মুসলিমদের বিভক্তির পরিনামের ফলাফল নিয়ে আল্লাহর সাবধান বানী
আল্লাহ তা'য়ালা মুসলিমদের বিভক্তি ও পরস্পর পরস্পরের সাথে শত্রুতা পোষন নিয়ে যে সাবধানতার কথা বলেছেন তা সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৮০-৮২ তে স্পষ্ট করেছেন।
تَرٰى كَثِیْرًا مِّنْهُمْ یَتَوَلَّوْنَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا١ؕ لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ اَنْفُسُهُمْ اَنْ سَخِطَ اللّٰهُ عَلَیْهِمْ وَ فِی الْعَذَابِ هُمْ خٰلِدُوْنَ
অর্থা:
আজ তুমি তাদের মধ্যে এমন অনেক লোক দেখছো যারা (ঈমানদারদের মোকাবিলায়) কাফেরদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে। নিঃসন্দেহে তাদের প্রবৃত্তি তাদেরকে যে পরিণতি দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। সে পরিণতি হলো, আল্লাহ তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং তারা চিরন্তন শাস্তি ভোগ করবে।(মায়েদা -৮০)
মূল কথা হলো:
তুমি তাদের মাঝে এমন বহু লোককে দেখতে পাবে, যারা (ঈমানদারদের বদলে) কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতেই বেশী আগ্রহী, অবশ্য তারা নিজেরা যা কিছু অর্জন করে সামনে পাঠিয়েছে তাও অতি নিকৃষ্ট, এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর ক্রোধান্বিত হয়েছেন, এ লোকেরা চিরকাল আযাবেই নিমজ্জিত থাকবে।
পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَ لَوْ كَانُوْا یُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ النَّبِیِّ وَ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِ مَا اتَّخَذُوْهُمْ اَوْلِیَآءَ وَ لٰكِنَّ كَثِیْرًا مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ
যদি এ লোকেরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ, নবী এবং নবীর ওপর যা নাযিল হয়েছিল তা মেনে নিতো তাহলে কখনো (ঈমানদারদের মোকাবিলায়) কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতো না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করেছে।(ময়েদা-৮১)
এর অর্থ হচ্ছে, যারা আল্লাহ, নবী ও আসমানী কিতাবকে মেনে নেয় তারা স্বাভাবিকভাবে মুশরিকদের মোকাবিলায় এমন লোকদের প্রতি বেশী সহানুভূতিশীল হয়, যাদের সাথে ধর্মের ব্যাপারে বিরোধ থাকলেও তারা তাদেরই মতো আল্লাহ ও আল্লাহ প্রেরিত অহির ধারাবাহিকতা ও রিসালাতকে মানে। কিন্তু এ ইহুদীরা এক অদ্ভূত ধরনের আহলি কিতাব। তাওহীদ ও শিরকের যুদ্ধে এরা প্রকাশ্যে মুশরিকদের সাথে সহযোগিতা করছে। নবুওয়াতের স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির লড়াইয়ে এদের সহানুভূতি রয়েছে নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের প্রতি। এরপরও এরা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এ দাবী করে বেড়াচ্ছে যে, তারা নবী ও কিতাব মানে
ইহুদীদের অবাধ্যতার কারণ :
পরিশেষে ষষ্ট পারার শেষ প্রাস্তে এসে বনী ইসরাইল সংক্রান্ত সমাপনী বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে। এখানে কোরআনে কারীম রসূলের যুগে এদের অবস্থা কী ছিলো তা বর্ণনা করছে। মূলত বনী ইসরাইলদের অবস্থা সর্বযুগে সর্বকালে একই ছিলো, তারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতো এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতো । তার একমাত্র কারণ হচ্ছে তারা আহলে কেতাব হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর প্রতি ও রসূলের প্রতি অবতীর্ণ বিষয়ের প্রতি ঈমান আনেনি । সর্বোপরি তারা আল্লাহর সর্বশেষ দ্বীনেও প্রবেশ করেনি, সুতরাং তারা মোমেন নয়। যদি তারা ঈমানদার হতো, তবে কাফেরদের সাথে কখনো বন্ধুত্ব করতো না। কোরআনের এই ভাষ্যটি যেমনিভাবে রসূলের যুগে ইহুদীদের বেলায় প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সর্ব যুগেই তাদের ব্যাপারে এটা প্রযোজ্য, অনুরূপভাবে উপরোক্ত ভাষ্য আজকের বিশ্বের আহলে কিতাবীদের অপর দলটির ওপরও প্রযোজ্য ৷ অতীতে ইহুদীরাই মোশরেকদের সাথে বন্ধুত্ব করতো এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদেরকে ষড়যন্ত্রে, লিপ্ত করত। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, “তারা (কেতাবধারীরা) কাফেরদেরকে বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে ।” কোরআনে হাকীমের বিভিন্ন আয়াতে তাদের পুরোপুরি অবস্থা বর্ণনা এসেছে। আহযাব যুদ্ধ চলাকালীন সময়, তার পূর্বে এবং পরে এমনকি বর্তমান যুগের ঘটনাবলীর মাধ্যমেও এটা পরিস্ফুটিত হয়েছে। নাস্তিক জড়বাদী নব্য কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব এবং সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমেই এই বনী ইসরাইলীরা অবশেষে আজ ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আহলে কেতাবদের অপর দলটি মুসলমানদের কোনো কোনো বিষয়ের ব্যাপারে নাস্তিক জড়বাদীদের সাথে সাহায্য সহযোগিতা করে। আব্দুল ওহাব নযদি নামক হাদিসে বর্নিত শয়তানের শিং খ্যাত বাতিল ফেরকার জন্মও ড.হামফেরী নামক কমনওয়েলথ ব্রিটিশ গোয়েন্দার মাধ্যমে খ্রিস্টানরাই মুসলমানদের বিভক্তির জন্য সৃষ্টি করেছেন। অনুরূপভাবে তারা মোশরেক পৌত্তলিকদেরও সহযোগিতা করে। যখন মোশরেক এবং মুসলমানদের মাঝে কোনো যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়- যদিও ওই সমস্ত মুসলমানরা সত্যিকার ইসলামের প্রতিনিধিত্ব না করে নামকা ওয়াস্তে মুসলমান হয় তবুও তাদের এ হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতা দ্বীন ইসলাম এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে কখনো বন্ধ হবে না। এমনকি যদি তারা দ্বীনের সত্যিকার অনুসারী না হয় তবুও ৷ মহান আল্লাহ তায়ালা সত্যিই বলেছেন, 'আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে ।' 'তারা নিজেদের জন্যে যা পাঠিয়েছে তা অবশ্যই মন্দ । তা এই যে, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা চিরকাল আযাবে থাকবে ।' নিসন্দেহে তাদের প্রবৃত্তি তাদেরকে আস্তে আস্তে যে পরিণতির দিতে ঠেলে দিচ্ছে তার প্রতিফলন হচ্ছে তাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ এবং চিরকাল শাস্তি ভোগ করা। সুতরাং ওই পরিণাম কতই না নিকৃষ্ট এবং ওই উপঢৌকন কতই না খারাপ, ইহুদীদের কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার পরিণতি কি এক আশ্চর্য্য ব্যাপার? আমাদের মধ্য থেকে যে কেউ উপরোক্ত সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহর বাণী শুনবে, সে নিজ থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না, যার অনুমতি আল্লাহ তায়ালা তাকে দেননি। যেমন ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং তাদের শত্রু কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বকারীদের মাঝে বন্ধুত্ব ও সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারটি আল্লাহ্ তায়ালা কখনো আমাদের এ অনুমতি দেননি । যদি প্রশ্ন করা হয় ওই সম্প্রদায়ের কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব না করার কারণ কী হতে পারে? জবাবে বলা হবে একমাত্র কারণ হচ্ছে, 'আল্লাহ এবং তার রসূলের প্রতি ঈমান না আনা ।' (আয়াত ৮১)
এটাই হচ্ছে মূলত সত্যিকারের কারণ । নিসন্দেহে তারা আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূল(সা:) এর প্রতি ঈমান আনেনি । তাদের অধিকাংশ লোকই ফাসেক। তারা অনুভুতি ও গতিপথের দিক থেকে কাফেরদের সমকক্ষ । সুতরাং তারা মোমেনদের সাথে বন্ধুত্ব না করে কাফেরদের সাথেই করবে। এখানে কোরআনে কারীমের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের সামনে তিনটি উল্লেখযোগ্য বাস্তব সত্য পরিস্ফুটিত হয়েছে।
১। আহলে কিতাবীদের সকল লোকই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি । তারা তার পক্ষ হতে প্রেরিত সর্বশেষ নবীর প্রতি ঈমান আনেনি । কোরআনে করীমের কথানুযায়ী তারা শুধু সর্বশেষ নবীর প্রতি ঈমান আনাকেই অস্বীকার করেনি, বরং আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমান আনাকেও তারা অস্বীকার করেছে। 'যদি এ লোকেরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ, নবী এবং নবীর ওপর যা নাযিল হয়েছিল তা মেনে নিতো, তাহলে কখনো (ঈমানদারদের মোকাবেলায়) কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতো না ।' এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে স্পষ্ট বর্ণনা, যা কোনো প্রকার ব্যাখ্যার প্রয়োজন রাখে না, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে তাদের দাবী যাই হোক না কেন বিশেষ করে যদি আমরা তাদের এই ভূমিকাকে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কিত চিন্তা চেতনার বিকৃতি ধরে নেই তাহলে বিষয়টা আরো পরিস্কার হয়ে যাবে।
২। সমস্ত আহলে কিতাবীদের মোহাম্মদ(স.) এর ভাষায় আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করার জন্যে আহবান করা হয়েছে। যদি তারা মোহাম্মদ(স.) এর আহবানে সাড়া দেয়, তবে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করবে। আর যদি তারা তা থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহর বর্ণনানুসারে তারা কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
৩। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে আহলে কিতাবী ও মুসলমানদের মাঝে বন্ধুত্ব ও সাহায্য সহযোগিতা হতে পারে না। কারণ মুসলমানদের কাছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র হবে তার নিজের দ্বীনের অনুগত । ইসলাম তার অনুসারীদেরকে আহলে কিতাবীদের ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার ও আচরণ করতে ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের জান মাল ও ইযযত আবরু হেফাযত করতে তাদেরকে তাদের নিজস্ব আকীদা বিশ্বাসের ওপর ছেড়ে দিতে, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত উত্তমরূপে পৌছে দিতে, তাদের সাথে উত্তমভাবে কথা বলতে সর্বোপরি তাদের সাথে দেয়া প্রতিশ্রুতি এবং সন্ধির শর্ত পূরণ করে চলতে । কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দ্বীনের ক্ষেত্রে তাদের ওপর বল প্রয়োগ করা যাবে না। আর এটাই হচ্ছে ইসলামের স্পষ্টতা, ইসলামের অনুগ্রহ ৷ আল্লাহ তায়ালা সদা সত্য কথা বলেন এবং হামেশা মানব জাতিকে সঠিকপথের সন্ধান দেন।
পরের আয়াতে আল্লাহ আরো কঠিন বার্তা দিয়েছেন,
لَتَجِدَنَّ اَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوا الْیَهُوْدَ وَ الَّذِیْنَ اَشْرَكُوْا١ۚ وَ لَتَجِدَنَّ اَقْرَبَهُمْ مَّوَدَّةً لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوا الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّا نَصٰرٰى١ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّ مِنْهُمْ قِسِّیْسِیْنَ وَ رُهْبَانًا وَّ اَنَّهُمْ لَا یَسْتَكْبِرُوْنَ
ঈমানদারদের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে তুমি ইহুদী ও মুশরিকদের পাবে সবচেয়ে বেশী উগ্র। আর ঈমানদারদের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিকটতম পাবে তাদেরকে যারা বলেছিল আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। এর কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে ইবাদাতকারী আলেম, সংসার বিরাগী দরবেশ পাওয়া যায়, আর তাদের মধ্যে আত্মগরিমা নেই।(মায়েদা-৮২)।
অন্য ভাবে অনুবাদ করলে:
অবশ্যই তোমরা ঈমানদারদের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে ইহুদী ও মোশরেকদেরই বেশী কঠোর (দেখতে) পাবে, (অপরদিকে) মোমেনদের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে তোমরা সেসব লোককে (কিছুটা) নিকটতর পাবে, যারা বলেছে আমরা খৃস্টান; এটা এই কারণে যে, (তখনো) তাদের মধ্যে ধর্মীয় পন্ডিত ব্যক্তি ও সংসারবিরাগী ফকীর-দরবেশরা মজুদ ছিলো, অবশ্যই এ ব্যক্তিরা অহংকার করে না।
আল্লাহ মুসলমানদেরকে ঐক্য বজায় রাখার তৌফিক দিন(আমীন)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ