড় দিয়ে কয়েক ঘা পেদানী দিয়ে বলল কেন মেরেছি আগামী কাল সকাল ৮ টায় এখানে এসে জেনে যাবি। চুপচাপ চলে গেলাম। পরের দিন সকালে আমি আর আপুর বলা ঐ স্থানে রাগের কারনে যাই নি। কিন্তু বোরকাওয়ালা আপু নাছর বান্দা, আমার ৩ বছরের সিনিয়র, আমার ক্লাশে গিয়ে সামনে দাঁরিয়ে আছে, ক্লাশ শেষে ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টিনে, তার পর বলে তোকে কাল কেন মেরেছি জানিস? আমি বলি আপনি ভাল জানেন। তখন আপু বলে সত্য করে বল কাল কি তুই ঐ মেয়েটার গায়ে ঘেঁষে হাটছিলি। এ কথা শোনে আমি তো বেকুবের মত। আপু অবস্থা বুঝতে পেরে বলল সত্য করে বল, আমি জানি তুই মিথ্যা বলবি না, আমি বললাম না আপু ভিড়ের মাঝে ও আমার পাশ দিয়ে কথা বলতে বলতে হাটছিলো। আপু বলল সত্যি, আমি মন খারাপ করে বল্লাম সত্যি, তা ছাড়া আমি এই বিষয়ে আল্লাহর দেওয়া বিধানকে মেনে চলার চেষ্টা করি। তার পর আপু সরি বলে ব্যাগ হতে নিজের তৈরী করা এক বক্স খাবার আমার ১১ জন একই ক্লাশের ইসলামি সংগঠনের সাথে জড়িত ছেলে বন্ধুদের নিয়ে খাওয়ার কথা বলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে সবাই মিলে খাবি আর ইসলামী সংগঠন করবি। ১ বছর পর জানতে পারি ঐ আপু ছিলো তখন আমাদের ক্যাম্পাসের ছাত্রী সংস্থার সভা নেত্রী। এমন শাসন আর স্নেহও তো আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গুলোতে আছে।
এবার আসেন মাদরাসা পড়েয়া আলেমরা যে নিজেদের নিয়ে অহঙ্কার করেন, আর বলেন কলেজে পড়া ছেলে মেয়েরা ধর্মহীন তাদের মাদরাসার ঘটনা একটু বিস্তারিত বিবরন দেই।
আগে আসুন আলিয়া মাদরাসা গুলোর বিষয়ে। আগেই ক্ষমা চেয়ে নেই,কারন এখনে বাস্তবতা তোলে ধরব এবং এতে তিতা কিছু কথা আসবে, এটা আমার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফল নয়, বরং সত্যতা প্রকাশ। আলিয়া মাদরাসায় ছেলে মেয়ে ফ্রি মিক্সিং হয় না? অধিকাংশ আলিয়া মাদরাসায় ছেলে মেয়ে পাশাপাশি বসে ক্লাস করে আর প্রায় সব আলিয়া মাদরাসায়ই ছেলে-মেয়ে একই ক্যাম্পাসে থাকে। এটা কি ফ্রি মিক্সিং নয়? আলিয়া মাদরাসার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক হয় না? প্রেম-পিরিতী করে না? কত শত শত প্রমান লাগবে? কোন আলিয়া মাদরাসায় পড়ুয়া কোন বন্ধু থাকলে গোপনে জিজ্ঞেস করবেন। আলিয়াতে ছেলে-মেয়ের মধ্যে অবৈধ দৈহিক সম্পরকের মাধ্যমে অপ গর্বের ঘটনারও ভুড়ি ভুড়ি প্রমান দেখাতে পারব। কিন্তু তাই বলেকি আলিয়ার সকল আলেম খরাপ? না বরং ঐগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটমা এবং সংখ্যাও কম। তদরুপ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনা গুলো আপনারা দেখছেন তার পরিমানও নেহায়েত কম।
এবার আসুন কওমী মাদরাসার বিষয়ে আসি।কওমীতে তো ছেলে মেয়ে একসাথে থাকার সুযোগ নাই। তাই বলে সবাই ফেরেশতা? কওমীর আলেম আলি হোসেন উসামার কওমীর চরিত্র নিয়ে একটি ভাইরাল ওয়াজ আসা করি আপনারা শুনেছন। আমি আর বেশী কিছু বলব না। এত টুকুই বলব তিনি তার বক্তব্যে বলেছে কওমী মাদরাসার আলেমরা প্রায় সবাই সমকামীতায় জড়িত, আমি জানি না সত্য কিনা, তবে উনি মিথ্যা বলে থাকলে তার জাবাব আল্লাহর কাছে সে দিবে। উসামা সাহেব কওমী পুরুষ ও মহিলা আলাদা বলেন নি। তবে সংবাদিকতার সুবাদে আমার কাছেও কওমী মাদরাসার অনেক ঘটনার ফাইল ফুটেজ আছে যা আলী হাসান উসামার কথার সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। তাই বলে কওমীর সবাই খারাপ না।
এবার আসুন মেয়েদের উচ্ছ শিক্ষা আর চাকুরী নিয়ে কথা বলি। আপনারা যারা মেয়েদের চকরী নিয়ে চুলকান সে সকল আলেম-আলেমাদের বলছি। আলেমারা যখন অসুস্থ হন তখন কি পুরুষ ডাক্তার দেখান না মহিলা ডাক্তার দেখান? আলেমদের বউদের তল পেটে যখন ব্যাথা হয় তখন পরীক্ষার জন্য কোন ডাক্তার দেখান, মহিলা ডাক্তার না পুরুষ ডাক্তার? যদি মেযেরা ুচ্চ শিক্ষা না করে তখন মহিলা চিকিৎসক কোথায় পাবেন?
যদি আপনি বিদেশ যাওয়ার সময় মহিলা ইমিগ্রেশন অফিসার না পান তবে আপনার মেডিকেল পুরুষ করতে হবে, মহিলা পুলিশ মহিলা ক্রিমিনাল ধরার জন্য সহ এমন বহু কাজ আছে যেখানে মহিলা অবশ্যম্ভাবী। এরকম অনেক কাজ আছে যেগুলো উচ্চ শিক্ষিত নারী ছাড়া সম্ভব না।
কিন্তু কথা হলো এই চাকুরী গুলো যেন অবশ্যই পর্দা মেনে করা হয়। যেকানে পর্দা ও ইজ্জত হুমকীর মুখে পড়বে সেই চাকুরী হতে অবশ্যই সরে পড়তে হবে।
লেখক:চিকিৎসক, জার্নালিস্ট ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ