-ভারতীয় হিন্দুদের পেছনের ইতিহাস
ভারতীয় অধিবাসীদের মধ্যে অতীতে উপনিষদ, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য দর্শন বিকশিত হচ্ছিল। তাদেরকে, পরবর্তীতে আর্যদের কর্তৃত্বকে গ্রহন করার জন্য নিজেদের প্রাচীন প্রথা সমূহ বিসর্জন দিয়ে বৈদিক সামাজিক শ্রেণী প্রথা গ্রহন করতে বাধ্য করা হয়।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ:
জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শৈবধর্ম, নাথিজম (শৈব ধর্মের সাথে তন্ত্রের সংযোগ) এবং নাস্তিক্যবাদ (পুনর্জন্মে এবং নিয়তিতে বিশ্বাসী) ইত্যাদি ধর্ম বিশ্বাস সমূহ অ-বৈদিক, অনার্য অথবা ব্রত্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত। ব্রত্য ধর্ম সমূহ মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, পছন্দ বা আগ্রহের ভিত্তিতে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র সমূহের মত বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিল।
তবে, ব্রত্য সমাজে উত্তরাধিকার ভিত্তিতে অথবা ব্যাক্তি বিশেষের জন্মগত বা পারিবারিক অধিকার সুলভ “শ্রেণী বিন্যাস” স্বীকৃত ছিলনা। এই সমাজ শুধু কোন ব্যক্তির নিজস্ব যোগ্যতাতে বিশ্বাস করতো, কারও সন্তান বা উত্তরসূরি হিসাবে নয়। প্রকারান্তরে, ব্রত্য সমাজ ছিল শ্রেণীহীন সমাজেরই অন্যরূপ এবং ব্রাম্মন্যবাদী সমাজের তুলনায় প্রগতিশীল।
যেভাবে বৈদিক শ্রেণী প্রথা ভিত্তিক ধর্মের প্রবর্তন করা হয়:
প্রাচীন ভারতে প্রাথমিক ভাবে, শ্রম বিভাগ গঠন করা হয় ব্রত্য সমাজের মাধ্যমে ব্যাক্তি বিশেষের যোগ্যতা এবং আগ্রহের উপর ভিত্তি করে। যদি কেউ কবিতা লিখে বা রচনা করে সমাজের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠতো অথবা সন্মান লাভ করতো, তাহলে সে “ব্রাম্মন” হিসাবে স্বীকৃতি পেত। অথবা, যদি কোন ব্যাক্তি অস্ত্র ব্যাবহারে বিশেষ যোগ্যতা প্রদর্শন করতো, তাহলে সে “ক্ষত্রীয়” হিসাবে স্বীকৃতি পেত, ইত্যাদি। “ব্রাম্মন” অথবা “ক্ষত্রীয়” শব্দদ্বয়ের শ্রেণী বিন্যাসের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না, তেমনি কারও জন্ম বা পারিবারিক সূত্রের সাথেও এদের কোন সম্পর্ক ছিলনা।
এই নিয়মানুসারে, কোন ব্যাক্তি নির্দিষ্ট কোন শ্রেণী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় যোগ্যতার কারনে অন্য শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেত। এভাবে, কোন শূদ্র পুরুষ ব্রাহ্মণের পদ মর্যাদা পেতে পারতো অথবা ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কোন বালককে তার কৃত কর্মের কারনে সূদ্র পর্যায়ে নেমে আসতে হতো। এভাবেই, গোত্র সমূহের মাঝে এমন এক সমাজ গঠনের সূত্রপাত হয়, যেখানে সকল কিছুই সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ব্রাম্মন্যবাদের জন্য লাভজনক পরিগণিত হওয়ার কারনে সমাজের এই শ্রম পদ্ধতিতে বিন্যাসের প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু শাসক অথবা কার্যনির্বাহী সদস্যদের সহযোগিতা ভিন্ন এই এককেন্দ্রিক নীতির প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে উঠে। সেই সুত্রে প্রবর্তিত হয় শ্রেণী প্রথা।
সে জন্যই প্রধান কার্যনির্বাহীকে সর্বোচ্চ পদ প্রদান করা হতো এবং এমন এক নিয়মের পালন করা হতো, যে নিয়মানুসারে কোন রাজপুত্র নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই রাজার উত্তরাধিকারী হিসেবে গন্য হতো, যার মাধ্যমে সে সকল প্রকার বিশেষ সুযোগ সুবিধার অধিকারী হতো, শুধু তাই নয়, এ নিয়ে সকল প্রকার বিতর্কেরও বিলুপ্ত সাধন করা হয়। এ ভাবেই প্রধান কার্যনির্বাহীর সন্তানও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে প্রধান কার্যনির্বাহীর পদ লাভ এবং কোন ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাম্মণের মর্যাদা লাভ করতো।
প্রধান কার্যনির্বাহী বা শাসনকর্তাকে রাজা হিসেবে অভিহিত করে দেবতার প্রতিনিধি বা সমাজের রক্ষাকর্তা হিসেবে তাকেই বিধাতার স্থলাভিষিক্ত করা হতো। এই নিয়মানুসারে রাজাকে সমাজের আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। অন্যান্য কার্যনির্বাহীদের, যাদের সহায়তা ব্যাতিরেকে নতুন আইন বা নিয়ম কানুন সমাজে প্রয়োগ করা সম্ভব হতো না, সেহেতু শুধু তাদেরকেই প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পদ্ধতি সমাজের সর্বত্র শ্রেণী প্রথার মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে প্রচলিত হতে থাকে। তবে, এমন ব্যক্তি বা ব্যাক্তি সমষ্টিও ছিল যারা এই শ্রেণী প্রথা এবং একাধিপত্যের বিপক্ষে ছিল। অ-বৈদিক অথবা ব্রত্য পদ্ধতির বিশেষত্ব ছিল প্রকারান্তরে শ্রেণীহীনতা।
এভাবেই, শ্রেণী প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষের জনগনের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
ঐতিহাসিক ভাবে, বৌদ্ধ, জৈন, ধর্মাবলম্বী এবং নাস্তিকতার অনুসারীগন এই শ্রেণী প্রথার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে। এদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীগন শুধু প্রতিপক্ষই হয়ে উঠে নাই বরং তারা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করে। এভাবে এঁরা ব্রাম্মন্যবাদের কট্টর অনুসারীগনের প্রধান শত্রু এবং অত্যাচারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠে। তথাপি, বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের বিলুপ্ত না করা পর্যন্ত এই শ্রেণী প্রথা প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব হয়ে উঠে। এই কারনে, অন্যান্য শ্রেণীর জনগনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পরে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সাক্ষ্য দেয় যে, ব্রাম্মণ এবং ক্ষত্রিয়গনের সম্মিলনের মাধ্যমেই শ্রেণী প্রথা বা বর্ণাশ্রম অদম্য শক্তি অর্জন করে।
ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে। মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বাজজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন…‘… এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে নাস্তিক, চার্বাকদের উক্তিতেই প্রমাণ রয়েছে। অতএব বৌদ্ধরা মূর্তিপূজা যজ্ঞবলি বা ধর্মাচার নিষিদ্ধ করে প্রচার করছিল পরকাল নেই,জীব হত্যা মহাপাপ প্রভৃতি। মোটকথা হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের বিপরীতে জাত ভেদ ছিল না।’গতিশীল বৌদ্ধবাদ যখন জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করল তখন থেকে শরু হল ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে বৌদ্ধবাদের বিরোধ।
সংঘাত ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠল। উভয় পক্ষই পরস্পরকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। হিন্দুরা তাদের রাজশক্তিরআনুকুল্য নিয়ে বৌদ্ধদের উৎখাতের প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত রাখে। কখনো কখনো বৌদ্ধরা রাজশক্তির অধিকারী হয়ে তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়। বৌদ্ধবাদ কেন্দ্রিক নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাঙন সৃষ্টির জন্য হিন্দুরা চানক্য কৌশল অবলম্বন করে। বৌদ্ধদের মধ্যকার অধৈর্যদের ছলেবলে কৌশলে উৎকোচ ও অর্থনৈতিক আনুকূল্য দিয়ে বৌদ্ধবাদের চলমান স্রোতের মধ্যে ভিন্ন স্রোতের সৃষ্টি করা হয় যা কালক্রমে বৌদ্ধদের বিভক্ত করে দেয়। বৌদ্ধবাদকে যারা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে থাকে তাদেরকে বলা হতো হীনযান। আর হিন্দু ষড়যন্ত্রের পাঁকে যারা পা রেখেছিল যারা তাদের বুদ্ধি পরামর্শ মত কাজ করছিল তাদেরকে ব্রাহ্মণ্য সমাজ আধুনিক বলে অভিহিত করে। এরা মহাযান নামে অভিহিত। এরাই প্রকৃত পক্ষে পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
মহাযান নতুন দল হিন্দুদের সমর্থন প্রশংসা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বৌদ্ধবাদের মূল আদর্শ পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তিমূলও নড়ে যায়। বৌদ্ধদের এই শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে প্রথমত নির্ভেজাল বৌদ্ধবাদীদের ভারত ভূমি থেকে উৎখাত করে এবং পরবর্তীতে মহাযানদেরও উৎখাত করে। কিন্তু যারা একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশ্রয় নিয়ে বৌদ্ধ আদর্শ পরিত্যাগ করে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে তাদের জাতি সত্তাকে বিসর্জন দেয় তারাই টিকেথাকে। সে কারণে আজ বৌদ্ধের সংখ্যা বৌদ্ধবাদের জন্মভূমিতে হাতে গোনা। কোন জাতি তার আদর্শ ও মূলনীতি পরিত্যাগ করে অপর কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করলে সেই জাতিকে স্বাতন্ত্রবিহীন হয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। ছয়শতকে যখন আরবে জাহেলিয়াতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে ইসলামের অভ্যুদয় হয়েছে সে সময় বাংলায় চলছিল বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞ।
৬০০ থেকে ৬৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শিবভক্ত রাজা শশাঙ্ক বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত গয়ার বোধিদ্রুম বৃক্ষ গুলিতিনি সমূলে উৎপাটন করেন। যে বৃক্ষের উপর সম্রাট অশোক ঢেলে দিয়েছিলেন অপরিমেয় শ্রদ্ধা সেই বৃক্ষের পত্র পল্লব মূলকাণ্ড সবকিছু জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। পাটলিপুত্রে বৌদ্ধের চরণ চিহ্ন শোভিত পবিত্র প্রস্তর ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। বুশিনগরের বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেন।
গয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে বৌদ্ধদেবের মূর্তিটি অসম্মানের সঙ্গে উৎপাটিত করে সেখানে শিব মূর্তি স্থাপন করেন। অক্সফোর্ডের Early History of India গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ মঠগুলি ধ্বংস করে দিয়ে মঠ সন্নাসীদের বিতাড়িত করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের পাদদেশ পর্যন্ত বৌদ্ধ নিধন কার্যক্রম চালিয়েছিলেন কট্টর হিন্দু রাজা শশাঙ্ক। ‘আর্য্যা মুখশ্রী মূলকল্প’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম নয় জৈন ধর্মেরওপরও উৎপীড়ন ও অত্যাচার সমানভাবে চালিয়েছিলেন তিনি। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক চেতনা একই রকম।
উভয় ধর্মে জীব হত্যা নিষেধ। ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করা হল এবং বৌদ্ধদের নিহত অথবা বিতাড়িত হতে হল অথচ মহাবীরের ধর্ম জৈন আজো ভারতে টিকে রয়েছে। এটা বিস্ময়কর মনে হলেও এর পেছনে কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সেটা হল বৌদ্ধরা শুরু থেকে হিন্দুদের দানবীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা প্রতিক্রিয়াশীল-চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। পক্ষান্তরে জৈনরা হিন্দুদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়নি। হিন্দুদের সাথে সহ অবস্থান করেছে তাদের ধর্মীয় রীতি নীতি সভ্যতা সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে। তারা মেনে নিয়েছে হিন্দুদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি, তারা ব্যবসায়ের হালখাতা, গনেশ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, দুর্গাকালি স্বরস্বতী পূজা পার্বন হিন্দুদের মত উদযাপন করতে শুরু করে। ভারত জনের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে- ‘হিন্দু মতে যদিও জৈন ও বুদ্ধ উভয়ে নাস্তিক তাহা হইলেও হিন্দু ধর্মের সহিত উভয়ের সংগ্রাম তীব্র ও ব্যাপক হয়নি।হিন্দুদের বর্ণাশ্রম হিন্দুদেব দেবী এবং হিন্দুর আচার নিয়ম তাহারা অনেকটা মানিয়া লইয়াছেন এবং রক্ষা করিয়াছেন।
সেন হিন্দু ব্রাহ্মণরা পাল রাজাদের হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে ও বিহার গুলো ধ্বংস করে ॥ ১২৬ বছর বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে॥ এবং বৌদ্ধের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে ॥ এবং সৃষ্টি করে বর্ণবাদী জাত প্রথা ॥ এর জন্য সেন রাজাদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশ ত্যাগ করে অসংখ্য বৌদ্ধ ॥
ঐতিহাসিকগণ মতামত প্রদান করেন যে, সমূদ্র গুপ্তের (রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৩৩৫ – ৩৮০ অব্দ) সময় কাল থেকে শঙ্কারাচার্যের (খ্রিস্টিয় ৮ম শতাব্দী) সময় কাল পর্যন্ত বৈদিক ব্রাহ্মণগণ বৌদ্ধ ধর্মকে বিলুপ্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। জানা যায় যে, শঙ্করাচার্যই বৌদ্ধ ধর্মের উপর সর্বশেষ আঘাত হানে। এতদসত্তেও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি, এমন কি শঙ্কারাচার্যের শাসনকালের পরও টিকে থাকে কিন্তু অগাধ আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধার লোভে অগনিত বৌদ্ধ পণ্ডিতদের বৈদিক ধর্মে ধর্ম্যান্তরিত হওয়ার কারনে ভারতের বেশীর ভাগ অঞ্চলেই তাদের শক্তি এমন ভাবে লোপ পায় যে বৌদ্ধ ধর্মের শক্তি কার্যত পঙ্গু হয়ে পরে। সর্বশেষে, ১৪ শতাব্দীতে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বারানসিতে বৌদ্ধ ধর্মের অবশিষ্টাংশ বিলুপ্ত করে।
ব্রাম্মণ্যবাদ ক্রমশঃ রাজা বা শাসকের এবং ধনিক শ্রেনীর সহযোগিতা নিয়ে বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ধর্ম বিধ্বংস করে এবং এসব ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারীদের ব্রাম্মন্যবাদে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্রাম্মণ্যবাদ উত্তরোত্তর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ থেকে ধারণা করা যায়, কি ভাবে বৈদিক ধর্মের নামে শ্রেণী প্রথা বিস্তার লাভ করে। রাণী এবং প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে সুবিখ্যাত শৈব আপ্পার এবং তিরুঙ্গনা সাম্বান্দর, মহারাজা মৌর্য বর্মণকে জৈন ধর্ম থেকে শৈব ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয় এবং ধর্মান্তরিত হওয়ার দিন ৮০০০ জৈন পুরোহিতের শীরচ্ছেদ করা হয়। এমন কি আজও মাদুরাই মন্দিরে এই দিবস পালন করা হয়। তারপর, এই সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিরুগনানা সাম্বান্দার এর মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যে সকল মন্দিরে স্থাপন করা হয়। খৃস্টীয় ১০ম শতাব্দীতে নম্বি অন্দর নম্বি এবং ১২শ শতাব্দীতে শেক্কিঝার মহারাজা মৌর্য বর্মণকে ধর্মান্তরিত করার এবং জৈন পুরোহিতদের হত্যা করার বিষয়টিকে শৈব ধর্মের মহা বিজয় বলে গন্য করে।
তিরুমাঙ্গাই আলোয়ার, নাগপত্তিনাম মন্দির থেকে স্বর্ণ দ্বারা তৈরি বৌদ্ধমূর্তি চুরি করে এবং এই চুরি করা ধন দিয়ে সুবিখ্যাত শ্রী রঙ্গনাথ মন্দির নির্মাণ করার জন্য সে বিখ্যাত হয়ে উঠে। বৌদ্ধ, জৈন মন্দিরকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার বহুল ঘটনাই ঘটে।
নিম্নে এসবের কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ
১। কুঝিথুরাই এর নিকটবর্তী বর্তমানের হিন্দু তিরুচানম মন্দির ছিল মূলত একটি জৈন মন্দির। এই মন্দিরে পার্সোনাথ, মহাবীর এবং পদ্মাবতী দেবীর মূর্তি সংরক্ষিত আছে।
২। নগরকইলে নাগরাজ মন্দিরও ছিল একটি জৈন মন্দির, যা হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা হয়।
৩। পেরুম্বাভুর নিকটবর্তী কলিল গুহা মন্দির ছিল প্রকৃতপক্ষে জৈন মন্দির।
৪। মাদিয়াম পল্লি মন্দির ছিল জৈন মন্দির। জৈন দেবী পদ্মাবতীকে দেবী ভগবতী হিসেবে রূপান্তর করা হয়।
৫। অন্ধ্র প্রদেশের চেয়ারলা এলাকার কপোতেশ্বরা মন্দিরকে আনুমানিক পঞ্চম/ ষষ্ঠ শতাব্দীতে রূপান্তর করা হয়।
৬। মহারাষ্ট্রের শোলাপুর এলাকার তাকাড়া মন্দির ছিল বৌদ্ধ মন্দির যা ৫ম শতাব্দীতে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা হয়।
৭। জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, সুবিখ্যাত দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর এর তিরুপতি মন্দির ছিল জৈন মন্দির। জৈন তিরথামকার “নেমিনাথ” কে এই মন্দির উৎসর্গ করা হয়েছিল। এমনও বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে বর্তমান দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর এর মূর্তি প্রকৃতপক্ষে ছিল “নেমিনাথ” এর মূর্তি। এই মন্দিরকে ব্রাম্ম মন্দিরে রূপান্তর করা হয়।
উত্তর ভারতেও এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে বৌদ্ধ মন্দির সমূহ হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা হয়েছে, গৌতম বুদ্ধ কে বিষ্ণু রূপে অথবা তাকে বিষ্ণুর পুনর্জন্ম হিসেবে দেখানো হয়েছে। এসবের মধ্যে একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে, গয়ার বৌদ্ধ মন্দিরকে এবং গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণু হিসেবে রুপান্তর করা। এই মন্দিরে প্রতিটি হিন্দুকে তার পূর্ব পুরুষের আত্নার মুক্তি এবং পরমাত্মার মাঝে বিলীন হওয়ার প্রার্থনায় বিষ্ণুর নামে বুদ্ধের পদ্মপাতা সদৃশ চরণে পিন্দাদনম বিসর্জন দিতে হয়। বোধগয়ার নিকটে বর্তমানের “কাল-ভৈরব” বা মহাকাল মন্দির প্রকৃত পক্ষে একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। কালো পাথরের তৈরি বৌদ্ধ ভিক্ষুর আকৃতিতে বুদ্ধের মূর্তিকেও মহাকাল রূপে পরিবর্তন করা হয়।
নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির:
কাঠমুন্ডুর বিশ্ব বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দিরও বাস্তবে একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল যা পরবর্তীতে শীব মন্দিরে রূপান্তর করা হয়। ভগবান বিষ্ণুর “অনন্ত শয়ন” মূর্তিও ছিল গৌতম বুদ্ধের যা বর্তমান রূপে পরিবর্তিত হয়। সম্ভবত, এই রূপান্তরের ঘটনা ঘটে ৫০০ খ্রিঃ গুপ্ত যুগে। ৫০০ খ্রিঃ এর পূর্বে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কোথাও বিষ্ণুর মূর্তি বা কোন দলিল পাওয়া যায় নাই।
বিখ্যাত চিন্নামস্ত দেবী, বাংলা-উড়িষ্যার দেবী তারা বা তারিণী ছিল প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী যা রূপান্তর করা হয়। বর্তমান কালে তাকে শক্তিদেবী কালী রূপে ধারণা করা হয়।তারা 2
বৌদ্ধ ধর্মের পূর্বে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মগ্রন্থ সমূহে বিষ্ণুর অথবা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের কোন প্রমান পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ ধর্মই তাদের ধর্মে ধর্ম চক্রের প্রচলন করে। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এটাকে অশোক চক্র বলে গন্য করা হতে থাকে। পরবর্তীতে, ব্রাম্মন্যবাদ এই চক্র বৌদ্ধ ধর্ম থেকে গ্রহণ করে, বৌদ্ধ ধর্মকে ভারতে নিশ্চিহ্ন করে।
মন্দির ও মঠ সমূহের মাধ্যমে বিদ্যাচর্চা, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল ইত্যাদীর পরিচালনার অনুশীলন বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলন থেকে গ্রহণ করা হয়। ব্রাম্মন্যবাদ এসবও বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনুকরণ করে। বৌদ্ধ ধর্মই সর্বপ্রথম জনসাধারণের ধর্মশিক্ষার জন্য মঠ জাতীয় শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠা করে। শঙ্কারাচার্যের মঠ নির্মাণ এরূপ একটি জ্বলন্ত উদাহরন।
শিক্ষিত ব্যক্তি বা কবিগন যারা বর্ণ প্রথায় উৎসাহিত ছিল তাদেরকে ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য ব্যক্তিগনকে তাদের স্বীয় সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এভাবেই, ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থ সমূহে আদি কবি, বাল্মিকি, বৈশ্য দেব প্রমূখ ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃত হয়। ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ মত প্রদান করেন যে, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সমাজ যখন পুনর্গঠিত হচ্ছিল, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মানুসারী পরিবার সমুহের কোন কোন সদস্যকে ব্রাহ্মণ হিসেবে এবং অন্যান্যদের তাদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী অন্যান্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইতিহাসবিদ এবং গবেষকগণ এমনও উল্ল্যেখ করেন যে সামাজিক এই পুনর্গঠনের প্রাক্কালে দরিদ্র ব্রাহ্মণদেরকেও শূদ্র শ্রেণীভুক্ত করা হয় অথচ ধানাঢ্য এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সমূহকে সমাজে তাদের প্রভাব ও ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয় এবং বৈষ্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জনগনের যে অংশ এই বর্ণ প্রথার বিরোধিতা করেন তারা রাজার বা এই প্রথার অনুসারীদের শত্রু হিসেবে পরিগণীত হয় এবং তাদেরকে শূদ্র ও অস্পৃশ্য শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে, দক্ষিন ভারতে “পানা” নামক এক সম্প্রদায় আছে, যারা বর্তমানে হরিজন বা অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য হয় অথচ এই “পানা” সম্প্রদায় ৪০০ খ্রিঃ ব্রাহ্মণদের তুলনায় অধিক সন্মানের অধিকারী ছিলেন। তবে খ্রিঃ ৫০০ তারা পুনরায় ব্রাহ্মণদের সম মর্যাদা লাভ করেন। বর্ণপ্রথামুখি সামাজিক পুনর্গঠনের প্রাক্কালে অনেক শিক্ষিত “পানা” এবং কাব্যিক নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ হিসেবে ঘোষণা দেন। যে সকল “পানা” ঐ শ্রেণী প্রথার বিপক্ষে ছিলেন, তাদেরকে ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে বহিস্কার করা হয়, এবং তারা বর্তমানে হরিজন বলে পরিচিত। মজার বিষয় এই যে, মালয়ালম ব্রাহ্মণগণ সকলেই “নামবুদিরি পদ ব্রাহ্মণ” হিসেবে পরিচিত ছিল। এই “পদ” শব্দটি শুধুমাত্র বৌদ্ধ সমাজেই প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হয়, এই “নামবুদিরি” গন সকলেই অতীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
উত্তর ভারতে, “পানা” দের মতই বাল্মিকি, মৌর্য, বৈশ্য, মাল, কাপিল, নিসাদ বা তদ্রুপ সম্প্রদায় সমূহ শূদ্র বা অস্পৃশ্য শ্রেণীর হরিজন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হন।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, যে সকল শাসনামল ব্রাম্মন্যবাদ ভিত্তিক শ্রেণী প্রথাকে সহযোগিতা প্রদান করে এবং শ্রেণী প্রথা ভিত্তিক সমাজ গঠনে কাজ করে, ব্রাম্মন্যবাদী সমাজের লেখকগন ভারতীয় সাহিত্য সমূহে, ঐ সকল শাসনামলেরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও গৌরবান্বিত করে এবং ঐ সকল শাসনামলকেই ভারতের স্বর্ণ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এভাবেই, মগধের গুপ্ত বংশ, বাংলার সেন বংশ, দক্ষিন ভারতের চোলাস, পান্ডিয়া এবং কূলাসেকর বংশের রাজত্ব কালকে হিন্দু সাহিত্যে স্বর্ণ যুগ আখ্যায়িত করা হয়।
এই সমাজ পুনর্গঠনের প্রাক্কালে, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ব্রত্য ধর্ম গ্রন্থাদি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ফেলা হয়, তাদের স্থাপত্য এবং মঠ সমূহ বিধ্বংস করা হয়। কথিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সুবিখ্যাত “নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়”x কে এক সপ্তাহের অধিক সময় যাবত অগ্নিদগ্ধ করা হয়।
x নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত “বড়গাঁও” গ্রামের পাশেই। তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০, তাদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরো ২,০০০ শিক্ষক। বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি বেধ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ দান চলত এখানে। শিক্ষকদের পাঠ দান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠ।
ধারণা করা হয় যে, গুপ্ত সম্রাটগণই নালন্দা মহাবিহারের নির্মাতা এবং সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তই সম্ভবত এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কনৌজের হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) নালন্দা বিহারের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
বাংলার পাল রাজগণ নালন্দার প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রেখেছিলেন। এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মপাল বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। লামা তারনাথ উল্লেখ করেন যে, ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা মহাবিহার তত্ত্বাবধানকারী প্রধান ব্যক্তি নালন্দা দেখাশোনা করার জন্যও রাজা কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হন। সুবর্ণদ্বীপের শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্রদেব জাভার ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য দেবপালএর অনুমতি নিয়ে নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। এদের প্রতিপালনের জন্য দেবপাল ৫টি গ্রামও দানকরেন। সে সময় নালন্দা বিহার ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতিজগতের বিশেষ কেন্দ্র এবং এর অভিভাবক হিসেবে পাল রাজগণ সমগ্র বৌদ্ধ জগতে উচ্চস্থান লাভ করেন। ঘোসরাওয়া শিলালিপি থেকে নালন্দা বিহারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ এবং বৌদ্ধ ধর্ম ওবিশ্বাসের প্রতি দেবপালের গভীর অনুরাগের কথা জানা যায়।nalandauniversity. wordpress.comabout-2
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে একটি মিথ্যা বানোয়াট ও অমার্জনীয় তথ্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে… বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ খৃস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ দিয়েছে ১১০০ খৃস্টাব্দ। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার উদন্ত পুরীআক্রমণ করেছেন ১১৯৩ খৃস্টাব্দে আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুভারত মুসলিম বিজেতাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য ইতিহাসের তথ্য বিকৃত করতেও কুণ্ঠিত নয়।
তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর বাংলা আক্রমণ ও বিজয়ের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৬৯ইং মৃণালিনী নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন। যেখানে বখতিয়ার খলজীকে এবং মুসলমানদের গালাগালি মূলক শব্দ যবন, বানর, অরন্যনর ও চোর হিসেবে উল্লেখ করে লিখেন। মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন বখতিয়ার খলজী অভিযানের প্রাক্কালে, সে সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুরক্ষিত দূর্গ মনে করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় এবং ভিক্ষু বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হত্যা করে ৷ অথচ ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, বখতিয়ার খলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করেননি বরং বঙ্কিম তাঁর সাহিত্যে ঐতিহাসিক সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, নালন্দা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। যতদূর জানা যায় সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খৃষ্টাব্দে) মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানাদের দ্বারা। উল্লেখ্য মিহিরকুলার নেতৃত্বে হানারা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পূণর্গঠন করেন।
প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়’র রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে তার বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, তিনি সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ও এর একান্ত অনুরাগী। উল্লেখ্য রাজা শশাঙ্কের সাথে বুদ্ধের অনুরুক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড় একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থ স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় তীর্থস্থান বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে । হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন (চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৩ সালে গুপ্ত রাজাদের শাসনামলয়ে নালন্দা ভ্রমণ করেন): Sasanka-raja, being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet be did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka’s hatred towards Buddhism.
প্রকৃত ঘটনা হল একজন ব্রাহ্মণ কর্তৃক সম্রাট হর্ষবর্ধনকে হত্যা তারপর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ক্ষমতা দখল করেন। এই সময় ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে একদল উগ্রবাদী ধর্মোন্মাদ হিন্দু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও ভস্মীভূত করে। ৪০০ খৃষ্টাব্দে চীনা পর্যটক ফা হিয়েন যখন গান্ধারা সফর করেন তখন উত্তর ভারতে বিকাশমান বৌদ্ধ ধর্মের গৌরবোজ্জল অধ্যায় দেখতে পান। কিন্তু ৬২৯ খৃস্টাব্দে অপর একজন চীনা বৌদ্ধ সন্নাসী ১২০ বছর পর নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। ৬২৯ সালে আর একজন চীনা পর্যটক গান্ধারা সফর করে বৌদ্ধবাদের করুণ পরিণতি দেখে মানসিকভাবে বিপন্ন হন।
বখতিয়ার বৌদ্ধদের ওপর কোন ধরনের নির্যাতন করেছেন এমন কথা ইতিহাস বলে না বরং বৌদ্ধদের ডাকে বঙ্গ বিজয়ের জন্য বখতিয়ার সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। এমনকি বিজয়ান্তে তিনি বৌদ্ধদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় থেকে বিরত থাকেন। বাংলায় ১৪ শতকের অভিজ্ঞতা: ১২ শতকে বাংলার ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাব ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির উত্থান। ১৩ শতকের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার দুশ’ বছরের মধ্যে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিধ্বস্ত হিন্দু শক্তির উত্থান সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৫ শতকে রাজাগনেশের আকস্মিক উত্থান কিভাবে সম্ভব হল? এ জিজ্ঞাসার জবাব পেতে সমকালীন ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে।
উপমহাদেশের বৌদ্ধবাদের উৎখাতের পর বহিরাগত আর্য অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এখানকার মূল অধিবাসীদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলেও অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উপস্থিতি তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। মূলত হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খলজি বাংলার মানুষকে মুক্তি দান করেন।
অত্যাচারিত নির্যাতিত বৌদ্ধরা দুবাহু বাড়িয়ে বখতিয়ার খলজিদের স্বাগত জানালো। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়-‘বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরাব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্য ও নির্মূল অভিযানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলার মুসলিম বিজয়কে দু’বাহু বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ড. নিহার রঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস আধিপূর্বে উল্লেখ করেছেন-‘যে বঙ্গ ছিলো আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে কম গৌরবের ও কম আদরের সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান মুসলিম আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হলো।’ সবচাইতে মজার যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০মে, স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ খৃস্টাব্দে। যে লোকটি ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গে প্রবেশ করেন সে কিভাবে ১১৯৩ খৃস্টাব্দে নালন্দা ধ্বংস করেন এটা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭জন সঙ্গী নিয়ে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কৌশলে সেনরাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদে হামলা করেন। এসময় লক্ষণ সেন দুপুরের খাবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন- তিনি বখতিয়ারের আগমনের খবর পেয়ে ভয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান, প্রায় বিনা রক্তপাতে বঙ্গ বিজয় করেন বখতিয়ার খলজি।
সুতরাং বখতিয়ার কতৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ঘটনা একটা মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছু নয়। নালন্দার ধ্বংস হয় সর্বোমোট তিনবার, এর মধ্যে প্রথমবার মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী বাংলার শাসক শশাঙ্ক দ্বারা ও শেষবার অত্যাচারী সেনরাজাদের দ্বারা। নালন্দাকে প্রথম দুইবার ধ্বংসস্তুপ থেকে দাঁড়করানো গেলেও তৃতীয়বার সম্ভব হয়নি গুপ্ত ও পাল রাজাদের মতো পৃষ্ঠপোষক না থাকায়। দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধদের ব্যাপকহারে দেশত্যাগ ও বৌদ্ধদের জ্ঞানার্জনের চেয়ে তান্ত্রিকতার প্রসারও এর জন্য দায়ী।
বখতিয়ার খলজির অভিযান ছিলো সেনরাজা লক্ষণসেনের বিরুদ্ধে, বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নয়। বৌদ্ধরা বখতিয়ারের অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছিলো। সুতরাং বিনা রক্তপাতে বঙ্গবিজয়ের পরে বৌদ্ধদের বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার কাহিনী মুসলিম বিজয়ীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার বৈ অন্য কিছু নয়।
University library bulding 2 - Kanchipuram দক্ষিন ভারতে, সম্রাট অশোক যে কাঁচি পুরাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেন তা ছিল প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ শিক্ষালয়। দক্ষিন ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্বানগন সেখানে পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ করতেন।পরিণতিতে, গ্রাম ও শহরের মঠ সমূহকে ব্রাহ্মণদের মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়, সকল জনসাধারণকে ব্রাম্মন্যবাদের কর্তৃত্বের অধিনে আনার মাধ্যমে “আদি শঙ্কর” ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের হত্যাকারী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠে।Adi_shankara
অন্যদিকে, সকল জনসাধারনকে ব্রাম্মন্যবাদের কর্তৃত্বের অধীনে আনার লক্ষ্যে ব্রত্য সমাজের সমুদয় প্রথা ও রীতি এই নতুন সমাজ প্রথায় সন্নিবেশ করা হয়। এ সবের মধ্যে রয়েছে কোন কোন প্রাণীকে যেমন হনুমান, গরু, মৈয়ুর, নাগ (সর্প), হাতি এবং কিছু বৃক্ষ যেমন, ডুমুর (পিপাল), তুলসী, এবং নীম ইত্যাদি পূজা করা। সকল দেবতা ও দেবী কে ব্রাম্মনীয় দেব দেবী রূপে গ্রহণ করা হয়।
এভাবেই, উন্নততর ও প্রগতিশীল ব্রত্য সমাজের ধ্বংসাবশেষের উপর ভিত্তি করে অপ্রগতিশীল “হিন্দু ধর্ম” নামে ব্রাম্মন্যবাদের জন্ম হয়। এই বিষয় স্মরনে রেখে বাংলায় শ্রেণী প্রথার বিশ্লেষণ করা যায়।
রাঢ় বঙ্গের (পশ্চিম বঙ্গ) উচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের ঐতিহাসিক পরিচিতি:
বঙ্গদেশে, “উপাধ্যায়” সম্বোধনধারী যেমন মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং গঙ্গোপাধ্যায়গন ছিল তথাকথিত উচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ ছিল নিম্ন শ্রেণীর। খৃস্টীয় শাসনামলে, খ্রিষ্টান শাসকগন এই সকল নাম সমূহকে নিজেদের পছন্দানুসারে মুখার্জী, চ্যাটার্জী, ব্যানার্জী এবং গাঙ্গুলিতে পরিবর্তন করে। পরবর্তীতে, তাদের কর্ম ও আবাসস্থলের উপর ভিত্তি করে আরও নতুন নতুন শ্রেণী তৈরি করা হয়। এদের বেশির ভাগই পশ্চিম বঙ্গের গঙ্গা তীরবর্তী রাধ অথবা রাধা অঞ্চলে যেমন বর্ধমান, বীরভূম, হুগলী এবং তদসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করে। তারা কূলীন ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চল বিশেষভাবে, প্রাচীন রাঢ বঙ্গ ছিল জৈন ধর্মের উৎস স্থান, মিথিলা ছিল উপনিষদ দর্শন সমূহের রচনার স্থান। প্রাচীন গৌড়ের বির বাহু জৈন মুনি ছিল চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের গুরু। এছাড়াও ছিল গৌড় পদ যে উপনিষদ সমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করতেন।
আধুনিক হিন্দু সাহিত্যে ৫১টি শক্তি পীঠের কথা উল্লেখ আছে। এই ৫১টি পিঠের অন্ততপক্ষে ২৫টি পীঠই অবস্থিত প্রাচীন বঙ্গে এবং ৭টি বঙ্গ সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলে। ৫১টির মধ্যে ৪টি পীঠকে বলা হয় আদি শক্তিপীঠ। এই পীঠ সমূহ হচ্ছে ১) উড়িষ্যার গঞ্জম জেলায় অবস্থিত দেবী তারার পীঠ। ২) জগন্নাথপুরির দেবী বিমলা ৩) কামরূপ এর দেবী কামাখ্যা এবং ৪) কলকাতা কালিঘাটের মা কালি মন্দির। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম তিনটি ছিল অতীতে বৌদ্ধ মন্দির। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, “মাতসেন্দ্রনাথ” কামাখ্যা পীঠে তন্ত্র সাধনা করতো। খুব সম্ভবত,মাতসেন্দ্রনাথই বৌদ্ধ তন্ত্রপীঠকে “শৈব শক্তি তন্ত্র পীঠ” এ রূপান্তরিত করে।
ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত যে কালীঘাটের মা কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিল গোরখ নাথ এবং তার অনুসারী চৌরঙ্গী নাথ ছিল এর তত্ত্বাবধায়ক। পূরীর দেবী বিমলা এবং গঞ্জমের তারা তারিণী উভয় পিঠকেই বৌদ্ধ পীঠ থেকে শিব শক্তি পীঠে রূপান্তর করা হয়। বঙ্গদেশের শুধুমাত্র রাধা অঞ্চলে (বর্ধমান, বীরভূম, হুগলী এবং তৎসংলগ্ন এলাকা) অবস্থিত এরূপ ৯টি শক্তি পীঠ।
বঙ্গে বর্ণ প্রথা ভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থার ক্রমবিকাশ
ঐতিহাসিক ভাবে এ বিষয় পরীক্ষিত যে বৌদ্ধ ধর্মই ছিল তন্ত্রবিদ্যার উৎস কেন্দ্র। ঐতিহাসিকদের মতে, পরবর্তী কোন সময়ে শৈব, জৈন, বৈষ্ণ ধর্ম এবং সর্বশেষে বৈদিক জনগণও তন্ত্রবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে।
ভ্রাম্যমান শিবরূপই ‘ভৈরব_ আমরা আজও দেখতে পাই অবশিষ্ট বৌদ্ধ, জৈন এবং সকল বৈদিক সাধকগন সকলেই “ভৈরব” এবং “কাল ভৈরব” সাধনা করে থাকে। কালক্রমে, মাতসেন্দ্রনাথ এবং শিব গোরখা নাথ সাধনার ধারণা এবং পদ্ধতি পরিবর্তন করে এবং তন্ত্র সাধনার প্রয়োজনে ভৈরব চরিত্রকে “মা” চরিত্রে পরিবর্তন করে। মাতসেন্দ্রনাথ এবং শিব গোরখা নাথ উভয়ই ছিল “নাথ শৈব” এবং “নাথ কৌল”। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, শিব দেবতাকে “মহা কৌল” হিসেবেও ডাকা হয়।
মাতসেন্দ্রনাথকে ভারতে কুল (শক্তি) বংশের অভিভাবক হিসেবেও দেখা হয়। সেই সূত্রে, মাতসেন্দ্রনাথ এর সামাজিক অনুসারীগন “কূলিন” (দেবী মাতা শক্তির পূজারী) নামে পরিচিত ছিলেন।
রাধা অঞ্চলে এই কূল সাধনার গভীর প্রভাব সম্মন্ধে ধারণা করা যায়, এই অঞ্চলে শক্তি পীঠের সংখ্যা থেকে, মোট ৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে ১০টি পিঠই এই রাধা অঞ্চলে অবস্থিত। এ সম্ভবপর হয়ে উঠত না, যদি এই অঞ্চলের প্রভাবশালী এবং বিদ্বান লোকজন এর পৃষ্ঠপোষকতা না করতো। বৈদিক সমাজ ব্যাবস্থা শক্তিধর এবং প্রভাবশালী গনের জন্য খুবই লাভজনক বলে প্রতিয়মান হয়। শ্রেণী প্রথার প্রতিষ্ঠার পেছনে এই শ্রেণীর লোকজনই ছিল মেরুদন্ড। এই শ্রেণী প্রথার বিশেষ সুবিধা ছিল এই যে, ইহা শুধু তাদের জন্যই লাভজনক ছিল না, বরং তাদের সন্তান এবং বংশধরদের জন্যও একটি স্থায়ী লাভজনক ব্যাবস্থা ছিল।
এভাবেই ভবিষ্যতের রাজা হিসেবে কোন রাজপুত্রের ভবিষ্যৎ এমন কি যোগ্যতা, সক্ষমতা নির্বিচারে ব্রাহ্মণের সন্তানের ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তিও পূর্বনির্ধারিত হয়ে যায়, যা ব্রত্য সমাজে স্বীকৃত ছিল না। ব্রত্য সমাজে শুধু ব্যাক্তিগত যোগ্যতাকেই স্বীকৃতি দেয়া হতো।
অংগ বা রাঢ় বঙ্গের বৈদিক প্রথার অনুসারীগন অ-বৈদিক অথবা ব্রত্য সমাজের অনুসারীগণের সাথে সামাজিক ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই কারনে ১২ শতাব্দীতে সেন বংশের শাসনামলের পূর্ব পর্যন্ত অংগ বা রাঢ় বঙ্গে শ্রেণী প্রথার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় নাই, যদিও তা মধ্য দেশে (বর্তমানে বিহার এবং উত্তর প্রদেশ) ৩য় শতাব্দীতে গুপ্ত বংশের শাসনামলের সময় থেকেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এও লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, বঙ্গের শ্রেণী প্রথা বৈদিক শ্রেণী প্রথার অনুরূপও নয়। বঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিল হয়তো “ব্রাহ্মণ- বৈদ্য- কেষ্ট- অথবা শূদ্র” কিন্তু তাদের মধ্যে ক্ষত্রীয় এবং বৈশ্য ছিল না।
এভাবেই ভারতীয় সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে এবং উপ শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। ফলে, “বিভক্তি এবং শাসন” পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা শ্রেণী প্রথার সমর্থকদের জন্য সুবিধাজনক হয়ে উঠে এবং তাদের পারিবারিক আধিপত্য সুদৃঢ় হয় এবং এভাবেই শ্রেণীহীন সমতা ভিত্তিক সমাজের বিলুপ্তি ঘটে। এই পদ্ধতি ভারতের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিন তথা সর্বত্রই গৃহীত হয়। রাজাকে বিধাতার স্থলে অথবা বিধাতার প্রতিনিধির স্থলাভিষিক্ত করা হয় এবং তার উত্তরসূরিদের প্রদান করা হয় সর্বোচ্চ স্থান, তার বিনিময়ে রাজা বা তার উত্তরসূরিগণ নিজেদের স্বার্থেই ব্রাম্মন্নবাদী অথবা বৈদিক শাসনকে সহযোগিতা করতে থাকে।
এখানে লক্ষ্য করা যেতে পারে, যে রাজা বা রাজবংশ ব্রাম্মন্যবাদী শাসনকে পৃষ্ঠপোষন এবং এই শ্রেণী- প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে, সে সকল রাজা বা রাজবংশের শাসনামলকে তাদের রচিত সাহিত্যে মহিমান্বিত এবং ভারতের স্বর্ণ যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এভাবেই, মগধের গুপ্ত বংশ, বাংলার সেন বংশ, দক্ষিন ভারতের চোলাস, পান্ডিয়া এবং কূলাসেকর বংশের রাজত্ব কালকে ব্রাহ্মন্য সাহিত্যে স্বর্ণ যুগ আখ্যায়িত করা হয়।
উল্লেখযোগ্য যে, সেন বংশীয় রাজাগন স্বয়ং ব্রাম্মন্যবাদী শাসনের অনুসারী ছিল। এভাবেই রাজা বল্লাল সেন এবং লক্ষন সেন বঙ্গে শ্রেণী প্রথা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রাহ্মন্য সাহিত্যে তাদের শাসন আমলকে বাংলার স্বর্ণ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ব্রাম্মন্যবাদের এই“এক শ্রেণীর আধিপত্য” এবং “বিভক্তি এবং শাসন” পদ্ধতি আজও ভারতবর্ষ জুড়ে বিদ্যমান যার ফলে শোষিত, নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত হচ্ছে ভারতেরই আদি অধিবাসী তথাকথিত নিম্নবর্ণের এবং অন্যান্য ধর্মের জনসাধারন। শুধু তাই নয়, অত্যাচারের ব্রাম্মন্যবাদী খড়গ আজ প্রতিবেশী দেশ সমুহের দিকেও প্রসারিত।
তথ্যসূত্রঃ
Dr. K.K. Debnath, Development of Vedic social system of casteism in Bengal
storyofbangladesh.com/…/dui- po…/93-chapter-1.html
বাংলার মুসলমানদের প্রকৃত পরিচয়:
আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে পার হতে হয়েছে ইতিহাসের বন্ধুর পথ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার সর্ববৃহদাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের বর্তমান পরিস্থিতি ভালো রূপে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে তাদের ইতিহাস জানাও অতি জরুরী।
প্রাচীন বাংলা:
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে টিকেও ছিল যুগে যুগে। উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। বাংলার ইতিহাস বলতে অধুনা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিগত চার সহস্রাব্দের ইতিহাসকে বোঝায়। প্রাচীন যে সকল সভ্যতার প্রভাব আজকের ভারতবর্ষের এবং তার আশে পাশের মানব সমাজে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছে সে সকল সভ্যতা হচ্ছে সান্তাল, মঙ্গোলীয়, আল্পিয়ান, দ্রাবিড় এবং আর্য সমাজ।
বাঙালি জনগোষ্ঠী:
আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে যে সভ্যতা এই উপমহাদেশে বিকশিত হচ্ছিল, তা হচ্ছে আল্পিয় সভ্যতা (Alpine civilization)। মধ্য এশীয় অধিবাসী আলপাইনগন (Eastern Bracycephalic) পূর্ব ভারতে (বাংলা, উড়িষ্যা, এবং আসামের সমতল অঞ্চল সমুহে) স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকার মাধ্যমে বর্তমান বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি সৃষ্টির মৌলিক উপাদান প্রস্তুত করে।
আল্পিয়ান সভ্যতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
আলপাইন জাতী সুনির্দিষ্ট ভাবেই প্রাচ্য এবং এশিয়া মহাদেশীয় সভ্যতার অংশ। ১৯ শতাব্দীর এবং প্রারম্ভিক ২০ শতাব্দীর কতিপয় প্রত্নতাত্ত্বিকগন আলপাইন জাতীকে মঙ্গোলীয় জাতীর ককেশীয় শাখা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। ধারনা করা হয়, আলপাইন গন নবপ্রস্তরযুগে মধ্য এশিয়া থেকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল এশিয়া মাইনর, ইরান, পামির এবং হিন্দুকুশ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এমন কি সুদূর ইউরোপেও গমন করেন।
প্রকৃতপক্ষে, আল্পাইন গন বিশ্বজুড়ে মানব সভ্যতা বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে, এবং এশিয়া থেকে ইউরোপে উন্নত কৃষ্টির বাহকের ভূমিকা পালন করে। রিপ্লে এবং কুন এর গবেষণা অনুসারে, আলপাইন গন মধ্য- দক্ষিন- পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার প্রধান অধিবাসী ছিল। রিপ্লের মতে, আলপাইন গনই এশিয়া মহাদেশ থেকে কৃষিকার্য, আদিম মৃত্শিল্প এবং পশু পালন পদ্ধতি ইউরোপীয় সমাজে প্রচলন করেন।
আলপাইনগন কে তাদের গোলাকৃতি মুখমণ্ডল বিশেষ ভাবে মস্তিস্কের পরিমাপ যেমন কপালাঙ্ক ইত্যাদি দিয়ে স্বতন্ত্র ভাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সে কারনে, তাদের মাথার খুলি বিস্তৃত মস্তকধারী হিসাবে গন্য করা হয়।
কিন্তু আলপাইনগনকে তিব্বত এবং উত্তর এশিয়ার অন্যান্য সমতল অঞ্চলের অধিবাসী চেরা নেত্রবিশিষ্ট মঙ্গোল দের সাথে তুলনা করাও সঙ্গত নয়। বাস্তবে, এই উভয় জাতির মানুষ জনই গোলাকৃতি মুখমণ্ডল ও কপালাঙ্কের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা একই সভ্যতার বা প্রজাতীর নয় যদিও অনেক নৃবেজ্ঞানী এই দুই সমান্তরাল সভ্যতাকে এক হিসাবে গ্রহন করে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন।
মঙ্গোল, তাতার এবং তুর্কী যারা ইউরোপের আগমন করেছিলেন, তাদের সাথে গোলাকৃতির মস্তিস্ক বা মুখমণ্ডল ভিন্ন আলপাইনদের সাথে অন্য কোন সাদৃশ্য নাই।
পূর্ব ভারতে আলপাইনগন তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কার অনুসারে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল যেমন, বঙ্গ (দক্ষিন বঙ্গ), পুন্দ্র (উত্তর বঙ্গ), এবং রাঢ (পশ্চিম বঙ্গ) অঞ্চল সমূহ। বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য (৭০০ বিসিই প্রাচীন) ছিল পুন্দ্র রাজ্যের রাজধানি। আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে অর্থাৎ আল্পিয় সভ্যতার সময় থেকেই বঙ্গ (দক্ষিন বঙ্গ) অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ অন্যান্য বঙ্গীয় অঞ্চল সমূহ থেকে তৎকালীন ধর্মীয় সংস্কারের কারনে বিভক্ত ছিল। কালের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুন্দ্র ও বঙ্গের মধ্যকার সেই বিভক্তি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হলেও রাঢ (পশ্চিম বঙ্গ) ও বঙ্গের (পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশ) মধ্যকার সেই বিভক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। শুধু সাংস্কৃতিক বিভক্তি নয়, রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই বিভক্তি স্থায়ী রূপ লাভ করে, যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রয়াত মনসুর আহমেদ তার “বাংলাদেশের কৃষ্টিক পটভুমি” তে উল্লেখ করেন, বাংলায় দুইটি কৃষ্টি ছিলঃ একটা বাঙালী হিন্দু কালচার, অপরটা বাঙ্গালী মুসলিম কালচার।
ইতিহাসের পাতা উল্টাইলেই দেখা যাইবে, যে ভুখন্ড লইয়া আজ বাংলাদেশ গঠিত, মোটামোটি ও মূলত সে জনপদই ইতিহাসের বঙ্গ। খৃস্টীয় চার শতকের গোড়া হইতে এগার শতকের শেষ পর্যন্ত পুন্ডু, পাল ও সেন রাজাদের আমলেও এই ভুখন্ডের নাম ছিল বঙ্গ। গঙ্গা (ভগিরথী) নদীর পশ্চিম পারের যে ভখন্ডকে আজ পশ্চিম- বঙ্গ বলা হয়, তৎকালে তার নাম ছিল অংগ।
গোটা বাংলার (পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা) কৃষ্টি বলিয়া কোন নির্দিষ্ট কালচার বা কৃষ্টি নাই, কখনোই ছিলনা। ভাষার বিচারে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার জনগনের একটা নির্দিষ্ট কৃষ্টি থাকার কথা। কিন্তু, সত্যি কথা এই যে, এই দুই বাংলার কোনও জাতীয় কৃষ্টির সৃষ্টি হয় নাই। বাংলায় জাতীয় কৃষ্টি গড়িয়া না উঠার কারণ রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা নয়, বরং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। প্রকৃতপক্ষে, বাংলার মানুষের সমাজ একটি নয়, দুইটি। তাঁদের মধ্যে, খাওয়া-পরা, বিবাহ-শাদি ইত্যাদি অনেক বিষয়েই সামাজিক মিল নাই। তাই এগারশ বছর এক দেশে বাস করিয়া, একই খাদ্য-পানীয় গ্রহন করিয়াও দুইটি পৃথক সমাজে রহিয়া গিয়াছে। এই দুইটি সমাজে দুইটি সমান্তরাল কৃষ্টি গড়িয়া উঠিয়াছে। বাংলা ভাগের মধ্যে দুইটা কৃষ্টি নিজ-নিজ আশ্রয় স্থল খুজিয়া পাইয়াছে। রাঢ বাংলার কৃষ্টি ভারতের জাতীয়তার অংশ, দক্ষিন বঙ্গের কৃষ্টি বাংলাদেশের জাতীয়তার অংশ।
কোন কোন সুত্রে ধারনা করা হয় যে, বাংলার আদি অধিবাসিগন জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক ভাবে বৈদিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠাকারী আর্য সমাজ থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্টের অধিকারি।
যাই হোক, আলপাইন গন সহস্র বৎসর যাবত আক্রমনকারী বৈদিক আর্যদের প্রতিহত করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দিতে আর্যগন এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
দ্রাবিড় সভ্যতার প্রভাব:
খৃষ্টের জন্মের প্রায় চার হাজার বৎসর পূর্বে উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে (বিশেষতঃ বর্তমান পাকিস্তান) অঞ্চলে দ্রাবিড় নামক এক প্রাচীন সভ্য জাতির অধিবাস ছিল। ভারত উপমহাদেশে আর্য জাতির আগমনের প্রায় দুই হাজার বছর আগে হইতেই এঁরা তথাকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। দ্রাবিড়রা সেমেটিক গোষ্ঠীর একটি সম্প্রদায়। ভারতে আগমনের পূর্বে এঁরা ব্যাবিলন অঞ্চলে বসবাস করতেন। প্রথমে তারা সিন্ধুদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বস্তি স্থাপন করেন। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা এদেরই দ্বারা স্থাপিত রাজধানী। এই দুই প্রাচীন নগরীর স্থপতি ও কারুকার্য হইতেই দ্রাবিড় জাতির সভ্যতার পরিমাপ করা যায়। এঁরা শুধু স্থপতি বিদ্যায়ই উন্নত ছিলেন না। উন্নত ভাষা ও বর্ণমালাও এদের ছিল। ভারতে বৌদ্ধ যুগে যে এই দ্রাবিড় বর্ণমালার প্রাধান্য ছিল, তার বড় প্রমান এই যে অশোক স্তম্ভগুলির স্মারক লিপিগুলি এই দ্রাবিড়ি সেমিটিক বর্ণমালাতেই লেখা। (সূত্রঃ অধ্যাপক নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান- “বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস”)
আর্যদের দ্বারা বিতাড়িত হইয়া দ্রাবিড়দের এক অংশ দক্ষিন ভারতের পথে ছড়াইয়া পরেন। সেখান হইতে এক দল বাংলাদেশের মাটির উর্বরতায় আকৃষ্ট হইয়া এখানে আসেন এবং স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন।
পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশ (বঙ্গ), পশ্চিম বঙ্গ (রাঢ), আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের অধিবাসীগণ আলপাইন ও দ্রাবিড়দের উত্তরসূরি, তবে রাঢ বা পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসীগণের মধ্যে তুলনামুলক ভাবে দ্রাবিড় ও আর্যদের প্রভাব বেশি বলে অনেক ঐতিহাসিকই ধারনা করেন।
আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল। এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এ এলাকার ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় একশ বছরের অরাজকতার (যাকে মাৎসন্যায় পর্ব বলে অভিহিত করা হয়) শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হয়, এবং পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করে। এর পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে।
যদিও বঙ্গ অঞ্চলে ভারতীয় অধিবাসীদের মাধ্যমে উপনিষদ, জৈন, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ভারতীয় দর্শন বিকশিত হচ্ছিল, যারা পরবর্তীতে উচ্চ বর্ণের (আর্যদের) স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাচীন প্রথা সমূহের পাশাপাশি উচ্চ বর্ণের (আর্যদের) কর্তৃত্বকে গ্রহন করার মাধ্যমে বৈদিক সামাজিক শ্রেণী প্রথা গ্রহন করে, তবে খ্রিস্টাব্দ এগার শতাব্দীতে সেন বংশের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গে কোন বর্ণ প্রথা ছিল না।
ইন্দো-আর্যদের আসার পর মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে । এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল । খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই (বিশেষ ভাবে পশ্চিম বঙ্গ) শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল । মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য।
আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৫০০, গৌতম বুদ্ধের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম আর্যদের অত্যাচার এবং অবদমনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। পরিশেষে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অত্যাচার ও হত্যার মাধ্যমে বিলুপ্ত করে এবং প্রাচীন ভারতীয় ব্রত্য সমাজে প্রচলিত ‘ব্যাক্তিগত যোগ্যতা’র ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণী বিভাগ কে রূপান্তরিত করে এক শ্রেণীর মানুষের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রাম্মন্যবাদ ভিত্তিক শ্রেণী প্রথার প্রচলিত করা হয়, যা অদ্যাবধি বিদ্যমান।
প্রাচীন ভারতে ইসলামের প্রভাব:
ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইসলামের আবির্ভাব হয় ৭ম শতাব্দীতে মালাবার সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে নব্য মুসলিম আরব বণিক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে আরব দেশ সমূহের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এমনকি, ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকেই আরবীয় বণিকগণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য বন্দরের সাথে সংযুক্ত মালাবার অঞ্চল ব্যবহার করত। নব্য মুসলিম আরব বণিক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ভারতে ইসলামের আগমন হয়।
ঐতিহাসিক ইলিয়ট ও ডউসন, তাদের রচিত “দ্য হিস্টরি অব ইন্ডিয়া এজ টোলড বাই ইটস অউন হিস্টরিয়ানস” গ্রন্থ অনুসারে, ভারতীয় বন্দরে মুসলিম পর্যটক বহনকারী প্রথম জাহাজ এমনকি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দেই দেখা যায় । এইচ, জি, রাওলিনসন তার রচিত গ্রন্থ, “এন্সিয়েন্ট এন্ড মেডিভাল হিস্টরি অব ইন্ডিয়া”তে দাবী করেন যে, ৭ম শতাব্দীর শেষের দিকেই মুসলিম আরবগন সর্বপ্রথম ভারতীয় সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেন।
এই বিষয়টি সম্মন্ধে জে, স্টার রক তার “সাউথ কানারা এবং মাদ্রাজ ডিসট্রিক্ট মেনুএলস” এ এবং হরিদাস ভট্টাচার্য “কালচারাল হেরিটেজ অব ইন্ডিয়া, ভলূম চার” এ বিশদ ভাবে বর্ণনা করেন। “ইসলামের ঊষালগ্নে আরবগন বিশ্বব্যাপী এক উন্নতমানের কৃষ্টিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হন। আরব ব্যাবসায়ী ও বণিকগণ এই নতুন ধর্মের বাহক রূপে যেখানেই তারা গমন করেন সেখানেই তা প্রচার করেন।“ কিন্তু ভারতে ইসলাম প্রচারকারীগণের অধিকাংশই অ- আরবীয় দেশ সমূহ থেকে আগমন করেন। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আরব মহাদেশের অন্যত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই আরব বনিকগন ভারতে আগমন করতেন।
ভারতে প্রথম ইসলাম প্রচারকারীগণ ছিলেন এমন সব ব্যক্তিত্ব যারা, ইসলাম প্রচার করাকে পূণের কাজ বলে মনে করতেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে সূফীবাদী ধর্ম প্রচারকগন বুখারা, তুরস্ক, ইরান, ইয়েমেন এমন কি আফগানিস্তান থেকে ভারত আগমন করেন। ভারতে ইসলাম প্রচারকারীগণের মধ্যে সবচাইতে স্বনামধন্য ছিলেন খাজা চিশতী, যিনি ইরান থেকে আগমন করেন এবং সূফীবাদ প্রচার করেন। ভারতে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠায় কোনভাবেই বলপূর্বক ধর্মান্তরকে দায়ী করা যায় না।
ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ৭১৩ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসিম আল থাকাফির সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের মাধ্যমে ১৮৫৮ সালে সর্বশেষ মোগল সম্রাটের পতন পর্যন্ত টিকে থাকে। যদিও ৮ম শতাব্দীতে মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে সিন্ধু বীজিত হয়, গযনির মাহমুদ এবং ঘোরের মুহাম্মদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশে ব্যাপক হারে মুসলমানদের অভিবাসন শুরু হয় নি। তবে সমসাময়িক ঐতিহাসিকগনের মতে ভারতের মুসলমানদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পেছনে বলপূর্বক ধর্মান্তর দায়ী নয়।
মুসলমান শাসকগণ বিশেষ করে মোগলগণ, দেশটি ঐক্যবদ্ধ করেন এবং একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অধিনে আনেন। তারাই সর্বপ্রথম দেশটিকে হিন্দ বা হিন্দুস্তান অর্থাৎ হিন্দুদের বা সকল অমুসলিমদের দেশ হিসাবে নামকরণ করেন। হিন্দু শব্দটি মূলত ফারসী, যা ভারতের মুসলমানগণ সর্ব প্রথম সকল অমুসলিম অধিবাসীদের বোঝাতে ব্যাবহার করতেন। অথচ হিন্দুগন, মুসলিম শাসকদের আগমনের পূর্বে ব্যবহৃত সংস্কৃতে কখনোই এই শব্দটি ব্যাবহার করেন নি।
স্বামী ধর্মতীর্থ বলেন, “মুসলমানগন, ভেদাভেদহীন ভাবে সকল অমুসলিম অধিবাসীদেরকে বোঝাতেই “হিন্দু” শব্দটি ব্যাবহার করতেন, যা প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র অমুসলিমই বোঝাত, এর বেশি কিছু নয়। এই সামান্য বিষয়টিই অন্যান্য অনেক ঘটনার তুলনায় ভারতের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সর্বাধিক অবদান রাখে, একই সাথে, কোটি কোটি মূক নিম্নবর্ণের সাধারন হিন্দুদের, তাদের শোষক শ্রেনীর যাজকদের নিকট চিরস্থায়ীভাবে পরাধীন হতেও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। পর্যায়ক্রমে ভারতের অধিকাংশ অধিবাসীর পরিচয় হয়ে উঠে ‘হিন্দু’, তাদের ধর্ম ‘হিন্দুত্ব’ এবং ব্রাহ্মণগণ তাদের প্রভু।
মুসলমান শাসকদের ভারত বিজয় সম্পন্ন করতে কয়েক শতাব্দী সময়ের প্রয়োজন হয়। মূর্তিপূজাকে নিন্দা করলেও মুসলমান সুলতানগণ হিন্দুদের এই সংস্কারকে উপেক্ষা করে যেতেন এবং তাদের উপর ইসলাম ধর্মকে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন নি। মুগল গনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের শাসনামল থেকে, ভারত বর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলই মুসলিম শাসনের অধিনে চলে আসে।
অনেক কণ্টকময় পথ পেরিয়ে ইসলাম ভারতের হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজে টিকে থাকে। যদিও ভারতে ইসলাম শতাব্দী সময়কাল ধরে প্রচারিত হয় কিন্তু কখনোই তা পূর্ণতা লাভ করেনি বরং ইতিহাসের সকল পর্যায়েই হিন্দুগনের কর্তৃত্বই ভারতে প্রাধান্য পায়।
মুসলিম মনীষীগণ এবং ধর্মীয় নেতাগন আদি অধিবাসীদের মাঝে ইসলাম প্রচার করতে সচেস্ট হলে, তাদের বিপুল সংখ্যক ইসলাম ধর্মকে গ্রহন করেন। বর্তমান কালের ভারতীয় মুসলমান গনের অধিকাংশ তাদেরই বংশধর।
এ কারনেই, এ কথা বলা যুক্তি সঙ্গত নয় যে, ভারতীয় মুসলমান গন ভারতীয় নন কিংবা তারা বহিরাগত। যেমনই, নিম্ন বর্ণের হিন্দুগন আর্য ধর্ম গ্রহণ করলেও তারা ভারতেরই আদি অধিবাসী, তেমনি, সূফি- দরবেশ, মুসলিম মনীষী বা ধর্মীয় নেতাগনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মুসলমান জনগণও ভারতের আদি অধিবাসী।
অন্যদিকে, আদি ভারতীয় পরিচয়ের বিচারে, আর্য অনুপ্রবেশকারীদের উত্তরসূরি যেমন, ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের সাথে পরবর্তীতে মোঘল, পাঠানদের উত্তরসূরিদের মাঝে কোন তফাৎ নেই। তারা উভয়েই ভারতে বহিরাগত। বস্তুত, ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়, যার বৃহদাংশ আদি ভারতীয়দেরই উত্তরসূরি, তারা খৃস্টপূর্ব ১৫০০ সালে উপমহাদেশ বিজয়কারী মধ্য ইয়োরোপ থেকে আগত আর্যদের বংশোদ্ভূত উত্তরসূরিদের তুলনায় অধিকতর ভারতীয়।
আর্যদের আগমনের পর থেকে ভারতীয় সমাজে শ্রেণী বিন্যাসের মাধ্যমে উচু নিচু ভেদাভেদ স্থায়িত্ব লাভ করলেও পরবর্তীতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দে) মুসলমান সূফি- দরবেশ ও আরবীয় বনিকদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম ধর্মের প্রসারের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ প্রকৃত পক্ষে সাম্য, সমতা এবং অন্যান্য মানবিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ উন্নত হয়।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ প্রয়াত আবুল মনসুর আহমেদ “বাংলাদেশের কালচার” গ্রন্থে যথার্থই লিখে গেছেন, “সময়ের সাথে সাথে, ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু এবং মুসলমান সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলন ঘটে এবং মুসলমানগণ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কৃষ্টিক উন্নতিতে বিশেষ অবদান রাখে।
বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের হাতে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২০৫-৬ সালের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খীলজী নামের একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত সেনাপতি রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজবংশের পতন ঘটান। ষোড়শ শতকে মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসার আগে পর্যন্ত বাংলা স্থানীয় সুলতান ও ভূস্বামীদের হাতে শাসিত হয়। মোঘল বিজয়ের পর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর।
অতি প্রাচীন বাংলাদেশের এই কালচারেরই নবরূপ আমাদের বর্তমান কালচার। ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশ ও তার জনগনের সামনে দিগ্বিজয়ীর বেশে আসে নাই। এখানে সে ধর্ম আসিয়াছে জনগনের ধর্ম হিসাবেই। বাংলাদেশে, ভারতে ও পাকিস্তানে ইসলামের আবির্ভাবের ইহাই মৌলিক পার্থক্য। ইতিহাসের অসাবধান লেখক ও পাঠকরা এইখানেই মস্তবড় ভুল করিয়া থাকেন। তারা দিগ্বিজয়ী বীর বখতিয়ার খিলজির বাংলাদেশে আগমনকেই এদেশে ইসলামের আগমন মনে করে থাকেন। এটা নিতান্তই ভুল ধারনা। বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশ জয় করেন ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। এই ঘটনার প্রায় তিন শ বছর আগে হইতেই বাংলাদেশে শুধু ইসলামের আবির্ভাবই হয় নাই, ততদিনে ইসলাম বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে জনগনের ধর্মে পরিনত হইয়াছে। বাংলাদেশে ইসলামের প্রথম আবির্ভাব হয় পশ্চিম ভারতের স্থলপথ দিয়া নয়, বরং দক্ষিন দিক দিয়া জলপথে।
প্রথমেই আসে সুফী সুলতান বায়জিদ বোস্তামির কথা। ইনি ৭৭৭ খৃস্টীয় সালে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৭৪ খ্রিঃ ইন্তেকাল করেন। তিনি ইরান, ইরাক ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার করিতে করিতে সম্ভবত আরব বণিকদের সাথে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে অবস্থিত তার নামীয় আস্তানা ও চিল্লার প্রতি স্মরণাতীত কাল হইতে সকল সম্প্রদায়ের জনগন, বিশেষত মুসলমানরা যে ভক্তি ও সম্ভ্রম দেখাইয়া এবং পবিত্র স্থানের মর্যাদা দিয়া আসিতেছে, তাতে বিনা-দ্বিধায় এটা ধরিয়া লওয়া যায় যে, সুফী সাহেব এই স্থানে ধর্ম সাধনা ও ইসলাম প্রচার করিয়া অগনিত ভক্ত ও শাগরেদ সৃষ্টি করিয়া গিয়াছিলেন।
সুলতান বায়যিদের পরেই মীর সৈয়দ সুলতান মাহমুদ শাহ মাহিসোওয়ার (মৃত্যু ১০৪৭ খৃঃ), শাহ মোহাম্মদ সুলতান রুমী (মৃত্যু ১০৫৩ খৃঃ), বাবা আদম শহীদ (মৃত্যু ১১১৯ খৃঃ), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুৎশিকান প্রমুখ ইতিহাস বিখ্যাত ওয়ালি- আল্লাগন বাংলার বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ইসলাম প্রচার করিয়া হাজার হাজার ভক্ত রাখিয়া গিয়াছেন।“
ব্রিটিশ ভারতে দুই বাংলার পরিস্থিতি:
ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাঙালি হিন্দু সমাজ ইংরেজি ভাষার সাহিত্য, দর্শনে পারদর্শিতা লাভ করে ইংরেজি সভ্যতা ও জীবন দর্শনকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করলেও মুসলমানগন বিধর্মী শত্রুর ভাষা, সাহিত্য, দর্শনকে পরিত্যাগ করেন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ইংরেজদের প্রিয়পাত্র হিন্দুরাই বেশির ভাগ জমিদারির মালিক হয়ে বসলেন এবং মুসলমানের বেশির ভাগ বিশেষত পূর্ব ভারতে চাষি ও প্রজা হয়ে জমিদারের অত্যাচারের বোঝা বইতে বাধ্য হলেন। হিন্দু ও মুসলমানের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত এই বিরাট পার্থক্যটি যতদূর সম্ভব দূর করার লক্ষ্যে ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল জর্জ ন্যথনিয়াল কার্জন বাংলা প্রদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি পশ্চিম বাংলা বিহার উড়িষ্যা এবং পূর্ব বাংলার আসামের অংশ বিশেষ নিয়ে দুটি প্রদেশ সৃষ্টি করলেন এবং এইভাবে মুসলমান প্রধান পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের শিল্প সংস্কৃতির পূর্ণবিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে দিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব সারা দেশের হিন্দু সমাজকে আলোড়িত করে তুললো। জমিদার শ্রেণী এই ভাবনায় চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থায় তারা এ পর্যন্ত যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিলেন বাংলা বিভাগের ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা।
বাংলার প্রভাবশালী তৎকালীন হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণীর কাছে এ পদক্ষেপ ছিল চরম আঘাত। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে বাঙালি রাজনীতিবিদরা বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তকে অকৃতকার্য করার জন্য শপথ করলেন, ঐ ঘোষণাকে তারা বানচাল করবেনই। এই রাজনীতিবিদদের সাথে যোগ দিলেন জমিদাররা। তাদের ভয় ছিল, নতুন প্রদেশ জমির ওপর তাদের অবাধ অধিকার বা মালিকানা স্বত্বের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
ভঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলমান বিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনের তাগিদে যে সকল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন, তারা সবাই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমান বিরোধী। প্রথম দিকে, সেই আন্দোলনে হিন্দু বাঙ্গালীদের সাথে মুসলমান বাঙ্গালিরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল কিন্তু এই আন্দোলনের প্রাক্কালে, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় অনৈক্য এবং বিরোধ। বিশেষ করে তখনকার বাঙ্গালি হিন্দু নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব এই ঐক্যবন্ধনকে আঘাত করেছিল। তাঁরা শুধু সাধারন মুসলমানদেরই বিভ্রান্ত করে নাই বরং সাধারন হিন্দু সমাজকেও বিপথগামী করেছিল।
পরবর্তীতে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও উপমহাদেশ বিভক্তি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস ও করমচাঁদ গান্ধি উক্ত প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। পশ্চিম বাংলার দাদা বাবুরা ও অবিভক্ত বাংলার প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভারতে যোগ দান করে।
১৯০৫ সালে ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল মুসলমানদের সম অধিকার দিতে হবে বলে। ১৯৪৭ সালে তারাই বঙ্গভঙ্গ করে ভারতে যোগ দেয় মুসলমান দের সাথে থাকবেনা বলে। তারা অতীতেও মুসলিম বিরোধী ছিল, বর্তমানেও আছে। ওরা যদি হিন্দু হিসাবে গর্ব করতে পারে আমরা মুসলমান হিসেবে পারবনা কেন?
পরিশেষে, ১৯৪৭ সালের পর ২৫ বৎসরের পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে শোষণ, অবদমনে থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হয়ে, আমরা দুটি পৃথক পর্যায় পার হয়ে ভারত (১৯৪৭) ও পাকিস্তান (১৯৭১) পৃথক জাতিসত্তা নিয়ে আত্নপ্রকাশ করেছি। বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্ব কোন চমকের বিষয় নয়। বিবর্তনের সুনির্দিষ্ট ধাপ পেড়িয়ে আজ আমরা বর্তমানে পৌঁছেছি। এই দেশের জনগনের জাতীয় পরিচিতি নিয়ে আজ আর কোন সন্দেহ বা দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকার সুযোগ নেই।
আমরা মুসলিম হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষার্থে ভারত থেকে এবং প্রাচীন বাংলা’র বাঙ্গালি হিসেবে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়েছি। আমরা একাধারে বাঙ্গালী এবং অধিকাংশ মুসলমান। এই উভয় সত্ত্বাই আমাদের বৃহদাংশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিচিতি বহন করে। ইস্রায়েলী- আমেরিকান- জার্মান- ব্রিটিশ- ফরাসী ইহুদি বা ক্যাথলিক- প্রটেস্টাণ্ট খ্রিস্টান, তেমনি বাঙ্গালী, মারাঠি সহ ভারতের বিভিন্ন জাতের হিন্দু জনসাধারণের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিচিতি পাশাপাশি চলতে পারলে, বাঙ্গালী মুসলমান পরিচয় যারা গ্রহণ করতে চায়না, তাদের উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক।
এই উভয় পরিচিতিই আমাদের অধিকাংশের হৃদয় এবং সমাজের গভীরে প্রোথিত। এই পরিচিতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের সামাজিক কৃষ্টি এবং আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক বছরের মাথায় তিন দিক ঘিরে রাখা প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রথম বারের মত সফরে আসছেন এবং ৭ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবেন। ইতিমধ্যেই, “বাংলাদেশ-ভারত” সম্পর্কের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে বাংলাদেশে সকল পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে আছে। অধির অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশী সহ ভারত এবং এশিয়ার, এমন কি বিশ্বের অগণিত মানুষ। কি হতে যাচ্ছে মোদীর বাংলাদেশে আগমনের পর? বাংলাদেশ সরকার, সরকার সমর্থিত জনতার অংশ এমন কি বিরোধী দল সমূহও তাকে সম্বর্ধনা দিতে সেজে গুজে অধির অপেক্ষায় আছে। যেন মহানায়কের দর্শনে সকলেই ব্যাকুল, অপেক্ষায় অধির।
প্রটোকল অনুসারে, ঢাকা সফরকালে মুসলিম বিদ্বেষী, বিজেপি নেতা চরম সাম্প্রদায়িক এবং গুজরাট দাঙ্গার নায়ক হিসাবে পরিচিত মোদি বাংলাদেশি নাগরিকদের সামনে ‘ ভাষণ দেবেন। এর আগেও চীনসহ যেসব দেশ সফর করেছেন সবখানেই জনসম্মুখে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে এ ‘ভাষণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ধরেই নেয়া যায় যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে প্রশ্নবিদ্ধ সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও প্রশ্নবোধক করতেই নরেন্দ্র মোদি তার ভাবনা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবেন।
আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ সমাজের সামনেও বক্তব্য নিয়ে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই বক্তব্যে তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসার বিরুদ্ধে বার্তা দেবেন !!
সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার একান্ত আলোচনাতেও অগ্রাধিকার পেতে চলেছে সাম্প্রদায়িক রাজনিতিকের এই অসাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গটি।
কথায় বলে, ‘ভুতের মুখে রাম নাম’। উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির নেতা হিসাবে পরিচিত এই লোকটির এই বার্তার পিছনে কি উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, তা পরিস্কার। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে অবদমিত রাখতে এটা তার উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনৈতিক বার্তা।
এদিকে, ভারতের পদলেহী আওয়ামী সরকার আর কতিপয় বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রী দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে, স্বাধীনতার স্বপ্ন ধুলিস্মাত করে, সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে শাড়ীর আচল বিছিয়ে রেখেছে।
অথচ, স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ভারত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমল) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে আসছে।
ভারত প্রেমিকদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়েছে, তাই ভারতের সাত খুন মাফ। প্রয়াত আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরন ও মনোভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে লিখেছিলেন, ‘একদা উপকার করিয়াছি বিধায় চিরদিনের জন্য গোলামীর পাশে আবদ্ধ রাখিব।’ ভারতেরই গোয়েন্দা সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকর্তা তাঁদের জীবনীতে কখনো সরাসরি কখনো ইঙ্গিতে ভারত সরকার অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু কন্যা প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে গিয়েছেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পিছনে তাঁদের আসল উদ্দেশ্য এবং লাভ কি।
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অপ্রতিবেশী সূলভ আচরনের কিছু নমূনাঃ
১। ফারাক্কা বাঁধ।
২। তিপাইমুখ বাঁধ।
৩। তিস্তার পানি বন্টন।
৪। স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন (৬৮ বছর পূর্বের আন্তর্জাতিক সীমান্ত চুক্তি)।
৫। সীমান্তে কাটাতারের বেড়া এবং নির্মমভাবে সাধারন মানুষকে হত্যা।
৬। সমতার ভিত্তিতে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ না দেয়া।
৭। উভয় দেশেই প্রচার মাধ্যমের অনুমতি প্রদান না করা, ইত্যাদি।
৮। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা।
৯। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা সদস্যদের গুপ্ত তৎপরতার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, ইত্যাদি।
নরেন্দ্র মোদীর আগমনে সম্ভাব্য দশটি
নতুন চুক্তি ও সমঝোতার অন্তরালে
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রাক্কালে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাদেও হতে পারে মোট ডজন খানেক নতুন চুক্তি ।
দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরের জন্য উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন, অভ্যন্তরীণ নৌ প্রটোকল নবায়ন, সমুদ্র অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ভারতকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও নিবিড় করতে এবার প্রথমবারের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হবে। বিশেষ করে নেপাল ও ভুটানে ভারত যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের কুমুদিনী ট্রাস্টের একটি পানি প্রকল্পের মাধ্যমে এটি শুরু করার কথা রয়েছে। দুই দেশের চুক্তি ও এমওইউর সংখ্যা সর্বমোট দশে দাঁড়াতে পারে।
৬৮ বছর পর স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন:
১৯৪৭ সনে ভারত- বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থল সীমান্ত নির্ধারণ করার কারিগর ছিলেন স্যার সিরিল রেডক্লিফের নেতৃত্বাধীন বাউন্ডারি কমিশনের পাঁচ সদস্য। পরে সুইডেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এলগট ব্যাগি, মাদ্রাজ ও ঢাকা হাইকোর্টের দুই বিচারকের সমন্বয়ে করা একটি ট্রাইব্যুনালও এই সীমান্ত নির্ধারণে কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা কেবল লাল কালিতে দাগ টেনে সীমান্তরেখা আঁকিয়ে রেডক্লিফের কথাই জানি, এলগট ব্যাগিও আমাদের সীমান্তরেখা টেনেছিলেন। তাই, এটা ব্যাগি লাইন হিসেবে পরিচিত। বাউন্ডারি কমিশন ও ট্রাইব্যুনালের আট সদস্য, যাঁদের বেশির ভাগই ভারত ও পাকিস্তানের বিচারপতি ছিলেন, তাঁদের কাছেও আমরা ঋণী । দুই রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে (১৩ আগস্ট, ১৯৪৭) করা স্যার রেডক্লিফের একটি উক্তি আজ স্মরণযোগ্য: ‘আসাম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ভূখণ্ডগত কিছু বিনিময় অবশ্যই ঘটাতে হবে, কিছু অমুসলিম ভূখণ্ড পূর্ববঙ্গে, কিছু মুসলিম ভূখণ্ড আসামে যাবে।’ ৬৮ বছর পরে তাই চূড়ান্তভাবে ফলল। তাদের কাছেও আজ আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ এবং ভারতের কট্টরপন্থীরা এই সীমান্ত চুক্তি সুনজরে দেখেনি। নূন-নেহরুর চুক্তিটা হয়েছিল ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘ভারতীয় জনসংঘ, যেটি আশির দশকে বিজেপিতে মিশে গেছে এবং নূন- নেহরুর মূল চুক্তির প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল তারই পথ ধরে নরেন্দ্র মোদি আজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছে, । সংগঠনটি ওই চুক্তি বাতিলে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে জোর আইনি লড়াই পর্যন্ত চালিয়েছিল। ১৯৭৪ এর চুক্তি ১৯৫৮ এর চুক্তির কার্বন কপি।
ভারতীয় বিলের প্রস্তাবনায় ১৯৭৪ এর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল ছাড়াও ১৯৮২ ও ১৯৯২ সালের সীমান্ত চুক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলেও স্থলসীমান্তে অগ্রগতি ঘটেছিল। এই ৪১ বছরে পর্যায়ক্রমে মোরার্জি দেশাই, রাজীব গান্ধী, এইচ. ডি. দেবে গৌড়া, অটল বিহারী বাজপেয়ী, ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেছেন।
ভারত- বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পাবে মোট ১৭,১৬০.৬৩ একর জমির ১১১টি ছিটমহল এবং ভারত পাবে ৭,১১০.০২ একর জমির ৫১টি ছিটমহল। বাংলাদেশ ১০ হাজার একর বেশি জমি পেয়েছে বলে অনেকে অবাক হন। তাঁদের জানা দরকার যে, নূন-নেহরুর সীমান্ত চুক্তি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যখন শুনানি চলছিল, তখন ভারতের সরকার আদালতকে বলেছে, সংবিধান সংশোধন না করে ১৯৫১ সালের চুক্তির আওতায় আমরা তো ভুটানকে ৩২ বর্গমাইল জায়গা ছেড়ে দিয়েছি, যা ছিল আসাম অংশের।
একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করার পরও, তা বাস্তবায়নে ৬৮ বছরের বিলম্ব বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতিকদের জন্য লজ্জাজনক।
তালপট্টি নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধ করেছে। ১৯৭৪ সালেই ইন্দিরা শ্রীলঙ্কার কাছে ‘কাছাতিভু’ দ্বীপের মালিকানার দাবি ত্যাগ করেন। ২০০৮ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জয়ললিতা সংবিধান সংশোধন না করে ওই দ্বীপ হস্তান্তর অবৈধ দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে রিট করেন। মনমোহনজির সরকার আদালতে সাফ বলেছেন, ওটা সব সময় বিরোধপূর্ণ ছিল। কখনো ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। একই যুক্তিতে ভারত আমাদের ছিটমহলগুলোকে অনেক আগেই দেয়া উচিত ছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, ১৯৪৭ সনে নির্ধারিত ভারত- বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থল সীমান্ত চুক্তি, বহু পূর্বেই বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল।
প্রকৃতপক্ষে, ভারত-বাংলাদেশের বর্তমানের প্রশ্নবোধক সম্পর্কে যদি কারো সাফল্য এসে থকে, তা একান্ত ভাবেই চানক্যের দর্শনে অনুপ্রাণিত উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতা মোদীর। বিনা যুদ্ধে দেশ দখলে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের দক্ষতা বিশ্বের অনেক আধিপত্যবাদী নেতাদের কাছে দৃষ্টান্ত সরূপ হয়ে থাকবে। বর্তমান বিশ্বে কোন দেশ দখল করতে হলে সে দেশের ভূমি দখল করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু সে দেশে সার্বিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ সৃষ্টি করার।
উক্ত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সফলতা অর্জনে স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বক্তারা আরও বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকাকালে রাষ্ট্র প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের মুখ দেখেছে। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন। ইতোমধ্যেই অনেকের বিচারের রায় হয়েছে, দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রবৃদ্ধি প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতি কি প্রকৃতপক্ষেই এমন?
নিম্নে কয়েকটি উদাহরন তুলে ধরা হলঃ
ক) দেশের গনবিমুখ অর্থব্যবস্থার ও জনসংখ্যার তুলনায় কর্মস্থল সৃষ্টিতে ব্যর্থতার কারনে, অগণিত মানুষ বেচে থাকার লক্ষ্যে জীবনের ঝুকি নিয়ে সমূদ্র পথে বিদেশের পথে পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্রে প্রান হারাচ্ছে। বিদেশী অজানা স্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে অগণিত মানুষ। শত সহস্ত্র মানুষ হচ্ছেন মানব পাচারকারীদের অর্থ লোভের শিকার। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফে উপকূলীয় বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৫০ হাজারের অধিক লোকজন মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। এর মধ্যে অনেকেরই সমুদ্রে সলিল সমাধি হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। কিছু লোক থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার জেলে বন্দি অবস্থায়ও মানবেতর দিন যাপন করছে।
খ) প্রথম আলোতে দেয়া মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকারে’র এক সমিক্ষায় প্রকাশ, এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অন্ততপক্ষে ৯৫ জন বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। তারমধ্যে শুধু মে মাসেই হত্যা করা হয়েছে ১৮ জনকে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, বিগত পাঁচ মাসে অন্ততপক্ষে ত্রিশ জন নাগরিক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় এবং আরও প্রায় ত্রিশ জন তাঁদের মাধ্যমে গুম হয়। উপরন্তু, বিগত জানুয়ারি থেকে, রাজনৈতিক সংঘাতের সময় অন্তত ১৩৭ জনকে হত্যা করা হয় এবং ৩৭৮৩ জন আহত হয়। এই সময়ে, ৪৬ জন সাংবাদিক আহত এবং ১৫ জনকে হুমকি দেয়া হয়। পাচ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
অন্ততপক্ষে ২০ বাংলাদেশী বছরের শুরু থেকেই ভারতের সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) কর্তৃক হত্যার শিকার হয়। এছাড়াও, একই সময়ের মধ্যে, ২৯ জনক আহত এবং ১৬ জন কিডন্যাপ হয়। ভারতের সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) কর্তৃক সাধারন মানুষজনকে হত্যার জন্য ‘অধিকার’ ভারত সরকারের নিকট ক্ষতিপূরণের দাবি করা সমিচিন মনে করে।
গ) আবহাওয়া অনুকূল ও নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা থাকায় বিগত বছরগুলোর মধ্যে এবারও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে।
খাদ্য বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, দেশের সরকারি খাদ্যগুদামে চাল ও গমের মজুদ সাড়ে ১২ লাখ মে. টনের বেশি আছে। আমদানি-রফতানি বুরোর ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, এ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি চাল ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ লাখ ৯১ হাজার ৪১০ মে. টন চাল আমদানি করা হয়েছে। ১৩-১৪ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৪ হাজার মে. টন চাল। ১২-১৩ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছিল ২৯ হাজার মে. টন চাল।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা আরো জানান, দেশের চালের ঘাতটি নেই। উদ্বৃত্ত চাল আছে তার পরও ভারত থেকে শুল্কমুক্ত ১৩ লাখ টন নিম্নমানের পুরনো চাল আমদানি করায় ধান-চালের বাজারে মহা ধস নেমেছে। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বর্গাচাষি পরিবার। এসব পরিবার দায়-দেনা করে ফসল ফলায়। বোরো চাষ করে প্রতি বিঘায় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লোকসান গুনবে এবার বর্গাচাষিরা। তারা কোনোভাবেই এসব দেনা আর শোধ করতে পারবে না। এজন্য তাদের শেষ সম্বল বিক্রি করা লাগতে পারে। অপরদিকে, বোরো চাষ করে লোকসানে পড়বে ২১ লাখ প্রান্তিক চাষি, ১১ লাখ ক্ষুদ্র চাষি, সাড়ে ৬ লাখ মাঝারি চাষি। বর্গাচাষিরা তো ক্ষতির মধ্যে আছেই। তাহলে দেখা যায়, এ অঞ্চলের ৪৭ লাখ কৃষক পরিবার বোরো চাষ করে লোকসানের মুখে পড়ছেন। গত বছর ভুট্টা, পাট শীতকালীন সবজি চাষ করেও এসব কৃষক দরপতনের কারণে দেনাগ্রস্ত হয়ে আছেন। এ অঞ্চলের ৪৭ লাখ কৃষি পরিবারের ২ কোটি মানুষ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ থেকে নিস্তারে তাদের কোনো পথ খোলা নেই। অনেকের আশঙ্কা কৃষিপণ্য উৎপাদন করে এভাবে ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকলে বাংলাদেশের কৃষকদেরও ভারতের কৃষকদের মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হতে পারে।
নদীপথে ট্রানজিট প্রটোকলের সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরের সমূহ সম্ভাবনা:
২৮ মে ২০১৫ যুগান্তরে প্রকাশ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সই এবং বাণিজ্য চুক্তির আওতায় নৌ ট্রানজিট প্রটোকলও সই হবে বলে জানান। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য চুক্তির ভূমিকায় তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের কথা রয়েছে সেকারনে, বাণিজ্য চুক্তি থেকে নৌ ট্রানজিট প্রটোকলকে আলাদা করার সুযোগ নেই।’
কিন্তু নৌ ট্রানজিট প্রটোকল সংশোধনীর খসড়ায় ভারত আপত্তি তুলে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়। খসড়া প্রস্তাবটি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ভারত এই আপত্তি তোলে। নতুন প্রস্তাবে ভারত নদীপথে ট্রানজিটের আওতায় তৃতীয় দেশে পণ্য চলাচলের বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। এছাড়া অপারেশনাল মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ বাড়ানোর বিধানও বাদ দিয়ে ওরা নতুন খসড়া পাঠিয়েছে।
ভারতের প্রস্তাব সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, নৌ প্রটোকল ট্রানজিটে অন্তর্ভুক্ত ছিল তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেয়ার বিষয়টি। এতে নৌপথে নেপাল ও ভুটান থেকে পাথর, কাঠসহ বিভিন্ন পণ্য কম খরচে পরিবহনের সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ভারতের ওই প্রস্তাব মেনে নিলে আমরা এসব সুবিধা পাব না। ভারতের আপত্তির কারনে বাংলাদেশ সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বলে জানা যায়। ভারতের নতুন প্রস্তাব গ্রহণ করতে হলে খসড়াটি আবার যাচাই-বাছাই (ভেটিং) এবং নতুন করে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের প্রয়োজন হবে বলে এ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়।
১৮ মে মন্ত্রিসভায় খসড়া প্রটোকল অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সংস্কার ও সমন্বয়) মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বলেন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকে টার্গেট করে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি ট্রানজিট প্রটোকলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, এতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চুক্তি, কনভেনশন কিংবা চর্চা প্রয়োগ করা এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ট্রানজিট গ্যারন্টি দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ভারতের দেয়া নতুন খসড়ায় পুরো এ বিষয়টি মুছে দিয়ে তাতে যে দেশের পণ্য পরিবহন করা হবে, তা ওই দেশের আইনে পণ্য চলাচলের বিধান প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। খসড়ায় বাংলাদেশের নদীপথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভারত বাংলাদেশকে বছরে ১০ কোটি টাকা দেয়ার বিধান রয়েছে। এই চার্জ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে বাড়ানোর কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ভারতের নতুন পরিবর্তিত খসড়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধির কথাও মুছে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথে ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকলের অধীনে ১৯৭২ সাল থেকেই ভারত ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করছে। তিন বছর পরপর বাণিজ্য চুক্তি নবায়নের পাশাপাশি নদীপথে ট্রানজিট প্রটোকলও নবায়ন করতে হয়। এবার ওই প্রটোকলে সংশোধনীতে প্রতি চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর কোনো পক্ষ আপত্তি না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই চুক্তি নবায়ন হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নেপাল, ভুটান সহ অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণকে পাশ কাটিয়ে চুক্তি সম্পন্ন হলে, তাতে হবে শুধুমাত্র ভারতের স্বার্থ চরিতার্থ।
তাছাড়া, ভারতের জন্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে সন্মান হারানোর প্রশ্নটি তো থেকেই যাচ্ছে।ট্রানজিট সুবিধা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। একজন সতী নারীর কাছে তার সতীত্ব যেমন তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু, তেমনি বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বহুমুখী করিডোর দেয়াও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সমরাস্ত্র পরিবহনেও সময় লাগবে যেমন কম, তেমনি নিরাপত্তা ঝুঁকিও প্রায় শূন্যের ঘরে। এছাড়া ভবিষ্যৎ ভারত-চীন সংঘর্ষে চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর হবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও নিরাপত্তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখানে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর পেলে ভারতের পক্ষে নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন কমে যায়, তেমনি অর্থনীতিতেও চাপ অনেক কমে যায়। সুতরাং ভারত বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এবং রাজনৈতিক দলের উপর করিডোর পাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। ভারতের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই তাদের দেশপ্রেমিকতার পরিচায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি সর্বনাশ স্বরূপ। কথায় বলে, ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।’ ভারতের জন্য করিডোর প্রাপ্তি তাদের সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থের সহায়ক, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি মৃত্যুফাঁদ। সে জন্যই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পর্যন্ত সকলেই ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে অতীতে বাংলাদেশের দু’একটি মহল ছাড়া সকলেই ট্রানজিট বা করিডোর প্রদানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। অনেক রাজনীতিবিদ অতীতে বহুবার বলেছেন যে, ট্রানজিট বা করিডোর কোনো বিনিময়যোগ্য বিষয় নয়। তাই তারা বজ্র নির্ঘোষে ঘোষণা করেছেন, জান দেব, তবুও ট্রানজিট বা করিডোর দেব না। আজ কোনো কিছু না পেয়েই বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সহ সবকিছু উজাড় করে দেয়ার জন্য বসে আছে।
তাই, ভারতকে একক ভাবে দোষ দেয়া যায়না। বাংলাদেশের জনগন ভারতীয় নর্তকীদের নগ্ন উরু দেখতে দেখতে গদা খাওয়া পছন্দ করলে, ভারতীয় সেনাদের বুটের লাথি খেতে পছন্দ করলে তাঁরা তো সানন্দে এসব করবেই। অবাক হওয়ার কি আছে?
আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার। সরকার এবং তাদের লবির লোকজন অনেকদিন থেকেই ভারতকে এই ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য অনেক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষকে তারা সেটা গেলাতে পারেনি।
প্রবল প্রতিকূল জনমত লক্ষ্য করে বিএনপি থেকে শুরু করে ২০ দলের সমস্ত উল্লেখযোগ্য দল ট্রানজিট তথা করিডোর প্রদানের বিরুদ্ধে সেদিনও উচ্চকণ্ঠ ছিল। কিন্তু আজ রহস্যময় কারণে এসব দল, মনে হয়, তাদের রাজনীতিতে ইউ-টার্ন ঘটিয়েছে। এখন নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি সরকারকে খুশি করার এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির আর্শীবাদ পাওয়ার জন্য সরকার যেমন সবকিছু বিসর্জন দিতে উদ্যত হয়েছে, তেমনি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোও তাকে তোষামোদ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।
বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সূত্র মতে, অতীতের সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়া সাক্ষাত না করার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেন সিনিয়র নেতারা। এবিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
সূত্রটি জানায়, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়া সৌজন্য সাক্ষাৎ না হওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হবে। বৈঠকে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে আলোচনা হলে প্রয়োজনে জামায়াতের ব্যাপারেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল অব. মাহবুবুর রহমান বলেন,বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বৈঠকে অতীতের ভুল ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিনগুলোতে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পরিকল্পনা করা হবে। দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মোদী সরকারের সহযোগীতা চাওয়া হবে। এতে জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার শর্ত এলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সেই প্রস্তাব বিবেচনা করবে বিএনপি।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে খালেদা জিয়া স্পষ্টভাষায় বলেছিলেন,বাংলাদেশের মাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কখনো প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। এবিষয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেস্টা এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, বৈঠকে মোদী সরকারের কাছে আমরা বিভিন্ন ইতিবাচক প্রস্তাব দেব। মোদী সরকারও আমাদের কাছে কিছু প্রস্তাব এবং কিছু শর্ত দেবেন। আমরা ভেবে সেগুলো মেনে নেওয়ার চেস্টা করবো। বিশেষ করে করিডোরের নামে ট্রানজিট। সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তির বিষয়েও আমাদের জোর দাবি থাকবে।
দলীয় সুত্রটি আরও জানায়, ভারতে মোদী সরকারকে খুশি করতে আপ্রাণ চেস্টা চালাচ্ছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিজেপি নেতাদের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। কারন আসন্ন ৭জুন মোদি-খালেদা বৈঠকে সকল টানাপড়েনের যবনিকাপাত এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয় নিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা তৎপর হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী জনগোষ্ঠী হাজার হাজার গুম খুনের শিকার হচ্ছে, বাংলাদেশের পুরো বাজার ভারতের দখলে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ভারত ধংস করে দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ, পররাষ্ট্র আজ ভারতের নিয়ন্ত্রণে, এমনকি বাংলাদেশের মানচিত্র ও ভূমির প্রতিটি ইঞ্চিও ভারতের কব্জায়। কিন্তু জেনারেল জিয়ার দল উচ্চ কন্ঠ হচ্ছে না।
আসলে এদেশের মানুষ ভাগ্যহত। জাতীয় স্বার্থে ভারত সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের জনগণই ঐক্যবদ্ধ এবং আপোষহীন হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা বিশ্ব সমাজের কাছ থেকে এই শিক্ষাটুকুও গ্রহণ করে নি।
পরিস্থিতি দেখে ধারণা করা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রস্তাবই মেনে নিবে। তাই, সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যে, বাংলাদেশ আজ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে এবং একটি অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের আজ্ঞাবাহী রাষ্ট্রে পরিণত করার সকল পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের পূর্ন অনুমতি পেতে যাচ্ছে ভারত
ইতিমধ্যেই, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ তৈরিতে প্রকল্পও হাতে নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ কানেকটিভিটির বিষয়কে বিশেষভাবে জোর দিয়ে আসছে। ভারতকে এ অনুমতি দিলে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোও যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করবে। যা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে বলে শেখ হাসিনা সরকার মনে করে।
পররাষ্ট্র ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রোববার এব্যাপারে নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ নিয়ে আরো আলোচনা হবে। জানা গেছে, এই চুক্তির বাস্তবায়ন হলে সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের সাতটি রাজ্যই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সরাসরি আমদানি-রফতানির সুবিধা নিতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরার সাবব্রুম পর্যন্ত সরাসরি যোগাযোগের জন্য প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। রেল সংযোগ হচ্ছে আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত। এই রেলপথে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় মালামাল পরিবহন করা সম্ভব হবে। এ সুবিধা শুধু ত্রিপুরাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া-সিলেট হয়ে করিমগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সরাসরি মেঘালয়ে যেতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটিকে পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের সিংহভাগ ঋণ হিসেবে ভারত দেবে বলে জানা গেছে। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার ফলে মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ থেকে মংলা সরাসরি আসার পথ তৈরি হবে।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন। কিন্তু, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের পূর্ন অনুমতি পেলেও বাংলাদেশ অনুরুপ ভাবে কোলকাতা বন্দর সহ অন্যান্য ভারতীয় বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পাবে কিনা তা এখনও জানা যায়নি।
তবে, ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তিস্তা চুক্তির সঙ্গে থেমে যায় এই বন্দর ব্যবহারে অনুমতি বিষয়ক সম্মতিপত্র। ওই সফরে এ দুটি বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশকে রাজি করাতে না পারলেও এবার সে অনুমতি পাচ্ছে প্রতিবেশি দেশটি!!
প্রকৃতপক্ষে, ভারত-বাংলাদেশ সর্ম্পকের মধ্যে যে দেয়া-নেয়া তাতে বাংলাদেশ ভারতকে যে সুবিধা দিচ্ছে তাতে পাচ্ছে খুবিই কম এবং নরেন্দ্র মোদির এই সফর থেকে, বাংলাদেশ যা পাবে তার চেয়ে বেশি পাবে ভারত।
মোদী ইতিমধ্যে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশ ভূটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। ফালে এই চারটা দেশের মধ্যে একটা বলয় তৈরি হবে। যে বলয়তে আমরা হয়ত ভবিষৎতে দেখবো ভারতের একক কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত হবে। যতটুকু বলা হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি এসে ১০০ কোটি ডলারের একটা ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এ ঋণ নিয়েও প্রশ্ন আছে । কারণ এ যুগে সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিট নিয়ে কেউ ঋণ নেয় না, এমন কি ভারত নিজেও সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিটে ঋণ নেয় না। এইযুগে সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিটে ঋণ নেওয়ার ফলে ৭০% পণ্য ভারত থেকে আনতে হবে। ফলে এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হবে। ভারত এখন চাইবে ত্রিপুরা হয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে এবং সেকারনে ফেনী নদীতে ব্রীজ তৈরি করতে বলছে।
কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা, গৌহাটি-ঢাকা-শিলং সরাসরি বাস যোগাযোগ:
মোদির আগমনে যেসব চুক্তি এবং সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা, তার মধ্যে রয়েছে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা সরাসরি বাস যোগাযোগ, চট্টগ্রামের রামগড় থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত, গৌহাটি-শিলং-ঢাকা বাস পরিসেবা এবং বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল মোটর ভেহিকেলস চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইতিমধ্যে, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি রুটে শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫ থেকে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরু হয়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ৬ জুন সল্টলেকের আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল থেকে বেসরকারি পরিবহন সংস্থার প্রথম বাস ছাড়বে ঢাকা হয়ে আগরতলার উদ্দেশে। আগরতলা থেকে আসাম ঘুরে কলকাতা পৌঁছতে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে এই রাস্তা মাত্রই ৫০০ কিলোমিটারের সামান্য বেশী।
কয়েকদিনের মধ্যেই খুব কম সময়ে, সামান্য খরচেই ত্রিপুরার মানুষ আগরতলা থেকে ঢাকা হয়ে কলকাতায় চলে আসতে পারবেন। নতুন রুটটি চালু হলে একটি বাসেই কলকাতা থেকে আগরতলা পৌঁছন যাবে।
সোমবার ০১.০৬.২০১৫ থেকে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা পথে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরু হয়েছে। পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, সেদিন কলকাতার সল্টলেক থেকে সকাল ৯টায় বাসটি ছেড়েছে। বাসটি সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছে। এরপর দিন সকালে ঢাকা থেকে সকাল ১০টা নাগাদ বাস পৌঁছে আখাউড়ায়। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বেলা ১১টার মধ্যে বাস ত্রিপুরায় পৌঁছে। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা রুটে বাস চলাচল কিভাবে হবে, কোন দেশের কতটি করে বাস চলবে, ভাড়া কত হবে, এ সুযোগের বিনিময়ে বাংলাদশে কী পাবে ইত্যাদি বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে দায়িত্বশীল র্কমর্কতারা এখনই এ নিয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না।
কলকাতা থেকে এই সার্ভিস চালাবে পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহন নিগমের লাইসেন্সে শ্যামলী যাত্রী পরিবহন। ঢাকা থেকে বিআরটিসির লাইসেন্সে শ্যামলী পরিবহন এই সেবা চালাবে। কলকাতা ও আগরতলা থেকে এই বাস সপ্তাহে তিন দিন করে চলবে। কলকাতা থেকে বাস ছাড়বে সোম, বুধ ও শুক্রবার। আর আগরতলা থেকে বাস ছাড়বে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার।
বি.দ্রঃ ইদানিং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবিশেষ আলোচিত বিষয় ছিল, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম হওয়ার বিষয়। অনেকেই ধারণা করেন, গুম হওয়া ব্যাক্তিগনের গন্তব্য হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে, যদিও তাঁদের অনেকেরই কোন হদিশ পাওয়া যায় নাই।
২০০৯ সালের শেষের দিকে গবেষণা মূলক পত্রিকা “The Week” নেপাল এবং বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আই.বি এবং ‘র’ এর সম্মিলিত ভাবে পরিচালিত গুপ্ত তৎপরতা সম্পর্কে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, উপরোক্ত গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ উপরোল্লিখিত প্রতিবেশী দেশ সমূহের অভ্যন্তরে অন্ততপক্ষে চারশত ‘snatch operation’ ‘ছিনতাই অপারেশন’ বা গুম-অপারেশন পরিচালিত করে। দীর্ঘ হস্তান্তর প্রক্রিয়া এড়ানোর লক্ষ্যে, ‘র’ বিভিন্ন দেশ থেকে সন্দেহভাজন ব্যাক্তিকে গুপ্ত ভাবে এরূপ ছিনতাই কর্মকান্ডের মাধ্যমে গ্রেপ্তার বা আটক করে। আটককৃত ব্যক্তিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিভিন্ন কায়দায় জেরা এবং অনুসন্ধান কর্ম পরিচালনা করে। আটক কৃত এরূপ সন্দেহভাজন ব্যাক্তি সম্মন্ধে ঐ সংস্থা সমূহ কোন তথ্য প্রকাশ করে না।
নেপালকে সন্ত্রাসীদের অতিক্রমণ পথ হিসাবে ধারণা করে, ‘র’ এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আই, বি নেপালে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করে। উক্ত পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশকে ‘র’ এবং আই,বি’র মাধ্যমে নেপাল, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ সমূহে অন্ততপক্ষে চারশত এধরনের ‘
হিন্দুত্ববাদ নিপাত যাক।
উত্তরমুছুন